রাজবধূ পর্ব ২৮
রেহানা পুতুল
“স্রস্টার ইশারা ছাড়া গাছের একটি পাতাও নড়ে না। এটা বিশ্বাস করো তুমি?”
“হ খুব করি।” বলেই শিখা এলোমেলো পায়ে ঘরের ভিতরে চলে গেলো। মানুষটি শিখার চলে যাওয়ার দিকে মোহাবিষ্ট চোখে চেয়ে রইলো।
তার খানিক পরেই রাজকে খুঁজে পেলো শিখা। দেখলো রাজ ঘরের ভিতরের পিছনের দিক থেকে আসছে। একটি রুমালে ভেজা হাত মুছে নিচ্ছে বারবার। সে ঘরের মাঝখানে দাঁড়িয়ে রইলো গোমড়া মুখে। শিখাকে দেখেই রাজ ব্যস্ত কন্ঠে বলল,
“হলদে প্রজাপতি এনিথিং রং?”
“আপনে না চেয়ারে বইসা ছিলেন? কই গেলেন?”
শিখার কন্ঠ অভিমানী। রাজ বুঝতে পারলো কিছু হয়েছে। অতি আগ্রহ নিয়ে জানতে বলল,
“আমি বাথরুমে আসছিলাম। কি হয়েছে বলো? কেউ কিছু বলেছে? আমার চাঁদমুখটায় অমাবস্যা ভর করার কারণ?”
“আপনারে মনে কইরা আমি জুবায়ের ভাইয়ারে ধইরা ফেলছি।”
প্রচন্ড ভীত ও বিরক্ত স্বরে বলল শিখা।
“ওহ হো! সেই খালি চেয়ারে তারই বসতে হলো। বড় ভাইয়ারা সামনে ছিলো বলে তোমাকে বলে আসতে পারিনি। সরি। তোমার খারাপ লাগা ও বিরক্ত হওয়াটা স্বাভাবিক। তবে এতে ভয় পাওয়ার কি? ভুলক্রমে এমন হতেই পারে। জুবায়ের আমাদের পরিবারের সদস্য। আসো আমার সঙ্গে।”
শিখা রাজের পায়ে পায়ে উঠানে গেলো। রাজের সেজো ভাই আসলাম হেসে তাকে বলে উঠল,
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
“কিরে রাজ, আজ দেখি আমাদের উঠানভর্তি সব হলদে পরীর মেলা।”
“সেটাই। সবাইকে দারুণ লাগছে।”
প্রাণোচ্ছল হেসে বলল রাজ।
“না। সবচেয়ে দারুণ লাগছে রাজ ভাইয়ের বউরে। যেন স্বর্গ থেইকা হুরপরী মর্ত্যে নাইমা আইলো। তবে আপনাদের সবাইকেও বাসন্তী রঙের পাঞ্জাবী ও পাজামায় সুন্দর লাগছে। মনে হয় এখানে সিনেমার শুটিং চলতাছে।”
রিনরিনিয়ে হেসে বলল রাজের এক কলেজ পড়ুয়া খালাতো বোন লিমা।
জুবায়েরের নানী হারিছা বলল,
“ঠিকই কইছত বইন। রাজের বউরেই চাঁদের টুকরার লাহান লাগতাছে। ওই রাজ, বউর কানের লতির নিচে তোর হাতে, পাড়া কাজল লাগাইয়া দে। তাইলে কারো নজর লাগব না।”
“ইয়েস নানু। দিচ্ছি একটু পরেই।”
সীমান্ত এক পাশে দাঁড়িয়ে নিজের মত করে অনুষ্ঠান উপভোগ করছে। সে হারিছাকে বলল,
“আজ দেখি আমাদের নানুও ম্যাচিং ম্যাচিং। হলদে বুড়িরে বিয়ে দেওয়া যাবে।”
” হ বিয়া তোর কাছে বইমু। যেন আমার সেবা কইরতে পারস। আমার নাতি সক্কলের হলুদ কাপড় কিনলো। আর আমার লাইগা আনব না?”
