নিষিদ্ধ শব্দের দিনলিপি পর্ব ১৪
ঝিলিক মল্লিক
রিদির কাকিমণি স্যুপ রান্না করেছেন মাত্র। ট্রে-তে করে শোবার ঘরে নিয়ে আসলেন তিনি৷ রিদি তখন বিছানায় বসে কোলে মিশিয়ে রাখা বালিশের ওপর বই ধরে পড়ছিলো। জামিয়া বাথরুমে গিয়েছে। তিতাস বাড়িতে নেই। ও বেরিয়েছে মোড়ের দোকান থেকে কিছু ভাজা খাবার আনতে। হালিমা খাতুন কিছুক্ষণ আগেই পাঠিয়েছেন ওকে।
রিদির মাথায় থাকা জলপট্টিটা শোবার জন্য রাখা বালিশের এক কোণে পরে আছে। রিদি চশমা ঠিক করে পড়াশোনায় ব্যস্ত। তা দেখে হালিমা খাতুন রেগে গেলেন। এগিয়ে এসে টেনে বইপত্র বন্ধ করতে লাগলেন। রিদি হতচকিত হয়ে ভাঙা গলায় বললো,
“কি করছো কাকিমণি! বই বন্ধ করছো কেন?”
হালিমা খাতুন শাসানোর সুরে রিদিকে বললেন,
“তোকে না কতবার করে তখন নিষেধ করে গেছি? এখন মনের ভুলেও বইখাতা ধরবি না। তাহলে তুই অসুস্থ শরীর নিয়ে উঠে বসলি কেন?”
“সামনে আমার এক্সাম আছে কাকিমণি। আর মাত্র আড়াই মাস। তাছাড়াও আমার জীবনে পড়াশোনার বাইরে আর কিছু নেই।”
শেষোক্ত কথাটা কিছুটা অন্যমনস্ক হয়ে বেশ জোর দিয়েই বললো রিদি। হালিমা খাতুন যেহেতু কোনোকিছু জানেন না, তাই রিদির শেষের কথাটার পেছনের জেদ ধরে উঠতে পারলেন না। বরং ছেলেমানুষী মনে করলেন। এজন্য রিদিকে টেনে বইপত্র সরিয়ে ওর সামনে বসলেন। জামিয়া ততক্ষণে বাথরুম থেকে বেরিয়ে এসেছে। ওকে দেখে হালিমা খাতুন বললেন,
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
“ও জামিয়া, জলপট্টিটা বাথরুম থেকে ধুয়ে নিংড়ে আন তো আবার। বেশি ভেজা রাখবি না। ওর মাথায় দিতে হবে। দেখি জ্বর কেমন আছে।”
জামিয়াকে কাজের নির্দেশ দিয়ে হালিমা খাতুন এগিয়ে রিদির মাথায় হাত রাখলেন। সঙ্গে সঙ্গে চমকে উঠলেন তিনি। আতঙ্কিত গলায় বললেন,
“ও রিদি! আম্মা, তোর তো গা পুড়ে যাচ্ছে। তুই আমাকে বলিসনি কেন? জামিয়া তো পাশে বসেছিল। ওকে কিছু বলিসনি?”
