নিষিদ্ধ শব্দের দিনলিপি পর্ব ১১
ঝিলিক মল্লিক
বাথরুমে শাওয়ার ট্যাব ছেড়ে তার নিচে দাঁড়িয়ে নিজের শরীরের দিকে একদৃষ্টিতে আনমনে তাকিয়ে আছে রিদি। আরবিনের প্রতিটা স্পর্শের বেশিরভাগ চিহ্ন রয়ে গেছে রিদির শরীরে। এসব মোটেও ভালোবাসার চিহ্ন নয়। এগুলোকে কী ভালোবাসার চিহ্ন বলা যায়?
মোটেও নয়! আরবিনের প্রতিশোধ স্পৃহা আর শাস্তির সিলমোহর যেন মিশে আছে রিদির শরীরের ভাঁজে ভাঁজে।
না আরবিন তেমন গভীরভাবে ঘনিষ্ঠ হয়নি। এই ঘনিষ্ঠতার সীমা রিদির বোঝা হয়ে গেছে। আরবিন শাস্তি দিয়েছে; তবে যথেষ্ট সতর্কতার সাথে, হুঁশে থেকে। খুব শেয়ানা লোক!
রিদি কথাটা ভেবে শাওয়ারের ট্যাবের পানিতে ভিজতে ভিজতে আরো এক দফা কেঁদে নেয়। নিজের জেদের কাছে হেরে গেছে। আজ স্বামীর সম্মোহনে সম্মোহিত হয়ে আহম্মকের মতো বিশাল বড় ভুল করে ফেলেছে ও। যেই ভুলের মাশুল ওকে সারাজীবন গুনতে হবে।
গলার নিচে বুকের কাছটায় হালকা লালচে দানার মতো চিহ্নটা ভালোভাবে অবলোকন করে দেখলো রিদি।
সম্পর্ক, সমীকরণ, জটিলতা — তিনটি শব্দ যখন একই সূত্রে বাঁধা পড়ে; তখন এর কী নাম দেওয়া যায়? শত্রুতা?
স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে শত্রুতাও হয়? এটা তাহলে অবশ্যই কোনো স্বাভাবিক সম্পর্ক নয়। রিদির মনে পরলো আরবিনের সাথে পুরোনো সখ্যতার কথা। দিনগুলো কত সুন্দর ছিল। রিদিও তো আরবিনকে মনে মনে পছন্দ করে বসেছিল। কিন্তু এমন সময়ও যে আসতে পারে, বুঝতে পারেনি ও!
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
আরবিন যখন রিদির কাছাকাছি এসেছিল রাতের দ্বিতীয় প্রহরের শেষ সময়ের দিকে, রিদির তখন সেই ঘনিষ্ঠতা থেকে পিছু হটে সরে আসার কোনো উপায় ছিল না। আগেই বরং স্বেচ্ছায় আরবিনের কাছে নিজেকে সমর্পণ করাটা যেন ছিল জীবনের সবচেয়ে বড় ভুল। কেন যে স্বেচ্ছায় ওই সম্মোহনে সম্মোহিত হয়েছিল! এতোটা অধঃপতন হলো কবে! আরবিন যে ওকে শাস্তি দিতে এসব করছে, তা জেনেও রিদি মাথা পেতে গ্রহণ করেছিল।
রাতের এখন শেষ প্রহর। আর কিছুক্ষণ হলেই সূর্য উদয় হবে পূর্বাকাশে। আরবিন উপুড় হয়ে কম্বল মুড়ি দিয়ে শুয়ে আছে। শেষরাতে রিদির কাছ থেকে দূরে সরে আরবিন বলেছিল,
“আহামরি তেমন কিছুই করিনি তোমার সাথে। এই শীতের মধ্যে এখন গোসল না করলেও চলবে।”