সীমান্ত বলল,
“আমি চিরকুমার থাকবো। তবুও তোমারে নয়। তোমার সব জায়গা জমি আমার নামে লিখে দিলেও নয়।”
রাজের সেজো ভাবি সীমান্তের চুলগুলো নেড়ে দিয়ে বলল,
“ওরে আমার দেবরটা। কি সিরিয়াস হইয়া গ্যালো। রসিকতা বুঝল না।”
ভাড়া করা ফটোগ্রাফার ও ক্যামেরাম্যানও চলে এলো আরো আগেই। এসব ম্যানেজ করেছে রাজ নিজেই। বিভিন্ন পোজে আদুরী ও অন্যরা ছবি তুলতে লাগলো তাদের নির্দেশনা অনুযায়ী। ভিড়িও শুট করাও শুরু হয়ে গেলো। তালুকদার পরিবারের একমাত্র কন্যার বিয়ে বলে বলে কথা।
রাজ শিখাকে নিয়ে নিজের বসা চেয়ারটায় সামনে চলে গেলো। দেখলো জুবায়ের বসে আছে পায়ের উপর পা তুলে। তার গায়েও হলুদের পাঞ্জাবী, পায়জামা। রাজ শিখাকে নিয়ে পাশাপাশি দুটো চেয়ারে বসলো। জুবায়েরের পিঠে চাপড় মেরে বলল,
“এই তুই আমার বউকে ভয় পাইয়ে দিলি কেন?”
“কিভাবে?”
কৌতুহলমিশ্রিত কন্ঠে বলল জুবায়ের।
“ও তোকে আমি ভেবে ধরে ফেলল যে?”
“এই চেয়ারে তুই বসা ছিলি আমি জানতাম ? নাম লিখে গেলিনা কেন? আর যদি তাই হতো , তাহলে এখানে বীরের মতো বসে থাকতাম? পালিয়ে যেতাম না? বল?”
চাপাহাসি দিয়ে প্রশ্ন করলো জুবায়ের।
“হুম। তোর কথা লজিক্যাল?”
জুবায়েরকে রাজ সকালেই বলে দিয়েছে যেন গায়ে হলুদের অনুষ্ঠানে পৌঁছে যায়। তাই জুবায়ের বাড়িতে এসেই নিজের রুমে ঝটপট তৈরি হয়ে নিলো। বের হয়ে উঠান ভর্তি মানুষের ভীড় ঠেলে পিছনে গেলো। খালি চেয়ার চোখে পড়তেই বসে পড়লো। সে জানতো না এটায় রাজ বসা ছিলো।
“শিখা আমাকে তেমন দেখেনি বলেই ভয় পেয়েছে হয়তো।”
হেসে বলল জুবায়ের। রাজ শিখার দিকে দৃষ্টি ঘুরিয়ে চাইলো। বলল,
“তুমি জুবায়েরকে আর দেখনি?”
“নাহ। খালি দুইবার দেখছি সামান্য সময়। এর লাইগায় ডরাইছি।”
জুবায়ের বলল,
“আমি সকালে যাই। রাতে ফিরি। না দেখাই স্বাভাবিক।”
“এখন শিখার ভয় কাটানোর জন্য কি করা যায়?” বলল রাজ।
“আমার নানুরে এটার মাসালা জিজ্ঞেস কর।”
রাজ জুবায়েরের নানুকে ডাক দিলো। তিনি গিয়ে বসলো তাদের পাশে। রাজ বলল সব। শুনে তিনি বললেন,
“জুবায়ের শিখারে ভালো করে ছুঁইয়া দে। ডর ছুইটা যাইবো। আমরার ছোড়কালে এমুন যারে দেইখা ডরাইতাম, মা তার কাছে নিয়া যাইতো আবার। তারে দিয়া শরীর ছোঁয়াইয়া দিতো। আর ডর বাপ বাপ কইরা পালাইতো।”
জুবায়ের ও রাজ চুপ করে আছে। শিখা বলল,
“নাহ লাগব না এইটা।”
“ক্যান বইন? কি হইছে? তোমার হাতটা ছুঁইয়া দেক জুবায়ের। দেখবা হের পর আর ডরাইবা না তারে দেখলে। রাজ জন্মানোর পনেরোদিন পরেই জুবায়ের হইছে। ওরা দুইজন দোস্ত। ল্যাংটা কাল ধইরাই দুইটার খাতির ম্যালা। জুবায়েরের লগে লগে এই রাজেরে কম পালিনাই আমি। কম খাটিনাই। জিগাও তোমার সোয়ামিরে।”
