রাজবধূ পর্ব ২৩

রাজবধূ পর্ব ২৩
রেহানা পুতুল

মাতালের মতো জড়ানো কন্ঠে বলল শোয়েব।
জংলায় কি ঘটবে আজরাতে? কোন হ*ত্যা না কি দুজন মানব মানবীর গোপন অভিসার?
“আপনি এগুলা কিভাবে আনলেন?”
চাপাস্বরে জিজ্ঞেস করলো আদুরী। সে সামনে শোয়েবকে আপনি করে বলে। চিঠিতে তুমি করে কথা বলে। শোয়েব আদুরীর হাত ধরে বলল,
“এইযে একটা কাগজের শপিং ব্যাগে করে নিয়া আসছি। চাদর, কয়েল, ম্যাচ, গামছা,হাওয়াই বালিশ। আমার গায়ের শাল এইটা গায়ে দিয়া দুজন একটু শোয়াও যাবে৷ এখানে ভালই ঠান্ডা লাগছে। তাইনা?”

“হুম”
শোয়েব আদুরীকে জড়িয়ে নেয় এক হাত কাঁধের উপর দিয়ে। জিজ্ঞেস করে,
“কিছু করতে পারলা বিয়ের ব্যাপারে?”
“নাহ! নিয়ম ভাঙ্গলেই আমাদের দুইজনের মৃত্যুদন্ড দিবো তারা। আমি আপনাকে ছাড়া কিভাবে অন্য পুরুষের বুকে মাথা রেখে ঘুমাবো? ”
বলেই আদুরী শোয়েবের গলা পেঁচিয়ে ধরে নিরব কান্নায় ভেঙ্গে পড়লো। শোয়েবও চোখের পানি ছেড়ে দিলো। গামছা দিয়ে আদুরীর চোখের পানি মুছে দিলো। হাওয়াই বালিশটার কাঠিটা বের করে ফুঁ দিয়ে ফুলিয়ে নিলো। আদুরীকে নিয়ে এক বালিশে একই চাদর গায়ে দিয়ে শুয়ে গেলো। আদুরী বলল,
“এই বালিশ আপনাদের আছে?”
“হ্যাঁ। আমার আব্বা যখন জাহাজে যাতায়াত করতো,তখন এই হাওয়াই বালিশ সঙ্গে রাখতো।পথে শুয়ে বিশ্রাম নেওয়ার জন্য।”

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

“কেউ দেখেনাই ব্যাগ নিয়া বাইর হইতে?”
“নাতো। কে দেখবে? চাদর,গামছা আমার। কয়েল,বালিশও আমার রুমেই ছিলো।”
“কয়েল আনাতে বড় উপকার হইছে?”
বলল আদুরী।
“তোমাকে আমি ইহজনমে পাব না চিন্তা করতেই হৃদয় ছিঁড়ে যায় প্রেয়সী। দুজন লুকায়া বিয়ে করে ফেললে কেমন হয়?”
“ওই যে মাইরা ফালাইবো।”
আদুরী খানিক চুপ রয়। শোয়েবের ভারি নিঃস্বাস তার অন্তরে শিরশির অনুভব জাগিয়ে তোলে। অসহায় সুরে সে বলল,

“আচ্ছা এটা করলে কেমন হয়? আমরা দুজন ত দুজনেরে পাব না। তাহলে দুজন অন্য কাউরে বিয়া না করি?”
“এটা সম্ভব? বলো? কস্মিনকালেও সম্ভব না। তুমি তোমাদের পরিবারের একমাত্র মেয়ে। তারা তোমাকে পাত্রস্থ না করে চিরকুমারী করে ঘরে বসিয়ে রাখবে? আমিও পরিবারের ছোট ছেলে। বিয়ে না করায়া রাখবে?”
“তাহলে আর বিকল্প কোন ব্যবস্থা নাই?”
“আমি দেখি না। অনেক কষ্ট হলেও মেনে নিতে হবে।”
আদুরী আবারো অশ্রুবাণে ভেসে গেলো। সে প্রাণ দিয়ে ভালোবাসে শোয়েবকে। শোয়েবও অনেক বেশি ভালোনাসে আদুরিকে। এভাবে দুজনে ভবিষ্যৎ বিরহ জাগানিয়া কথার স্রোতে হারিয়ে যায়। নিবিড় নির্জন তিমির আঁধার রাত্রিতে দুজন না চাইলেই ডুবে যায় অন্তরঙ্গ মুহূর্তে বেশকিছু সময়ের জন্য। তারপর হারানোর ব্যথা বুকে নিয়ে দুজন দুজন থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। চলে যায় যার যার গন্তব্যে।