আহামরি! হ্যাঁ আহামরি তেমন কিছু নয় বটে। সর্বনাশের কিছুই হয়নি। হলে এতোক্ষণে রিদি কাঁদতে কাঁদতে জ্ঞান হারাতো। কিন্তু আরবিনের ওপর জেদ দেখিয়েই এই কনকনে হাড় কাঁপানো শীতের মধ্যেও গোসল করতে চলে এসেছে। মগের পর মগ পানি ঢালছে মাথায়। শরীরের যেখানে যেখানে আরবিনের স্পর্শ লেগেছে, সেখানে জালে সাবান মেখে ঘষেমেজে ডলছে। তবু মনে হচ্ছে, এই স্পর্শ যেন আমৃত্যু যাওয়ার নয়।
রিদি আরো কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকলো শাওয়ার ট্যাবের সামনে। এই কনকনে ঠান্ডাও যেন গায়ে লাগছে না ওর। শরীরে বরফের ন্যায় ঠান্ডা পানিও উত্তপ্ত লাভা-র মতো তাপ ছড়াচ্ছে। সময় যেন কাটছেই না। রাতটা এতোটা দীর্ঘ না হলেও পারতো! শীতের রাত বলেই বোধহয় এতখানি দীর্ঘতা।
রিদি কোনোভাবেই মাথা থেকে আজ রাতের ঘটনা, আরবিনের তিক্ত কথাগুলো সরাতে পারছে না। আরবিন ওর কাঁধের উন্মুক্ত স্থানে ঠোঁট মিশিয়ে বলেছিল তখন,
“এই চুমু, এই স্পর্শ আমার তরফ থেকে তোমার জন্য একটা বিশেষ শাস্তি। মা’রতে পারলে তো জানেও মা-রা যায়। সব ঝামেলা একেবারে শেষ। অশান্তি নির্মূল হবে। কিন্তু তোমাকে আমি জানে মা’রবো না৷ যতদিন না তুমি নিজেকে শুধরাবে, ততদিন এভাবে তিলে তিলে শেষ করে দেবো। দেখি, তুমি কতটুকু সীমা অতিক্রম করতে পারো!”
রিদি তখন আরবিনের কথার কোনো জবাব দিতে পারেনি। অন্যসময় হলে ঠিকই কতগুলো শক্ত কথা শুনিয়ে দিতো। কিন্তু তখন ওই মুহূর্তে, অমন পরিস্থিতিতে — আরবিনের হাতের আঙুলের ভাঁজে রিদির হাতে আঙুল, পায়ের পাতার সাথে অপরজনের পায়ের পাতা মিশিয়ে রাখা, শক্তপোক্ত জিম করা শরীরের সাথে নরম দেহ মিশিয়ে অবস্থান করা— সবটাই যেন রিদিকে বোবা করে দিয়েছিল। তাহলে কী বলতে হয়, মেয়েমানুষের দুর্বলতা হলো স্বামীর সংস্পর্শ?
রিদিও কী সেই কাতারেই পড়ে? নিজেকে অথৈ জল পরিপূর্ণ সাগরে ভাসিয়ে দেওয়ার কী মানে? যেই সাগরের কোনো কূল-কিনারা নেই!
রিদির মনে প্রশ্নটা আবারও আসলো। দাঁতে দাঁত চেপে বসা থেকে উঠে দাঁড়ালো ও। ভেজা শাড়ি পরে আছে বাথরুমের ফ্লোরের এককোণে। ভেজা চুল, শরীর মুছে নিলো রিদি। তারপর ভেজা ব্লাউজ আর পেটিকোট পাল্টে একটা গাউন ফ্রক, চুড়িদার সালোয়ার পরিধান করে নিলো।
বাথরুম থেকে বের হয়ে রিদি দেখলো, আরবিন তখন ঘুমে আচ্ছন্ন। একইভাবে উপুড় হয়ে ঘুমিয়ে আছে। আপাতত এই শেয়ানাবাজ লোকটাকে দেখে রিদির একটাই কথা মাথায় আসছে — “একই অঙ্গে দেখিব কত রূপ!”