রাজ বলে উঠলো,
“হ্যাঁ। নানুর বলা সত্যি।”
জুবায়ের উঠে দাঁড়ালো। বলল,
“এই নানু থাক। ছোঁয়াছুঁয়ির কাজ নেই। এমনিতেই ওর ভয় কেটে যাবে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে।”
তারপর জুবায়ের তার পাঞ্জাবীর এক পকেটে হাত গুঁজে শশব্যস্ত হয়ে স্থান ত্যাগ করলো।
“কিরে কই যাস? আমরা গ্রুপ ফটো তুলব।” বলল রাজ।
“আসতেছি”
গলা বাড়িয়ে বলল জুবায়ের।
রাজ শিখাকে বলল,
“তুমি নানুর সঙ্গে গল্প করো। আমু আদুরীকে হলুদ লাগিয়ে আসি।”
“আঃ অহনও দেসনাই? ত্বরা কইরা যা। তোর সখীরে আমি পাহারা দিমুনি।”
রাজ উঠে হলুদের স্টেজে গেলো। দেখলো বোনের মন খারাপ। রাজ আদুরীর কপালে হলুদ লাগিয়ে দিলো। মিষ্টি খাইয়ে দিলো কাঁটাচামচে গেঁথে। আদুরীর চোখ ছলছল করে উঠলো ভাইকে দেখে। রাজ বলল,
“পাগলী। মন খারাপ কেন? আমরা সবাই তোকে দেখতে যাবো সবসময়। তুই সুখে থাকবি। তোর ভাবি তোকে হলুদ দিয়েছে?
“না থাক। তার দেওয়া লাগব না। সবাই ত দিছে।”
মলিন মুখে বলল আদুরী।
“তুই বললেই হলো। তার একমাত্র ননদ তুই। হলুদ লাগাবে না?”
রাজ এসে শিখাকে ডেকে নিলো। শিখা আদুরীর দুই গালে ও কপালে মিষ্টি হাসি ছড়িয়ে হলুদ লাগিয়ে দিলো। আদুরী বোবামুখে বসে রইলো। রাজ বুঝল,বোন স্বশুর বাড়ি চলে যাবে। মন খারাপ। তাই শিখার সাথে কথা বলল না। কিন্তু শিখা জানে বিষয়টা মোটেও তা নয়। তাকে দেখতে পারেনা আদুরী। তাই মুখ অমন গোঁজ করে রাখলো। যেটা রাজ জানেই না। সেও বলেনি। তখন জুবায়ের এসেও আদুরীকে গায়ে হলুদ দিয়ে দিলো।
তারপর সেসহ পরিবারের সবাই মিলে বিভিন্নভাবে,বিভিন্ন স্টাইলে ছবি তুলল। রাজের ব্যক্তিগত ক্যামেরা রয়েছে। রাজ সেটা অন্যের হাতে দিয়েও ছবি তুলেছে শিখাকে নিয়ে। সে দুটো রিল কিনে নিয়েছে৷ কারণ একটা রিলে মাত্র ছত্রিশটা ছবি তোলা যায়।
হলুদের অনুষ্ঠান সমাপ্তি হলো। উঠানেই নৈশভোজ সেরে নিলো সবাই। আদুরীসহ সবাই ঘরে চলে গেলো। মুরুব্বিরা যার যার মতো ঘুমিয়ে গেলো।
রাজের নির্দেশে বৈঠকখানা হতে উঠানে সাদাকালো একুশ ইঞ্চির টিভিটা বের করে নেওয়া হলো। সেন্টার টেবিল নেওয়া হলো। ভিসিয়ার সেট বের করা হলো। সে বিকালেই বাদশাকে পাঠিয়ে হিন্দি ও বাংলা দুটো ক্যাসেট ভাড়া আনলো। একটা ক্যাসেট একদিনের জন্য ভাড়া পয়ঁত্রিশ টাকা। টিভি চালু হলো। ভিসিয়ার সেট টিভির সঙ্গে কানেক্ট করলো। তার ভিতরে ক্যাসেট দেওয়া হলো।
এ সবই করলো সীমান্ত। সে টেকনিক্যাল কাজগুলো ভালো পারে।
