প্রেমপিপাসা পর্ব ৭

প্রেমপিপাসা পর্ব ৭
সুমাইয়া সুলতানা

নীলিমাতে আবারও দেখা যাচ্ছে কালো মেঘের হাতছানি। বৃষ্টি পড়ে ভিজিয়ে দিয়েছে ধরিত্রীর বুক জমিন। ভার্সিটির পুরো ক্যাম্পাস ঢেকে গিয়েছে স্নিগ্ধ শীতলতায়। মাঠ পানিতে স্নান করে স্যাঁতসেঁতে কাদায় লেপ্টে রয়েছে। হালকা মেঘলা আকাশে একফোঁটা রোদ দেখা যাচ্ছে না। কালো মেঘের আড়ালে লাজুকলতার ন্যায় সূর্য মুখ লুকিয়ে আছে।
অরু চুপচাপ ভগ্নহৃদয়ে বসে রয়েছে ভার্সিটির মধ্যে বরাদ্দকৃত লাইব্রেরির বারান্দার এক কোণে। তার ডাগর আঁখি যুগল ঝর্ণার অশ্রুপাত। মুখ জুড়ে রয়েছে একরাশ বিষণ্ণতা। তার পেছনে ভারী বইয়ের তাক আর সামনে অল্পসংখ্যক গাছপালা। ডাগর আঁখি দিয়ে একের পর এক অশ্রু গড়িয়ে পড়ছে, যেন থামার নাম নেই। অশ্রুর জলোচ্ছ্বাসে তার চোখের নিচে কিঞ্চিৎ লালচে দাগ পড়ে গিয়েছে। চেহারায় বিষণ্ণতার এমন ছাপ যে দূর থেকে কেউ তাকালেও তার হৃদয়ের ভার বোঝা যাবে। এক হাত দিয়ে মুখ চেপে ধরেছে, যেন নিজের কান্নার শব্দ অন্য কেউ না শুনতে পায়। নরম ঠোঁট জোড়া কাঁপছে, আর মাঝে মাঝে স্রোতের মতো কান্না ঠেকাতে ঠোঁট কামড়ে ধরছে।

অরু ব্যথাতুর হৃদয়ে নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে যখন বসে রয়েছে, ঠিক তখনই নিখিল এসে হাজির হয় সেখানে। ভাবনায় বিভোর অরু তাকে খেয়াল করেনি। নিখিলের ভারী পায়ের আওয়াজ বারান্দার মেঝেতে প্রতিধ্বনিত হতেই, তৎক্ষনাৎ অরু মূহূর্তের জন্য চমকে তার দিকে তাকায়। বিস্ময়কর দৃষ্টিতে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকল কিয়ৎপরিমাণ। পরমুহূর্তে অশ্রু চোখে এক ঝলক আশা জ্বলে ওঠে, যেন সেই পরিচিত মুখ তাকে এই দুঃখ থেকে মুক্তি দিবে। নিখিল’কে দেখে অরুর অধর কোণে হাসি ফুটে উঠল। খুশি তে কি বলবে বুঝে উঠতে পারছে না। কন্ঠ ফুঁড়ে শব্দ বের হতে সময় নিচ্ছে। অনিমেষ চেয়ে থাকল চিরচেনা, পছন্দের পুরুষটির দিকে।
অরু বসা হতে দাঁড়িয়ে পড়ল। চকচকে চোখে হাস্যোজ্জ্বল মুখে বলে উঠলো,

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

” নিখিল? সপ্তাখানেক ধরে তুমি কোথায় হারিয়ে গিয়েছিলে? কতবার কল করেছিলাম। ফোন ধরোনি কেন? ”
নিখিলের চোখে কঠোরতা, ঠোঁটের কোণে এক চিলতে ব্যঙ্গাত্মাক ভাব। তাচ্ছিল্য হেসে বলল,
” বেঈমান মেয়ে আমার খোঁজ পাওয়ার জন্য এতটা উতলা হচ্ছে? দারুণ তো! বড়োলোক বাড়ির ছেলের গলায় ঝুলে তো দেখছি দিব্যি আছো। শোনলাম খুব ভালো বর পেয়েছো। আমি গরিব ঘরের ছেলে বলে, স্বার্থপর মানুষের মতো পালিয়ে বিয়ে করে নিলে?
নিখিলের গলায় ঠান্ডা বিদ্রূপ ঝরে পড়ার সংকেত। চোখে একরকম জ্বলন্ত অভিমান, ঘৃণা যেন অরু তাকে কথাটা বলে অপমান করেছে।