জামিয়া ততক্ষণে বেরিয়ে এসে দাঁড়িয়েছে। মায়ের কথা শুনে বললো,
“না আম্মা। আপু আমাকেও কিছু বলিনি। জ্বর মাপতেও দেয়নি। জেদ ধরেছে, সে এখন বই পড়বে। গত পাঁচদিনেও তো এরকম করেছে৷ রাতে না ঘুমিয়ে বই পড়েছে সারারাত বসে। কিছু বলাও যাচ্ছে না৷ বললেই, ধমক দিয়ে বসিয়ে রাখছে।”
জামিয়া একপ্রকার নালিশ করে বসলো ওর মায়ের কাছে। হালিমা খাতুন উঠে গিয়ে থার্মোমিটার নিয়ে আসেন। থার্মোমিটারে মেপে দেখেন, রিদির জ্বর ১০১ আপ-ডাউন করছে। ভীষণ শঙ্কিত হলেন তিনি। সেই যে পাঁচদিন আগে থেকে জ্বর বেঁধেছে, সেরে ওঠার আর নামগন্ধ নেই। মেয়েটা প্রতিনিয়ত শারীরিক দিক থেকে দুর্বল হয়ে পড়ছে। ওষুধেও কোনো কাজ হচ্ছে না।
রিদির অসুস্থতার খবর শুনে ওর আব্বা-আম্মা চেয়েছিল, এখানে এসে ওকে বাড়িতে নিয়ে যেতে। কিন্তু হালিমা খাতুন নিষেধ করে বললেন, আবহাওয়া পরিবর্তনের কারণে এমনটা হয়ে থাকে। এখানে বরং থাকুক। ভাইবোনদের সাথে ভালো সময় কাটিয়ে সুস্থ হয়ে তবেই নাহয় বাড়ি ফিরবে। এই অসুস্থ শরীরে জার্নি করা ঠিক হবে না।
হালিমা খাতুনের অনুরোধে রিদির আব্বা-আম্মা ওকে নিয়ে যেতে আসেননি। হালিমা খাতুন-ই সময়মতো দিয়ে আসবেন বলেছেন।
কিন্তু এখন রিদির যেই অবস্থা, তা ভালো কিছুর ইঙ্গিত দিচ্ছে না। হালিমা খাতুন সামনাসামনি না হলেও মনে মনে ঠিকই শঙ্কিত হচ্ছেন।
বাংলাদেশে এই সময়টাতে ডেঙ্গু মশার উপদ্রব খুব বেড়ে যায়। সাথে সাথে ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যাও। এইতো সেদিনও হালিমা খাতুনের বোনের ছেলেটা ভয়াবহ ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত হলো। প্রথমে স্বাভাবিক জ্বর মনে হলেও পরে মাত্রাতিরিক্ত খারাপ অবস্থা আর জ্বর সারার কোনো লক্ষণ না দেখে শেষমেশ টেস্ট করাতে হলো। তারপরই তো ডেঙ্গু রিপোর্ট পজিটিভ আসলো। কপাল ভালো, সঠিক সময়ে চিকিৎসা করানো হয়েছিল। নাহলে খারাপ কিছু ঘটার আশংকা করেছিল সবাই।
হালিমা খাতুন স্বস্তি পাচ্ছেন না কোনোভাবেই। বিছানার ওপর শক্ত হাতে বই নিয়ে সেদিকে তাকিয়ে বসে থাকা রিদির চোখ-মুখ লক্ষ্য করে দেখলেন। মেয়েটা দিনে দিনে অনেক বেশি শুকিয়ে যাচ্ছে। জ্বরের কারণে চোখ ছলছল করছে। ঠোঁট শুকিয়ে ফেটে গেছে। টনসিলের ব্যাথার জন্য পানিটুকু গেলাও দুঃসাধ্যকর ব্যাপার হয়ে গেছে। কোনোকিছুই ঠিকমতো খেতে পারছে না।
তবুও, বাঁচার জন্য হলেও খেতে হবে। খাদ্য মানুষের জীবনে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। এটার অনুপস্থিতি মানে মৃত্যুর দিকে একধাপ এগিয়ে যাওয়া। হালিমা খাতুন একা হাতে সংসার, ছেলেমেয়ে সব সামলেছেন বহুদিন যাবত। তাই তার সবকিছু সম্পর্কেই কমবেশি অভিজ্ঞতা আছে। হালিমা খাতুন চিন্তাভাবনা করে সিদ্ধান্ত নিলেন, আগামীকাল-ই স্থানীয় হাসপাতাল থেকে রিদির ডেঙ্গু টেস্ট করিয়ে আসবেন। আর দেরি করা যাবে না। লক্ষণ ভালো মনে হচ্ছে না!
তিতাস এসেছে মাত্র। জামিয়া, তিতাস আর রিদি একসাথে গোল হয়ে বসলো৷ হালিমা খাতুন সবার হাতে স্যুপের বাটি ধরিয়ে দিলেন। রিদি ভাঙা গলায় খুব অনুরোধ করে হালিমা খাতুনকে বললো,
“কাকিমণি, আমার গলা দিয়ে খাবার নামছে না। খেতে পারবো না।”
“খা, জোর করে হলেও খেতে হবে। নাহলে বাঁচবি কীভাবে?”
