আষাঢ় রাতের সন্ধ্যা পর্ব ৩৭
Raiha Zubair Ripti
শুক্রবার দিন আষাঢ় ফের আসলো রাজশাহী রাতের দিকে । সাথে সন্ধ্যার জন্য ফোন ও নিয়ে এসেছে। ফোন পেয়ে মহা খুশি সন্ধ্যা। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে ছবি তুলছে। পাশেই রয়েছে এক গুচ্ছ লাল গোলাপ। যেটা আষাঢ় নিয়ে এসেছে। রাতের রান্না শেষ করেছে কনা। তিনজন মিলে খেয়ে ঘুমানোর জন্য রুমে চলে গেলো। বেলকনিতে দাঁড়িয়ে আছে কনা। কানে তার ফোন। রাতের সাথে কথা বলছে। রাত সবে অফিস থেকে ফিরে ফ্রেশ হয়েছে। একটুপর খাবার খাবে।
-“ ঘুমাবে কখন?
কনা জবাব দিলো-
-“ আপনি ফোন রাখলেই।
-“ খুব তাড়া দেখছি?
-“ তাড়া আমার কোনো কালেই ছিলো না। আপনি আসেন না কেনো?
-“ আমি তো আর ভাইয়ার মত জব করি না। আমার একদিন অফিস মিস তো স্যালারি থেকে টাকা কাট। তবে সামনে হয়তো জোড়া বন্ধ পাবো। তখন আসবো।
-“ সত্যি?
-“ হ্যাঁ। এখন ঘুমিয়ে পড়ো। আমার কাজ আছে। খেয়ে কাজ করতে হবে।
-“ ঠিক আছে। বেশি রাত জাগবেন না।
-“ ওকে ম্যাডাম।
আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন
কনা ফোন কেটে ঘুমিয়ে পড়লো। সকালে ঘুম থেকে উঠে ব্রেকফাস্ট বানিয়ে নিলো কনা। সন্ধ্যা এখনও ঘুমাচ্ছে। কনা টেবিলে খাবার সাজিয়ে নিজের রুমে বসে রইলো। আটটার দিকে ঘুম ভাঙলো সন্ধ্যার। গোসল সেরে রুম থেকে বের হতেই দেখলো খাবার টেবিল সাজানো। সন্ধ্যা স্মিত হাসলো। কনা সব করে রেখেছে। কনার রুমে উঁকি দিয়ে কনা কে বসে থাকতে দেখে ডেকে বলল-
-“ টেবিলে আয়।
সন্ধ্যা গিয়ে বসলো। কনা এসে পাশে বসে বলল-
-“ ভাইয়া খাবে না?
-” উনার উঠতে দেরি আছে। তাছাড়া আমাদের ক্লাস আছে। যেতে হবে তো। খাবার তো টেবিলেই থাকবে উনি খেয়ে নিবেন।
সন্ধ্যা আর কনা গল্প করতে করতে খেয়ে রেডি হয়ে ভার্সিটিতে চলে গেলো। আষাঢ়ের ঘুম ভাঙলো দশটার দিকে। পুরো বাড়ি ফাঁকা দেখে বুঝলো সবাই ভার্সিটি চলে গেছে। আষাঢ় উঠে গোসল সেরে বের হতেই হসপিটাল থেকে ফোন আসলো। জানালো রাতে একটা অপারেশন আছে। আষাঢ় ব্রেকফাস্ট করে সন্ধ্যাকে একটা টেক্সট করে বেরিয়ে পড়লো ঢাকার উদ্দেশ্যে।
সন্ধ্যা কনার ভার্সিটি শেষ করে বাসায় ফিরতে বিকেল হয়ে গেলো। দুপুরের দিকে আষাঢ়ের মেসেজ সিন করেছিলো সন্ধ্যা। আসার পথে কিছু বাজার করে নিয়ে এসেছে সন্ধ্যা। আপাততঃ রাতে শুধু খিচুড়ি খাবে।
আষাঢ় ঢাকায় ফিরে হসপিটালে গিয়ে অপারেশন টা শেষ করে কেবিনে আসতেই দেখতে পায় আগে থেকে বসে আছে ডক্টর সুমন। একজন হাতুড়ে ডক্টর। মাস কয়েক হলো বউ চলে গেছে অন্য পুরুষের সাথে। মাথায় তার চুল নেই। অনেকের ভাষ্যমতে সে টাকলা।
ডক্টর সুমন কে মন খারাপ করে বসে থাকতে দেখে আষাঢ় বলল-
-“ হোয়াটস হ্যাপেন্ড সুমন? মন খারাপ কেনো?
