রাজবধূ পর্ব ১৪
রেহানা পুতুল
এতক্ষন পুরো ঘটনাটি বাগানের শেষ মাথায় দাঁড়িয়ে অবলোকন করলো আরেকজন মানুষ। সে প্রকাণ্ড এক বৃক্ষের আড়ালে লুকিয়েছিলো। তার আঁখিদ্বয় ভীতসন্ত্রস্ত! তবুও নূরীকে বাঁচানোর জন্য সে খালি পায়ে ছুট দিলো বাগানের দিকে।
কিন্তু কয়েক পা এগিয়ে সে আবার পিছিয়ে গেলো। যেখানে নিজের প্রাণ সশংয় সেখানে যাওয়া বোকামি ছাড়া কিছুই নয়। সে পূনরায় আরেকটি গাছের আড়াল হয়ে গেলো। তার সরু চাহনি নূরী ও তার চেনা পুরুষটির দিকে। ঘটনার আকস্মিকতায় সে নিজেই বাকরুদ্ধ। নিজের চোখকে সে বিশ্বাস করতে পারছে না। তালুকদার বাড়িতে প্রথম আসা একজন অতিথির সঙ্গে একি বিরুপ আচরণ। নিশ্চয় এখানে বড়সড় কোন রহস্য আছে।
খামচি দিয়ে ধরে রাখা পুরুষটির পাঞ্জাবী ছেড়ে দিতে বাধ্য হলো নূরী। কারণ তার নিঃশ্বাস আটকে যাচ্ছে বলবান পুরুষের বলিষ্ঠ হাতের চাপে। পুরুষটিও এবার নূরীর গলা থেকে হাত সরিয়ে নিলো। নূরী গলায় হাত দিয়ে হাঁফাতে হাঁফাতে বসে পড়লো।
কম্পিত ও দুর্বল কন্ঠে আবারো জিজ্ঞেস করলো,
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
“কে আপনে? আমারে ক্যামনে চিনলেন? শিখার বিয়াতে আপনারে ত দেখিনাই। কন কইলাম?”
পুরুষটি দাঁড়ানো থেকে নূরীর দিকে দানবীয় দৃষ্টি তাক করলো। বলল,
” তোর তেজ দেখি একটু কইমা আসলো।আমি কে সেইটা বলার দরকার মনে করিনা। আবার কইলেও সমস্যা নাই। কিন্তু কমুনা। তুই পারলে জাইনা নিস আমার পরিচয়।”
পুরুষটি বাগিচায় ঝরে পড়া স্তুপাকারে শুষ্ক পত্রপল্লব মাড়িয়ে এগিয়ে যায়। তিন কদম না এগোতেই পিছন হতে শুনতে পেলো নূরীর আকুতিমাখা কন্ঠস্বর।
“খাড়ান কইতাছি। আল্লার দোহাই লাগে।শুনুন।”
পুরুষটি থমকে দাঁড়ায়। নূরী তার সামনে গিয়ে ক্ষীণকায় স্বরে দু’হাত জোড় করে বলল,
“আপনার পরিচয় দেন। কথা দিলাম। কাউরে কমুনা। গোপন রাখুম।”
শক্ত চোয়ালে চোখ পাকিয়ে ক্রুর হেসে পুরুষটি বলল,
“কি কইবি আর কি গোপন রাখবি তুই? আমি পুরুষ। না ডরাই কোনকিছু। তোর বিষয়টা আমি গোপন রাখবো কিনা সেইটা তোর চিন্তার বিষয় এখন। কারণ এইটা তোর মেয়ের শ্বশুরবাড়ি। জানাজানি হইলে মান ইজ্জতের বিষয়। ময়লা যত ঘাঁটাঘাঁটি হয় ততই দুর্গন্ধ ছড়ায়।”
নূরী আতংকগ্রস্ত হয়ে পড়লো। চোখেমুখে ভীতিকর ছাপ স্পষ্ট। ঘাবড়ে গেলো। নূরীকে পর্যুদস্ত করতে পেরে পুরুষটি ভিতরে উল্লাসে ফেটে পড়ে। এদিক ওদিক চেয়ে স্থির গলায় বলল,
