নিষিদ্ধ শব্দের দিনলিপি পর্ব ২৫

নিষিদ্ধ শব্দের দিনলিপি পর্ব ২৫
ঝিলিক মল্লিক

“আমার নিজেকে এখন নিজেরই প্রচন্ড অসহ্য লাগছে রে সাইফা।”
“তুই শান্ত হ না। একটু মাথা ঠান্ডা কর। এখনও ওখানে আছিস কীভাবে তুই? ওইরকম একটা লোকের সাথে? ডিভোর্স দিয়ে চলে আয় এখানে!”

“সবকিছু মুখে বলা যতোটা সহজ, করা তত সহজ নয়। তুই একবারও ভেবে দেখেছিস, সংসার জীবনের শুরুতেই যদি আমি সবকিছু ছেড়েছুঁড়ে নিজের বাড়িতে ফিরে যেয়ে ডিভোর্সের কথা তুলি; তখন আমাকে জবাবদিহি করতে হবে না? আর জবাবদিহিটা অবশ্যই স্ট্রং হতে হবে। নাহলে মনুষ্য সমাজ পারলে আবার আমাকে এখানে ভেড়াবে, উপরন্তু দোষারোপ করবেও আমাকে। আর ওই লোক নির্দোষ, মহান আখ্যা পেয়ে যাবে। কিন্তু আমি তা কখনোই হতে দেবো না। পরাজিত হওয়ার চেয়ে লজ্জার আর কিছু নেই। একবার এই সম্পর্ক আনুষ্ঠানিক ঘোষণায় শেষ করলে, তা আর জোড়া লাগানোর নূন্যতম রুচিবোধ আমার কখনোই জন্মাবে না। তাছাড়াও আঘাত যা পাওয়ার যথেষ্ট পেয়েছি। একটু ফিরিয়ে না দিলে চলে কী করে? নাহলে তো আমি মরেও শান্তি পাবো না।”

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

“তারমানে…”
সাইফার কথা পুরোটা শেষ করতে দেয় না রিদি। মাঝখানে বাঁধা দিয়ে বলে,
“হ্যাঁ। ওই লোককে তার প্রাপ্য শাস্তি না দিয়ে আমি এখান থেকে যাচ্ছি না। তিনটা মাসের মতো সময় হাতে আছে আমার। উনার জীবন ছারখার করে দিয়ে তবেই ডিভোর্স দেবো। আর ডিভোর্সের আগে নারী নির্যাতনের মামলাও। তখন দেখবো, সাধের চাকরি কিভাবে টিকে থাকে; যেই চাকরির জন্য আজ এতো নিকৃষ্ট ব্যবহার!”
সাইফা ফোনের ওপাশ থেকে বলে,
“দুলাভাই এখন কোথায়?”
“তুই ফোনের মধ্যে না? বিলিভ মি, সামনাসামনি থাকলে এখন তোর দুই গালে ঠাটিয়ে দু’টো চড় মা’রতাম। দুলাভাই কি রে? কীসের দুলাভাই?!”
“তোর স্বা..”

“স্বামী মানি না আমি। ভোররাতের ওই কথাগুলোর পরেই আমি তাকে স্বামী হিসেবে গ্রহণ করি না আর। মন থেকে পরিত্যাগ করে দিয়েছি। আমার জীবনে তার আর কোনো অস্তিত্ব থাকবে না৷ সব মুছে দেবো। এখানে থাকছিও শুধুমাত্র ওই দু’টো কারণে। ডিভোর্স দেওয়ার জন্য কিছু উপযুক্ত জবাবদিহি দিতে আর তাকে অতিষ্ঠ বানিয়ে শেষ করে দিয়ে যাওয়ার জন্য। এই ফ্ল্যাটে থাকবোও পেইন গেস্টের মতো। দু’টো বেডরুম। আমি আরেকটাতে নিজের থাকার ব্যবস্থা করেছি।”

