পারমিতা পর্ব ২১

পারমিতা পর্ব ২১
Nabila Ahmed

আজ শুক্রবার। পুরো বাড়ি জুরে সবাই ঘুমাতে ব্যস্ত। ৯ টা বেজে গেলেও বাড়ির কাজেরলোক ছাড়া কেউ এখনো ঘুম থেকে উঠেনি।
বিছানার উপর বসে আছে আনিকা চৌধুরী। হাতে একটা ফটো এলবাম। এলবামে অরিয়ন,আর আবরারের ছোটবেলার ছবি থেকে এখনের ছবি পর্যন্ত দেখা যাচ্ছে। আনিকা চৌধুরীর পাশেই গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন হাবিব চৌধুরী। আনিকা চৌধুরী এলবামটা ড্রয়ারে রেখে নিজের কাঁপা কাঁপা হাতে হাবিব চৌধুরীর বালিশের নিচে হাত দেয়। একটু পরেই হাতে করে নিয়ে আসে একগোছা চাবি। ধীরে ধীরে আলমারির কাছে গিয়ে হাবিব চৌধুরীর লক করা ড্রয়ার খুলতে চাবি প্রবেশ করায়।

–আনিকা।
পেছন থেকে বলে উঠে হাবিব চৌধুরী।
হঠাৎ করে হাবিব চৌধুরীর কণ্ঠ শুনে লাফিয়ে উঠে আনিকা চৌধুরী। পরক্ষণেই চোখে পানি চলে আসে। মনে মনে সৃষ্টিকর্তার কাছে বলতে থাকে “কেনো আর কিছুক্ষণ ঘুমাতে পারলো না হাবিব”।
চাবি হাতে নিয়ে হাবিব চৌধুরীর দিকে ফিরে আনিকা চৌধুরী, চোখের কোণে পানি জমেছে। চোখ তুলে হাবিব চৌধুরীর দিকে তাকিয়ে অনুরোধের দৃষ্টিতে কিছু বোঝাতে চাইলো। হাবিব চৌধুরী বিছানা থেকে উঠে ধীরে ধীরে আনিকা চৌধুরীর সামনে এসে দাঁড়ায়। নিজের হাত দিয়ে আনিকা চৌধুরীর হাত থেকে চাবিটা নিতেই চোখ দিয়ে পানি পড়তে শুরু করলো আনিকা চৌধুরীর।
–অতীত ভুলে যাও আনিকা।
আনিকা চৌধুরীকে জড়িয়ে ধরে বলে হাবিব চৌধুরী।
হাবিব চৌধুরী জড়িয়ে ধরতেই হাওমাও করে কাঁদতে লাগলেন আনিকা চৌধুরী।

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

মিতা নিজের রুমে মাটিতে বসা অবস্থায় দরজার সাথে হেলান দিয়েই ঘুমিয়ে পড়েছে। গতকাল রাতে কান্না করতে করতে ঘুমিয়ে পড়েছে।
ডান পাশের গালে ৫ আঙ্গুলের ছাপ এখনো স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে। সাদা ধবধবে শরীরে আঙ্গুলের ছাপ কালচে দাগের মতো ফুটে আছে।
সকাল ১০ টা।
ডাইনিং টেবিলে সবার জন্য নাস্তা রেডি করে রেখেছে শায়লা। হাবিব চৌধুরী সোফায় বসে নিউজপেপার পড়ছেন। ওয়াহিদ চৌধুরী পাশেই বসে চা খাচ্ছেন আর বড় ভাইয়ের সাথে মাঝে মধ্যে দেশের বর্তমান অবস্থা নিয়ে কথা বলছেন।
মায়া চৌধুরী আর আনিকা চৌধুরী ডাইনিং টেবিলে বসে চা খেতে খেতে গল্প করছেন।