“শোনো নূরী। ভালো কইরা কই। কাকপক্ষীও জানবো না পুরানা ইতিহাস। কেবল মাঝে মাঝে আন্ধার রাইতে আমি তোমার খালি ঘরে যামু। তোমার বিছানায় আরাম করমু। তুমি আমারে একটু খাতির করবা খালি। যৌবনতো দেখি তোমার এখনো টলটলা গাঙের জল। আমার জবান বন্ধ রাখার এইটাই একমাত্র উপায় তোমার জন্য। প্রস্তাব আমার। সিদ্বান্ত তোমার।”
“একজন মানুষের দুর্বলতার সুযোগ নিয়া নিজে লুইচ্চামি করবেন? নোংরামি করবেন? মরনের ডর নাই?চাপ্পা দাঁড়িগোঁফ দেইখা মনে হয় আপনে বড় কোন মাওলানা বা পীর সাব। কিন্তু… ”
নূরীর বাক্য অসমাপ্ত রয়ে যায়। তার গলা টিপে ধরে আবারো পুরুষটি। কন্ঠনালী যেন ছিঁড়ে আসবে তার।
“এই রূপসী মা* গী। পুরুষ মানুষ যা করে সবই ভালো কাজ। তোর মাইয়ার ভালো চাইলে আমার কথা শুনতে হইবে। আমার মনের জ্বা* লা মিটাইতে হইবো তোর।”
নূরী যেমন বুদ্ধিমান। তেমনই চতুর। পুরুষটির হাত ছাড়িয়ে নিলো। কিয়ৎক্ষণ থেমে নিচু স্বরে জবাব দিলো।
“আমি ভাইবা আপনারে জানামু। কিন্তু ক্যামনে জানামু? আর ক্যামনে যাইবেন আমার ঘরে? শিখাওতো এখন থেইকা আমার কাছেই থাইকবো।”
“শিখা যখন দিনে বিদ্যালয়ে যাইবো। তখন আমি রিকশা পাঠামু তোমার বাড়ির সামনে। তুমি রিকসায় উঠবা কেবল আর কিছুই করতে হইবো না। এইটা পনেরো দিনে একবার হইলেই আমার শান্তি।”
“তা না হয় বুঝলাম। এবার পরিচয় দেন। আমগো মাঝেতো আপোষ হইলো।”
“এখন না। গহীন রাইতে তোমারে সু*খ দিতে দিতে আমার পরিচয় দিমু। এখন বাড়িতে যাও। কেউ দেইখা যাইবো।”
পুরুষটি চলে যায়। নূরী নির্বিকার ভঙ্গিতে তার চলে যাওয়া দেখলো। যার পুরো মুখের অর্ধেকজুড়ে রয়েছে মেহেদী দিয়ে রঙ করা ঘন, লম্বা দাঁড়িগোঁফের বহর। মাথার চুলেও মেহেদীর রঙে রাঙানো। তাকে এর আগে কোথাও দেখেছে বলে নূরীর স্মরণে আসছে না। নূরী নিজেকে ধাতস্থ করে নেয় ইতিউতি চেয়ে। হেঁটে গিয়ে পুকুরঘাটে নামলো। ভালো করে পানির ঝাপটা মেরে হাত মুখ ধুয়ে নিলো। উপরে উঠে দাঁড়াতেই একটু অদূরে দেখতে পেলো বাদশাকে। বাদশা দ্রুতপদে তার সামনে চলে এলো।
লুকানো,নিষিদ্ধ, গোপন কিছুর প্রতি মানুষের অদম্য কৌতুহল সেই প্রাগৈতিহাসিক কাল থেকেই। তাই বাদশা ইচ্ছে করেই নূরীকে দেখা দিলো। নূরী নিরীহ মানুষ। কিছু জানা গেলে তার থেকেই জানা যাবে। সেই লোকটির থেকে নয়। এরমধ্যে নূরীর বাড়িও বাদশার একবার যাওয়া হয়েছে। তাই নূরীর সাথে কথা বলায় তার মাঝে কোন আড়ষ্টতা নেই। বাদশা ছল করা কন্ঠে নূরীকে শুধালো,
“খালাম্মা দেখবেন আশপাশ? লন দেখাই আপনেরে।”
“নাহ। দেখছিতো এতক্ষণ। আইচ্ছা বাদশা উনি কে এই ঘরের?”