অরু অবাক হয়ে নিখিলের দিকে তাকায়। নিখিল এসব কি বলছে? অরু স্বার্থপর হলো কিভাবে? আর পালিয়ে বিয়ে করেছে কখন? অরু ঠোঁট নড়ে কিছু বলার মতো শক্তি পাচ্ছে না। শব্দ গুলো কন্ঠনালীতে দলা পাকিয়ে গিয়েছে মনে হচ্ছে। তার চোখে যেন একসঙ্গে হাজার প্রশ্নের রেশ। আশ্চর্য হয়ে জিজ্ঞেস করলো,
” তুমি এমন কথা কেন বলছো, নিখিল? তোমাকে কে বলেছে আমি পালিয়ে বিয়ে করেছি? তোমার কি আমাকে সেরকম মানুষ মনে হয়? ”
নিখিল অরুর দিকে আরেকটি বিষাক্ত মন্তব্য ছুঁড়ে দেয়,
” মনে না হওয়ার কি আছে? পালিয়ে বিয়ে না করলেও লুকিয়ে তো বিয়েটা করেছো, নাকি? তুমি তো ভুলেই গিয়েছিলে আমার কথা। তাই তো ফালতু নষ্টা মেয়েদের মতো প্রেমিক’কে রেখে বড়োলোক বাড়ির ছেলে পেয়ে নাচতে নাচতে বিয়ে করে নিয়েছো। বিয়েতে আমন্ত্রণ পাঠাতে, সবার মতো আমিও শুভেচ্ছা জানাতাম। বিয়েতে বাঁধা প্রদান করতাম না। ”

নিখিলের কণ্ঠে এতটা কটাক্ষ ভাব, অরুর বুকটা যেন ছিঁড়ে যাচ্ছে। অরুর সামনে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষটাকি সেই নিখিল, যাকে অরু ভালোবাসে? কই অরুর তো তাকে চিনতে পারছে না! মনে হচ্ছে এটা অন্য কোনো নিখিল। কিন্তু অরু’কে এধরনের বিশ্রী ভাষায় সম্বোধন করায় অরু রাগ বেড়ে গেল। রগে রগে জ্বলে উঠল স্ফুলিঙ্গ! বিয়ে হয়েছে বলে কি ভালোবাসার মানুষকে এরকম নোংরা শব্দ ব্যবহার করে কথা বলবে? আর যে বলে সে কি সত্যি ভালোবাসেছে? ভালোবাসলে তো ভালোবাসার মানুষকে এসব কথা বলা যায় না, সর্বদা সম্মান দিয়ে কথা বলতে হয়।
নিখিলের দিকে কঠিন দৃষ্টি নিক্ষেপ করে অরু ঝাঁঝালো গলায় চেঁচিয়ে বলল,

” মাইন্ড ইয়োর ল্যাঙ্গুয়েজ, নিখিল! ভদ্র ভাবে কথা বলো। আমি জানি, তুমি আমার উপর রেগে আছো। তারমানে এই নয় যে আমাকে অভদ্রতা সমেত যা ইচ্ছে তাই বলবে! মুখের ভাষা খারাপ করলে, ভালো হবে না কিন্তু! ”
নিখিল দ্বিগুণ তেজ ফুটিয়ে কটাক্ষ করে জবাব দিল,
” এই তো সাপের খোলস ছেড়ে বেরিয়ে এসেছিস। তোদের মতো মেয়েদের আমার চেনা আছে। তোর ভাবসাব আমার শুরু থেকেই সন্দেহ লেগেছিল। তুই আমার সাথে সম্পর্কে থাকা অবস্থায় তোর বান্ধবীর বয়ফ্রেন্ড এর সঙ্গে গোপনে তার সাথেও সম্পর্কে জড়িয়ে ছিলি। কি ভেবেছিস? আমি কিছু জানতে পারবো না? এসব জানা সত্ত্বেও তোর মতো নোংরা মেয়েকে আমি ভালোবাসবো ভেবেছিস? ”

