ধরিয়া রাখিও সোহাগে আদরে পর্ব ১৫

ধরিয়া রাখিও সোহাগে আদরে পর্ব ১৫
জেনিফা চৌধুরী

“আপনি আমার বাবা নন, তাহলে কে আপনি?”
মেহনূর প্রশ্নটা করতেই আবির সাহেব চমকে উঠলেন। মেহনূর কি তবে সবটা জেনে গেল? সব সত্যি জানলেও তো এই সত্যিটা জানার কথা না। তাহলে? সব প্রশ্ন ঝেড়ে ফেলে নিজেকে সামলে কান্নারত বাক্যে বলে উঠলেন,
“এসব কি বলছিস, ম? আমি মানছি আমি একটা ভুল করেছি। অপরাধ করেছি। কিন্তু তার পেছনে কারণ ছিল। তুই বা তোরা অর্ধেক সত্যি জেনেছিস বাকি অর্ধেক সত্যি জানার চেষ্টা করিস নি। আমাকে ভুল বুঝলি রে, মা। এতটাই ভুল বুঝলি যে এখন আমাকে বাবা বলে অস্বীকার করছিস?”

মেহনূর একটু দমে গেল। কেন যেন আবির সাহেবকে ভুল বুঝতে ওর মন চাইছে না। কিন্তু কাল রাতে নিজের কানে যা শুনেছে তারপর আবির সাহেবকে বিশ্বাস করাও ঠিক হবে না। মেহনূর এবার আগের ন্যায় শক্ত বাক্যে বলল,
“দেখুন, আমাকে আর বোকা বানানোর চেষ্টা করবেন না। আমি আপনার ভোলাভালা চেহারায় ভুলব না। আর সবথেকে বড় কথা হলো, আপু এখনো আপনার আসল চেহারাটা দেখেনি। এখনো জানেনা যে তার কলিজায় তারই বাবা হাত দিয়েছে। তাহলে আপু ভুলে যাবে আপনি কে? আপু যে কি ভয়ংকর হতে পারে ভুলে গেছেন?”
আবির সাহেব নিজেকে বহু কষ্টে সামলে রেখেছেন। ইচ্ছে করছে মেহনূরকে এক্ষুনি শুট করে দিতে। কিছুতেই সহ্য হচ্ছে না এই মেয়েটাকে। কিন্তু এখন রাগের বশে কোনো ভুল পদক্ষেপ নেওয়া যাবে না। সায়র সবটা জানে। মেহনূরের কিছু হলে সায়র নিশ্চয়ই তাকে ছেড়ে দিবে না। আবির সাহেব এবার মেহনূরের হাত দুটো আঁকড়ে ধরে বলতে লাগলেন,

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

“মা! মা রে, আমার কথাটা একবার শোন। আমি আনায়াকে এয়ারপোর্ট থেকে কিডন্যাপ করিনি। আমি তো আনায়াকে পেয়েছি কিডন্যাপ হওয়ার পরের দিন। আনায়ার সেফটির জন্য আনায়াকে আমি লুকিয়ে রেখেছিলাম। আসল অপরাধীকে খুঁজে বের করার জন্য আনায়াকে লুকিয়ে রাখাটা গুরুত্বপূর্ণ ছিল। আমি তোদের কাছে সবটা প্রমাণসহ ক্লিয়ার করব। শুধু আমাকে একটু টাইম দে, মা।”
মেহনূর সাথে সাথে আগের ন্যায় বলল,
“ আগামী ২৪ঘন্টা আপনাকে টাইম দিলাম। এর মধ্যে নিজেকে প্রমাণ করে দেখান, মিস্টার আবির সিকদার।”
বলেই মেহনূর চলে যাওয়ার জন্য পা বাড়িয়েও থেমে গেল। পেছন ঘুরে আবির সাহেবের মুখোমুখি হয়ে শান্ত স্বরে জিজ্ঞেস করল,