সাইফার সাথে আরো কিছুক্ষণ টুকটাক কথাবার্তা হলো রিদির। তারপর কল কেটে নিজের ঘর সাজানোয় ব্যস্ত হলো ও। সকালেই কোয়ার্টারে আরবিনের জন্য বরাদ্দকৃত ফ্ল্যাটে এসেছে রিদি। ওর পরিকল্পনা ছিল আলাদা থাকার। সৌভাগ্যবশত পেয়েও গেল আরেকটা ভিন্ন ঘর। একটাতে আরবিন থাকে বরাবরের মতো। আরেকটা বন্ধ। রিদি বন্ধ ঘরটাই বেছে নিলো। ফ্ল্যাটে এসে সোজা নিজের লাগেজ নিয়ে এই ঘরে চলে আসলো। আরবিন অবশ্য কিছু বলেনি। কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিয়ে, সাইফার সাথে কথা বলে এখন কাজে লেগে পরেছে রিদি। যথেষ্ট সহজ, স্বাভাবিক ও। দেখে মনেই হয় না, মেয়েটার ওপর গতরাত থেকে এতোকিছু গিয়েছে!

আরবিন কোয়ার্টারে নেই। রিদি এঘরে যে এসেছে, বেরিয়ে জিজ্ঞাসাও করেনি যে আরবিন কোথায় গেছে। তবে রিদির ঘরের দরজা খোলা থাকায় রিদি শুধু দেখেছে, আরবিন খাকি ইউনিফর্ম পরে বেরিয়েছে ফ্ল্যাট থেকে।
রিদি এবার বিছানা থেকে নেমে বের হলো ঘর থেকে। এগিয়ে গিয়ে দেখলো, ফ্ল্যাটের দরজা লক করে রেখে গেছে আরবিন। রিদির তাতে নূন্যতম হেরফের হলো না। মেজাজ যথেষ্ট ফুরফুরে রাখার চেষ্টা করে সোফায় গিয়ে বসলো ও। ফোন বের করে একটা হরর মুভি ডাউনলোড করে দেখতে শুরু করলো। রিদি নিজেকে ওয়াদা করেছে যে! আজ থেকে তো ও ভালোভাবে বাঁচবে৷ কোনোকিছুর পরোয়া করবে না। কাউকে নিয়ে ভাববে না। বিয়ের আগের রিদি যেমন ছিল, আবারও তেমনই হয়ে যাবে পুরোপুরি।

রিদি ভাবলো আজ-ই বের হবে উদ্ভাস সিলেট ব্রাঞ্চের কোচিং-এ ভর্তি হওয়ার জন্য। বসে থাকার সময় নেই ওর। ভালো স্টুডেন্ট, পরীক্ষাও ভালো হয়েছে যেহেতু; ভালো রেজাল্টের আশাও করা যায়। তারপর ভার্সিটি নাহয় মেডিকেল। এজন্য অ্যাডমিশন কোচিং করা আবশ্যম্ভাবী। তবে আরবিন যদি দুপুরের মধ্যে না ফেরে, তবে রিদি কল দিয়ে ডেকে এনে দরজার লক খোলাবে ওকে দিয়ে। কষ্ট করাবে একটু। অবশ্য এতে মনে মনে খুব আনন্দ-ই হবে ওর।
রিদির আর বেশি পরিশ্রমের প্রয়োজন পরলো না। আরবিন না ফিরলেও দুপুর নাগাদ ফ্ল্যাটের আরেকটা চাবি আরবিনের ঘরে একটু সময় নিয়ে খুঁজতেই ওয়ারড্রবের ওপর পেয়ে গেল ও। চাবির সাহায্যে লক খুলে বাইরে বের হলো।