শীতের অবসন্ন বিকেল। প্রকৃতি তার সমস্ত রুক্ষতার দায় স্বীকার করে ঝিমিয়ে পড়েছে। আকাশটা ক্রমশ বর্ণিল হয়ে উঠেছে। যেন স্রস্টা নিপুণ হাতে রঙ তুলির আলপনায় মেতে উঠেছে অম্বরের বুকে। পাখিরা নীড়ে ফেরার তাড়া নিয়ে উড়ে যাচ্ছে। রাজহাঁসগুলো পুকুর থেকে উঠে এসেছে। দুলে দুলে খোয়াড়ের দিকে হেঁটে যাচ্ছে। এমন সময় উঠান হতে পরিচিত কারো কন্ঠের হাঁক শোনা গেল।
“কইগো নাতনি? কই? আসো।”
নূরী কয়েক পা এগিয়ে এলো। সেই চিরচেনা খাঁকি পোশাক পরা চেনা ডাকপিয়ন আতাহার আলী।
“চাচা মিয়া বসেন। শিখা আইতাছে।”
আতাহার আলী ঘরে প্রবেশ করলেন। চেয়ার টেনে বসলেন। নুরী ব্যস্তসমেত হয়ে ভাপা পিঠা ও এক গ্লাস পানি এনে দিলো। তিনি খেতে খেতে নূরীর প্রশংসা করলেন।

“বুঝলে মা,পায়ে হেঁটে দশগ্রাম যাই আমরা। মানুষের বাড়ি বাড়ি গিয়ে মানুষের মনের কত জরুরী খবর বিলি করি। কিন্তু খুব কমজনাই আছে তোমার মতো করে সম্মান করে একজন ডাকপিয়নরে।”
শিখা ওড়নার আঁচলে ভেজা হাত মুছতে মুছতে আতাহার আলীর সামনে এলো।
“পিয়ন দাদা, আসসালামু আলাইকুম।”
“ওয়ালাইকুম আসসালাম। কেমন আছো নাতনি? পড়াশোনা কেমন চলতাছে?”
“আলহামদুলিল্লাহ দাদা। ভালোই চলতাছে। দোয়া করবেন।”
“ধরো তোমার জামাইয়ের পত্র। সময় কইরা উত্তর দিয়া দিও।”
“দিমুনি। দাদা আপনে কি সবার বাড়ি রিকসায় কইরা যান? না পায়ে হাঁইটা?”

“না বইন। ডাকপিয়নেরা পথের মানুষ। অল্প আয়ের মানুষ। যানবাহন ব্যবহার করলে পোষায় না। ”
দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন আতাহার আলী। তারপর উঠে চলে গেলেন। শিখা করুণ চোখে চেয়ে রইলো সেই ডাক পিয়নের হেঁটে যাওয়ার দিকে। মানুষটির আকৃতি মাঝারি গড়নের। স্বাস্থ্য মোটামুটি। হাতে একটি চেইনের ঘড়ি। গায়ের রঙ ফর্সা। কিছুটা গোলগাল সুন্দর মায়াবী চেহারা। কাঁধে চওড়া ফিতার পাটের ঝুলানো মজবুত একটি ব্যাগ। সেই ব্যাগে উনি যত্ন করে বয়ে চলেন কত হাজারো মানুষের প্রিয়জনদের মনের কথা। তার পরনে কোটের আকৃতি শার্ট ও ঢিলে প্যান্টটি একই রঙের। হালকা হলদে কিংবা খাকি রঙের বলা যায়। কোটের বুকপকেট দুটো দুপাশে। নিচে দুই সাইডে কাটা। রোজ পরতে পরতে উনার গায়ে বেশ মানিয়ে গিয়েছে নিজ পেশার ইউনিফর্মটি।
শিখা মুখ ঘুরিয়ে মাকে বলল,

