খেয়ালি আমি হেয়ালি তুমি পর্ব ১৪
আনিকা আয়াত
কপাল কুঁচকে ভাবল এটা কোন চৈতী? সেই চুমকি? নাকি অন্য কেউ? মস্তিষ্কে উল্টাপাল্টা চিন্তা করে, পরক্ষণেই সে নিজেকে বুঝাল চুমকি নয়। বরং অন্যকেউ মনে করে, বেশী মাথা ঘাঁটাতে চাইল না।কিন্তু অবাধ্য মন কি তার কথা শুনে? দিব্যি হাঁসফাঁস করে উঠল মেয়েটাকে দেখার লোভে।মনে পড়ল, চুমকিও কি বাকিদের মতো নিজেকে অন্য রূপে সাজিয়েছে? শাড়ি পড়েছে? যদি পড়ে-ই থাকে কেমন দেখাচ্ছে তাকে? এক পলক দেখাই যায়! আজ যে, দেখা হয়নি। সে কি আমাকে দেখেছে? মনে হাজার কল্পনা জল্পনা নিয়ে, সে এলোমেলো দৃষ্টি ফেললো চারপাশ।
তার ভেতরের ব্যাকুলতা নিয়ে ধারালো সু/চের মতো চোখ দুটি এত মানুষের ভীরেও খুঁজতে লাগলো চৈতী কে। একপলক দেখার আশায় কেনো জানি হঠাৎ করে অস্থির লাগা শুরু করছে। মনে হচ্ছে, এই তৃষ্ণা মিটবে ওই মেয়েটার মুখ এক পলক দেখলেই। নয়তো, ভয়ানক অস্থিরতা থেকে আজ নিস্তার নেই।
মেয়েটিকে যখন একজোড়া তীক্ষ্ণ চোখ খুঁজে চলছে অথচ মেয়েটি অস্বস্তি -ভয়ে নিজেকে গুটিয়ে নিয়েছে। জিনিয়া কাঁধে হাত বুলিয়ে দিলেও সহজ হতে পারছে না। বার-বার বলছে,
“ জিনিয়া..! এত লোকের সামনে দাঁড়িয়ে একটা কথাও বলতে পারবো না। এখন কি করবো? ”
“ তুই দাঁড়া। মনে কর এখানে শুধু ই আমরা। চুপচাপ হেঁটে স্টেজ উঠে বক্তৃতা দিয়ে চলে আসবি। ”
চৈতী জিনিয়ার হাত খামচে ধরে আছে। ভয়ার্ত মুখে অর্পণের অস্থির চোখের দিকে তাকিয়ে হালকা ঢোক গিললো। ধীরে ধীরে সময় গড়ায় কিন্তু মেয়েটির নড়চড় নেই। স্নিগ্ধা নিচু স্বরে ধমকে উঠলো। হাত টেনে নিয়ে বলল,
“ চল। এত লজ্জা নিয়ে বেঁচে আছিস কিভাবে? তোর তো ম/রে যাওয়া উচিৎ! সাধারণ উপস্থাপন করতে ভয় পাচ্ছে সে নাকি ডান্স করবে। ঢং! ডান্সের বেলায় এমন করলে ভালো হবেনা বলছি। ”
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
চৈতীকে নিয়ে উঠে ব্যস্তপায়ে স্টেজের উদ্দেশ্যে সামনে আসতেই অর্পণের চোখ আটকায় চৈতীর ভীতু মুখে। শাড়ির মাঝে সুনিপুণ ভাবে নিজেকে ঢেকে রেখেছে নাজুক নারীটি। অর্পণের দৃষ্টি আরোও গভীর হলো। মেয়েটির মুখ দেখেই বুঝা যাচ্ছে অস্বস্তিতে ভুগছে। মাথা নত করে হাত মুচড়ে যাচ্ছে অনবরত। পা থেকে মাথা অব্দি খুটিয়ে খুঁটিয়ে দেখে ভ্রু কুঁচকে তাকায় অর্পণ। আনমনেই ঠোঁটের কোনে হাঁসি ফুটে উঠে। বুকের ভেতরের যন্ত্রটা ও আজ নিজের সাথে বিরোধীতা করে অস্বাভাবিক ভাবে ধক ধক শব্দ করল। এত লোকের মাঝেও স্পষ্ট শুনতে পেলো সেই অস্থির হৃৎস্পন্দন। আকুল হৃদয়কে শাসিয়ে মনে মনে বলল,
“ হাতুড়ি পিটানো থামা ভাই..! সামনের মেয়েটি যে শুনতে পাবে। আমার ইজ্জত বলতেও একটি কথা আছে!”