রিদির চুল আঁচড়াতে ইচ্ছা করলো না। চারিপাশের সবকিছু অসহ্য লাগছে। সবচেয়ে বেশি অসহ্য লাগছে, নিজেকে। কেন যে বোকার মতো আরবিনের কর্মকাণ্ডে আশকারা দিয়েছিল! জেনে-বুঝেও ভুল করে ফেলেছে ও।
রিদি এসে বিছানার ওপর বসলো৷ আরবিনের শান্তির ঘুম রিদির সহ্য হচ্ছে না। ওর জীবনটাকে অশান্তিতে পতিত করে লোকটা এখন শান্তির ঘুম দিচ্ছে! রিদি কোনোভাবেই মেনে নিতে পারছে না। খুব রাগ উঠছে। ওর মনে পরলো, আজ বিকালে আরবিনের সিলেটের উদ্দেশ্যে যাত্রা করতে হবে।
এজন্যই হয়তো শান্তির ঘুম দেওয়ার প্রচেষ্টায় আছে।
কথাটা মাথায় আসতেই রিদির হঠাৎ খুব দুঃসাহসিক কান্ড ঘটাতে ইচ্ছা করলো।
ইচ্ছা অনুযায়ী কাজটা করেও ফেললো রিদি। বাথরুম থেকে এক মগ পানি এনে আরবিনের উদাম বুক ও মুখ বরাবর ঢেলে দিলো। এমনিতেও সারারাতের ঝক্কি সামলে শেষরাতে ক্লান্ত শরীরে ঘুমিয়েছে আরবিন। ঘুম তখনও পাকাপোক্ত হয়নি। কাঁচা ঘুমের মধ্যে ঠান্ডা বরফের মতো পানি যেন শরীরে তলোয়ারের ফলার ন্যায় আ’ঘাত করলো। সঙ্গে সঙ্গে শোয়া থেকে ধড়ফড়িয়ে উঠে বসলো ও। ভ্রু কুঁচকে, বিরক্ত চাহনিতে সামনে মগ হাতে বিজয়ীর হাসি নিয়ে দন্ডায়মান রিদিকে দেখলো। রিদি ঝড়ঝড়ে কন্ঠে বলে উঠলো,
“আমার ঘুম নষ্ট করে শান্তিতে ঘুমাচ্ছেন! উঁহু! তা তো হবে না।”
আরবিন ঘুম ঘুম কন্ঠে জবাব দিলো,
“তারমানে তুমি বলতে চাচ্ছো, আমার জন্য তোমার ঘুম নষ্ট হয়েছে?”
“হুঁ!”
“তাহলে তো বলতে হয়, আমি আমার কাজে শতভাগ সফল। এক বেয়াদবকে সারারাত উপযুক্ত শাস্তি দিতে পেরেছি। তাই না?”
প্রশ্নটা করে আরবিন জিজ্ঞাসাসূচক দৃষ্টিতে রিদির মুখের দিকে তাকিয়ে থাকলো জবাবের আশায়। রিদি ভ্রু কুঁচকে ফেললো। আবারও আরবিন ওকে কথার ফাঁদে ফেলতে চাইছে। রিদি কঠিন গলায় বলে উঠলো,
“আপনি শাস্তির নামে নোংরামি করেছেন। অসভ্যতামিকে কী শাস্তির আখ্যা দেওয়া যায়?”
“নিজের বউয়ের সাথে অন্তরঙ্গ হওয়া মানে যে নোংরামি আর অসভ্যতামি করা, এই সংজ্ঞা তো আমার জানা ছিল না। আপনি কী নতুন নতুন শিক্ষকতা শুরু করলেন। তো আমাকে আপনার পাঠশালায় শেখাবেন ম্যাডামজি? আসলে আমি আপনার মতো অতো জ্ঞানী মানুষ নই তো।”
বালিশে হেলান দিয়ে বসে রিদির চোখে চোখ রেখে কথাগুলো বলে আরবিন। রিদি আরো কঠিন গলায় বলে,
“আপনি আমার ওপর জোর-জুলুম করেছেন। আপনার নামে আমি নারী নির্যাতনের মামলা করে দেবো। তখন আপনার চাকরিও যাবে, আর সাথে আপনিও।”
“কোর্টে দাঁড়িয়ে জজকে কি স্বীকারোক্তি দেবে? যে, ‘আমার স্বামী বিয়ের প্রথম রাতে আমার কাছে এসেছিল। আমিও সাড়া দিয়েছিলাম। কিন্তু পরে মনে হলো, এসব জোর-জুলুম;’ তাই তো?”
“আপনি আমার সাথে ছলনা করেছেন আরবিন। তা আমি কী করে ভুলে যাই?”