মানুষ বরারবর উঠানের দুইপাশে বড় দুইটা ভাড়া করা স্ট্যান্ড ফ্যান সেট করা হয়েছে। ফ্যান দুটো অনবরত ঘুরে ঘুরে হাওয়া বিলিয়ে যাচ্ছে সবাইকে।সামনের চেয়ারগুলোতে উপবিষ্ট রয়েছে খালেদ,আসলাম, রাজ,জুবায়ের, সীমান্ত,রানী,সুমনা, ডলি, শিখা,লিমা,বাদশা,ফুলবানু,জোছনা,বরকত ও ছোট, বড় আরো অনেকে।
মতির মা সবার জন্য কেটলি ভরে রঙ চা বানিয়ে দিলো। সঙ্গে কালিজিরা বিস্কুট। রাজ ও জুবায়ের পাশাপাশি চেয়ারে বসা। শিখা ও লিমা পাশাপাশি চেয়ারে বসা। সিনেমা শুরু হয়ে গেলো।
গ্রীষ্মের উষ্ণ রজনী। হাজারো লাল,নীল,হলুদ, সবুজ বাতির ঝিলিক মারা আলোয় বিয়ে বাড়ির পরিবেশ ঝলমলে! উৎসবমুখর। সিনেমা শুরু হয়ে গেলো। একানব্বই সালের সাড়া জাগানো বাংলা সিনেমা ‘চাঁদনী’। শাবনাজ, নাঈম জুটি। সবার উল্লসিত চাহনি টিভি স্ক্রিনের উপর। রোমান্টিক দৃশ্য ও গানগুলো শুরু হলে শিখা মুখ টিপে হাসতে থাকে।
“কন্যার বয়স কি ষোল, পাত্র উনিশ বছরের। কখন তাদের প্রেম হয়ে গেলো কেউ তা বুঝেওনি….”
” ও আমার জান তোর বাঁশি বুঝি যাদু জানেরে….”
“বন্ধুর বাঁশি বাঁজেরে আমার কানে কানে…”
রাজ একটু পরপর শিখাকে দেখছে প্রেমিক চাহনিতে। জুবায়ের রাজকে বলল,
“ঘাড় বাঁকা করিস না। ওকে তোর পাশে বসা। আমি অন্য চেয়ারে যাই।”
“আরেহ ভাইয়ারা আছে। বেক্কল। তুই থাক।”
হিসহিসিয়ে বলল রাজ।
জোছনা এসে রাজকে বলল,
“ভাইজান, ভাবির জন্য অন্যরুম রেডি হইছে। জেঠি কইছে আপনারে জানাইয়া যাইতে।”
জোছনা চলে গেলে জুবায়ের তার জোড়া ভ্রুযুগল কুঞ্চিত করে জিজ্ঞেস করলো,
“কিসের রুম ঠিক করলো? বুঝলাম না।”
রাজ বলল সব।
“ওহ!বুঝলাম।”
রাজ এক মিনিট, বলে উঠে গেলো দোতলায়। সেই সুযোগে একজোড়া তৃষিত চোখ ঘাড় ঘুরিয়ে শিখাকে দেখলো পলকহীনভাবে। শিখা কিন্তু তাকে দেখেনি। রাজ খানিক পরেই ফিরে এসে বসলো।
রাত্রির শেষ প্রহর। সিনেমা শেষ হয়ে গেলো। সবাই নেশাখোরের মতো টলতে টলতে নিজ নিজ কক্ষে গিয়ে নিদ্রায় ডুবে গেলো। রাজ শিখাকে নিয়ে ঘরের পিছনে একটু অন্ধকারে গেলো। বলল,
“ভিতরটা মরুভূমি হয়ে যাচ্ছে। দু ‘এক ফোঁটা জল দিয়ে পথিককে বাঁচিয়ে তোলো না।”
শিখা অবোধ চোখে অন্যদিকে চাইলো। রাজ শিখার দু’গালে গাঢ় চুম্বন করলো। শিখার ব্লাউজের ভিতরে একটি ছোট্ট চিরকুট গুঁজে দিলো। শিখা তব্দা খেলো। কিন্তু কিছু জিজ্ঞেস করার ও পড়ার সময় সুযোগ পেলনা। তার পূর্বেই রাজ শিখাকে বলল,
“আসো তোমার রুম কোনটা দেখি।”
শিখা গুরু শিষ্যের ন্যায় রাজের পিছন পিছন গেলো। ঘরের ভিতরের পিছনের বারান্দা লাগোয়া একটি রুম পরিপাটি করে তৈরি হলো। নতুন বিছানা চাদর খাটে পাতা হলো। রাজের পছন্দ হলো।
বলল,
“এখন ত অনেক গেস্ট। কয়েকজন মিলে ঘুমাও। কেমন লক্ষিটি। আমি এবার যাই?”