মাইকে চৈতীর কম্পিত কণ্ঠ পেয়ে সম্বিত ফিরে পেলো ছেলেটা। কখন যে দুকদম পিছিয়ে মেয়েটাকে জায়গা করে দিয়েছে তাও খেয়াল নেই। নিজের ভাবনায় আশ্চর্য হলো অর্পণ। চোখ সরিয়ে দৃষ্টি ঘুরাতেই এতক্ষণ হৃদয়ে অদ্ভুত শান্তি লাগার বদলে চোখ-মুখ শক্ত হলো। ভার্সিটির কিছু ছেলে নাঁকা ঘুষা করছে চৈতীকে নিয়ে। মেজাজ চটে যায় ছেলেটার। চৈতী ধীরে ধীরে সম্পূর্ণ স্কিপ শেষ করার আগেই অর্পণ মাইক সরিয়ে নেয়। মেয়েটি হকচকিয়ে উঠে। চট করে পাশে তাকাতেই চোখাচোখি হয় দুজনের। তৎক্ষনাৎ অর্পণ বাঁকা হেঁসে মাইকে জানালো, অল্প বক্তৃতায় কথা শেষ করা ভালো। তাছাড়া চৈতী এখন যেতে পারে। কিছুক্ষণের মধ্যেই গান শুরু হবে।
প্যান্ডেল ভর্তি মানুষের সামনে অপমান! লজ্জায় আড়ষ্ট হয়ে তরতরিয়ে রাগ উঠে যায় মেয়েটির। এমনিতেই এতক্ষণ অস্বস্তি তে কথা বলতে বেগ পেতে হচ্ছিল। এবার একটু নিজেকে স্বাভাবিক করার সর্বোচ্চ প্রয়াস চালিয়ে যাচ্ছিল। আর শেষ সময় এসে এই ছেলে বরবাদ করে দিলো।
দাঁতে দাঁত চেপে হিংস্র চোখে তাকায়। উপস্থিত সবাই প্রশংসাও করল বটে! প্রিন্সিপাল স্যারের মুখে হাঁসি লক্ষ্য করে চৈতী তর্কে জড়ায় না। অনুষ্ঠানে এত লোকের সামনে বেয়াদবি হবে ভেবে চুপচাপ ধপধপ পায়ে নেমে গেলো। এবার তার লজ্জা করছে না। বরং রাগে গজগজ করছে সারা শরীর। ইচ্ছে করছে, লোকটার মুখ থেঁতলে দিতে। হনহনিয়ে হাঁটার সময় হঠাৎ কয়েকটি সিনিয়র ছেলে সামনে পথ আটকে দাঁড়াল। রাগান্বিত চৈতীর উদ্দেশ্যে বলল,
“ হেই অপ্সরা! তুমি ফাস্ট ইয়ার? ”
চৈতীর উত্তর দেওয়ার বিন্দু মাত্র ইচ্ছে নেই। সে পাশ কেটে যাওয়ার চেষ্টা করল। কিন্তু সফল হলো না। উল্টো ছেলেগুলো আরোও গা ঘেঁষার চেষ্টা করছে। মেয়েটা দমে গিয়ে বলল,
“ জি। এবার পথ ছাড়ুন। ”
“ আরেহ। শান্ত হয়ে দাঁড়াও। দুটো কথা বলি সুন্দরী। ”
রাগে গা পিত্তি জ্বলে গেলো চৈতীর। বলল,
“ কথা বলার বিন্দুমাত্র ইচ্ছে নেই। বিরক্ত করবেন না। নয়তো স্যার-কে জানাতে বাধ্য হব। ”
ছেলেগুলোর দৃষ্টি প্রখর হলো। ঢাকার নামি-দামি বাপের বখে যাওয়া ছেলেটি কিছু না ভেবেই চৈতীর হাত চেপে ধরে হিসহিসিয়ে বলল,
“ তেজী মেয়ে খুব ভাল্লাগে আমার। কি জানি বললি? স্যার-কে জানাবি? শুনি দেখি কি বলবি।”