অরু বিস্ময়ে কিংকর্তব্যবিমুঢ় হয়ে গেল। তিরিক্ষি মেজাজ নিয়ে বলে ওঠে,
” তুই তুকারি কেন করছো? তোমার এতটা অধঃপতন হয়েছে নিখিল? মস্তিষ্কের ভেতর এতটা নোংরামি লুকিয়ে রেখে ছিলে? আমার বান্ধবীর বয়ফ্রেন্ড এর সঙ্গে গোপনে সম্পর্কে জড়াইনি। ওদের দু’জনর মধ্যে মনোমালিন্য চলছিলো। আমি জাস্ট তাদের মিলিয়ে দেওয়ার জন্য হেল্প করেছিলাম। আর তুমি আমার চরিত্র নিয়ে কথা তুলছো? তোমার সাহস দেখে আমি রীতিমতো অবাক হচ্ছি। ”
নিখিল ব্যঙ্গাত্মক করে বলল,
” সাহসের কি দেখেছিস? সত্যি বলেছি বলে গা জ্বলে উঠল? ”

অরু চোখমুখ শক্ত করে নিলো। দাঁতে দাঁত পিষে কটমটিয়ে উঠে। রক্তিম চোখে নিখিলের দিকে চেয়ে বলে,
” তুমি আর কখনো আমার সামনে আসবে না। আব্বু ঠিকই বলতো, তুমি খারাপ ছেলে। যার মস্তিষ্কে ভালোবাসার মানুষকে নিয়ে এসব কুরুচিপূর্ণ চিন্তা আসতে পারে, সে মানুষ কেমন আমার বোঝা হয়ে গিয়েছে। তুমি একটা চিপ মাইন্ডের লোক! ”

” আমি না, কুরুচিপূর্ণ মনোভাব আর লোভী মেয়ে মানুষ তুই। তাই তো এক বাচ্চার বাবাকে শুধু মাত্র টাকার লোভে বড়োলোক বলে চোখ বুঝে বিয়ে করো ফেলেছিস। দেখবি ভবিষ্যতে ওই লোক নিজের খায়েশ মিটিয়ে, তোকে টিস্যুর মতো ডাস্টবিনে ছুড়ে ফেলবে। কারণ নোংরা জিনিস কেউ বেশিক্ষণ সাথে রাখে না। ”
অরু সজোরে থাপ্পড় মেরে বসলো নিখিলের গালে। তবে থাপ্পড়টা গালে পড়ার আগেই নিখিল অরুর হাত ধরে ফেলল। চোয়াল শক্ত করে অরুর হাত মুচড়ে ধরল। অরু মুখ থেকে ব্যথাতুর ক্ষীণ আওয়াজ বেরিয়ে আসে। নিখিল রাগী লুক নিয়ে তাকিয়ে চওড়া গলায় বলে,

” খবরদার! এই সাহস দ্বিতীয় বার দেখাস না। তাহলে তোর সুন্দর এই নরম শরীরটার এমন হাল করবো, কারো সামনে মাথা উঁচু করে বাঁচার মতো অবস্থায় থাকবি না। তোর বর তোর শরীরটা ভালো মতো ভোগ করার আগেই বাড়ি থেকে ঘাড় ধাক্কা দিয়ে বের করে দিবে। ”
অরুর মুখটা ফ্যাকাশে হয়ে গেল। তার চোখে জল জমে উঠছে, কিন্তু সে ভেঙে পড়বে না। নিজেকে সামলানোর চেষ্টা করল। অরু জানে, এখন কাঁদা মানে তার দুর্বলতা প্রকাশ করা। অরু দুর্বল হবে না। নরম ঠোঁটের কোণে কেঁপে ওঠা দুঃখ আর মুখে চাপা শ্বাস লুকানোর যথাসাধ্য আয়ত্ত করল। একদিকে নিখিলের ভালোবাসার স্মৃতি, আর অন্যদিকে তার আজকের অপমান দুটো মিলে অরুর ভেতরটা একেবারে ভেঙে দুমড়ে মুচড়ে যাচ্ছে।
অরু ঝাড়া মেরে হাত ছাড়িয়ে নিলো। তীব্র ঘৃণা নিয়ে জানায়,