“কে খালাম্মা?”
নূরী পুরুষটির বর্ণনা দিলো নিজের সাধ্যমতো। বাদশা বললো,
“আর কইতে হইব না। বুঝছি কার কথা বলতাছেন। ছোট তালুকদার। আপনার আপন বেয়াইর ছোট ভাই। খায়রুল কাকা।”
নূরী চোখমুখের স্তম্ভিতভাব লুকানোর চেষ্টা করলো। বলল,
“ওহ আইচ্ছা। পরিচয় হইলো। দাঁড়িগোঁফ থাকলে কি হইবো। রসিক আছে মানুষটা। বিয়ার দিন উনি গেলনা ক্যান আমাদের বাড়ি?”
“উনি তখন গ্রামে ছিল না। ঢাকায় ছিলো। বাড়িতে আসার পর শুনলো ভাতিজা বিয়ে করছে মধুপুর গ্রামে।”
“হুম বুঝলাম।”
“খালাম্মা যাই। কাম আছে। আপনার কোন দরকার পড়লে আমারে খবর দিয়েন। চইলা আসুম।”
বাদশা চলে যায় তার মনে গজিয়ে উঠা কিছু প্রশ্ন নিয়ে। সে বোকা নয়। তাই পুরো বিষয়টা তার দৃষ্টিগোচর হয়েছে, এটা নূরীকে বুঝতে দিয়ে বিব্রতকর পরিস্থিতিতে ফেলে দিল না। নূরীও বুঝে নিলো কেউই দেখেনি সদ্য ঘটে যাওয়া বিশ্রী ঘটনাটি। নূরী ভেজা মুখখানি শাড়ির আঁচল দিয়ে মুছে নেয়। যেন সবকিছুই স্বাভাবিক আছে। এমন ভান করে চলে যায় ঘরে মেয়ের রুমে।
“এতক্ষণ লাগলো তোমার সব দেখতে? আমিতো রেডি হইয়া সবার কাছ থেইকা বিদায় নিয়া নিছি।”
“আরেহ হাঁটতে হাঁটতে আমি বাড়ির শেষ মাথায় চইলা গ্যাছি। এত ফল পাকড়ার গাছ।কত গুলান জাম্বুরা ঝুইলা রইছে গাছে। যদি দেখতি। ”
” কপালে যদি থাকে লেখা। তবে হইবো এই বাড়ির লগে দেখা।”
“তুই মনে হয় সব দেখস নাই। নাহ?”
“অনেকখানি দেখছি। কয়দিন আগে হেগো ফাটা মামু মরলো যেদিন। সেদিন।”
শিখা ও নূরী বেরিয়ে যায় তালুকদার বাড়ির আঙিনা ছেড়ে। শিখা মুখ তুলে দোতলায় রাজের বদ্ধ রুমের দিকে চাইলো করুণ চোখে। তাদেরকে এগিয়ে দিতে এলো মতির মা,ফুলবানু,বরকত, বাদশা ও আমেনা। তাদের চোখ ছলছল। কেননা শিখা বলেছে দরকার না হলে নিজ থেকে সে এই বাড়িতে আর আসবে না। নূরী তাদের সবাইকে তাদের বাড়ি যেতে বলল মন চাইলেই।
শিখার মন খারাপ হলো। নিজ ঘরের গুরুত্বপূর্ণ কেউই এলোনা তাকে বিদায় দিতে। মাত্র একজন এলো। সে হলো শিখার স্বশুর জয়নুল তালুকদার। আর বাকি সবাই ইঁদুরের মতন ঘাপটি মেরে যার যার রুমে বসে রইলো। বড় ভাসুর রাশেদ বাড়িতে নেই বলে দেখা হলো না। জয়নুল তালুকদার পুত্রবধূর মাথায় হাত বুলিয়ে আশীর্বাদ করে দিলেন। বললেন তিনি মাঝে মাঝে দেখতে যাবেন শিখাকে। শিখাও প্রভুভক্ত পোষা প্রাণীর ন্যায় ঘাড় হেলিয়ে সম্মতি জ্ঞাপন করলো শ্বশুরের কথায়।