-“ একটা বিয়ে করতে চাই আষাঢ়।
-“ সে তো ভালো কথা।
-“ কিন্তু মেয়ে কোথায় পাবো? তুই তো বিয়ে করছিস তোর কোনো শালি আছে নি। থাকলে আমার সাথে সেটিং করায় দে। টাকা পয়সা চেহারা সবই ভালো আমার। শুধু চুল টাই নেই।
-“ আমার কোনো শালি… উম আছে একটা। তবে দজ্জাল। তোরে বিয়ে করবে না।
-“ কেনো?
-“ কারন আমাদের সংসারে আগুন জ্বালানোই তার কাজ।
-“ একটু দেখ না কোনো মেয়ে যদি পাস।
-“ আচ্ছা খুঁজে দেখবো।
আষাঢ় রাতে বাসায় ফিরলো। মা’কে সোফায় বসে থাকতে দেখে এগিয়ে গিয়ে বলল-
-“ মন খারাপ?
-“ আরে নাহ্। আজ শ্রেয়াকে দেখতে এসেছিল।
-“ তাই নাকি?
-“ হু।
-“ ছেলে কি করে?
-“ বিজনেস।
-“ বাহ্ ভালোই তো।
-“ শুধু ভালোই না ভাইয়া। সুগার ড্যাডিও।
রাতের কথা শুনে আষাঢ়ের কপাল কুঁচকে আসলো।
-“ সুগার ড্যাডি?
-“ হ্যাঁ আমার থেকে একটু ছোট হবে এমন বয়সী একটা মেয়েও আছে।
-“ শ্রেয়া রাজি হলো?
-“ শ্রেয়াই তো নিয়ে এসেছে।
-“ কিহ!
-“ হ্যাঁ ফেসবুকে পরিচয় দুজনের। তারপর দেখা সাক্ষাৎ আর এখন সোজা বিয়ে।
-“ বাহ্ অনেক ফাস্ট দেখি শ্রেয়া।
-“ সে আর বলতে নাকি। আঙ্কেল তো এমন ড্যাডির সাথে বিয়ে দিবে না। সেজন্য শ্রেয়া কি করেছে জানো?
-“ কি?
-“ বলেছে রাজি না হলে হারপিক খেয়ে পটল তুলবে।
-“ এবারও ইমোশনাল ব্ল্যাকমেইল?
-“ হ্যাঁ। আঙ্কেল বলে দিয়েছে ঐ ড্যাডি কে বিয়ে করলে এ বাড়ির দরজা তার জন্য চিরতরে বন্ধ।
-“ শ্রেয়া কি বললো?
-“ বললো তার ড্যাডির বাড়িতে হাজার টা দরজা আছে। একটা দরজা বন্ধ হলে তার কোনো যায় আসে না।
-“ ভেরি গুড। এই না হলে মেয়ের মতো মেয়ে।
-“ তুই এপ্রিশিয়েট করছিস শ্রেয়াকে?
-“ না মা। বুঝালাম কেমন মেয়ের সাথে এতদিন মেলামেশা করতে। রুচি কি দেখছো?