“পিয়ন দাদারে দেখলেই আমার মায়া লাগে আম্মা। নিজের আপন দাদা মনে হয়। আমার দাদাও কি এমন সুন্দর ছিলো আম্মা?”
“তোর দাদা লম্বা ছিলো। শুকনা ছিলো। ব্যবহার এত ঠান্ডা ছিল না। তোর বয়স যখন দুই,তখন মারা যায় উনি। এনারে অনেক আগে থেইকাই আমি চিনি। তোর উত্তর ঘরের চাচাগো চিঠি,টাকা নিয়া আসতো। যা রুমে গিয়ে জামাইয়ের চিঠি পড়। উত্তর দিতে বিলম্ব করিস না।”
মায়ের মধুর আদেশ পেয়ে শিখা নিজের রুমে চলে যায়। বিছানায় উপুড় হয়ে শুয়ে যায় বুকের নিচে পাতলা একটা বালিশ দিয়ে। হলদে খামটা ছিঁড়ে নেয়। মাথা ঝুঁকিয়ে বোবা ভাষায় পড়তে লাগলো শহর হতে আসা তার নববরের দুই পৃষ্ঠার চিঠিখানা।

” মাই বাটারফ্লাই,
কেমন আছো তুমি? নিশ্চয়ই ভালো। তুমি প্রতিটিক্ষণ ভালো থাকো, এ আমার অনন্ত চাওয়া। আমি ভালো কিনা তা ঠিক জানিনা। আমার একলা বারান্দায় হুহু করে শীতের পশ্চিমা বাতাস বয়ে যায়। সেইক্ষণে ভিতরটা খাঁ খাঁ করে উঠে। আমার চারপাশে হাজারো মানুষের ভীড়। তাদের মুখরিত আনাগোনা। তবুও তুমি নামক মানুষটার অভাব আমাকে নিস্তেজ করে দেয়। বিরহের রাশি রাশি স্তুপ আমার মনভূমিতে। এই অসীম বিরহের মাঝেও যতটুকু ভালো আছি প্রিয়া, তাও তোমার জন্যই। কারণ আমি তোমাকে পাই ভোরের নরম আলোতে, দুপুরের আগুন রঙা রোদ্দুরে, পড়ন্ত বিকেলের ঘন ছায়ার মাঝে,সাঁঝের বর্ণিল মেঘের মাঝে, নিশিরাতের নিদ্রাচ্ছন্ন স্বপ্নের মাঝে। তোমার বিরহ এই যুবকটাকে পোড়ায়। কাঁদায়। ভাবায়। উদাস করে তোলে।
প্রিয়া আমি জানুয়ারী মাসে যেকোন সময় বাড়ি আসবো। এরপর আসবো তোমার ফাইনাল পরিক্ষা শেষ হয়ে গেলে। তার আগে আর আসব না। প্রতিবছর এই সময় মায়ের অনুরোধে শীতের কয়েকরকম পিঠা ও রসের ক্ষীর খেতে গ্রামে আসতে হয়। কিন্তু এবার ত আমার উপর মা বেজায় অসন্তুষ্ট। এদিকে উনার বড় সন্তান নেই। সবমিলিয়ে সিচুয়েশন ভিন্ন। তবুও আমি আসবো মাকে দেখতে। এবং তোমার ওই নিষ্পাপ কচি মুখখানি দেখার জন্য। আমাদের বাড়িতে এসে পরে তোমাদের বাড়িতে আসবো।
মন দিয়ে পড়াশোনা করো। দশবছরের সাধনার ফল এসএসসির রেজাল্ট। প্রয়োজনীয় যা লাগে কিনে নিও। আমি আসলে টাকা দিয়ে দিবো। সময় না পেলে জবাব দিতে হবে না। আমাদের দেখাতো হচ্ছেই। আম্মা, আপা, দুলাভাইকে আমার সালাম দিও। ইচ্ছে করে তোমায় গভীরভাবে কিছু লিখি। কিন্তু তুমি যদি মাইন্ড করো, তাই অনুভূতিকে জলাঞ্জলী দিলাম। তুমি প্রেমিকা হয়ে উঠো। তবেই না হয় বলব গোপন কিছু।
একটা ধাঁধা। উত্তর জানবো তোমার মুখোমুখি হয়ে।