–শায়লা আমাকে নাস্তা দেও।
আবরার টেবিলের সামনে গিয়ে চেয়ার টেনে বসে বলে।
–একটু অপেক্ষা কর, অরিয়ন আসছে এরপর একসাথেই নাস্তা করিস।
বলে আনিকা চৌধুরী।
–ওহ হো মা,তোমার রাজপুত্রের জন্য এখন নাস্তাও খাওয়া যাবে না। তো মহারাজ আসবে কখন?
–বড় ভাইয়ের সাথে কীভাবে কথা বলতে হয় তা কি ভুলে গেছিস আরিয়ান?
সোফার থেকে গম্ভীর কন্ঠে বলে উঠে হাবিব চৌধুরী।
–ওহ হাবিব, তুমি একটু বেশি বাড়াবাড়ি করো।
বলে আনিকা চৌধুরী।
–ঠিক ভাইয়া। আপনি কিন্তু ঠিক এভাবেই ওয়াহিদের সাথে লেগে থাকতেন।
কথাটা বলেই হেসে ফেলে মায়া চৌধুরী।
মায়া চৌধুরীর কথায় সকলেই হেসে ফেলে।

–শায়লা, মিতাকে ডেকে আনো।
বলে মায়া চৌধুরী।
–আর ডাকতে হবে না, আমি চলে এসেছি।
ড্রয়িং রুমে ঢুকতেই মুখে হাসি ফুটিয়ে বলে মিতা।
মিতার পড়নে আজ সাদা রঙের কামিজ। চুল ডানপাশে এনে নিজের গাল লুকিয়ে রেখেছে। হাসতে হাসতে মায়া চৌধুরীর পাশে গিয়ে বসে মিতা।
–গুড মর্নিং এভরিওয়ান।
বলে মিতা।
–গুড মর্নিং।
সকলেই জবাব দেয়।
–খুব ক্ষিদে পেয়েছে মা, কি আছে তাড়াতাড়ি দেও।
একটু বেশি আগ্রহ নিয়ে বললো মিতা।

সকাল সকাল বিনা কারণে মিতাকে এতোটা প্রফুল্ল দেখে মায়া চৌধুরীর মনটা যেন কেমন করে উঠলো। সব কিছু ঠিক মনে হচ্ছে না মায়া চৌধুরীর। মিতার দিকে ভালো করে তাকিয়ে রইল। সব সময় বড় চুল নিয়ে বিরক্ত হওয়া মিতা আজ সকাল সকাল কেনো চুল খুলে রেখেছে তাও বুঝতে পারছে না মায়া চৌধুরী।
–এইতো অরিয়ন ও চলে এসেছে। চলো, চলো নাস্তা শুরু করা যাক।
ওয়াহিদ চৌধুরী বলে।
সকলে ডাইনিং টেবিলের কাছে চলে আসতেই মিতা নিজের চেয়ার থেকে উঠে গিয়ে ওয়াহিদ চৌধুরীকে জায়গা দেয়। নিজে গিয়ে বসে তার পরের চেয়ারে। মিতার মুখোমুখি বসেছে আবরার আর আবরারের ডানপাশের সিট খালি রাখা অরিয়নের জন্য।

অরিয়ন যতো টেবিলের দিকে আগাচ্ছে মিতার ভয় যেন ক্রমাগত ততোই বেড়ে চলেছে। না চাইতেও হাত পাঁ কাঁপছে মিতার। নার্ভাসনেসের কারণে অনবরত পা নাচিয়ে যাচ্ছে মিতা। আড় চোখে অরিয়নের দিকে তাকাতেই দেখতে পায় কফি কালারের একটা টি শার্ট আর সাদা ট্রাউজার পড়া। বাম হাত ট্রাউজারের পকেটে ঢুকানো আর ডান হাত, ডান হাত দেখতেই যেন অবাক হলো মিতা। ডান হাতে ব্যান্ডেজ করা। “গতকাল রাতেও তো ঠিক ছিলো” মনে মনে ভাবে মিতা।
অরিয়ন আবরারের পাশের চেয়ারে বসতেই নজর যায় মিতার দিকে। মিতা নিচের দিকে তাকিয়ে আছে। মনে হচ্ছে উপরের দিকে তাকালেই হয়তো কেউ শাস্তি দিবে। কারণটা ভালোই জানে অরিয়ন। নিজের অজান্তেই ডান হাত মুঠ করে ধরে অরিয়ন।
সবাই নাস্তা খাওয়া শুরু করতেই লক্ষ্য করে অরিয়নের হাতের ব্যান্ডেজ।