“ভুলতে হবে না। সারাজীবন মনে রেখো। আর আমাকে ঘৃণা কোরো। আমিও তোমাকে অপছন্দ করতে থাকি। আমৃত্যু এভাবেই কেটে যাক; তোমার আর আমার সম্পর্ক বৈরিতার সাথেই কাটুক। একজন দেশদ্রোহীর সাথে সৈনিকের ভালোবাসাবাসির সম্পর্ক কখনোই হতে পারে না।”
“তাহলে কাছে এসেছিলেন কেন?”
মুখ ফসকে প্রশ্নটা করে থমকে যায় রিদি। নিজের মুখের ওপর নিয়ন্ত্রণ না থাকার জন্য নিজেকে একশো একটা গালি দিয়ে ফেলে মুহূর্তের মধ্যে। আরবিন ওর দিকে তাকিয়ে কিঞ্চিৎ ক্রুর হেসে বলে,
“প্রশ্নের উত্তরটা তুমি নিজের দিকে তাকালেই বুঝতে পারবে। দেশদ্রোহীরা মৃত্যুর যোগ্য। আমি তো তোমাকে ছুঁয়েছি মাত্র। তবে এটাই তোমার জন্য মৃত্যুর মতোই ভয়ানক শাস্তির সমতুল্য। তুমি এখন বুঝতে না পারলেও, যখন আমি থাকবো না; তখন প্রতিটা মুহূর্তে উপলব্ধি করতে পারবে।”
“বারবার দেশদ্রোহী দেশদ্রোহী করছেন কেন? এই দেশ আপনার জন্য কী করে রেখেছে? যে এসবের জন্য এতোটা নিষ্ঠুর আর স্বার্থপর হচ্ছেন?”
“তোমার এই প্রশ্নের মধ্যেই উত্তর লুকিয়ে আছে। এই কথাগুলোর দ্বারাই দেশের প্রতি তোমার মারাত্মক বিদ্বেষ স্পষ্ট বোঝা যায়। স্বার্থপর তুমি। গতকাল থেকে বহুবার তোমাকে বোঝানোর চেষ্টা করেছি। কিন্তু তুমি তোমার জেদ আর যুক্তিহীন অবস্থানে থেকে গেছো। এরজন্য এই শাস্তির উপযুক্ত প্রার্থী তোমাকেই করা হয়েছে। রিদি, আমার বাড়তি কথা পছন্দ না। আর কোনো তর্ক করবে না। মুখে মুখে তর্ক করলে ভীষণ রাগ লাগে বুঝলে! এখন না ঘুমালে আমার বিকালের জার্নিতে কষ্ট হবে। সো প্লিজ, ঘুমাতে দাও। আর যদি বেশি সমস্যা বোধ করো; তো আসো, শুয়ে পড়ো আমার সাথে। শাস্তিটা যে খুব উপভোগ করেছো, তা বলা বাহুল্য। কিশোরী মেয়েদের মন এমনই আনচান করে। নতুন নতুন পুরুষ মানুষের সঙ্গ পেলে অমনি হয়। কিন্তু পরে টের পাবে, যেচে কতবড় ভুল করেছো৷ আমার কি ঠ্যাকা!”
আরবিন ভেজা জায়গা থেকে সরে অপর পাশে এসে ঘুমালো। রিদি আরো একবার তর্কে হেরে রাগ-ক্ষোভ আর অতি দুঃখে জর্জরিত হয়ে ঘর ছেড়ে ব্যালকনিতে চলে গেল।
আরবিন বের হবে সকালের নাস্তা সেরেই। রিদির পরিবার অনেক করে অনুরোধ করেছিল, অন্তত দুপুরের খাওয়া সেরে তারপর এখান থেকে যেতে। কিন্তু আরবিন তা নাকচ করেছে। অবশ্য বুঝিয়েই বলেছে শ্বশুরবাড়ির মানুষদেরকে। এখান থেকে সকালে না গেলে আরবিনের বেশকিছু কাজ অসমাপ্ত থেকে যাবে, আর কাজগুলো শেষ করা খুবই জরুরি। তাছাড়াও দুপুরের খাওয়া সেরে তারপর গেলে আব্বা-আম্মার সাথে কিছুটা সময় কাটানোর পরিকল্পনা বানচাল হবে।
আরবিনের কথায় আর জোরাজোরি করলেন না সোহরাব হোসেন এবং বাড়ির বাকি সদস্যরা। তবে আরবিনের এখনই চলে যাওয়ার খবর শুনে রিদিকে অনেক বেশি খুশি দেখা গেল। ও ঘুরিফিরে রুটি খেতে খেতে মনে মনে বললো,
“আপদ বিদায় হলেই বাঁচি। এরপর আর কোনোদিনও দেখা না হোক আমাদের!”