“আপনি আমার আসল, বাবা?”
আবির সাহেন থতমত খেয়ে জবাব দিলেন,
“কোনো সন্দেহ আছে তোর? তাহলে চল এক্ষুনি হসপিটালে চল। ডি.এন.এ টেস্ট করে সন্দেহ দূর করে নিস।”
মেহনূর কিছুটা অবাক হলো বটে। আবির সাহেব নিজের থেকে ডি.এন.এ টেস্টের কথা বলছে? মেহনূর সায়রকে না বলে কোনো সিদ্ধান্ত নিতে চাচ্ছে না তাই কিছুটা সময় নিয়ে জবাব দিল,
“যদি তোমাকে আর আমাদের রক্তকে নির্দোষ প্রমাণ করার জন্য ডি.এন.এ টেস্টের প্রয়োজন হয় তাহলে সময় মতো তুমি ঠিক জেনে যাবে, বাবা।”
বলেই রুম থেকে বেরিয়ে গেল। মেহনূর চলে যেতেই আবির সাহেবের মুখে রহস্যময় হাসি ফুটল। মনে মনে বলে উঠল,
“আমি কে___এটা জানার জন্য তোমাকে আরেকবার জন্ম নিতে হবে, মা।”

সায়র নিলুফা বেগমের মুখোমুখি বসে আছে। নিলুফা বেগম চিন্তিত স্বরে জিজ্ঞেস করলেন,
“এনিথিং রং, সায়র? হঠাৎ এভাবে বাড়ির বাইরে ডাকলে যে?”
সায়র ইতস্তত হয়ে জবাব দিল,
“আন্টি, আপনাকে কিছু প্রশ্ন করার ছিল।”
নিলুফা বেগম হেসে বললেন,
“তা আবার জিজ্ঞেস করা লাগে বুঝি? করো। তোমার যা ইচ্ছে হয় প্রশ্ন করো। নো প্রবলেম।”
সায়র সৌজন্যমূলক হেসে বলল,
“কিছুটা পারসোনাল।”
নিলুফা বেগম বললেন,
“তুমি প্রশ্ন করো। উত্তর দেওয়ার দায়িত্ব আমার। যদি আমার মনে হয় যে, প্রশ্নের কোনো উত্তর নেই তাহলে চুপ থাকব।”
সায়র কিছুক্ষণ চুপ থেকে প্রথম প্রশ্ন করল,

“আংকেলের কোনো টুইন ব্রাদার আছে?”
নিলুফা বেগমের হাসিটা মিলিয়ে গেল। শান্ত স্বরে জবাব দিলেন,
“ছিল। তবে এখন নেই।”
সায়রের ঠোঁটের কোনে হাসি ফুটল। এই উত্তরের অপেক্ষায় ছিল। পরক্ষণেই আবার প্রশ্ন করল,
“নেই কেন?”
নিলুফা বেগম দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে জবাব দিলেন,
“সে অনেক ইতিহাস। শুধু জেনে রাখো, সাবির মা°রা গেছে। অন্য প্রশ্নে যাও।”
সায়র আর সাহস করে এই বিষয়ক প্রশ্ন করতে পারল না। গলা ঝেরে আবার প্রশ্ন করল,
“আংকেল আর সাবির সাহেবের মাঝে কি কোনো অমিল আছে যা দ্বারা তাদের আলাদা ব্যক্তি হিসেবে চিহ্নিত করা যায়?”
নিলুফা বেগম একটু ভেবে জবাবে বললেন,

“ওরা দুজন আইডেন্টিক্যাল টুইনস। ওদের মধ্যে সত্যিকার অর্থে অমিলের কিছু নেই। বিয়ের প্রথম প্রথম আমি নিজেই এলোমেলো করে ফেলতাম। নিজের বরকেও চিনতাম না আর ভাসুরকেও চিনতাম না।”
বলেই হাসলেন একটু। পরক্ষণেই খুব উত্তেজিত বাক্যে বলে উঠলেন,
“ তবে একটা জিনিস আছে___তিল। হ্যাঁ, আবিরের একটা তিল আ…।”
এইটুকু বলে আবার থেমে গেলেন। বলতে দ্বিধাবোধে ভুগতে শুরু করলেন। কথাটা সায়রকে কিভাবে বলা যায়? ন্যারো মাইন্ডের শুনাবে না? নিলুফা বেগম কে দ্বিধাদ্বন্দে ভুগতে দেখে সায়র জিজ্ঞেস করল,
“আন্টি, আপনি ফ্রী মাইন্ডে বলতে পারস।”
নিলুফা বেগম ভাবনা চিন্তা সাইডে রেখে বলে উঠলেন,