“যা দেখা যায়,বোঝা যায়,অনুভব করা যায়,কিন্তু ছোঁয়া যায় না।” কি? আমি ক্লু দিতে পারতাম। বাট নো। ভেবে খাতায় লিখে রেখো। আজ আর নয়। অনেক ভালোথেকো আমার নিবিড় ভালোবাসায়।
সমাপ্তিতে,
তোমার আমি।”
শিখা চিঠিটি বুকের মাঝে চেপে ধরলো। হৃদপিণ্ডটা ধুকপুক করছে। তবুও দুই অধরকোণে দুষ্টমিষ্ট হাসির ফোয়ারা। আনমনা হয়ে আছে। মায়ের ডাকে সম্বিত ফিরে পায় শিখা।
“আইতাছি আম্মা।”
“এতক্ষণ লাগে সামান্য একটা পত্র পড়তে? তোর সেতারা চাচীর থেইকা আমগো কোদালটা নিয়া আয়। এক খাসলত এই বেডির। কারো কিছু নিলে আর দিয়া যায়না। গিয়া আনতে হয়। মরার মন আমার। কেউ কিছু চাইলে না দিয়াও পারি না।”

শিখা ছুট দেয় সেই ঘরের দিকে। দুই উঠান ডিঙিয়ে সেই ঘরে যায়। কোদাল চাইতেই পেয়ে যায়। এনে দেয় তার এক দাদী। তিনি তার ভাঁজ পড়া ললাটখানিকে আরো কুঞ্চন করে আধভাঙ্গা গলায় জিজ্ঞেস করলেন,
“কিরে আগুনী? হাসনের কি হইছে অন? অমন গাল টিইপা হাসছ ক্যান? আলগায় ধরছে তোরে?”
“হিঃহিঃহিঃ। আমি হাসুম না তো তুমি হাসবা বুড়ি? আমার হাসার ব্যারাম হইছে তাই হাসি। ”
তার হাতের ঝুলে পড়া চামড়া টেনে দিয়ে বলল শিখা।
সেই দাদীর ছেলের বউ বলল,
“শিখার জামাই চিঠি দিছে মনে হয়। তখন তাদের ঘর থেইকা পিয়নরে বাইর হইতে দেখলাম। নারে মাইয়া?”
“হ চাচী।”

লজ্জাবনত স্বরে জবাব দিয়েই শিখা কোদাল নিয়ে দৌড় দিলো নিজেদের ঘরে।
নূরী কোদাল নিয়ে মাটির স্তুপে কোপ বসালো। জিজ্ঞেস করলো,
“জামাই চিঠিতে কি লিখছে?”
আমার কাছে যা লিখার লিখছে। বলে শিখা মাকে বাকি কথাগুলো জানালো।
নূরী দুঃখিত গলায় বলল,
” আসুক। আমি তারে পিঠা,রসের ক্ষীর রাইন্ধা খাওয়ামু। একটা হারামি মা। পোলার মন যারে চাইছে তারে বিয়া করছে। তুই এমন গাল ফুলায়া থাকস ক্যান? নতুন চেয়ার ত কেনা হইলোই। ঢেলাগুলান লেইপা দিমু। সুন্দর লাগব দেখতে। আমার যা আছে তাই। অজু কইরা ঘরে যা। আজান দিয়া দিব। নামাজ পইড়া পড়তে বয়।”
শিখা পুকুর ঘাটে চলে। তালগাছের মোটা গুঁড়ির উপরে বসে ঠোঁট ভিড়িয়ে আপন মনে হাসতে থাকে। আজানের ডাক শুনতে পেয়েই তড়বড়িয়ে নিচের সিঁড়িতে নেমে যায় অজু করার জন্য।