” চলে যাও এখান থেকে। তোমার মতো অসভ্যের মুখদর্শন করতে চাই না আমি। ”
” ভার্সিটি কি তোর একার? ”
অরু নিজেই কিছুটা দূরে সরে দাঁড়ায়। মুখ ঘুরিয়ে নৈঃশব্দ্যে অবরিত কেঁদে চলেছে। ভেবেছে নিখিল তাকে সান্ত্বনা দিবে। এক্ষুনি এসে বলবে, অরু আমি এতক্ষণ যা বলেছি সব মিথ্যা ছিল। রেগে ভুল করে বলে ফেলেছি। কিন্তু না, অরুর ভাবনাটাই মিথ্যা হয়ে গেল। অরুর কান্নায় পাষাণ মানুষটার কিছু এসে যায় না। নিখিলের চোখে ক্রোধ আর কুটনৈতিক আচরণের ঝলক। সে ধীর পায়ে চলে যায়, পেছনে রেখে যায় এক ভগ্নহৃদয়ের মানবীয় নারীকে।
নিখিল চলে গেলে অরু আর নিজেকে ধরে রাখতে পারলো না। বারান্দার রেলিং আঁকড়ে ধরে কাঁদতে শুরু করে, যেন পুরো আকাশটাই তার সঙ্গে শোক প্রকাশ করছে। লাইব্রেরির পরিবেশ তার কান্নার ভারী সুরে আরও নিস্তব্ধ হয়ে যায়। কান্নার শব্দ কারো কর্ণগোচর যেন না হয়, সেজন্য দু হাতে মুখ চেপে ধরে। তার মুখের প্রতিটি রেখা আর মন চিৎকার করে বলছে,

” তুমি আমার সাথে এভাবে ব্যাড ল্যাঙ্গুয়েজে কথা বলতে কিভাবে পারলে? আমার বিয়ে হয়ে গিয়েছে শোনার পরও কেন একবার ছুটে আসো নি? কেন আমার সাথে একটিবার দেখা করার প্রয়োজনবোধ করোনি? এমন কেন করলে, নিখিল? আমি কি তাহলে এতদিন ভুল মানুষকে ভালোবেসে ছিলাম? ”

টুটুল’কে বুকে নিয়ে ঘুম পারাচ্ছে হ্যাভেন। অফিস থেকে ফিরে এসে দেখে ছেলে কেঁদে-কেটে চোখমুখের অবস্থা বেগতিক অস্বাভাবিক করে ফেলেছে। সায়রা’কে জিজ্ঞেস করলে জানতে পারে, কোনো কারণ ছাড়াই কাঁদছে। তখন থেকে ছেলেকে সামলানোর কাজে লেগে পড়েছে সে। হ্যাভেন’কে পেয়ে টুটুল আস্তে ধীরে শান্ত হয়। অরু কাছে ডাকলেও যায়নি। তার আব্বু চাই। কেঁদেছে বলে চোখ জুড়ে ঘুম বাবাজী এসে হামলা চালায়। হ্যাভেন কোলে তুলে টুটুল’কে বিছানায় শুইয়ে, পাশে শুতেই টুটুল স্বল্প সময়ের মধ্যে ঘুমের দেশে পাড়ি জমায়। টুটুল ঘুমিয়ে গিয়েছে বুঝতে পেরে, তার কপালে চুমু খেয়ে হ্যাভেন পাশ হতে উঠে পড়ল।