–হাত কাটলো কিভাবে?
প্রশ্ন করে হাবিব চৌধুরী।
–উনাকে নিয়ে কোথায় যাচ্ছো শায়লা?
শায়লার সাথে একজন লোক দেখে প্রশ্ন করে ওয়াহিদ চৌধুরী।
–অরিয়ন স্যারের রুমে। বেসিনের আয়নাটা ভেঙ্গে গেছে তা ঠিক করাতে।
জবাব দেয় শায়লা।
–আয়না ভাঙ্গলো কীভাবে? আর হাত? হাত কাটলো কিভাবে?
প্রশ্ন করতে থাকে আনিকা চৌধুরী।
–পা পিছলে পড়ে যেতে নিয়েছিলাম। আয়না ধরতেই ভেঙ্গে হাত কেটে গেছে।
জবাব দেয় অরিয়ন।

–এটা আবার কখন হলো? গতকাল রাতেও তো ভালো দেখলাম যখন মিতা..
কথাটা বলতে নিতেই বড় বড় চোখ করে আবরারের দিকে তাকায় অরিয়ন। চুপ হয়ে যায় আবরার।
সকলেই কেমন যেন সন্দেহের চোখে অরিয়নের দিকে তাকিয়ে রইল। খাবার খেতে খেতেই অরিয়ন মিতার দিকে তাকালেও মিতা যেন একবারও চোখ তুলে উপরে তাকালো না। প্রতিনিয়ত ডান হাতে শক্তি প্রয়োগ করায় আবারও রক্ত বের হতে শুরু করেছে অরিয়নের হাত থেকে,তাও যেন অরিয়নের চোখ মিতার থেকে সরছে না।
–অরিয়ন, তোর হাত থেকে আবারও রক্ত বের হচ্ছে বাবা।
ঘাবরে গিয়ে বলে আনিকা চৌধুরী।

–আমার খাওয়া শেষ।
বলেই টেবিলে থেকে উঠে চলে যায় অরিয়ন।
–আমি যাচ্ছি হাতে ব্যান্ডেজ করে দিতে।
বলেই টেবিল থেকে উঠে যেতে নেয় আনিকা চৌধুরী।
–ওয়েট, আনিকা।
আনিকা চৌধুরীর হাত ধরে বলে হাবিব চৌধুরী।
–এসব কাজ অরিয়নের স্ত্রীর।
আবারও বলে হাবিব চৌধুরী।
হাবিব চৌধুরীর কথা শুনে কাশতে থাকে মিতা।
–আমি কেনো!
আমতা আমতা করে বলে উঠে মিতা।
–কারণ তুই ওর ওয়াইফ।
বলে হাবিব চৌধুরী।

–হাবিব, তুমি বেশি বাড়াবাড়ি করছো। অরিয়ন আমার ছেলে। ওর উপর আমার অধিকার বেশি।
রেগে বলে আনিকা চৌধুরী।
–হাবিব ভাই, আপাকে যেতে দিন।
বলে মায়া চৌধুরী।
–সব জায়গায় এখন আর আনিকা থাকতে পারবে না তা বুঝতে হবে ওকে, মায়া। মিতা নিজের দায়িত্ব পালন কর। যা।
বলে হাবিব চৌধুরী।
আনিকা চৌধুরী আর কোনো কথা না বলে মিতার দিকে ঘৃণার চোখে তাকিয়ে রইল।

অরিয়নের রুমের দরজার সামনে ফাস্ট এইড কিট নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে মিতা। মিতার চোখের সামনে শুধু গতকাল রাতের ঘটনা ঘুরছে। অরিয়নকে এমন ভাবে কোনোদিন ভয় পাবে মিতা তা নিজেরই বিশ্বাস হচ্ছে না। নিজের অজান্তেই হাত গিয়ে মিতার ডান গাল স্পর্শ করে।
ব্যাথা অনুভব করতেই হাত সরিয়ে নেয় মিতা। রুমের মধ্যে শায়লা আর মিস্ত্রি আছে ভাবতেই কিছুটা হাফ ছাড়ে মিতা।
“শায়লা আপু আর বাকিদের সামনে কিছু করতে পারবে না, তারা থাকতে থাকতেই ব্যান্ডেজ করে চলে আসবো” মনে মনে ভাবে মিতা। আস্তে করে দরজা খুলে ভিতরে প্রবেশ করে মিতা। অরিয়ন বিছানায় বসে আছে। শায়লা ওয়াশরুমের দরজার সামনে দাঁড়িয়ে মিস্ত্রি ঠিক মতো কাজ করছে নাকি তা দেখছে।
মিতা রুমে প্রবেশ করতেই অরিয়ন মিতার দিকে তাকায়। মিতার দিকে তাকাতেই মিতা নিচের দিকে তাকিয়ে থাকে। হাত পা যেন ঠান্ডা হয়ে আসছে মিতার।