আরবিনও বেশ বুঝতে পারলো, রিদির মনোভাব। তবে বাকিটা সময় বেশ গম্ভীর রইলো ও। এরমধ্যে খাওয়ার পরে ড্রয়িংরুমে শ্বশুর, শাশুড়ী আর চাচিশাশুড়ীর উপস্থিতিতে আরবিন একটা প্রস্তাব উপস্থাপন করলো। যা শুনে সবাই কিছুক্ষণ হতভম্ব হয়ে বসে রইলো। আরবিন তার শ্বশুরকে উদ্দেশ্যে করে বললো,
“আব্বু, আমি একটা সিদ্ধান্ত নিয়েছি।”
সোহরাব হোসেন বললেন,
“বলো আব্বা। কি সিদ্ধান্ত?”
“আমি চাইছি, এখন থেকে রিদির সকল খরচ আমি বহন করবো। ওর সব ধরনের অভিভাবকত্বের দায়িত্ব নেবো। এ বিষয়ে আপনার মতামত?”
সোহরাব হোসেনকে দ্বিধান্বিত দেখালো৷ কিছুটা চিন্তিতও। তিনি ও তার স্ত্রী একে অপরের দিকে তাকিয়ে রইলেন কিছুক্ষণ। আরবিনকে দেখে বোঝার উপায় নেই, রিদির আর ওর সম্পর্ক ঠিক নেই। চরম অস্থিতিশীলতা বিরাজ করছে ওদের মধ্যে। তাই সোহরাব সাহেবও ওর প্রস্তাবের পেছনের জটিল উদ্দেশ্য ধরতে পারলেন না। তবুও কিছুটা দ্বিধায় পরলেন, মেয়েজামাইয়ের এমন হুটহাট সিদ্ধান্তে। আরবিন তাদের সংকোচ কাটাতে বললো,
“আপনারা ব্যাপারটাকে অন্যভাবে নেবেন না প্লিজ। আসলে কিছু মাস পরে রিদি যখন আমার সাথে ক্যান্টনমেন্টে থাকবে, তখন ওর সব দায়িত্ব আমাকেই নিতে হবে। তাই আমি চাইছিলাম, আগে থেকে অভ্যস্ত হতে। যেহেতু আমার পূর্ব অভিজ্ঞতা নেই। এটুকু বুঝে নেওয়া ভালো। এতে করে পরবর্তীতে কোনো ঝামেলায় পরতে হবে না।”
সোহরাব সাহেব “না” সূচক কোনো মন্তব্য করার জন্যই কথা বলতে মুখ খুলছিলেন বোধহয়। তখনই রিদি তার পেছন থেকে বলে উঠলো,
“সমস্যা নেই। আমার আব্বু এমনিতেই সারাজীবন আমার জন্য কম করেনি। বহুত টাকা-পয়সা খরচ করেছে। আর করতে পারবে না। আর করবেই বা কেন? এখন আপনি আছেন। আপনিই নাহয় করলেন। আপনি প্রত্যেক মাসে টাকা পাঠিয়ে দেবেন আমার খরচার জন্য, এতেই দায়িত্ব ভালোভাবে পালন করা হয়ে যাবে। আমার বিকাশ নাম্বারটা নিয়ে রাখুন বরং।”
রিদির কথা শুনে সোহরাব হোসেন কিছুটা বিব্রত হলেন। তানিয়া বেগম মেয়ের দিকে তাকিয়ে কঠিন চোখে ইশারা করে চুপ থাকতে বললেন। কিন্তু রিদির ঠোঁটের কোণে তখন কুটিল হাসি। কে পুড়বে, তা ভবিষ্যৎ বলে দেবে। এবার জ্বালিয়ে-পুড়িয়ে সর্বস্বান্ত করে ছাড়বে এই লোককে। আরবিন চাইছে, রিদির প্রতি নিজের কর্তব্য পালন করার অজুহাত দেখিয়ে রিদিকে আরো পোড়াতে। যে, দেখো; আমি তোমার সাথেই আছি, পাশেই আছি; কিন্তু কাছাকাছি নেই।
এর থেকে ভয়াবহ দহন যন্ত্রণা আর কী হতে পারে?