রিদি কোয়ার্টার থেকে ব্যাগ নিয়েই বেরিয়েছে। ব্যাগে কয়েক হাজার টাকা রাখা আছে সযত্নে। রিদি একটা সিএনজি ধরে উদ্ভাস কোচিং সেন্টারের নাম বলতেই ড্রাইভার উঠে বসতে বললো। উদ্ভাস পরিচিত কোচিং সেন্টার। এমনকি সারাদেশে বিখ্যাত। তাই এটার লোকেশন জানা সবার জন্য স্বাভাবিক ব্যাপার। যদি এমনটা না হতো, তাহলে রিদির হয়তো কাউকে প্রয়োজন পরতো সঙ্গে নিয়ে যাওয়ার জন্য। আপেক্ষিকভাবে দেখতে গেলে আরবিনকেই। কিন্তু আরবিনের সহযোগিতা ও কোনোভাবেই নেবে না। ম’রে গেলেও না। ফোনটা ব্যাগে রেখেছে রিদি। সাইলেন্ট করা ছিল, তা ওর খেয়াল নেই। একটা ইংলিশ কোচিং-ও শুরু করতে হবে। প্রথমে উদ্ভাসে যাবে আগে।
সিএনজি করে উদ্ভাসের সিলেট ব্রাঞ্চের সামনে আসার পরে ভাড়া চুকিয়ে রিদি আশেপাশের দোকানদারদের কাছ থেকে ভালোভাবে শুনে নিশ্চিত হয়ে নিলো। তারপর সামনের সুবিশাল চারতালা ভবনের দিকে পা বাড়ালো।
উদ্ভাসে আজ শুধু ভর্তি হয়েছে রিদি। তবে ক্লাস করবে আগামীকাল থেকে৷ স্যারের সাথে কথাবার্তা শেষ করে সেখান থেকে বের হয়ে এবার রিকশা ধরলো ও। ইংলিশ কোচিং-এর একটা বিজ্ঞাপন আগেই দেখেছিল। বিজ্ঞাপন অনুযায়ী ঠিকানা বলতেই রিকশাওয়ালা রওনা হলেন সেইপথে।

সিলেট শহরে রিদির আজ প্রথম দিন। অচেনা শহর, অচেনা মানুষজন। রিদির এখন ভয় পাওয়ার কথা। কিন্তু ওর এতটুকুও ভয়ভীতি হচ্ছে না। বরং হঠাৎ করেই ওর খুব বেশি সাহস বেড়ে গেছে যেন। ওর একটাই মনোভাব — এখন থেকে ওকে একাই নিজের পথ চলতে হবে। লড়াই করে যেতে হবে। কাউকে প্রয়োজন নেই ওর। ও নিজেই নিজের ঢাল হয়ে দাঁড়াবে। নিজেকে আগলে রাখতে শিখে নেবে। কোনোকিছুর তোয়াক্কা করবে না। নিজের মনমতো মুক্তভাবে চলাফেরা করতে শুরু করেছে আজ থেকে। আরবিনের কথা তো ভুলেও মাথায় আনছে না একবারও।

গুড লার্নাস কোচিং সেন্টার। রিদি ফোন গ্যালারিতে ঢুকে ফটোটা ভালোভাবে দেখে নিলো একবার। হ্যাঁ, ঠিকঠাক জায়গাতেই এসেছে। মূল শহরের ওপরেই কোচিং-টা অবস্থিত। এর অনেক নাম-ডাকও রয়েছে। রিদি আর সময় নষ্ট না করে ভেতরে চলে গেল৷ এখানেও আজ ভর্তি হয়ে যাওয়ার পরিকল্পনা। ক্লাস করার ইচ্ছা রয়েছে আগামীকাল থেকে।
কোচিং-এর অফিস রুমে পরিচালক বসেছিলেন। হিকমত আলী স্যার। রিদি সোজা গিয়ে তার সামনে দাঁড়ালো। স্যার ব্যস্ত হয়ে বসতে বললেন ওকে। স্যারের নির্দেশ পেয়ে রিদি বসলো চেয়ারে। স্যারকে ওর দরকারের কথা জানাতেই স্যার কো-অপারেট করলেন৷ রিদির হাতে একটা ফরম ধরিয়ে দিয়ে বললেন,
“এটা পূরণ করে জমা দাও এখানে। তাহলেই তোমার ভর্তি কনফার্ম হবে। তাছাড়াও ব্যাগ নিয়ে এসেছো যখন, তখন ক্লাস করেই যাও নাহয়। এই পাপন, ওকে ক্লাসরুমটা দেখিয়ে দাও তো।”
আরেকজন স্যারকে ডেকে রিদিকে ক্লাসরুম দেখিয়ে দিতে বললেন হিকমত স্যার। রিদি কিছু বললো না। অর্থাৎ নিরবতা সম্মতির লক্ষণ। আজ বরং ক্লাস করে তারপরেই কোয়ার্টারে ফিরবে। এতো তাড়াহুড়োর কি আছে!