অরু ভঙ্গুর মনে হাঁটু ভাঁজ করে সোফায় বসে আছে। চেয়ারা জুড়ে মলিনতার ছাপ। নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে ভেবে চলেছে কতশত গল্পকথা। মুখটা শুকিয়ে একটু খানি হয়ে গিয়েছে। বোঝাই যাচ্ছে সারাদিন কিছু খায়নি। নাসারন্ধ্রে গরম খাবারের ঘ্রাণ আর ধোঁয়া চোখেমুখে আসতেই অরু মলিন চোখে তাকায়। হ্যাভেন হাস্যোজ্জ্বল মুখে প্লেটে খাবার নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। একপল তাকিয়ে অরু নজর ফিরিয়ে নিলো। মাথা নিচু করে চুপচাপ বসে রইল।
হ্যাভেন ভ্রু কুঁচকে ফেলল। কি ব্যাপার? অরু মুখ ঝামটি মারলো না কেন? গাড়ির ঘটনার পর হ্যাভেন’কে দেখে অরুর এতটা শান্ত থাকার তো কথা না? ময়না পাখির মতো বুলি আওড়ানোর কথা। খাবার সাইডে রেখে হাঁটু ভেঙে অরুর কাছ ঘেঁষে সম্মুখে বসলো। অরু সড়ল না, নড়লও না। প্রাণহীন হিমশীতল মূর্তির মতো বসে রয়েছে। হ্যাভেনের চিন্তা বাড়লো। ঠান্ডা হাতটা অরুর মসৃণ গালে রেখে শান্ত কন্ঠে শুধাল,

” কি হয়েছে অরু পাখি? তোমাকে ভীষণ আপসেট দেখাচ্ছে। সকালের ঘটনা নিয়ে মন খারাপ? সরি পাখি! তুমি আমাকে রাগিয়ে না দিলে, আমি তোমার সাথে ওরকম বিহেভিয়ার দেখাতাম না। ”
অরু নির্বিকার হয়ে হ্যাভেনের দিকে তাকিয়ে থাকল। কিছু বলল না। হয়তো বলার মতো কোনো কথা খুঁজে পাচ্ছে না। হ্যাভেন, অরুর পাশে বসলো। প্লেট হাতে নিয়ে ভাত মাখতে শুরু করে। প্রথম লোকমা অরুর মুখের সামনে তুলে ধরল। অরু পলক ঝাপটিয়ে পিটপিট করে তাকায়।
হ্যাভেন শীতল গলায় বলে,

” হা করো, খাবার ঠান্ডা হয়ে যাবে। ”
অরু নিশ্চুপ রইল। কোনো প্রতিত্তোর কিংবা প্রতিক্রিয়া দেখানোর প্রয়োজনবোধ করল না।
” কি হলো? হা করছো না কেন? অন্য সময় তো ধারালো অস্ত্রের ন্যায় মুখ চলে, তাহলে এখন চুপ করে আছো কেন? কথা কেন ফুটছে না মুখে? ”
অরু এইবারও নিরব। হ্যাভেনর ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে যাচ্ছে। ধমকে বলল,
” কি বলেছি, কথা কানে যায়নি? লাস্ট বার বলছি, হা করো। নয়তো খুব খারাপ হয়ে যাবে। ”