ধীরে ধীরে মিতা অরিয়নের একটু কাছাকাছি গিয়ে দাঁড়ায়। অরিয়নের নজর মিতা থেকে সরছে না। চুলগুলো দিয়ে এখনো ডান গালটা ঢাকা। তার কারণ ভালোই জানে অরিয়ন। হঠাৎ করেই নিজের উপর যেন প্রচন্ড রাগ হচ্ছে অরিয়নের।
–বড় চাচ্চু পাঠিয়েছে।
ধীর কন্ঠে আমতা আমতা করে বলে মিতা।
–অপেক্ষা কর।
জবাব দেয় অরিয়ন।
অরিয়নের কথা শুনে যেন দম বন্ধ হয়ে আসলো মিতার। বড় বড় চোখে একবার অরিয়ন ও একবার শায়লার দিকে তাকিয়ে থাকলো।

–আমার পড়া আছে, বেশিক্ষণ লাগবে না তো। এখন করে দেই।
একটু এগিয়ে গিয়ে বলে মিতা।
মিতার কন্ঠে যেন ডেস্পারেশন ছাড়া আর কিছুই প্রকাশ পাচ্ছে না।
–আই সেইড ওয়েট।
গম্ভীর কন্ঠে বলে অরিয়ন।
মিতার ভয়ে কান্না পাচ্ছে খুব। কেনো ওর সাথেই এমন হয় ভেবে পাচ্ছে না। একদিকে আনিকা চৌধুরী, যার ঘৃণা ভরা দৃষ্টি প্রতিনিয়ত মিতাকে কষ্ট দেয় তার উপর এখন অরিয়নের এই পরিবর্তন।
–আমাদের শেষ।
বলে শায়লা।
–যাবার সময় দরজা লাগিয়ে দিয়ে যেও।
বলে অরিয়ন।
–দরজা কেনো, খোলা থা…।
অরিয়নের কথা শোনা মাত্রই মিতার মুখ থেকে কথাটা বের হয়ে যায়। কিন্তু অরিয়নের দিকে চোখ যেতেই আবারও চুপ হয়ে যায় মিতা।

শায়লা রুম থেকে বের হওয়ার সময় দরজা বন্ধ করে দিয়ে যায়। মিতা নিজের জায়গায় স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। ভয়ে নিজের ঠোঁট কামড়ে ধরেছে মিতা।
–ব্যান্ডেজ কি করবি নাকি দাঁড়িয়েই থাকবি?
মিতাকে নিজের জায়গা থেকে নড়তে না দেখে বলে অরিয়ন।
অরিয়নের কথা শুনেই তাড়াতাড়ি করে বিছানায় বসে পড়ে মিতা। বক্স খুলে তুলা, সেভলন যাবতীয় জিনিস বের করে নেয়। কেঁচি দিয়ে ব্যান্ডেজ কেটে ধীরে ধীরে খুলতে থাকে মিতা। মিতার নজর যেন অরিয়নের হাত থেকে অন্য কোথাও যাচ্ছে না।

অরিয়ন মিতার দিকে এক নজরে তাকিয়ে আছে। মিতা খুব সাবধানে কাজ করছে, যেন একটু ভুল হলেই অনেক বড় মাশুল দিতে হবে মিতাকে। কাজ কর‍তে থাকা মিতার হাত যে অনবরত কাঁপছে তা খেয়াল করতেই বুকের মধ্যে কেমন করতে লাগলো অরিয়নের। নিজের বাম হাত এগিয়ে দিতেই মিতা ভয়ে পিছিয়ে পড়ে। অরিয়নের হাত বাড়াতে দেখে আবারও চর মারবে ভেবে ভয়ে পিছিয়ে পড়ে মিতা। অরিয়ন অজানা এক দৃষ্টিতে মিতার দিকে তাকিয়ে নিজের হাত বাড়িয়ে দিয়ে মিতার গাল থেকে চুল সরিয়ে কানের পিছনে গুজে দেয়। হাতের উলটো পাশ দিয়ে মিতার গালে স্পর্শ করে অরিয়ন। থাপ্পড়ের দাগটা বার বার স্পর্শ করতে থাকে অরিয়ন।