রিদিকে জোর করেই নিজ হাতে স্যুপ খাইয়ে দিলেন হালিমা খাতুন। তিনি উঠে দাঁড়াতেই রিদি আবারও বই নিয়ে বসলো পড়ার জন্য। তা দেখে হালিমা খাতুন একটা চূড়ান্ত ধমক দিয়ে বললেন,
“এই বেঁহুশের মতোন অবস্থায় আবার বই নিয়ে বসেছিস! তোর তো হেদিয়ে মরা ছাড়া উপায় নেই দেখছি।”
“আমাকে পড়তে হবে কাকিমণি। পড়াশোনা করে জীবনে অনেকটা এগিয়ে যেতে হবে। এসব জ্বরজারি, অসুখ-বিসুখ দেখে পেছানো যাবে না বুঝলে।”
“বুঝলাম, পড়াশোনা তোর আরেক জীবন। কিন্তু তাই বলে তো নিজের ওপর এতো চাপ নেওয়া যাবে না৷ রাখ! এখনই বই রাখবি!”
হালিমা খাতুন রিদির কাছ থেকে বই টেনে নিয়ে ওকে টেনে বিছানায় শুইয়ে মাথায় জলপট্টি দিয়ে চলে গেলেন। জামিয়া আর তিতাস রিদির পাশে বসে নানান বিষয় নিয়ে গল্প-আড্ডা দিতে ব্যস্ত হলো। রিদি চুপচাপ ওদের কথা শুনতে লাগলো।
আজ প্রচুর কাজের চাপ আরবিনের ওপর। নিজস্ব ডেস্কে বসে অনবরত হাত চলছে ওর কম্পিউটারের কিবোর্ডের ওপর। এরইমধ্যে অরবিন্দু এসে দু’বার দু’টো ফাইল দিয়ে গেছে। সেগুলো চেক করে রেখেছে আরবিন। কিছুক্ষণ আগে ফারিয়া এসে সফট ড্রিংকস অফার করে গেছে। কিন্তু আরবিন বরাবরের মতোই নাকচ করেছে। এখন ওর সম্পূর্ণ মনোযোগ কম্পিউটারের স্ক্রিনে। সেখান থেকে চোখ সরানোর উপায় নেই কোনো।
এখন আরবিন বেশিরভাগ সময়ই কাজের মধ্যে ডুবে থাকে। কয়েকদিন বাসায় যোগাযোগ করা হচ্ছে খুবই কম। দিনে দু-একবার আব্বা-আম্মার সাথে কথা হচ্ছে। বন্ধুদের সাথে মাঝেমধ্যে। তবে হোয়াটসঅ্যাপে বন্ধুদের আড্ডাগ্রুপে চ্যাটিং চলে প্রায়ই। এভাবেই কেটে যাচ্ছে আরবিনের দিনগুলো। কিন্তু কোথাও গিয়ে হিসাব মেলাতে যেয়ে মনে হচ্ছে, কি যেন একটা নেই! সেই “কি”-টা যে কি; তা আরবিন ধরতে পারছে না কোনোভাবেই। অবশ্য এসব নিয়ে ও কখনোই তেমন ভাবে না ইচ্ছাকৃত। যদি কখনো মনের ভুলে ভাবনাতে চলে আসে, তখন একটু-আধটু চিন্তা করা হয়— এ-ই যা। জীবনে যতটুকু যা কিছু পেয়েছে, তাই নিয়েও ওর সাজানো পরিকল্পনা। এর বাইরে আর কিছু ভাবতে চায় না আরবিন।
সবেমাত্র আরেকটা নিউ ফাইল ওপেন করেছে আরবিন, তখনই ওর সেলফোন শব্দ করে বেজে উঠলো। দ্রুত হাতে ফোন উঠালো আরবিন। এই অসময়ে তো কেউ আরবিনকে কল দেয় না। বেশিরভাগ সবাই-ই জানে এটা আরবিনের কাজের সময়। একমাত্র রিদি-ই কল দিতো এই সময়ে। কিন্তু ও কেন কল দেবে! কথাগুলো ভাবতে ভাবতেই লক খুলে ফোন স্ক্রিনে দেখলো আরবিন। না, ওর আম্মা কল দিয়েছে। ব্যস্তভাবে কল রিসিভ করে কানে ধরলো আরবিন। কোনোরকম খোঁজ-খবর নেওয়ার বাইরে গিয়ে ফোনের ওপাশ থেকে আফসানা বেগমের কন্ঠস্বর শোনা গেল। আরবিনকে তিনি বললেন,
“তুমি কী অফিসে?”
“জি আম্মা। কেমন আছেন?”
“কেমন আছেন-টাছেন বাদ দাও এখন। ওসব বিষয়ে পরে কথা হবে। এখন জরুরি কথা শোনো।”
“বলুন আম্মা।”
“রিদির সাথে তোমার কথা হয় না?”