“আবির সাহেবের তল পেটের একটু নিচে একটা দাগ আছে, জন্মদাগও বলা যায়।”
সায়র বুঝল। এবার সায়র সোজাসাপটা বলে উঠল,
“আন্টি আমি কালই মেহরিশকে বিয়ে করতে চাই। আপনি মেহরিশকে রাজি করাবেন। বাকি সব ব্যবস্থা আমি করে নিব। আপাতত বাড়ির কয়েকজন বাদে আর কেউ বিয়ের কথা জানবে না। সোজা রেজিস্ট্রি ম্যারেজ হবে। অনুষ্ঠান না হয় আমেরিকা ফিরে যেয়ে হবে।”
নিলুফা বেগম হা হয়ে তাকিয়ে রইলেন। সায়রের সব কথা মাথার উপর দিয়ে গেল। অবাকপানে জিজ্ঞেস করলেন,
“বাবা, কালকে বিয়ে? কিভাবে সম্ভব? মেহরিশ কিছুতেই রাজি হবে না।”
সায়র শান্ত বাক্যে বলল,
“রাজি করাবেন। কিভাবে রাজি করবেন এটা আপনার ব্যাপার শাশুড়ী মা। এখন আসি। বিয়ের ব্যবস্থা করতে হবে তো। আপনি সাবধানে বাড়ি পৌঁছে যাবেন।”
বলেই সায়র উঠে দাঁড়ালো। বুকে ঝুলানো সানগ্লাসটা চোখে দিয়ে, পকেটে হাত ঢুকালো। অতঃপর শিস বাজাতে বাজাতে বেড়িয়ে গেল। নিলুফা বেগম মাথায় হাত দিয়ে বসে রইল। কিভাবে রাজি করাবে মেহরিশকে?

“ভাইয়া, বাবা তো ডি.এন.এ টেস্ট করাতে রাজি হয়ে গেল। কি করব?”
সায়র হেসে জবাব দিল,
“রাজি তো হবেই।”
বলেই থামল। তারপর বলল,
“এখন আর ডি.এন.এ টেস্ট করাতে হবে না। এখন বোনের বিয়ের তোরজোর শুরু করো। তার আগে চলো আমার ডার্লিং এর সাথে দেখা করে আসি।”
মেহনূর হেসে ফেলল। সায়রের এই রোমান্টিক রুপটা মেহনূর খুব এনজয় করে৷ তাই সায়রকে সাথে নিয়ে চলল মেহরিশের রুমে। মেহরিশ আনায়াকে গোসল করিয়ে জামা কাপড় পড়াচ্ছিল। এর মধ্যেই সায়র আর মেহনূর রুমে প্রবেশ করল। রুমে প্রবেশ করেই সায়র বিছানায় গিয়ে আনায়াকে কোলে তুলে নিল। আনায়াও সায়রকে দেখে গালে চুমু দিয়ে আধো আধো ভাঙা স্বরে বলতে লাগল,

“বা বাহ। বা বাহ।”
সায়রও সাথে তাল মিলিয়ে বলতে লাগল,
“আমার এঞ্জেল। আমার মা, কি করছে?”
আনায়া আবার বলে উঠল,
“বা বাহ।”
আনায়ার বয়স ১০মাস। মোটামুটি এখন সব ধরনের শব্দ আওড়াতে পারে। মেহরিশ কপাল কুঁচকে আনায়াকে বলে উঠল,
“বাবাহ কি? বলো যে, আংকেল?”
সায়র বাঁধ সেজে বলল,
“নো, মাম্মা। বলো যে, বাবা, বাবা।”
মেহরিশ সায়রকে চোখ রাঙিয়ে বলল,
“এই ব্যাডা বাবা কি? আপনি কি ওর বাবা?”
সায়র ডোন্ট কেয়ার ভাব নিয়ে বলল,

ধরিয়া রাখিও সোহাগে আদরে পর্ব ১৪

“তোমার সাথে আমার বিয়ে হলেই আমি আনায়ার বাবা হয়ে যাবো, ডার্লিং। সহজ ব্যাপারটা বুঝতে পারছো না কেন, সোনা?”
‘ডার্লিং’ ‘সোনা’ শব্দ দুটো মেহরিশের কানে যেতেই মেহরিশ কেশে উঠল। এই লোকটা হঠাৎ এভাবে কথা বলছে কেন? মেহরিশকে কি চমকে দিয়ে মে°রে ফেলার চেষ্টা করছে নাকি?

ধরিয়া রাখিও সোহাগে আদরে পর্ব ১৬