-“ হু দেখছি ফ্রেশ হয়ে আয় যা।
আষাঢ় চলে গেলো। তার এক সপ্তাহ পর শ্রেয়া বাড়ি ছেড়ে চলে গেলো তার সুগার ড্যাডির কাছে। আষাঢ়ের মাথায় ঢুকলো না কি দেখে দুজন দুজনকে পছন্দ করলো? শ্রেয়া তো মা হতে পারবে না। আর ঐ লোকটারও যথেষ্ট বয়স তাহলে? হয়তো লোকটার বেবি দরকার নেই এই বয়সে। আর শ্রেয়ার হয়তো শুধু জামাই হলেই চলতো সাথে মানি। শ্রেয়া চলে যাওয়ার এক দিন পরই খবর আসলো তারা বিয়ে করেছে। কথাটা কানে আসতেই আষাঢ় ইন্না লিল্লাহ পড়লো। পৃথিবীতে টাকা কি না পারে? এর চেয়ে তো সুমনই ভালো ছিলো। দেখতেও হ্যান্ডসাম। শুধু মাথায় চুল নেই যাকে বলে টাকলা।
এরমধ্যে কেটে গেলো দেড় মাস। সন্ধ্যার শরীর টা আজকাল ভীষণ দূর্বল লাগে। মুখে রুচি নেই। খাবার খেতে পারে না ঠিকমতো। সেজন্য কনা একটা ভিটামিনের বোতল কিনে এনেছে যাতে ঠিক মতো খেতে পারে। সন্ধ্যা কিছুক্ষণ সেই বোতলের দিকে তাকিয়ে রইলো। বোতল টা সন্ধ্যা কনার হাতে ধরিয়ে দিয়ে বলল-
-“ যেই দোকান থেকে কিনে এনেছিস সেই দোকানে ফেরত দিয়ে কিট কিনে আনবি।
কনা বোতলের দিকে তাকিয়ে বলল-
-“ আশ্চর্য কিট খেলে কি তোর রুচি বাড়বে?
-“ কিট মানুষ খায়?
-“ তাহলে কি করে?
-“ প্রেগন্যান্সি কিট।
-“ হ্যাঁ তো…প্রেগন্যান্সির কিট! তুই কি প্রেগন্যান্ট?
-“ তুই নিয়ে আসলে পরীক্ষা করে দেখলে তো জানতে পারবো।
-“ ওয়েট এখনই নিয়ে আসতেছি।
মিনিট দশেক পর কনা কিট নিয়ে আসলো। সন্ধ্যা নিয়ে ওয়াশরুমে চলে গেলো। আগে আন্দাজ করতে পেরেছিলো সেজন্য কিট পরীক্ষা করার জন্য আগেই সব ঠিক করে রেখেছিলো। এখন পরীক্ষা করে দেখলো পজিটিভ। আপনা-আপনি হাত চলে গেলো পেটে। খুশি হবে নাকি রাগ করবে বুঝতেছে না। কয়েক মাস বাদেই তার এক্সাম। সন্ধ্যা ওয়াশরুম থেকে বের হয়ে ফোন হাতে নিলো তারপর আষাঢ়ের নম্বরে কল লাগালো।
আষাঢ় রুমে বসে ল্যাপটপে কাজ করছিলো। সন্ধ্যার ফোন পেয়ে একগাল হেসে ফোন রিসিভ করলো। মূহুর্তে ওপাশ থেকে ভেসে আসলো-
-“ এ্যাই আপনি কি বলেছিলেন?
আষাঢ় সন্ধ্যার এহেন কথায় ভরকে যায়। আমতাআমতা করে বলে-
-“ ক..কি ব..বলেছিলাম?
-“ মনে নেই?
-“ না নেই। কি বলেছিলাম তোমায়? আজ তো আসার কথা ছিলো না রাজশাহী আমার।
-“ রাজশাহী শুধু এসে দেখেন আপনার মাথার চুল গুলো সব টেনে ছিঁড়ে ফেলবো আমি।
-“ কেনো? করেছি টা কি?
-“ আপনি বলেছিলেন আপনি প্রতিবার রাজশাহী এসে আমাকে জড়িয়ে ধরে ঘুমিয়ে তারপর চলে যাবে। এদিকে আপনি আমাকে প্রেগন্যান্ট বানিয়ে চলে গেলেন!
শুঁকনো মুখে বিষম খেলো আষাঢ়। পাশ থেকে জল খেয়ে অবাক হয়ো বলল-
-“ তুমি প্রেগন্যান্ট?
-“ হ্যাঁ। এইতো হাতে থাকা কিটে দুটো লাল দাগ স্পষ্ট জ্বলজ্বল করছে।
-“ আমাকে ছবি পাঠিয়ে দাও তো।
-“ কেনো ছবিটা জলের সাথে কি গুলিয়ে খাবেন? আপনাকে বলি নি সামনে আমার এক্সাম? আপনি কেনো প্রটেকশন নিয়ে কাছে আসলেন না?
-“ এখন দোষ আমার? আমি না হয় প্রটেকশন নেই নি তাই বলে তুমি কি খেতে পারো নি মেডিসিন?
-“ এখন যদি আমি বাচ্চার চিন্তায় ডিপ্রেশনে চলে যাই তার দায়ভার কে নিবে? আপনি?