শীতবস্র বিতরণ শেষে তালুকদার সবাইকে নিয়ে বাড়ি ফিরে এলো। বাদশা গিয়ে তার দূর সম্পর্কের এক খালার আশ্র‍য়ে থাকা মা জুলফাকে দেখে আসলো। জুলফার শরীর আজকাল ভালো যাচ্ছে না। বাদশার ভিতরে তাড়না কাজ করে। দ্রুত কাজ সারতে হবে। তবে শীতটা পার হয়ে যাক। শীতের জন্য কাজ সফল করা অসম্ভব। তালুকদারও শীতে একটু অসুস্থ থাকে। তাকে ঘর থেকে বের করা দুরুহ হয়ে পড়বে। বাদশা তার মত করে সকল প্রস্তুতি নিতে থাকে। সুযোগ করে মধুপুর গ্রামে আসে। নূরীর সঙ্গে দেখা করে।
সে নূরীকে ভারিক্কি গলায় জিজ্ঞেস করে,

“খালাম্মা,আপনার সকল প্রস্তুতি কতদূর? আর একটা কথা আপনাকে সাবধান কইরা দিতে আসছি। মাথা একদম ঠান্ডা রাখবেন। উত্তেজিত হইলে ব্যর্থ হবেন। আর ব্যর্থ হওয়া মানেই আপনার আমার গর্দান কর্তন। আপনি যতই বুদ্ধিমান হোন,তবুও একজন নারী। আমি যতই আপনার ছোট হইনা কেন,আমি একজন পুরুষ। সুতরাং সব আমার ইশারায় চলবে তখন। কিন্তু আপনার যা ইচ্ছা তাও করতে পারবেন। সেই সুযোগ আমি আপনেরে দিমু।”
“আমার প্রস্তুতি চলছে বাদশা। তোমার কথায় যুক্তি আছে। ঠিক আছে তুমি যেমনে কইবা,তেমনেই সব হইবো।”
বাদশা চলে যায় গটগট পায়ের আওয়াজ তুলে।

নূরী সন্দেহভাজন চোখে পিছন থেকে বাদশাকে চায়। মনে মনে নিজেকে প্রশ্ন করে,
কে এই বাদশা? কি তার পরিচয়? একটা চাকরের কথাবার্তা এত শক্তিশালী কিভাবে হয়?
কুসুম স্কুল থেকে বাড়ি যাচ্ছে। একটা পথের পাড়ে উঠতেই কুসুমের মাথার উপরে কয়েকটি কাঁচা বরই টুপটাপ করে ঝরে পড়লো। কুসুম তাতানো মেজাজে উপরে চাইলো। দেখে সেই ছেলেটি আমগাছের একটি মগডালে বসে আছে দুই পা ঝুলিয়ে। লাগোয়া বরই গাছের ডাল থেকে কিছু বরই সে নিয়ে কুসুমের গায়ে ফেলল। কুসুম কিছুই বলল না তাকে। হতচকিত হয়ে পা বাড়িয়ে হাঁটা ধরলো। ছেলেটি ঝুপ করে লাফিয়ে মাটিতে ঘাসের উপরে পড়লো। কুসুমের সামনে গিয়ে পথ আগলে দাঁড়ালো। সহাস্য হেসে বলল,

“কেমন আছো কুসুম?”
“আপনি এত ফাজিল ক্যান? কি ভয়টাই না পাইছিলাম।”
“ফাজিল বলেইত ফাজলামো করলাম তোমার সঙ্গে।”
“আপনার আর কাজকাম নাই? লেখাপড়া নাই? কেবল আমার পিছু লাইগা থাকেন?”
“লেখাপড়া নাই। বি.এ ভর্তি হয়ে আর পড়া হয়নি। এখনো তোমার উপরেই আছি। আর কাপড়ের ব্যবসা আছে আমাদের। সদরের ডালিয়া মার্কেটে। আব্বা,ম্যানেজার বসে। আমিও বসি। যেদিন তোমাকে বেশি মনে পড়ে। সেদিন যাইনা। তোমার স্কুলের এদিকে চলে আসি।”
“হইছে দেখছেন ত। এবার চইলা যান।”