রিদি ভীষণ ক্লান্ত। কোয়ার্টারে অনেকগুলো অ্যাপার্টমেন্ট। দোতলার ফ্ল্যাটটা ওদের। ক্লান্ত শরীর টেনে বিধ্বস্ত পায়ে ধীরেসুস্থে সিঁড়ি বেয়ে ওপরের দিকে উঠতে লাগলো রিদি। রেলিং ধরে ধরে হাঁটছে ও। এতোটা বেশি ক্লান্ত।
মাগরিবের আজান দিয়েছে অনেকক্ষণ হলো। মাগরিবের আজানের পরপরই কোচিং ছুটি দিয়েছে। তবে একটা বিশেষ কাজের জন্য ওর ফিরতে ফিরতে আরো এক ঘন্টা দেরি হয়েছে। চারিদিক অন্ধকার হয়ে এসেছে। অবশ্য রিদির তাতে কোনো তোড়জোড় নেই। দুশ্চিন্তাও হয়নি।
চাবি একটা রিদির কাছেই ছিল। কিন্তু ফ্ল্যাটের সামনে আসতেই ও দেখতে পেল, ফ্ল্যাটের দরজা আঁট করে খোলা। ভীষণ অবাক হলো রিদি। এসময়ে আরবিন এসেছে বুঝি। অবশ্য রিদির তাতে কিছু যায় আসে না৷ কোনো মাথাব্যাথাও নেই। ভেতরে ঢুকেই সোজা নিজের ঘরে যেয়ে দরজা আঁটকে দেবে৷ তারপর পরদিন আরবিন কোয়ার্টার থেকে বের হলেই নাহয় দরজা খুলবে। এতো ভালোই হবে। ওই লোকের মুখ আর দেখতে হবে না ওকে।
এমন একটা পরিকল্পনা নিয়েই ভেতরে ঢুকে দরজা ভেড়িয়ে সামনের দিকে এগিয়ে গেল রিদি৷ ও জানতোও না, সামনে কি হতে চলেছে!

ড্রয়িংরুমের মাঝামাঝি এসে উপস্থিত হতেই চমকালো রিদি। আরবিন দুই হাতে কপাল চেপে ধরে সোফায় বসে আছে মাথা নুইয়ে করে। কি মারাত্মক বিধ্বস্ত লাগছে ওকে। চুল এলোমেলো। হাতের তালুতে সদ্য কাটা দাগও চোখে পরলো রিদির। গভীর ক্ষত। এড়িয়ে যাওয়ার নয়৷ তাতে তাজা র ক্তের দাগ স্পষ্ট। একটা কাঁচের লম্বা ফুলদানি নিচে পাপোশের ওপর ভেঙে চুরমার হয়ে পড়ে আছে। কাঁচের টুকরোগুলো এদিক-ওদিক ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রয়েছে। সকালেও রিদি ফুলদানিটা সেন্টার টেবিলের ওপর দেখেছে। দুপুরের আগে বের হওয়ার সময়েও পরিপাটি দেখে যাওয়া ফ্ল্যাটের একাংশের এমন বিধ্বস্ত অবস্থা আর আরবিনকে এমনভাবে বসে থাকতে দেখে ভীষণ অবাক হলো রিদি। আরবিন তখনও ওর উপস্থিতি টের পায়নি।