শিখা ঘাড় হেলিয়ে সম্মতি দিলে রাজ উপরে চলে গেলো। শিখা তড়িতেই ব্লাউজের ভিতর হতে কাগজটি বের করলো।
“প্রজাপতি, সেদিন পথের ধারে আমার গোলাপটা ওভাবে ছিঁড়ে ফেলে দিলে কেন? আর কেনই বা নিজের মানুষটাকে চিনতে পারনি? তুমি আমার এতটাই শখের, এতটাই প্রিয়। তোমার ছায়া দেখলেও আমি ঠিক চিনে নিতে পারবো।”
শিখা আশ্চর্য হয়ে গেলো। মনে মনে বলল,
আপনে একটা মস্তবড় শয়তান পুরুষ। দাঁড়ান দেখাচ্ছি মজা। বলে লিমাকে দিয়ে একটা কলম যোগাড় করলো। চিরকুটের বিপরীত পিঠে জবাব লিখলো। লিমাকে বলল,
“আপনার খালাতো ভাইরে এইটা দিয়া আসেন না আপু।”
লিমা মুচকি হেসে এক দৌড়ে দোতলায় উঠে গেলো। রাজের রুমের দরজা বন্ধ। সে জানালা দিয়ে,
“এইযে নেন, উনি দিয়েছে। বলেই লিমা পালংকের উপরে ছুঁড়ে মারলো কাগজটি।”
রাজ হাতে নিয়ে মেলে ধরলো চিরকুটটি।
“যে চোরের মতো রাতের আঁধারে বউয়ের পায়ে মলম লাগিয়ে চলে যায়। যে দিনের আলোতে ডাকাতের মতো ছদ্মবেশ ধারণ করে। তাকে চিনতে না পারাই ঠিক আছে।”
রাজ খালি রুমে শব্দ করে হেসে উঠলো। ইসস কবে যে সুখ পাখিটাকে বুকে নিয়ে ঘুমাতে পারবো। ভেবেই দপ করে বিছানায় পড়লো।
ছোট তালুকদারের মন মেজাজ বিক্ষিপ্ত! ভীতসন্ত্রস্ত! যারফলে গায়ে হলুদের আয়োজনটাও ঠিকভাবে উপভোগ করতে পারেনি। একটু শরীর খারাপ, এই বলে সবার থেকে গা বাঁচিয়ে নিজের কক্ষে রয়েছে। সে নানা ফন্দী ফিকির করছে আংটি নিয়ে। এই মেয়ের হাতে চলে গিয়েছে তার হাতের আংটি। রাজ বাড়িতে। সবাই বাড়িতে। এই মেয়ে যদি আসল ঘটনা খুলে বলে তাহলে জিন্দেগী এখানেই খতম। যেমন মা তেমন মেয়ে। পুরাই দাবানল। একটা তুচ্ছ মেয়ের মুখের কথাকে বিশ্বাস করে অঢেল সম্পত্তির মালিক খায়রুল তালুকদারের মর্যাদা এভাবে ধূলিসাৎ হয়ে যেতে পারে না। বরং তার মুখের কথা সবাই বিশ্বাস করবে এমন কিছুই বলতে হবে। এমন চিন্তা করতে করতে তার মাথা খেলে গেলো।
এইতো পেয়ে গিয়েছি। এই মেয়ে আংটি চোর। মহাচোর। জোচ্চর!