অরুর ভালো লাগছে না। এখন কোনো প্রকার ঝামেলা চাইছে না। জলে টইটম্বুর অশ্রুসিক্ত নয়নে চেয়ে, হা করল। হ্যাভেন মুখে খাবার তুলে দিল। অমনি টুপ করে মসৃণ গাল বেয়ে অশ্রু বিসর্জন হলো। হ্যাভেন হতভম্ব নেত্রদ্বয়ে ড্যাবড্যাব করে চেয়ে থাকল। সে তো এখন তেমন কিছু বলেনি! তাহলে অরু এখন কাঁদছে কেন?
হ্যাভেন চোখের জল মুছে দিল। কিন্তু অরুর বেহায়া আঁখি যুগল আজ যেন কথা শুনতে নারাজ। মেঘ হয়ে ধরা দিতে সদা প্রস্তুতি গ্রহণ করতে উঠে পড়ে লেগেছে। মন কান্না করলে তার আভাস চোখে ধরা তো পড়বেই!
হ্যাভেন আর চোখের জল মুছে দিল না। কথাও বলল না। নির্বিকার ভঙ্গিতে অরু’কে খাওয়াচ্ছে আর নিজে খাচ্ছে। খাবার শেষে যত্ন করে ধানিলংকা বউয়ের ঠোঁট মুছ দেয়। এঁটো প্লেট, বাটি নিয়ে রুম ত্যাগ করে রান্নাঘরে রেখে আসার জন্য।

অরুর মাথাব্যথা করছে। হয়তো দীর্ঘক্ষণ কান্না করার ফলে এরকমটা হচ্ছে। আজ সারাদিন অরুর সময় খারাপ গিয়েছে। নিখিলের সঙ্গে কথা হওয়ার পর থেকে একাধারে অনেকক্ষণ কেঁদে ছিল। তারউপর মস্তিষ্কে হাজারো দুশ্চিন্তার আনাগোনা। ঘুমানো দরকার। ঘুমালে মাথাব্যথা কমে যাবে। অরু সোফা হতে উঠে দাঁড়ায়। হঠাৎ মাথা ঘোরাতে শুরু করল। শরীর টলছে। হাত, পা অবশ অবশ লাগছে। মনে হচ্ছে শরীরে বিন্দু মাত্র শক্তি সঞ্চিত নেই। কপালে হাত রেখে পুনরায় সোফায় বসে পড়ল। হ্যাভেন দরজা আটকে তড়িঘড়ি করে অরুর কাছে এসে জাপটে জড়িয়ে ধরল। অরুর নেত্রদ্বয় বুঁজে আসতে চাইছে। খুলে রাখা কষ্টসাধ্য ব্যাপার হয়ে যাচ্ছে। বেখেয়ালে হ্যাভেনের উপর ভরসা যোগ্য মানুষ হিসেবে শরীরের ভার ছেড়ে, কাঁধে মাথা এলিয়ে দিল।
হ্যাভেন অরুর গালে আলতো চাপড় মেরে ডাকে,

” অরু? অ্যাই অরু? কি হয়েছে তোমার? শরীর খারাপ লাগছে? ”
অরু মৃদুস্বরে গুঙিয়ে উঠল। কিছু বলতে পারলো না। আজও হ্যাভেনের কথা কর্ণগহ্বরে পৌঁছেছে কি-না বোঝা গেল না। অরুর গায়ে ভারী কাপড় নেই। শরীর বরফের মতো ঠান্ডা হয়ে রয়েছে। অরুর নিস্তেজ পাতলা শরীরটা হ্যাভেন দ্রুত কোলে তুলে নিলো। বিছানায় এসে টুটুলের পাশে নির্বিঘ্নে সন্তর্পণে আস্তে করে বালিশে শুইয়ে দিল। এসির টেম্পারেচার লৌ থেকে একেবারে টোটালি অফ করে দিল। ওয়ারড্রব হতে আরেকটা ভারী নরম কম্বল এনে ওদের উপর মেলে দেয়। অরু শীতে থরথর করে কাঁপছে। দাঁতে দাঁত লেগে ঠকঠক শব্দ হচ্ছে। হ্যাভেন হাত, পায়ের তালু ঘষছে গরম করার প্রয়াসে। কিছু মনে পড়তেই হ্যাভেন চটজলদি ওঠে পড়ে।