তবে রিদি আরো ভয়াবহ দুঃসাহসের একটা কাজ করে ফেললো। এগিয়ে গিয়ে আরবিনের অমন অবস্থাকে তোয়াক্কা না করে নিচু হয়ে ফ্লোরে বসে ফুলদানির একটা বড় ভাঙা টুকরো হাতে নিয়ে বললো,
“এমাহ! ফুলদানিটা ভাঙলো কীভাবে? ইশশ! কত সুন্দর দেখতে ছিল ফুলদানিটা।”
রিদি ফুলদানির টুকরোটা হাতে নিয়ে বড় দুঃখ করতে লাগলো। যেন কতদিনের সযত্নে রেখে দেওয়া জিনিস ওর।
আরবিন রিদির কন্ঠস্বর কাছ থেকে পেয়ে চকিতে মাথা তুলে তাকালো। মুখ রক্তিম হয়ে উঠেছে ওর। চোখ লাল। কপালের শিরা ফুলে গেছে। চোয়াল শক্ত।
আরবিনের এমন অবস্থা দেখে ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে রইলো রিদি। পরপরই কি যেন মনে করে উঠে নিজের রুমের দিকে পা বাড়ালো উল্টোপথে। আরবিন সঙ্গে সঙ্গে উঠে ওর হাত টেনে ধরে থামিয়ে দিলো। রিদি ঘুরে তাকালো আরবিনের দিকে। ভ্রু কুঁচকে, বিরক্তিকর চাহনিতে। আরবিন যথেষ্ট শান্ত তবে গম্ভীর স্বরে রিদিকে প্রশ্ন করে,

“কোথায় ছিলে তুমি?”
“কোচিং-এ গিয়েছিলাম। আর কোথায় যাবো?”
“ফোন কোথায় তোমার?”
“ফোন?”
ফোনের প্রসঙ্গ আসতেই রিদি সেটার খোঁজ করতে লাগলো। কাঁধের ব্যাগ নামিয়ে শেষ পকেট থেকে ফোনটা বের করলো ও। কোচিং-এ ক্লাস করার সময় থেকে শুরু করে গত সাড়ে তিন ঘন্টা ফোন ধরা-ই হয়নি ওর। আরবিন এবার বুকে দুই হাত গুঁজে দাঁড়িয়ে রিদিকে আদেশ করলো,
“লক খোলো ফোনের।”
রিদি কোনো জবাব দিলো না। নিশ্চয়ই কিছু একটা হয়েছে! তর্ক না করে বরং ফোনের লক খুললো ও। আরবিন আবারও বললো,

“কনট্যাক্ট লিস্টের রিসেন্ট কল অপশনে যাও।”
রিদি গেল সেখানে। বড় বড় চোখে দেখলো, আরবিনের একশো তেরোটা মিসকল উঠে রয়েছে ফোন স্ক্রিনে। একশো তেরোটা মিসকল! ডাটাও অন ছিল রিদির। নোটিফিকেশন আসতেই চেক করে দেখলো, হোয়াটসঅ্যাপে আরবিনের অগণিত মেসেজ। রিদির আর সেগুলো পড়ে দেখার সময় বা সুযোগ কোনোটাই হলো না। তার আগেই আরবিন ওর হাত থেকে টান মেরে ফোনটা কেঁড়ে নিয়ে ঠাস করে ফ্লোরের ওপর ফেললো৷ এতোটাই জোরে, যে শব্দে কেঁপে উঠলো রিদি। পিছিয়ে গেল কিছুটা। ভয়ে মুখ রক্তশূণ্য হয়ে গেল। আরবিন এবার শক্ত করে রিদির কাঁধ চেপে ধরলো দুই হাতে। খুব হিংস্রভাবে। ব্যাথায় কুঁকড়ে উঠলো রিদি। “উহ” শব্দ করতেই আরবিন আরো খামচে ধরলো ওর কাঁধ। দাঁতে দাঁত পিষে বললো,
“তুমি বাইরে গিয়েছিলে ভালো কথা, বলে গিয়েছো আমাকে? অন্তত একটা ফোনকল, বা একটা মেসেজ? করতে পারতে না? হাতে ব্যাথা ছিল? এই হাত আজ কেটে ফেলবো আমি। যেই হাত কোনো ভালো কাজে লাগে না, লাগে শুধু ফাতরামিতে!”