“হঠাৎ এমন প্রশ্ন কেন?”
“আগে বলো, হয় কি-না?”
“হ্যাঁ হয় তো। কাজের চাপ একটু বেশি ছিল; তাই কিছুদিন তেমন কথা হয়নি। কিন্তু কেন? কী হয়েছে?”
আরবিন কিছুটা মিথ্যে বললো। রিদির সাথে ওর আজ নিয়ে প্রায় এক সপ্তাহের কাছাকাছি সময় কথা হয় না। তাছাড়া রিদিও আর কনট্যাক্ট করেনি।
আফসানা বেগম বললেন,
“রিদির ডেঙ্গু জ্বর হয়েছে। আজ টানা ছয় দিন বিছানায় শুয়ে আছে। উঠে বসতেও পারছে না। পরশু তো অবস্থা গুরুতর খারাপ হয়ে গিয়েছিল। গতকাল নাকি ওর কাকি হসপিটালে নিয়ে যেয়ে ডেঙ্গু টেস্ট করায়। সন্ধ্যায় রিপোর্ট পজিটিভ আসে। এরপরই রিদিকে বাড়িতে এনে স্যালাইন দেওয়া হচ্ছে। জ্বরের মাত্রা নাকি আরো বেড়েছে। আমি এসব শুনলাম তোমার আব্বার কাছ থেকে। তিনি আজ সংবাদ পেয়েছে বেয়াইয়ের মাধ্যমে। রিদির চাচাবাড়ি অনেক দূরে হওয়ায় আমরা আর আজকে যেতে পারিনি। তাছাড়াও বেয়াই-বেয়াইন-ই আগামীকালকে তাদের মেয়েকে দেখতে যাবেন। তখন একসাথেই আমরা যেতে চাচ্ছি। রিদির নাম্বারে কল দিয়েছিলাম কিছুক্ষণ আগে। জ্ঞান হারিয়েছিল নাকি। এজন্য কথা বলতে পারেনি। ওর কাকির সাথে কথা হয়েছে কিছুক্ষণ। তখন সে বললো যে, তুমি তো কল দিয়ে খোঁজ নাওনি।”
আরবিন ওর আম্মার কথা স্তব্ধ হয়ে শুনছে। হাতের রগে যেন চিনচিনে ব্যাথা অনুভব হচ্ছে। মাথা ঝিম মেরে আছে।। আরবিনের কি হলো জানে না ও। ধীর গলায় বললো,
“আম্মা, আমি আপনাকে পরে কল করছি। রাখি, আল্লাহ হাফেজ।”
আরবিন কল কেটে দিলো। কনট্যাক্ট লিস্টে ঢুকে খুঁজে বের করে “বেয়াদব মেয়েমানুষ” লিখে সেভ করা নাম্বারটাতে কল করলো ব্যস্ত হাতে। কিন্তু আইটি সেক্টরে এক্সপার্ট লেফটেন্যান্ট আরবিন সঙ্গে সঙ্গে বুঝে গেল, রিদি ওকে ব্লক করেছে। আরবিনের মন-মেজাজ ঠিক নেই। প্রচন্ড অস্থিরতা কাজ করছে মস্তিষ্কে। হোয়াটসঅ্যাপে গিয়ে দেখলো, সেখানেও ব্লক করে রেখেছে ওকে। আরবিন চেষ্টা অব্যাহত রাখলো৷ ফেসবুকে গিয়ে রিদির আইডি সার্চ করলো৷ না! আইডিও আসছে না। তারমানে ফেসবুক থেকেও ওকে ব্লক দিয়েছে রিদি। আরবিন উঠে দাঁড়ালো। মুখে হাত চেপে অস্থিরতার সাথে অনবরত পায়চারি করতে লাগলো। বিরবির করে বললো,
“হাউ রিডিকিউলাস! কনট্যাক্ট করতে নিষেধ করেছি বলে সব জায়গা থেকে ব্লক করেছে। ওকে তো আমি!”
আরবিন রয়্যাল চেয়ারে বসে একগ্লাস পানি পান করে রাগ সংবরণ করার বৃথা চেষ্টা করলো। মেজাজটা যে এমন কেন! বিনা কারণে, হুড়মুড়িয়ে বেড়ে যায় হঠাৎ হঠাৎ! আরবিন প্রচন্ড নাছোড়বান্দা। আবার ওর আম্মাকে কল দিলো। ওর আম্মা কল রিসিভ করতেই আরবিন বললো,
“আম্মা, আপনার কাছে রিদির কাকিমণির মোবাইল নাম্বার আছে?”