অজানা ভয়ে এবার চৈতীর অন্তর আত্মা কেঁপে ওঠে। হাত মুচড়া মুচড়ি করে এক ঝটকায় ছাড়িয়ে যেতে নেয়। দূর থেকে শ্রাবণ ব্যাপারটা খেয়াল করেই দৌঁড়ে আসছে। কিন্তু স্টেজের উপর দুটি শক্ত চোখ এই দৃশ্য দেখে জ্বলে উঠল। মাইকে চিৎকার করে বলল,
“ শান্ত! আমি তোর দৃষ্টি আকর্ষণ করছি। ভরা লোকসমাগমে তুই একটি মেয়েকে উত্ত্যক্ত করছিস। চুপচাপ মেয়েটাকে যেতে দে। ফলাফল ভালো হবে না। অনুষ্ঠানের পর এই ব্যাপারে আলোচনা হবে। ভার্সিটির ভেতর কোনো নোংরামী চলবে না।”
অর্পণের গর্জনে পুরো ক্যাম্পসের শান্তশিষ্ট অবস্থা মুহুর্তেই হইচই বেঁধে যায়। প্রিন্সিপাল দ্রুত ব্যাপারটা অর্পণকে দেখতে বলল। ছেলেগুলো রাগান্বিত হয়ে চোয়াল শক্ত করে অর্পণের দিকে তাকিয়ে হনহনিয়ে চলে যায়। ততক্ষনে সবাই কৌতুহল বশত উঠে দাঁড়িয়ে তাদের বাঁকা চোখে দেখছে । চৈতী রাগে দুঃখে কান্না পেলো। আজকের দিনটা সে যতটা স্বপ্নের মতো ভেবেছিল তার কিছুই হলো না। উল্টো এই দিনের মতো বিশ্রী দিন তার জীবনে একটাও নেই। চোখে নোনাজল ভরে উঠায় আলতো হাতে মুছে নিলো। সামনে পা বাড়াতেই শ্রাবণ ধরে নিয়ে চেয়ারে বসালো৷ স্নিগ্ধা জরিয়ে ধরে বলল,
“ ছেলেগুলো কি বলছিল?”
“ কিছু না। বাদ দে।”
ফোঁস করে নিশ্বাস ফেললো স্নিগ্ধা। জিজ্ঞেস করে,
“ উপস্থাপন সুন্দর করছিলি। কিন্তু অর্পণ শেষ পর্যায়ে থামিয়ে দিলো কেনো?”
“ ভালো লাগছে না। ”
চৈতী শক্ত মুখে বসে রইলো চুপচাপ। বক্তৃতা শেষে গানের পালা শুরু হয়। অর্পণের গ্যাং গান করবে শুনতেই চারপাশের সবাই চিৎকার করে উঠে। হইহই করে করতালির শব্দে মুখরিত হয়। স্নিগ্ধা নড়েচড়ে মুখ মুচড়ে বলল,
“ ছাগলের গলায় ওরা গান গাইবে? সেই গান কি আধোও শুনার যোগ্য হবে?”
জিনিয়া আনমনেই বলল,
“ হয়তো আসলেই ভালো গায়। শিহাব নামের ছেলেটা সারাদিন গিটার নিয়ে ঘুরে। ”
স্টেজে তৎক্ষনাৎ শুরু হলো গিটারের শব্দ। অর্পণ সহ বাকি ৪ বন্ধু। তারা একসাথে মিলে গেয়ে উঠে “ কিছু হিন্দি রিমিক্স ” গান। চৈতী থমথমে মুখে এক পলক তাকাল অর্পণের পানে। তৎক্ষনাৎ লজ্জায় থতমত খেয়ে যায় বেচারী। গাল দুটি লাল হয়ে মাথা নুইয়ে রাখল। কারণ ছেলেটা যে ওর পানেই তাকিয়ে গান গাইছে। চোখের ভুল ভেবে আবারোও সে চো/রা চোখে স্টেজে তাকায়। পরক্ষণেই দ্বিতীয় বারে মতো থতমত খায়। এটা দেখার ভুল নয়। এ যে সত্যি! কিন্তু অর্পণ কেনো তার দিকে তাকিয়ে আছে? নাকি দূর থেকে তার ভুল ধারণা তৈরি হচ্ছে?