মিতার শরীরে দেওয়া অরিয়নের দাগ দেখে কখনো এমন লাগেনি অরিয়নের। সেই দাগগুলো যেন মিতার প্রতি এক অধিকারবোধ প্রকাশ করতো কিন্তু গালের এই দাগ? এই দাগ বড্ড বেমানান লাগছে মিতার শরীরে। তার থেকেও বেশি নিজের প্রতি রাগ হচ্ছে অরিয়নের। গতকাল রাতে নিজের রুমে এসে রাগে আয়নায় একের পর এক ঘুষি মারতেই হাত ক্ষতবিক্ষত হয়ে যায় অরিয়নের। সেই ব্যাথাটা যেন কিছুই মনে হচ্ছে না অরিয়নের। ইচ্ছে করছে এই হাতটাই কে*টে ফেলতে,যে হাত মিতার গায়ে উঠেছে।

–তুই বলেছিলি..
হুট করে বলে উঠে অরিয়ন।
অরিয়নের অর্ধেক কথা শুনে অরিয়নের দিকে ভয়ে ভয়ে তাকায় মিতা।
–তুই বলেছিলি তুই আমাকে ভালোবাসিস। সত্যি ভালোবাসিস?
প্রশ্ন করে অরিয়ন।
এতোদিন পর অরিয়ন কেনো এই কথা উঠালো তা মাথায় ঢুকছে না মিতার। হ্যাঁ, মিতা অরিয়নের এই রূপকে অপছন্দ করে, ঘৃণাও করে হয়তো। তবে ভালোবাসা, ভালো তো মিতা সেই মিষ্টি অরিয়নকে বাসে যার জন্য মিতার অনুভূতি একটু ও পরিবর্তন হয়নি। মিতা মুখে কিছু না বলে মাথা নাড়িয়ে হ্যাঁ বোঝায়।
–কথাটা ভুলে যাবি না তো?
আবারও প্রশ্ন করে অরিয়ন।
এবার মাথা নাড়িয়ে না বোঝায়।
অরিয়ন আর কোনো কথা বললো না। চুপ করে রইল। মিতাও নিজের কাজে মন দিলো। হাতে ব্যান্ডেজ করা হলে আস্তে করে উঠে যায়।

–পরী?
মিতা দরজার কাছাকাছি যেতেই ডাক দেয় অরিয়ন।
অরিয়নের ডাক শুনে ফিরে তাকায় মিতা। অরিয়ন নিচে ফ্লোরের দিকে তাকিয়ে আছে।
–আই এম সো সরি,লাভ। গতকাল রাতে যা হয়েছে তার জন্য।
কেমন যেন এক করুন সুরে বলে উঠলো অরিয়ন।
অরিয়নের এই জিনিসটা সব থেকে বেশি কষ্ট দেয় মিতাকে। এই অসহায়ত্বতা। নিজের আইডল, নিজের সব থেকে পছন্দের মানুষকে এভাবে ভেঙ্গে পড়তে দেখলে হয়তো মনের মধ্যে সব তছনছ হয়ে যায়?অরিয়নের কণ্ঠ ঠিক এমনটাই শোনা গিয়েছিলো আফরিন চলে যাওয়াতে। মিতার চোখের কোণে যেন পানি নিজে নিজেই চলে আসলো। আর কোনো কথা না বলে রুম থেকে বেড়িয়ে যায় মিতা।
“ভালোবাসলে কেনো এতো কষ্ট পেতে হবে? কষ্টই যদি পেতে হবে তাহলে ভালোবাসা না থাকলেই কি হতো?” প্রশ্ন জাগে মিতার মনে।