“না তো আব্বা।”
“আপনি এখুনি রিদির নাম্বারে কল দিয়ে ওর কাকিমণির নাম্বারটা নেবেন। তারপর আমাকে দেবেন।”
“কেন কী হয়েছে?”
“ইমিডিয়েট দরকার আছে আম্মা। আপনাকে এখন বলতে পারছি না।”
“আচ্ছা, দাঁড়াও আমি দেখছি।”
আফসানা বেগম কল কাটলেন। আরবিন চুল টেনে পেছনের দিকে ঠেলে চিন্তিত মুখে বসে রইলো অন্যমনস্কভাবে।
আফসানা বেগম আবারও কল দিলেন প্রায় আট মিনিট পরে। আরবিন তার কলের অপেক্ষাতেই ছিল। কল রিসিভ করতেই আফসানা বেগম রিদির কাকিমণির নাম্বারটা আরবিনকে বললো। আরবিন নাম্বারটা নোটপ্যাডে নোট করে নিলো।
আফসানা বেগমের সাথে কথা শেষ করে রিদির কাকিমণির মোবাইল নাম্বার কললিস্টে উঠালো আরবিন। কাকিমণির নাম্বারে কল করতেই তিনি মিনিট দুয়েক পরে রিসিভ করলেন। আরবিন তাকে পরিচয়সহ অত্যন্ত ভদ্রতার সহিত সালাম-কালাম দিয়ে আর টুকটাক সৌজন্যতামূলক কথাবার্তা বলার পরে বললো,
“কাকিমণি, রিদির অসুস্থতার খবর শুনলাম। আসলে আমি মারাত্মক কাজের প্রেশারে আছি তো, তাই ওর সাথে তেমন কথা হয়নি। আপনি যদি একটু ওর কাছে ফোনটা দিতেন..”
“ওর তো হাতে ক্যানোলা লাগানো বাবা। কিছুক্ষণ আগে হুঁশে এসেছে। আজকে জ্বর আরো মাত্রা ছাড়িয়েছে। বিকাল পর্যন্ত দেখতে বলেছেন একজন পরিচিত ফার্মেসীর ডাক্তার। তারপর অবস্থা স্বাভাবিকের দিকে না আসলে হসপিটালে অ্যাডমিট করাতে হবে। মেয়েটার আমার মারাত্মক কষ্ট পাচ্ছে। মুখের দিকে তাকানো যায় না।”
কাকিমণির কথা শুনে আরবিন চুপ করে রইলো কিছুক্ষণ। তারপর অনুরোধের সুরে বললো,
“জাস্ট একবার ওর কাছে ফোনটা দিন কাকিমণি। বেশি কথা বলবো না। শ্রেফ দুই মিনিট লাগবে।”
“আচ্ছা দিচ্ছি। ও ফোন হাতে ধরতে পারলে তো ভালো।”
হালিমা খাতুন জামিয়ার ঘরে আসলেন। এখানের রিদির থাকার ব্যবস্থা করা হয়েছে। খাটের পাশ ঘেঁষে রিদির মাথার কাছে একটা স্ট্যান্ড রাখা হয়েছে। তাতে স্যালাইন ব্যাগ ঝুলিয়ে স্যালাইন টিউব ক্যানোলার সাথে সংযুক্ত করে রিদির হাতের শিরায় প্রবেশ করানো হয়েছে। আগে একটা, এরপর এখন একটা— পরপর দু’টো স্যালাইন চলছে আজ।
হালিমা খাতুন রিদির মাথার পাশে বসে ওর মাথায় আলতো করে হাত বুলিয়ে আস্তেধীরে ডাকলেন ওকে। রিদি ঘুমায়নি। তবে চোখ বুঁজে শুয়েছিল। কাকিমণিকে দেখে জিজ্ঞাসাসূচক দৃষ্টিতে তাকালো। হালিমা খাতুন বললেন,
“আরবিন কল দিয়েছে। কথা বলতে চাচ্ছে তোর সাথে। নে কথা বল।”
রিদি আশ্চর্য হলো। সাথে হতভম্বও। অসুস্থ শরীরে যেন এসব ওর শরীরে আরো সূঁচালো কাঁটার ন্যায় বিঁধতে লাগলো। বিমঢ় চাহনিতে কিছুক্ষণ কাকিমণির দিকে তাকিয়ে থেকে ও বহুকষ্টে জবাব দিলো,
“আমি উনার সাথে এখন কথা বলতে চাই না কাকিমণি। তুমি নিষেধ করে দাও।”
আরবিন তখন কলেই ছিল। ফোনের ওপাশ থেকে সব শুনছিল। হালিমা খাতুন বললেন,
“কেন কথা বলবি না? ঝগড়া হয়েছে তোদের?”