আরবিন রিদির হাতের তালু চেপে ধরলো এবার। রিদি ছিটকে সরে যেতে চেয়েও পারলো না। বৃথাই আরবিনকে ধাক্কা দিলো। আরবিন এবার আরো ক্ষেপে গিয়ে উত্তপ্ত দৃষ্টিতে তাকালো রিদির দিকে। জোরে চেঁচামেচি করে বললো,
“যেই ফোন কোনো দরকারে পাওয়া যায় না, সেই ফোনের কোনো প্রয়োজনীয়তা নেই। কতবার কল দিয়েছি তোমাকে? কতবার? চোখ দু’টো খুলে একটু দেখো তো। একটুও কমনসেন্স নেই তোমার? একা ফ্ল্যাটে লক করে রেখে গেছি নিরাপত্তার কথা চিন্তা করে। আর তুমি রাগ-জেদ দেখিয়ে কোনোকিছু পরোয়া না করে বেরিয়ে তো গেলেই, তারওপর ফোন সাইলেন্ট করে ব্যাগের মধ্যে রেখে দিলে। কোথায় না খুঁজেছি তোমাকে। খুঁজতে খুঁজতে একবার অ্যাক্সিডেন্ট করার মতো অবস্থা হয়েছে। দিশাহারা হওয়ার কারণে ফুলদানি হাতে লেগে পরতেই সেটা তুলতে গিয়ে হাত কেটেছে। আরো কিছু হওয়ার বাকি আছে? তুমি কী আমাকে মেরে ফেলতে চাও হ্যাঁ? কথা বলছো না কেন?”

রিদির কাঁধ ধরে ঝাঁকায় আরবিন। রিদি এতোক্ষণ চুপ ছিল। এবার ধীরে ধীরে মুখ তুলে বলে,
“আমি কেন আপনাকে এতো কৈফিয়ত দিতে যাবো? আর আপনিই বা কে আমাকে এতো প্রশ্ন করার? কোনো অধিকার নেই আপনার। একই ছাঁদের নিচে দায়ে পড়ে আছি বলে একদম অধিকারবোধ খাটাতে আসবেন না৷ আমি কিন্তু ছেড়ে কথা বলবো না মোটেও! আমি যেখানে খুশি যাবো, যা খুশি করবো, ইচ্ছে হলে ফোন সাইলেন্ট করে রেখে দেবো। আপনাকে এতো ভাবতে বলেছে কে? আপনার আমাকে নিয়ে এতো না ভাবলেও চলবে।”
রিদির শক্ত কথা শুনে আরবিন কিছুক্ষণ দাঁতে দাঁত চেপে তাকিয়ে রইলো ওর দিকে৷ তারপর এক পা এগিয়ে এসে ঝাঁঝালো সুরে বললো,

“ভাবতে হচ্ছে, কারণ তুমি এখন আমার দায়িত্বে। তোমার কিছু হলে সেই দায়ভার আমার ওপরেই পড়বে। যা আমি কখনোই মেনে নিতে পারবো না। এজন্যই তোমাকে বলেছি, এখান থেকে যত দ্রুত সম্ভব চলে যাও। আমাকে শান্তিতে বাঁচতে দাও। তুমি আমার অশান্তি আর দুশ্চিন্তার কারণ।”
“আমি পারলে এখনই চলে যেতাম। কিন্তু আরবিন, তার আগে একটা প্রশ্ন। হঠাৎ ডিভোর্সের কথা তুললে দোষারোপটা আমি কার ওপর দেবো? আপনার ওপরে? আপনি একসেপ্ট করবেন?”
“প্রশ্ন-ই আসছে না!”

“এজন্যই আমাকে এখানে কিছুদিন হলেও থাকতে হবে। একপ্রকার বাধ্য হয়েই। কারণ, আমরা একসাথে সংসার-ই করিনি। সেখানে ডিভোর্স দেওয়ার কোনো যৌক্তিক কারণ দেখাতে হবে। আর আমি অবশ্যই নিজের ঘাড়ে দোষ চাপিয়ে নেবো না। অতোটা উদার হতে পারবো না কখনোই।”
আরবিন আর কোনো কথা বললো না। রিদি ঠেলে ওর কাঁধ থেকে আরবিনের হাত সরিয়ে দিয়ে আঙুল উঁচিয়ে বললো,
“আমি মরবো, বাঁচবো, যা খুশি করবো; আপনি চোখ বন্ধ করে থাকবেন। আপনার ওপর কোনো দায় চাপানো হবে না — এই গ্যারান্টি আমি আপনাকে দিচ্ছি। তবু আমাকে আমার মতো থাকতে দেবেন। আপনার মুখও দেখতে চাই না আমি!”