কিছুক্ষণ পর গান শেষ হলে চারপাশ হাই-হ্যালো’র শব্দ এবং করতালি তে পরিবেশ মুহূর্তেই জমজমাট হয়ে উঠে। অর্পণ আর শিহাবের গানের গলা অসাধারণ!
সব আয়োজনের পর নাচের পালা শুরু হয়। প্রথমে দলীয়ভাবে ফাইনাল ইয়ার থেকে তৃধা এবং পৃথা নাচে স্টেজ কাঁপিয়ে বেড়াল।
বরাবরের মতোই এবারও দুজন প্রতিটি মানুষের হৃদয় ভরিয়ে দিল। কারণ মেয়ে দুটো যে, আসলেই অসাধারণ ডান্স করে। তাদের ডান্স করার মাঝেই, রিয়াদ স্যার কর্নারে বসেই বাঁকা হাঁসলো। তাকিয়ে রইলো অনিমেষ। তৃধার রূপ যৌবন এবং আজকের দেহ বাঁকিয়ে ডান্স স্যারের কঠিন হৃদয় যেনো গুঁড়িয়ে দিল। শীতল চোখে তৃধার নৃত্যে নিজেকে খোঁজায় সে ম/রিয়া। সে কোনো এক কল্পনার জগতে হারিয়ে গেল। মেয়েটা যে প্রতিদিন কৌশলে নিজের রূপ, কথায় তাকে একটু একটু করে গভীরভাবে বশ করছে। এতদিন সহ্য করলেও আজ সহ্য হলো না। সে উঠে দাঁড়াল। অস্থির পায়ে হেঁটে এগিয়ে গেলো স্টেজের পাশে। পরপর দুটি গানে নৃত্য করে থামলো তারা। ঠোঁটে বিজয়ী হাঁসি নিয়ে তৃধা অস্থির নয়নে সামনে তাকায়। মুহূর্তেই হাঁসফাঁস করে উঠে ভেতরটা। রিয়াদ স্যারের কি হলো কে জানে? বাচ্চাদের মতো চোখ দিয়ে ইশারা করে ওয়াশরুমের পানে অস্থিরতায় হাঁটা ধরল। তৃধার খুশি কে দেখে। পৃথার বাহু খামচে ধরে বলল,
“ স্যার আমাকে চোখের ইশারায় তার কাছে যেতে বলেছে দোস্ত। নিশ্চয়ই প্রপোজ করবে। ”
পৃথা খিলখিল করে হাঁসলো। তাদের উপরের এত মানুষের নজর লুকিয়ে ফিসফিস করে বলল,
“ সাবধানে দোস্ত। আবার যেনো লোভ সামলাতে না পেরে খেয়ে টেয়ে ফেলে না। ”
“ যাহ শয়-তান। লজ্জা পাই না?”
“ এহহ! ঢং। ”
স্যার-রা সবাই প্রশংসায় পঞ্চমুখ তাদের নৃত্যে। সমুদ্র চারপাশের সুন্দরী মেয়েদের সঙ্গে চুটিয়ে ফ্লার্ট করছে!