তার পরেরদিন অর্থাৎ বিয়ের আগের দিন বাড়িতে আরো নিকটজনেরা আসতে লাগলো। শিখার মা নূরীও চলে এলো। তার বড় মেয়ে ও জামাই আসবে বিয়ের দিন সকালে। নূরী নিজের কানের দুল ভেঙে আদুরীর জন্য চার আনার একটি সোনার আংটি গড়ে নিলো স্বর্ণকার দোকানে গিয়ে। অভাব তার ঘরে। তার জীবনে। সামাজিকতা ও আত্মীয়তার মান রাখতে সে বদ্ধ পরিকর। শিখার রুম দেখে নূরী বেশ খুশী হলো। সব রুমে অতিথিরা গিজগিজ করছে। তাই শিখা মাকে নিয়ে পুকুর পাড়ে নিরিবিলি স্থানের দিকে চলে গেলো। সে উপরে উপরে হাসিখুশি থাকলেও তার মন পড়েছিলো মায়ের কাছে। মা কখন আসবে এই প্রতিক্ষায় ছিলো সে। শিখা মাকে আংটির কথা ডিটেইলস বলল। মতির মাকে জানালো তাও বলল। রাজ ও অন্যকেউই জানে না তাও বলল।
নূরী পাশে থাকা ডালিম গাছের ডালটি ধরে ফেলল। মাথায় হাত দিয়ে ঘাসের উপর বসে পড়লো। শিখাও মায়ের সঙ্গে বসে পড়লো। নূরীর শরীরের সমস্ত শিরা উপশিরাগুলো দাপাদাপি করতে লাগলো। মাথার মগজগুলো টগবগিয়ে ফুটতে শুরু করলো। শিখা বলল,
“এই লুইচ্চা বুইড়ারে ক্যামনে শাস্তি দেওন যায় আম্মা?”
“তুই এইটা নিয়া ভাবিস না। জামাইরে নিয়া আনন্দে ফুর্তিতে থাহিস। শহরে বাস করা পোলা। গেরামের বউয়ের থেইকা মন ছুইট্টা যাইতে সময় লাগব না। আর বেডার বিষয়ে তোর মায়ের উপর ভরসা কইরা ছাইড়া দে। নূরীর নিষ্পাপ মাইয়ার বুকে যে অসৎ হাতের ছোঁয়া পড়ছে সেই হাত আমি কুচি কুচি কইরা ফালামু!”
দাঁতে দাঁত পিষে চোখ কটমট করে বলল নূরী। জোছনা শিখাকে ডাকতে ডাকতে এগিয়ে গেলো।
“এই যে ভাবিজান, লন। রাজ ভাই দিলো। পিরিতের চিঠি আপনের।”
জোছনা কাগজটি শিখার হাতে দিয়ে কাজের তাড়ায় পা ঘুরিয়ে বাড়ির অন্দরে চলে এলো। নূরী বলল,
“কিরে মা?”
“আরেহ আম্মা,উনি আমার সঙ্গে বাড়িতে থেকেই চিঠি চালাচালি করে। পলাপলি খেলার মতন।”
নূরী শান্ত গলায় বলল,
“তাইলে যা। উত্তর দে। আমি এইখানে গাছতলায় কিছুক্ষণ থাকি। মাথা ভনভন করতাছে।”
শিখা চলে আসে বাড়ির দিকে। বাদশা বাগানের ভিতর দিয়ে লুকিয়ে নূরীর সামনে গিয়ে দাঁড়ায়। সালাম দিয়ে আস্তে করে নূরীকে বলল,
“খালাম্মা, আমার সব পাক্কা। আদুরীরে তুইলা নিলেই আপনের কামটা সারতে চাই। সুযোগ মেলান বড় টাফ।”
“আমিও একশো পার্সেন্ট রেডি বাদশা মিয়া। তবে পারলে তারে আমি এখনই মাটির নিচে জিন্দা গাঁড়াইয়া ফালাই।”
রাজবধূ পর্ব ২৭
নূরীর চোখ ভর্তি একশো চুল্লী দাউদাউ করে জ্বলছে। বাদশা নূরীর সেই জ্বলন্ত চোখের দিকে চেয়ে মনে মনে বলল,
“হ* ত্যা আমি নয়। আপনারে দিয়েই করামু।”