শিখাকে নিয়ে নূরী বাড়িতে চলে গেলো। শিখা নিজের রুমে গিয়ে কাঁধের ভ্যানিটি ব্যাগ ও ব্রিফকেস রাখলো। বাবার বাড়িতে এসেছে। এখন তার মন অনেক ভালো। তিড়িংবিড়িং করতে করতে শিখা বাড়ির অন্যান্য ঘরে চলে গেলো সালাম দিতে ও দেখা করতে। নূরীর মনে অশান্তির আখড়া। রাজ্যের উৎকন্ঠা তার মনজমিনে দাফিয়ে বেড়াচ্ছে হায়েনার মতো। সে শিখার পড়ার টেবিলের উপরে হলুদ খামে মোড়ানো মুখবন্ধ একটি চিঠি রাখলো। কৃতজ্ঞতার সাথে রাজকে মনে করলো। কারণ রাজের এই চিঠি নিয়েই তার মেয়ে এখন ডুবে থাকবে কল্পরাজ্যে। এতে তার চিন্তাগ্রস্ত মুখচ্ছবিখানি সহজে শিখার নজরে পড়বে না। নয়তো তার দুরন্ত মেয়েটা কিছু আঁচ করে ফেলবে।
শিখা ঘরে এসে নিজের রুমে গেলো। শাড়ি চেঞ্জ করে নিলো। কাঠের আলনা থেকে তার কামিজ,সেলোয়ার পরে নিলো। তালুকদার পরিবারের অজস্র গল্প কথা তার মস্তিষ্কের প্রতিটি কোষে কোষে ডিগবাজি খাচ্ছে মাকে বলার জন্য। টেবিলে চোখ পড়তেই শিখা একটি নতুন চিঠির খাম দেখে ভূত দেখার মতো চমকে উঠলো। খামটি হাতে নিয়ে মায়ের সামনে গেলো।
“আম্মা আমার টেবিলে এইটা কি? কে রাখলো?”
অবাক করা কন্ঠে বলল শিখা।
“এইটা তুই চিনস না কি? চিঠির খাম আর কোনদিন দেখসনাই? জামাইয়ের চিঠি আরো এক সপ্তাহে আগেই তোর পিয়ন দাদা ঘরে আইসা দিয়া গেলো। আমি পঞ্চাশ টাকা বকশিস দিলাম জোর কইরা। যেন চিঠি আইলেই দ্রুত পৌঁছায়া দেয়। তোরে টাসকি খাওনের লাইগাই এর আগে কইনাই। রুমে যাইয়া পড়। সুন্দর কইরা মধুর ভাষা দিয়া উত্তর লেইখা দিস। পোস্ট অফিসের ডাকবাক্সে আমি গিয়া দিয়া আসুম।”
শিখার সারামুখে খুশীর ঝলকানি। মুক্তোদানার মতো চিকচিক করছে অধরকোণের হাসি। শিখা দৌড়ে চলে গেলো রুমের দিকে। নূরী আপন মনে হাসল। এবং বলল,
ল্যাদা মাইয়া বিয়া দিয়া আমার যত মুসিবত। আল্লাহ রহম করো সকল বিপদ আপদ থেকে আমার দুই কন্যারে।
সান্ধ্যকালীন কাজ সেরে নূরী শরীর খারাপের অজুহাতে নিজের রুমে গিয়ে শুয়ে পড়লো। চিন্তা করছে খায়রুল তালুকদারকে নিয়ে। উজানপুর গ্রামের এক পুরুষ কিভাবে সতেরো, আঠারো বছর পূর্বের মধুপুর গ্রামের এক বাড়ির আঁধার রাতের ইতিহাস জানে। আগে এই বিষয় খোলাসা করতে হবে। তারপরে হবে বাকি ফয়সালা।