রিদির এমন ব্যবহারে আরবিন কিছুক্ষণ ভ্রু কুঁচকে উত্তপ্ত চাহনিতে তাকিয়ে রইলো রিদির দিকে। কিছু বলতে যাবে, তখনই ফ্লোরের ওপর পড়ে থাকা রিদির ফোনটার ব্রাইট স্ক্রিন অন হলো। ফোনটার তেমন কিছু হয়নি। রিদি দ্রুত ফ্লোর থেকে তুলে নিলো ফোনটা। একটা আননোন নাম্বার থেকে কল এসেছে। রিদি ফোন রিসিভ করে ওপাশের কথা শুনতেই বলে উঠলো,
“ওহহ শিহাব তুমি! এটা তোমার নাম্বার বুঝি? হ্যাঁ এইতো আমি বাসায় পৌঁছেছি মাত্র। তোমার দুশ্চিন্তা করতে হবে না। নিশ্চিন্ত থাকো। কাল আমাকে নিতে আসবে? আচ্ছা, এসো বরং। আমার আরো সুবিধা-ই হবে। একা যেতে বোরিং লাগে।”

কথা বলার ফাঁকে আরবিনের রক্তচক্ষু আড়চোখে দেখলো রিদি। তবে তা সম্পূর্ণ উপেক্ষা করে গিয়ে বললো,
“আচ্ছা, এখন রাখছি গো। পরে কথা হবে। রাতের খাবার খেয়ে নক দিও কেমন? ওকে বাই!”
রিদি কল কাটতেই আরবিন এগিয়ে আসলো৷ রিদির চোখে চোখ রেখে রাশভারী গলায় প্রশ্ন করলো,
“কার সাথে কথা বলছিলে?”
“একটা ছেলের সাথে।”
“কোন ছেলে?”

“আমার বন্ধু। শুধু বন্ধু না, খুব ভালো বন্ধু। আজকেই ইংলিশ কোচিং-এ পরিচয়। তারপরেই ফোন নাম্বার দেওয়া-নেওয়া। ও আমাকে মোড় পর্যন্ত এগিয়ে দিয়ে ওর বাড়ির দিকে গিয়েছে। তাই আমাকে ফোন দিয়ে জিজ্ঞাসা করছিল, ঠিকমতো পৌঁছেছি কিনা। বেচারা খুব দুশ্চিন্তা করছিল আমার জন্য।”
আরবিন এবার দাঁতে দাঁত চেপে বললো,
“ওই ছেলেটার সাথে ওভাবে কথা বলছিলে কেন তুমি?”
“কেমনভাবে?”
“ওগো, হ্যাঁ গো, রাখছি গো— এসব কেমন ধরনের কথাবার্তা? ও কী তোমার স্বামী হয়?”

নিষিদ্ধ শব্দের দিনলিপি পর্ব ২৪

“স্বামী না হলেও খুব ভালো বন্ধু তো। অন্তত আপনার চেয়ে ভালো। তাই ও ভালো ব্যবহার ডিজার্ভ করে। ছাড়ুন তো। আপনার সাথে কথা বাড়াতে ইচ্ছা করছে না। আমি রুমে যাচ্ছি। ডিস্টার্ব করবেন না৷ শিহাবের সাথে রেস্টুরেন্ট থেকে খেয়ে এসেছি। তাই আর রাতে খাবো না। কাল সকালে ঘুম থেকে উঠে যেন আপনার মুখ দেখতে না হয়, সেই ব্যবস্থা করবেন আশা করি। আপনার মুখ দেখলে আমার দিন খারাপ যাবে।”
রিদি আর দাঁড়ালো না সেখানে। ও যাওয়া মাত্র-ই আরবিন ওর ফোনটা সেন্টার টেবিলের ওপর ছুঁড়ে মেরে সোফায় বসে পড়লো। তারপর মেজাজ নিয়ন্ত্রণে রাখতে না পেরে হাত মুঠো করে টেবিলের ওপর আলতো করে একটা ঘুষি মারলো।

নিষিদ্ধ শব্দের দিনলিপি পর্ব ২৬