৩ মাস পর।
সেদিনের পর থেকে অরিয়ন নিজেকে কাজে এতোটাই ব্যস্ত করে দিলো যে একে অপরের সাথে দিনে দু একবার দেখা হয়। মিতাও নিজের পড়ার দিকে মন দিয়েছে, কিছুদিন পরেই ইন্টারমিডিয়েট পরীক্ষা শুরু হবে মিতার। সেদিনের পর থেকে মিতা আর একদিনও দরজা খোলা রেখে ঘুমায় নি। আবরার আর দু জন বডিগার্ড মিতাকে সাথে করে কলেজে নিয়ে যায় আর নিয়ে আসে।
–বাংলা ব্যাকরণ কিছু শেষ করতে পেরেছিস? আমার তো কিছুই মাথায় ঢুকছে না। এখন মনে হচ্ছে ইংলিশ গ্রামার থেকে বাংলা গ্রামার বেশি কঠিন।
পড়ার টেবিলে বসে ফোনে কথা বলছিলো মিতা।
–তুই হাসিস না তো, আমার মনে হচ্ছে আমি বাংলায় ফেল করবো।
বলে মিতা।
–হা হা হা, আমি কি স্যার বাংলার জন্য রেখেছি? আমি তো রে…
মিতার কথা শেষ হওয়ার আগেই বিকট শব্দ শুনতেই দূরে ছিটকে পড়ে মিতা। জ্ঞান হারানোর আগে চোখের সামনে দেখতে পায় শুধু আগুন আর আগুন।

মিটমিট করে চোখ খুলে মিতা। মাথা আর শরীরে প্রচন্ড ব্যাথা অনুভব করছে। ভালো করে নড়তেও পারছে না।
–মিতা, মা আমার। কেমন লাগছে তোর এখন? খারাপ লাগছে কোনো? কি হয়েছে বল আমাকে।
মিতাকে চোখ খুলতে দেখেই বলতে থাকে মায়া চৌধুরী।
–প্রচন্ড ব্যাথা।
কোনোমতে জবাব দেয় মিতা।
–ব্যাথা কমে যাবে খুব তাড়াতাড়ি। বেশি কিছু হতে পারেনি। ভাগ্যিস আরিয়ান তখন নিজের রুমে ছিলো আর শব্দ পেয়েই দৌড়ে তোর রুমে গিয়েছিলো।
বলে ওয়াহিদ চৌধুরী।
–কি হয়েছিলো?
প্রশ্ন করে মিতা।
–এসি ব্লাস্ট করেছিলো। বিছানায় ছিলি না বলেই বেঁচে গিয়েছিস তা না হলে কি যে হতো।
মিতার সামনে আসতে আসতে বলে হাবিব চৌধুরী।
–তুই রেস্ট কর মিতা, কিছু ভাবতে হবে না তোর।
বলে মায়া চৌধুরী।

–হুম।
জবাব দেয় মিতা।
বিছানায় শুয়ে থাকলেও ঘুম আসছে না মিতার। রুমের দিকে তাকাতেই চিনতে পারলো সাথে সাথে। আবরারের রুমে শুয়ে আছে মিতা। আবরার যদি না থাকতো তাহলে আজ হয়তো মিতাও বেঁচে থাকতে পারতো না। অথচ রুমের কোথাও আবরারকে দেখতে পাচ্ছে না মিতা।
–পরী? পরী?
দরজা খুলেই রুমের মধ্যে প্রবেশ করে অরিয়ন। টাই আর শার্টের বাটন খোলা। যেভাবে নিঃশ্বাস নিচ্ছে মনে হচ্ছে দৌড়ে এসেছে এখানে। দৌড়ে গিয়ে বিছানায় বসেই মিতার শরীর পরীক্ষা করতে থাকে কোথায় কোথায় ব্যাথা পেয়েছে তা দেখার জন্য।

–কোথায় আঘাত পেয়েছিস? বেশি খারাপ লাগছে? এসিতে কি সমস্যা ছিলো? ফা*, সমস্যা থাকলে আগে কেনো বলিসনি? তোর যদি কিছু হয়ে যেত তাহলে? কি হয়েছে কথা বল?
একের পর এক অনবরত প্রশ্ন করে যাচ্ছে অরিয়ন।
মিতা যেন উত্তর দেওয়ার ও সময় পাচ্ছে না। অরিয়ন কেমন যেন অদ্ভুত ব্যবহার করছে মিতাকে এমন দেখে।
–ভা…ভালো আছি। কিছুই হয়নি।
ধীরে ধীরে বলে মিতা।

পারমিতা পর্ব ২০

–শান্ত হও অরিয়ন, মিতা এখন ভালো আছে। ভয়ের কিছু নেই।
বলে মায়া চৌধুরী।
–হুম।
সায় দিয়েও মিতার হাত শক্ত করে ধরে রাখলো অরিয়ন।
–তুই..তুই এখন থেকে আমার রুমে থাকবি। আমার সাথে।
হঠাৎ করে বলে উঠে অরিয়ন।

পারমিতা পর্ব ২২