অপরদিকে রিদি পরিকল্পনা করছে, স্ত্রী হিসেবে নিজের হক আদায়ে যথাযথ সচেষ্ট ভাব দেখিয়ে আরবিনকে নিঃস্ব করে ছাড়বে। দুই মেরুর দু’জন বাসিন্দার কি জটিল পরিকল্পনা। অথচ ভাগ্য তাদের কোথায় নিয়ে যাবে; তা কে জানতো!
“দেশের জন্য মনে যুক্তিহীন বিদ্বেষ পুষে রাখা একজন স্বার্থপর মেয়েমানুষের সাথে আমার আর এজীবনে কখনো দেখা না হোক। তোমাকে দেওয়া শাস্তির মাত্রা খুবই কম হয়ে গেছে। এ তো শুধু তোমাকে একজীবন পোড়াবে। কিন্তু আমার অনুপস্থিতি তোমাকে প্রতি ন্যানো সেকেন্ডে সহস্রবার পোড়াবে। কেন বলো তো? শুধুমাত্র ওই শাস্তির জন্য। আমি ভুলে যাব। গতরাত, তুমি — সবকিছু ভুলে যাওয়া আমার জন্য খুব সহজ ব্যাপার। এখান থেকে যাওয়ার পরে লেফটেন্যান্ট আরবিন দেশের নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পরবে। তার মনেও থাকবে না, রিদি নামে কেউ একজন আছে, কোনো একসময় তার জীবনে এসেছিল।”
আরবিন রিদির চোখে চোখ রেখে কথাগুলো বলে থামে। একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে জেদ, নির্লিপ্ততায় ভরপুর ওই জিদ্দি নারীর চোখজোড়ার দিকে।
রিদির ঘরের দরজা আপাতত ভেতরে থেকে আবদ্ধ। আরবিন আর রিদি মুখোমুখি দাঁড়িয়ে আছে। বিদায়ের পালা এসে গেছে। আরবিন আজ এখান থেকে যাওয়ার পরে রিদির সাথে তার সাক্ষাৎ হতে পারে তিনমাস, চারমাস কি ছয়মাস পরে। তবু আরবিন মনেপ্রাণে চায়, এই মেয়ের সাথে তার আর কখনো সাক্ষাৎ না হোক। যাওয়ার আগে রিদিকে বেশকিছু কঠিন কথা শোনানোর জন্যই এমন আয়োজন করে দরজা আঁটকে রিদির সামনে দাঁড়িয়েছে ও। তবে রিদি বোধহয় আগে থেকেই প্রস্তুত ছিল। হঠাৎই আরবিনের পাঞ্জাবির কলার আলতোভাবে চেপে ধরলো ও। পায়ে ভর দিয়ে দাঁড়িয়ে আরবিনের কলার চেপে ধরে ওর চোখে চোখ রাখলো। দাঁতে দাঁত চেপে বললো,
“যেমন আপনি আমাকে শাস্তি দিয়েছেন, তেমনই আপনার জীবনের প্রতিটা মুহূর্ত জ্বলন্ত দাবানলে পরিণত না করা পর্যন্ত আমি কোনোকিছু ভুলবো না আরবিন। স্ত্রী’র দায়িত্ব নেওয়ার খুব শখ না আপনার? এবার থেকে স্ত্রী হিসেবে এতো বেশি হ্যারাসমেন্ট করবো, আপনি দেশের সেবাযত্ন ভুলে আমার পেছনে পরে থাকবেন। মিলিয়ে নিয়েন।”
নিষিদ্ধ শব্দের দিনলিপি পর্ব ১০
“এমন দিন কখনো আসবে না রিদি।”
আরবিনের কাটখোট্টা জবাবরের বিপরীতে রিদি জবাব দিলো,
“অবশ্যই আসবে। শুধু সময়ের অপেক্ষা।”
আরবিন কিছুক্ষণ নির্লিপ্ত চাহনিতে রিদির দিকে তাকিয়ে থাকলো। গম্ভীর স্বরে বললো,
“কলার ছাড়ো।”