শিখা দরজা বন্ধ করে দিলো। বিছানায় বসলো। মুখ হাসি হাসি। খামের মুখ ছিঁড়ে নিলো একপাশ হতে। ভাঁজ করা বড় চিঠিটি মেলে ধরলো চোখের সামনে। নীল আর গোলাপি আভার চমৎকার একটি লেটার প্যাডে লিখা চিঠিটি। কালো কালির ফাউন্টেন কলম ব্যবহার হয়েছে চিঠিতে। মাঝে মাঝে দোয়াতে কলম চুবিয়ে নেওয়ার ফলে চিঠির মাঝে দু এক ফোঁটা কালির দাগ বৃত্তাকারে ছড়িয়ে আছে। চিঠির উপরের ডানপাশে তারিখ। ৭।১০। ১৯৯৪ ইং। ঢাকা ১২০৯। সায়েন্সল্যাব। এপিঠ শেষ করে ও বিপরীত পিঠের অর্ধেক পর্যন্ত চিঠি লিখা রয়েছে। চিঠির শেষে নিজ হাতে আঁকা দুটো পাখি। একটি জামাই পাখি। আরেকটি বউ পাখি। তাদের দুই জোড়া ঠোঁট ঘনিষ্ঠ অবস্থায় রয়েছে। শিখা তা দেখেই লজ্জায় নিজের ঠোঁট কামড়ে ধরলো। চিঠি পড়তে লাগলো একরাশ ব্যকুলতা নিয়ে।
আমার প্রিয় বালিকা,
তুমি কেমন আছ? এই চিঠি আমি যখন লিখছি, তখন পূর্বাকাশে সূর্যটা উদিত হবার পূর্বক্ষণ। ঊষালগ্ন শুরু হবে কিছুক্ষণ পরেই। দিবারাত্রির এই মিলনক্ষনে ভীষণ ইচ্ছে করে মিশে যাই তোমার মাঝে। আজ হৃদয় মাতোয়ারা। একটি মুহূর্তের জন্যও তোমাকে ভুলতে পারিনা। ভোলা যায়না দীঘির স্বচ্ছ জলের মতো তোমার ভীরু চাহনির কাজল কালো মায়াবী দুটি আঁখি। আমি বারনার ডুবে যাই তোমার চোখের অনন্ত মায়ায়।
আপন মনে হাসি। যখন মনে পড়ে ,আমাদের বাড়িতে দিবসের আলোকে সাক্ষী রেখে আমাদের প্রথম সাক্ষাৎতে তোমার বলা কথাগুলো। কোন কিশোরী মেয়ের বিরক্তিকর কন্ঠ ও ঘাবড়ে যাওয়া দৃষ্টিও এত মোহনীয় হতে পারে তা অনুভব করলে আমি মোহাবিস্ট হয়ে যাই। যদি ম্যাজিক জানতাম তাহলে রোজ নিশিতে গিয়ে তোমাকে দেখে আসতাম। এই চিঠি লিখতে বসেছি আমি রাত্রির মধ্যপ্রহরে। কিন্তু কাটাকাটি করতে করতেই এত সময় বয়ে গেলো। জীবনে প্রথম প্রণয় পত্র লিখছি। তাই আমার ভাষারা এলোমেলো। দিগবিদিক ছুটছে। ইচ্ছেকরে পৃথিবীর সব সুন্দর ছন্দময় শব্দের কাব্যিক গাঁথুনি দিয়ে তোমায় লিখি।
তুমি যেন আমার সেই অব্যক্ত অনুভূতিগুলোকে বুকের মাঝে যত্ন করে আগলে রাখতে পারো। যেন আবেশে নয়ন বুঁজে আসে তোমার। আচ্ছা খুকী, তোমারও কি এই যুবকটার কথা মনে পড়ে? নাকি ভুলেই বসে আছে বেখেয়ালি ভাবুকের মতো। তোমাকে লিখতে গেলে কাগজ,কালি ফুরিয়ে যাবে। কিন্তু আমার কথা শেষ হবে না। তাই আজ বিদায় নিই। আমাদের বাড়িতে তোমার কোন সমস্যা হয়েছে কিনা, জানাতে ভুল করনা। মন দিয়ে পড়াশোনা করো। জানো প্রিয়া, তুমি আমার বউ এই ফিলিংসের চেয়ে, তুমি আমার প্রেমিকা,এটা আমার অনুভূতিতে ঘুরপাক খায় বেশী। কারণ তোমাকে যেভাবে দেখেছি,যতটুকু পেয়েছি তা প্রেমিকার মতই। আম্মাকে আমার সালাম দিও। চিঠি পাওয়া মাত্রই চিঠি লিখবে আমায়। নিঃসংকোচে লিখো। প্লিজ। তোমার অনুভূতি জানার আকুল প্রতিক্ষায় রবো।