রিদি মাথা নেড়ে “না” বোঝালো। হালিমা খাতুন কিছু একটা বুঝলেন যেন। রিদির খালি হাতে ফোন ধরিয়ে দিয়ে বললেন,
“একবার একটু কথা বলে নে। ছেলেটা টেনশন করছে।”
কথাটা বলে হালিমা খাতুন ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন। রিদি অসহায় চাহনিতে ওর কাকিমণির চলে যাওয়া দেখলো। নিরুপায় হয়ে ফোন কানের সাথে চেপে ধরলো। সঙ্গে সঙ্গে ওপাশ থেকে একটা চিন্তিত কন্ঠস্বর শোনা গেল।
“কী অবস্থা এখন তোমার? কেমন আছো?”
“যেমন-ই থাকি, আপনাকে বলতে যাবো কেন? কে আপনি?”
“এখনো পর্যন্ত তোমার হাসবেন্ড। অবশ্যই আমার জানার অধিকার আছে।”
“আমি মানি না। আপনাকে চিনি না আমি।”
রিদি প্রচন্ড শক্ত গলায় কথাটা বললো। আরবিন দাঁতে দাঁত চেপে শুনলো, সহ্য করে নিলো। তারপর আবারও শান্ত গলায় প্রশ্ন করলো,
“সব জায়গা থেকে ব্লক করেছো কেন? কনট্যাক্ট করার কোনো ওয়্যে রাখোনি কেন?”
“আমার মর্জি। তাতে আপনার কী?”
রিদি প্রায় চিল্লিয়ে উঠলো।
আরবিন তবুও প্রতিক্রিয়াহীন। আবারও শান্তভাবে বললো,
“রিদি, অসুস্থ শরীর নিয়ে চেঁচামেচি করো না, আরো অসুস্থ হয়ে পরবে।”
“দরকার হলে হবো, দরকার হলে ম’রে যাবো; তাতে আপনার কী? হু আর ইউ?”
আরবিন এবার আর সহ্য করতে পারলো না। অনেকক্ষণ দাঁতে দাঁত চেপে সহ্য করেছে ও। নিজের রাগ সংবরণ করেছে৷ কিন্তু আবারও এই মেয়ে সহ্যসীমা পার করে গেছে। আরবিন এবার হালকা চেঁচিয়ে বলে উঠলো,
“এই মেয়ে! সমস্যা কী তোমার? মেরে ফেলবে আমাকে? তো আসো, এসে মেরে দিয়ে যাও। ডিরেক্ট ছুরি বসিয়ে দেবে। আমি নিজে তোমাকে ছুরিটা ধরিয়ে দেবো। তবুও এতো যন্ত্রণা দেবে না৷ আই কান্ট টলারেট দিস। কন্টিনিউসলি তুমি এতো প্যারা দিচ্ছো কেন আমাকে? তোমার জন্য এতো অশান্তিতে থাকতে হচ্ছে কেন?”
রিদি এবার প্রায় কেঁদেই ফেলবে। নিজেকে সামলে ঠোঁটে ঠোঁট চেপে ঝাঁঝালো কণ্ঠে বললো,
“আপনার সাথে আমি কনট্যাক্ট করি না, আপনাকে জ্বালাই না; তবু আপনি বলছেন, আমি আপনাকে যন্ত্রণা দিই? অশান্তি দিই?”
নিষিদ্ধ শব্দের দিনলিপি পর্ব ১৩
“হ্যাঁ দাও। ভাগ্যিস দূরে সরে এসেছি। দূরে দূরে থেকেই এতো যন্ত্রণা দাও, কাছাকাছি থাকলে বোধহয় মে’রেই ফেলতে! আমি আসবো শীঘ্রই। তোমার শরীর, মনের উত্তাপ আর তেজ ছুটিয়ে ছাড়বো। তারপর দেখবো, কিভাবে যন্ত্রণা দাও!”