“যাইতাছি। বরইগুলা নাও। বাড়িতে গিয়া লবন দিয়া খাইবা আর আমার কথা মনে করবা।”
কুসুম হাত বাড়িয়ে বরইগুলো নিজের হাতে নেয়। তারপর জিজ্ঞেস করে,
“আইচ্ছা আপনার নাম কাউরে কইতে মানা করছেন ক্যা?”
“এসব বিষয়ে সবার বাধা থাকে। কে কখন কিভাবে জাইনা যায়, আর আমাদের সম্পর্কে ফাটল ধরে ঠিক আছে তার? সেজন্যই মানা করছি। তুমি কি কাউকে বলে ফেলছ নাকি?”
“না। তবে আমার বান্ধবীরে জানানোর ইচ্ছা আছে। সেও তার নতুন জামাইয়ের কথা আমারে সব বলে?”
“নাম কি তার?”
“শিখা। পড়াশোনায় আমার চাইতে ভালো। তবে অর্থনৈতিক অবস্থা আমাদের চাইতে খারাপ। ও ছোট থাকতেই বাবাকে হারাইছে।”

ছেলেটি নির্বাক হয়ে যায় শিখার নামটি শুনতে পেয়েই। শিখা এই স্কুলের ছাত্রী? নিজেকে স্বাভাবিক করে নিয়ে বলল,
“ওকে সারপ্রাইজড দিও একবারে আমার সঙ্গে দেখা করিয়ে দিয়ে। এখন বলার দরকার নেই কুসুম।”
কুসুম মাথা হেলিয়ে সম্মতি জানায় ছেলেটিকে। ছেলেটি চিন্তিত মনে বাড়ি ফিরে যায়। ভালোবাসার মানুষের সবকথা, আদেশ বেদবাক্য মনে হয়। তাই কুসুমও শিখাকে তার প্রেমিকের কথা কিছুই বলে না। লুকিয়ে রাখে।
তুমুল শীত পড়ছে৷ একদিন শিখা কোচিং শেষে ক্লাস থেকে বেরিয়ে এলো। নমিতা রানী এগিয়ে এসে শিখাকে ডাকলো। একটি বড় কাঁটাবিহীন ফুটন্ত গোলাপ হাতে ধরিয়ে দিলো। বলল,

“আজ তিনি সরাসরি গেটের ভিতরে আইসা আমার হাতে দিলোগো।”
“কে দিদি?”
চমকিত চোখে জানতে চাইলো শিখা।
“কে আবার? তোমার আড়ালের বন্ধু। প্রেমিক।”
“এখন কই উনি দিদি?”
“তাতো জানিনা ভাই। আমাকে দিয়ে বলল,এটা এসএসসি ক্যান্ডিডেট শিখাকে দিবেন। তারপর দেখলাম পথ ধরে এগিয়ে গেলো।”

রাজবধূ পর্ব ২২

শিখা দেখলো আজ কোনো চিরকুট নেই। গোলাপের ডাঁটায় একটি কাঁটাও নেই। খুব যত্ন করে কাঁটাগুলো ছেটে ফেলা হয়েছে। যেন ফুলের কোমল ছোঁয়া পেতে গিয়ে শিখা কাঁটার আঘাত না খায় তার সরু আঙ্গুলগুলোতে। শিখা মনে মনে একচোট ঝাড়লো সেই অচেনা মানুষটিকে। ফুলটা হাতে নিয়েই হাঁটা ধরলো বাড়ির দিকে। উঁচুনিচু মেঠোপথ মাড়িয়ে কিছুদূর চলে এলো শিখা। অমনি শিস বাজাতে বাজাতে একটি যুবক তার পাশাপাশি হয়ে গেলো।
শিখা বিস্মিত হয়ে মাথা তুলে তার দিকে তাকালো। তার দু-চোখ ঢাকা বড় সানগ্লাস দিয়ে। হাতে ব্রেসলেট। মাথার চুলগুলোও কালো ক্যাপ দিয়ে ঢাকা। শিখা তার অবাক করা অচেনা দৃষ্টি তাক করলো মানুষটির দিকে।
ভড়কে যাওয়া কন্ঠে শুধালো,

রাজবধূ পর্ব ২৪