সোফায় ল্যাপটপ নিয়ে বসে পড়ল হ্যাভেন। অতি গুরুত্বপূর্ণ একটা ইমেইল একজনকে সেন্ড করে দিল। খুবই মনোযোগ সহকারে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে চেয়ে একটা ভিডিও দেখতে লাগলো। ভিডিও দেখা শেষে ঠোঁটে ঠোঁট চেপে ভ্রু কুঁচকে ভাবুক চিত্তে ফ্লোর, রুমের চারপাশে নজর বোলালো। বুড়ো আঙুল কামড়ে ধরে, ললাটে প্রগাঢ় ভাঁজ ফেলে বিচক্ষণ মস্তিষ্কে কিছু চিন্তা করে চলেছে। মেবাইল ফোনে টুং করে মেসেজ আসার শব্দ কর্ণগোচর হতেই ফোনের স্ক্রিনে নজর রাখল। ছোট্ট করে লেখা একটি শব্দ নেত্রদ্বয়ে ভেসে উঠল,
” ডান৷ ”

ল্যাপটপ অফ করে হ্যাভেন সেটা যথাস্থানে রেখে দিল। বেশি পাওয়ারফুল লাইট অফ করে ডিম লাইট জ্বালিয়ে, বিছানায় আসে। টুটুল’কে উঠিয়ে খাটের ওপর প্রান্তে সাইডে শুইয়ে দিল। কোলবালিশ রেখে দেয় সাইডে। টুটুলের গড়াগড়ি করার অভ্যাস আছে। কখন গড়াতে গড়াতে খাট থেকে নিচে পড়ে যায়, বলা মুশকিল। সেজন্য কোলবালিশ রেখে দিয়েছে।

টুটুল’কে সুন্দর করে শুইয়ে দিয়ে, হ্যাভেন ফটাফট মা ছেলের মাঝখানে কম্ফোর্টের ভেতর ঢুকে গেল। টুটুল’কে আরও কাছে এনে শরীরের সঙ্গে মিশিয়ে নিলো। বলিষ্ঠ হাত বাড়িয়ে অরু’কে বুকে টেনে নেয়। অরুর চোখের পাতা অশ্রুতে ভিজে জুবুথুবু অবস্থা। হ্যাভেন সন্তর্পণে তা মুছ দিল। অরুর ঠোঁট কাঁপছে। শীতে মুখমন্ডল ফ্যাকাসে বর্ণ ধারণ করেছে। শরীর এখনো গরম হয়নি। বরফের মতো ঠান্ডা, যেন অরু দীর্ঘক্ষণ ফ্রিজে আটক ছিল। হ্যাভেন যতটা পারলো অরু’কে উষ্ণতা দেওয়ার চেষ্টা করল। কিয়ৎপরিমাণ পর অরু কিছুটা নড়েচড়ে উঠল। পুরুষালী প্রসস্থ বুকের উষ্ণতা পেয়ে নিজেকে আরও গুটিয়ে ফেলল। অচিরেই পেলব হাতে আঁকড়ে ধরে হ্যাভেনের গলা। গুটিশুটি মেরে বুকের ভেতর ঢুকে পড়ার তীব্র চেষ্টা চালাল। কিন্তু ফলাফল শূন্য। কারণ আর জায়গা নেই। এখন হ্যাভেন যদি বুক খুলে দেয়, তাহলে যদি ঢুকতে পারে। তবে এটা কি কোনক্রমে সম্ভব?

প্রেমপিপাসা পর্ব ৭

অতঃপর অরু ঠোঁট উল্টে হ্যাভেনের গলায় মুখ গুঁজে, ঘুমের ঘরেই মৃদু আওয়াজে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠল। হ্যাভেনের হাসি পেলো। সুন্দর চকচকে দন্তপাটি বের করে মুচকি হাসল। অরুর কোমর টেনে ভালোভাবে বুকের সঙ্গে জড়িয়ে রাখল। উষ্ণ ওষ্ঠপুট এগিয়ে অরুর এলোমেলো চুলের ভাঁজে আলতো চুমু খেল। হ্যাভেন তপ্ত নিঃশ্বাস ছেড়ে, চোখ বন্ধ করতে করতে হতাশাজনক চিন্তা করল। ভাবছে, সকালে ঘুম থেকে ওঠে তার অরু পাখি নামক ধানিলংকা তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু না করলেই হয়!

প্রেমপিপাসা পর্ব ৮