সকলের দৃষ্টি লুকিয়ে অদ্ভুত উত্তেজনায় বরফের ন্যায় হিম শীতল হয়ে আসা দেহ নিয়ে পা টিপে টিপে তৃধা ওয়াশরুমে নিকট হাঁটা ধরল। একদিকে খুশি আরেকদিকে অস্বাভাবিক অস্থিরতা এবং লজ্জা তাকে ভয়াবহ ভাবে গ্রাস করল। মেয়েটার দেহ কাঁপছে। জোরে হাঁটলেও মনে হচ্ছে পথ ফোরাচ্ছে না। তৃধা ঘনঘন কয়েকটা শ্বাস ফেলে দুতালার বিল্ডিংয়ের দিকে এগিয়ে গেলো। উপরের সিঁড়ি পার হয়ে হয়ে যাওয়ার মাঝেই কেউ তার বাহু ধরে হেঁচকা টানে একটি নির্জন, অন্ধকার এবং শুনশান নীরব রুমে নিয়ে আসে। মেয়েটির পিঠ দরজায় ঠেকলো।
তৃধা ভয়ে চোখ বন্ধ করে চিৎকার করার মাঝেই ওপর ব্যক্তি বামহাত মুখ চেপে ধরলো। ডানহাতে ঘাড়ের পেছনে হাত গলিয়ে দেয়। তৃধা মাত্রারূপে অনবরত কাঁপছে। অজান্তেই খামচে ধরেছে লোকটির পাঞ্জাবী। পলকহীন ভাবে তাকিয়ে তাগড়া যুবকটি তৃধার মুখে আসা এলোমেলো চুল কানে গুঁজে দিলো। তৃধার চোখ বন্ধ। তার ছোট আত্মা তখনও বিস্ময় কাটিয়ে উঠতে পারেনি। সে বন্ধ চোখেই অনুভব করছে যুবকটির ধারালো চাহনি। সেকেন্ডের ব্যবধানে সামনের ব্যক্তি গভীর দৃষ্টি ফেলে দুজনের মধ্যকার সমস্ত দূরত্ব ঘুচিয়ে ফেললো। কিছুক্ষণ পর আচমকা মেয়েটি গালে গাঢ় ভেজা স্পর্শ পেতেই ফট করে চেয়ে বিস্ফোরণ দৃষ্টিতে বলল,
“ ক- কি করছেন স্যার? ”
শান্ত বন্ধুকে নিয়ে সিগা/রেট ফুঁকছিল বটগাছের নিচে বসে। অর্পণের সঙ্গে ঝামেলা আজ নতুন নয়! এটা সেই পুরোনো ঘটনা! তার মধ্যে আজ লোকসমাগমে তাকে শাসিয়ে কথা বলেছে। মস্তিষ্ক গরম তো এমনি এমনি হয়নি! ঠোঁটের মাঝে সি/গারেট চেপে লম্বা টান দিলো। বন্ধুদের কাঠ কাঠ গলায় বুঝিয়ে বলল,
“ অর্পণের পাখা দুটি কেটে ফেললে কেমন হয়?”
“ সত্যি বলছিস শান্ত? তুই পারবি?”
শান্ত মৃদু হেঁসে শক্ত হয়ে বসলো। অর্পণের উপর ভয়ংকর রাগ থেকেই তার বন্ধু তামিমের সঙ্গে প্ল্যান করল আজ রাতে কিভাবে গ্যাঞ্জাম করা যায়। রাতের আধারে যখন অর্পণ একা বাসার উদ্দেশ্যে রওনা হবে ওই টাইমে তিনজন এট্যাক করবে। ছেলেটার হাড়-গোড় ভেঙে হসপিটালে ভর্তি করানোর ব্যাপারে খুব সিরিয়াস হলো। শান্ত দুই বন্ধুকে সাফ সাফ জানিয়ে দেয়, সাধারণ একটি মেয়ের জন্য এতগুলো মানুষের সামনে তাকে অপমান করার ফল কতটা ভয়ংকর! ওই মেয়েটা-কেও কাল দেখে নিবে। ভার্সিটির মাঠে কালি মেখে বুঝাবে, ওর রূপে শান্ত থু থু দেয়।
সে পরপর ছয়টা সি/গারেট শেষ করে তামিমকে কাঠকাঠ গলায় বলল,
“ ভার্সিটির প্রথম দিন থেকেই খুব সহ্য করছি ওই বানচদ-কে! যখন- তখন তুচ্ছতাচ্ছিল্য করে কথা বলেছে। ওর বাপের জন্য দমে গিয়েছি। সহ্য করেছি ওর ত্যাড়ামি! কিন্তু আর নয়! খনিকের পোলার দেহ থেকে কলিজা আলাদা করবো আজ!”
তামিমও জ্বলে উঠল। তার কথায় সহমত পোষণ করে হাতের সিগারেট নিচে ফেলে পা দিয়ে পিষে ফেললো।
একদিকে নাচের অনুষ্ঠান আরেকদিকে সকলের চক্ষু লুকিয়ে পাঞ্জাবী পরিহিত অর্পণ, হাতে মোটা একটি রড নিয়ে হনহনিয়ে প্যান্ডেল থেকে কিছুটা দূরে এলো। তুষিব আর রনি হকিস্টিক নিয়ে অর্পণকে বলল,
“ শান্ত বটগাছের নিচে বইসা আরাম করতাছে ভাই। ওরে কি উপরে পাঠানোর ব্যবস্থা করমু? নাকি হালকা জামাই আদর খাওয়ামু?”