-“ আশ্চর্য ডিপ্রেশনে কেনো যাবে? আমি আছি তো সবসময় ।
-“ আপনি ছিলেন বলেই তো এই অবস্থা আজকে। বাচ্চা নেওয়ার এটা কোনো সময় হলো? আমি স্টাডি সামলাবো নাকি বাচ্চা? আমি আপনাকে বলেছিলাম আমি স্টাডি শেষ করে বেবি নিব যাতে আমি বেবিকে প্রোপার সময় দিতে পারি। এখন আমি কয় দিকে সময় দিব?
-“ আমি আছি তো পাখি টেনশন নিচ্ছো কেনো?
-“ আপনার কি দেহ চৌদ্দ টা? আপনি কি সামলাবেন? আমার পেটে থাকা বাচ্চা নাকি আমার এক্সাম?
-“ তোমাকে সামলাবো। আর তুমি কি হ্যাপি নও বাচ্চা নিয়ে? আমি বেজায় খুশি কিন্তু। পুরো বিল্ডিংয়ে মিষ্টি বিলাবো।
-“ আমি বুঝতেছি না আমি হ্যাপি নাকি আন হ্যাপি। শুধু আপনাকে সামনে পেলে কাঁচা চিবিয়ে খেতাম।
-“ আচ্ছা শান্ত হও। এক্সিডেন্টলি হয়ে গেছে। ধরে নাও এটা আল্লাহর রহমত। কত মানুষ তো চেয়েও বাচ্চা পায় না। এই ধরো না শ্রেয়া নিখিল। ওদের তো বেবির জন্যই সংসার টা ভেঙে গেছে। আর দেখে আমরা প্ল্যান না করেও পেয়ে গেলাম। আমাদের তো উচিত শুকরিয়া আদায় করা।
-“ আপনি আসবেন কবে?
-“ তুমি বললে এখনই চলে আসবো।
-“ মজা ছাড়ুন বলুন কবে আসবেন?
-“ কাল হসপিটালে কাজ আছে। পরশু আসি। আর আমি তোমাদের বাসায় কাজ করার জন্য একটা বুয়া ঠিক করে দিব। তোমার কোনো কাজ করতে হবে না। শুধু খাবে। আর আমি দেখছি জব নিয়ে কি করা যায়।
-“ জব নিয়ে কি করা যায় মানে?
-“ রাজশাহীর কোনো হসপিটালে জবের ট্রাই করবো।
-“ কেনো?
-“ কারন আমি রাজশাহী থাকবো। এই সময়টাতে তোমার পাশে আমার থাকা জরুরি। আমি আমার বেবির আসার পুরো জার্নিটা তোমাদের পাশে থাকবো। আমার বাচ্চার হার্টবিট শুনবো। মাঝরাতে সে তোমায় বিরক্ত করলে আমি তার সাথে কথা বলবো। বুঝেছো?
-“ বুঝলাম।
-“ আচ্ছা এখন রাখি। মিষ্টি খাওয়াতে হবে তো নাকি সবাই কে? আফটার অল আমি বাবা হতে যাচ্ছি। দেখছো ২০২৫ সাল আমাদের জন্য কত লাকি?
-“ হু রাখছি তাহলে।
-“ আচ্ছা।
সন্ধ্যা ফোন কেটে পাশে তাকাতেই কনা কে দেখতে পেলো। কনা গম্ভীর মুখে তাকিয়ে আছে।
-“ কিছু বলবি?
-“ আশ্চর্য হলাম।
-“ কি নিয়ে?
-“ তুই বেবি আসা নিয়ে হ্যাপি নস?
-” ভয় হচ্ছে আমার।
-“ কেনো?
আষাঢ় রাতের সন্ধ্যা পর্ব ৩৬
-“ সামলাতে পারবো আমি তাকে? আমার পড়াশোনার জন্য ওর অবহেলা হবে না?
-“ পৃথিবীতে তুই প্রথম না যে পড়াশোনা করা কালিন মা হচ্ছিস। আরো অনেকে হয়েছে। এবং বাচ্চাকেও প্রোপার ভাবে সামলিয়েছে। আর তুই তো একা নস। আমি আছি ভাইয়া আছে। আর বাকিটা আল্লাহ ভরসা।