ইতি… মরুভূমির এক তৃষ্ণার্ত পথিক।
শিখা কাঁপছে অনবরত। হৃদয় উথাল-পাতাল। দিশেহারা। জামার গলা ফাঁক করে বুকের মাঝে চিঠিটি চেপে ধরলো। ওভাবেই ঘুমিয়ে পড়লো গোপন কল্পসুখের জাল বুনতে বুনতে।
সুফিয়া বিবি সেই নিরালা রাতে শিখাকে থাকতে দেওয়া রুমে গেলো। লাইট জ্বালিয়ে খাটের নিচে উঁকি মারলো। দেখলো পেঁপেটি নেই। ভীত হওয়ার বদলে তার মেজজ তেতে গেলো। হন্যে হয়ে চিপায়চাপায় খুঁজলো। পরে তার পালংকের নিচ থেকে উদ্ধার করলো পেঁপেটি। বাইরে নিয়ে ফেলে দিলো দূরে। বিষিয়ে আসা কন্ঠে বলল,
“কোন অমাইনষে করলো এই কামড়া। আমার ঘরেই আমার শত্রু! আমারে মারতে চায়। আরেহ বেক্কল, যার নামে পড়াইছি হেই ছাড়া অন্য কেউ বেমারে পড়বো? মরবো? আরো বড় কবিরাজি দাওয়াই আছে আমার হাতে। একবার আসুক ওই ফকিরনীর মাইয়া।”
তার দুইদিন পর শিখা স্কুলে গেলো। টিফিন পিরিয়ড়ে ক্লাস থেকে সব ছাত্রীরা বেরিয়ে গেলো। সে গার্লস স্কুলে পড়ে। কোন ছেলে নেই এখানে। সেও বের হলো খেলতে যাওয়ার জন্য মাঠে। তখনই স্কুলের আয়া নমিতা পাল তার হাতে একটি লাল টকটকে গোলাপ ফুল দিলো।
“কে দিলো দিদি?”
“চিনিনা। একটা পথের ছোট্ট ছেলে আমার হাতে দিয়ে বলল, দশম শ্রেণীর শিখাবুরে দিবেন। আমি তাকে বললাম কে দিলো? তুমি কে? সে বলল,আমি চিনিনা। আমার হাতে পাঁচ টাকা দিয়ে একটা আপু এইটা দিলো। তারপর সে চইলা গ্যালো।”
“ছেলেটাকে এখন পাওন যাইবো দিদি?”
“কই পাবো? কোন বাড়ির কে জানে? প্রেমপত্র ছাড়া আর কি হবে। দেখো খুলে।”
রাজবধূ পর্ব ১৩
এই বলে নমিতা পাল চলে গেলো তার দায়িত্ব পালনে। শিখা ভিমড়ি খেলো। হতবাক হয়ে গেলো। চোখ কোঠর হতে বেরিয়ে আসার উপক্রম। সে ওয়াশরুমে গিয়ে দরজা বন্ধ করলো। গোলাপের লম্বা কাঁটাযুক্ত ডাঁটাটি সাদা স্কচটেপ দিয়ে মোড়ানো। শিখা স্কচটেপটি টেনে খুলতেই ভিতর হতে বেরিয়ে এলো একটি সাদা কাগজের ছোট্ট চিরকুট।
“শিখা, বাবার বাড়ি চলে গেলে। আমাকে দেখা দিয়ে গেলে না। অথচ সেদিন ফাটা হাসুর মৃত্যুর ফাঁদ তৈরি করে তোমাকে কত বড় বিপদ থেকে বাঁচালাম। কষ্ট করে তোমার স্কুল খুঁজে বের করলাম। এছাড়া আর কোন পথ নেই তোমাকে কিছু বলার। তোমাকে না দেখতে পেয়ে খুব খারাপ লাগলো। তাই লিখলাম। ভালো থেকো। নিজেকে সুরক্ষিত রেখো।”
**তোমার চেনা শুভাকাঙ্ক্ষী।