অর্পণ বাঁকা হাঁসলো। হাতের রড সর্বোচ্চ শক্তি দিয়ে চেপে ধরে চুপচাপ বটগাছের নিকট হাঁটা দিলো। তুষিবও দৌঁড়াচ্ছে তার পাশাপাশি। ছেলেটাকে বগলদাবা করে মাথাটা নিজের বুকে চেপে অর্পণ হাঁসি মুখে বলল,
“ সিরিয়াস মুহূর্তে হাঁসতে নেই! কিন্তু এখন না হেঁসে পারছি না তুষিব! দিন দিন বেশ উন্নতি হচ্ছে তোর! জামাই আদর নামটা ভালো বলেছিস।” বলেই পিঠে চাপ্পড় মা/রল। তুষিব খুশিতে গদগদ হয়ে লজ্জা পাওয়ার ভান করল।
অর্পণ বড় বড় পা ফেলে বটগাছের নিকট এসে হুংকার ছেড়ে বলল,
“ কিরে মাদারবোর্ড! সি/গারেট খাচ্ছিস? আজ ওই সি/গারেট তোর পাছায় ভরে দিতে এসেছি। ”
বলেই অপর্ণ টান টান হয়ে দাঁড়িয়ে তেজী কণ্ঠে ফের বলল,
“ চুমকির পথ আটকে দাঁড়াস? ওর সঙ্গে ন/ষ্টামি করার পায়তারা করছিস? তোর উপর এখন বুলডোজার চালানো হবে। তুষিবের ভাষায় জামাই আদর।”
আকস্মিক গর্জনে চমকে উঠে শান্ত! তড়িৎ পেছন ঘুরে ভয়ে চুপসে গেলো। সঙ্গে থাকা বন্ধুদের মুখেও আতঙ্ক। ওদের কালো মুখ দেখে অর্পণ শব্দ করে হেঁসে উঠে। হাতে থাকা রড ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে একদম মুখোমুখি হলো। শান্ত আচমকাই দু কদম পিছিয়ে যায়। ছেলেটা ভেতরে ভেতরে ভয় পেলেও যথেষ্ট শক্ত থাকার অভিনয় করল। পাশ ফিরে ভীতু বন্ধুদের দেখে চোখ রাঙাতেই আকস্মিক ঘটনায় শান্ত ব্যথায় ছিটকে নিচে পড়ে যায়। ভারী শরীরটা ধপ করে পরায় শব্দও হলো বেশ!
অর্পণ দুহাতে রড দিয়ে তার হাঁটু বরাবর বারি মে/রেছে। রাগে- ক্রোধে হাতের শিরাগুলো ফুলে একাকার! অর্পণ ক্রোধে গর্জন করল,
“ কোন হাতে স্পর্শ করেছিলি ওকে? এই বামহাতে? নাকি ডানহাতে? কোনটা ভাঙবো আজীবনের মতো?”
“ দেখ অর্পণ! এসব কি করছিস? থাম বলছি। আমার কথা শুন..!”
তুষিব আর রনি ততক্ষণে ওর বন্ধুদের উড়াধুরা হকিস্টিক দিয়ে মে/রে আধা মরা করেছে। তাদের উপর হঠাৎ আক্রমণে কেউ নিজেকে রক্ষা করার সুযোগ পায়নি! এই হিংস্র অর্পণের শিকার হয়ে কলিজা শুঁকিয়ে কাঠ! অর্পণ যখন মাঠে নামে ক্ষতবিক্ষত না করে সেই মাঠ থেকে উঠে না। প্রতিনিয়ত নানান জায়গায় রেকর্ড আছে তার। মাটির লুটিয়ে পড়া ছেলেগুলো অনবরত গড়াগড়ি খেয়ে ব্যথায় চিৎকার করছে। তুষিব গর্জে উঠে তাদের অনবরত বুকে আঘাত করতে করতে বলল,
“ ভাই! আপনি যেহেতু কনফিউজড! তাইলে দু-হাত ই উপরে পাঠানোর ব্যবস্থা করেন।”
“ বাহ তুষিব! আজ সেকেন্ডে সেকেন্ডে ফাটিয়ে দিচ্ছিস।”
বলেই অর্পণ দু’হাতে লাগাতার কয়েক ঘা বসিয়ে দেয় তার বাহুতে। শান্ত ব্যথায় চিৎকার করল। হাঁপাতে হাঁপাতে বলল,
“ অর্পণ ভালো হচ্ছে না। আমার কথা শুন। ”
একদিকে বক্সে গান বাজছে সঙ্গে সকলের দৃষ্টি স্টেজে।অপরদিকে তিনটে ছেলেকে কু/ত্তার মতো পিটিয়ে চলছে। এত শব্দের মাঝে তাদের আর্তনাদ কারোর কানেই পৌঁছাচ্ছে না। কেউ হয়তো জানতেও পারবে না তাদের দৃষ্টির আড়ালে কি হয়েছে আজ!
শান্তর দেহ এবার নিস্তেজ হয়ে আসছে। অর্পণ ক্লান্ত তবুও সে থামছে না। গা থেকে ঝরঝরিয়ে ঘাম বেয়ে বেয়ে পড়ছে। কপাল, মুখ গরমে লাল বর্ণ হওয়ার দরুন অদ্ভুত হিংস্র পশু-র মতো দেখাচ্ছে। মনে হচ্ছে তার ভেতর নেই কোনো মায়া দয়া। আছে শুধু শিকার করার তীব্র আনন্দ।
উপায় না পেয়ে গলা ফাটিয়ে হাজার আকুতি মিনতি করেও ছাড়া পেলো না শান্ত!
মাটিতে গড়াগড়ি খেয়ে ক্লান্ত ঠোঁটে বিড়বিড় করে জ্ঞান হারিয়ে নিথর হয়ে পড়ে গেল রইলো । তৎক্ষনাৎ ভেসে এলো মাইকে চৈতী এবং স্নিগ্ধার নাম। অর্পণের হাত সহ দেহটাও সেখানেই থেমে যায়। কিছুক্ষণ স্তব্ধ হয়ে, সে পেছন ঘুরে একবার চৈতীকে দেখে নিল। মেয়েটা স্বাভাবিক ভাবেই মৃদু হাঁসছে। অর্পণ দৃষ্টি ঘুরিয়ে হাঁটু গেড়ে বসলো শান্তর নিস্তেজ দেহের সামনে। রড দ্বারা তার থুতনি উঁচু করে বলল,
“ আশা করি, আজকের স্পেশাল জামাই আদর ইহজীবনে ভুলবি না। আজ হাড়গোড় ভাঙলাম! এরপর ভুলেও আমার আশেপাশের মানুষদের দিকে চোখ তুলে তাকালেই সেই চোখও উপড়ে ফেলবো। ”
বলেই হাঁপিয়ে উঠা তুষিবের দিকে তাকিয়ে কপাল কুঁচকালো বলল,
“ অল্পতেই হাঁপিয়ে গেলে আমার এসিস্ট্যান্ট হওয়ার যোগ্যতা তোর নেই। যাহ ফাস্ট! এই কুলাঙ্গার দের হসপিটালে এডমিট করে আয়। ”
খেয়ালি আমি হেয়ালি তুমি পর্ব ১৩
তুষিব সঙ্গে সঙ্গে মাথা নাড়িয়ে কাজে লেগে পড়ে। অর্পণ কোমরে হাত রেখে লম্বা দীর্ঘশ্বাস ফেলে পেছন ঘুরলো। অজ্ঞান শান্তকে উদ্দেশ্য করে ক্রোধে জর্জরিত হয়ে বলল,
“ তুই বরং কয়েক মাস রেস্ট নে। অর্পণ শেখ এর মিষ্টি আদর আপ্যায়নে অনেক ধকল গেলো ছোট্ট শরীরটার উপর। একটু বেশীই হয়ে গেলো আমার ভালোবাসা! কি করবো বল? আমি যাকে তাকে স্পর্শ করিনা। কিন্তু যাকে করি একদম আধা মরা করে ছেড়ে দেই। বেচারা! কেনো যে শুধু শুধু চুমকির হাত ধরলি। দেখ এর পরিণাম কতটা ভয়ংকর হলো! ”