রেড রোজ ২ পর্ব ২১
ফারহানা নিঝুম
নিবিড় মেঘে ঢাকা আকাশ, যেন নিজেই কোনো এক রহস্য লুকিয়ে রেখেছে। হঠাৎ করেই বাতাসে শীতলতা ছড়িয়ে পড়ে, আর টুপটাপ শব্দে বৃষ্টি নামে। জানালা খুলে সেখানটায় দাঁড়ালো উৎসা। গাছের পাতায় জমে থাকা পানির ফোঁটা একে একে মাটিতে পড়তে থাকে। চারপাশে মাটির সোঁদা গন্ধ ভেসে বেড়াচ্ছে , আবেশে চোখ বুজে নেয় উৎসা। কিছুটা দূরে বড় গাছটারয় পাখিরা ডানার নিচে মাথা লুকিয়ে বৃষ্টির সঙ্গী হচ্ছে। ছাদের নিচে দাঁড়িয়ে সেই বদ্ধ ঘরের জানালার পাশে হাত বাড়িয়ে সেই শীতল ফোঁটা ধরার চেষ্টা করছে। বৃষ্টি যেন মনের গভীরে এক প্রশান্তি এনে দেয়।
কিন্তু কে বলবে এই প্রশান্তি সাময়িক সময়ের জন্য!এই বৃষ্টি যে উৎসার জীবনে জ’লো’চ্ছ্বা’স সৃষ্টি করে তুলতে এসেছে!
আঁধার কে টে গিয়ে নতুন সূর্য আকাশ জুড়ে ঝলমল করছে।তবে সেই আঁধার ধরণী থেকে কে টে গেলেও উৎসার জীবনে ঘো’র অন্ধকারে ছেয়ে দিয়ে গেছে।
কাফনের কাপড় গায়ে দিয়ে ফ্লোরে শুইয়ে রেখেছে সাবিনা পাটোয়ারী কে। মিহি পাশে বসে কী আহা’জারি করছে, কান্নায় পুরো বাড়ি কেঁপে উঠছে তার।
উৎসা গুটিসুটি হয়ে সিঁড়ির এক কোণে বসে আছে,তার চোখ মুখ কেমন শক্ত হয়ে আছে।সে কাঁদছে না,তার চোখ দিয়ে একটা বারের জন্যেও পানি আসেনি।
এক দুঃখি, যে তার জীবনকে সবসময় দুঃখের ছায়ায় আচ্ছন্ন মনে করে সে মেয়েটি আজ জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মানুষটি কে হারিয়ে ফেলেছে।আজ সে গভীর এক নিঃসঙ্গতার ভেতর বাস করছে। তার চারপাশে মানুষের ভিড় থাকলেও সে নিজেকে একা অনুভব করে।তার প্রিয় মানুষের নিথর দেহ খানা কেমন ফ্লোরে শুইয়ে রাখা!উৎসার চোখে ক্লান্তি আর অন্তরের গভীরে বয়ে যাচ্ছে এক অসীম শূন্যতা। তার স্বপ্নগুলো পথের ধুলোয় মিশে গেছে।
নিঃশ্বাস আটকে আসছে উৎসার,বুকের ভেতর টা কেমন ভারি হয়ে আছে তার।
সদর দরজা দিয়ে ভেতরে প্রবেশ করলো শহীদ, আফসানা, রুদ্র,নিকি, জিসান, ঐশ্বর্য এবং কেয়া। সবাই আজকে উপস্থিত আছে, আজকে সবাই কে তো আসতেই হতো।
ঐশ্বর্য চমকে উঠে উৎসা কে দেখে, মেয়েটা কেমন গুটিসুটি হয়ে বসে আছে সিঁড়ির পাশে ।চোখ দুটো দিয়ে যেনো আ’গু’ন বের হচ্ছে,লাল টকটকে সেই চোখ।
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
“উৎসা।”
নিকির কন্ঠস্বরে কিছুটা নড়েচড়ে বসল।নিকি ঠিক উৎসার সামনে বসে।
“তুই কাঁদবি না?”
উৎসা যেনো কান্না শব্দটি শুনে কিছুটা ঘাবড়ে গেল,সে কাঁদলেই তো তার মা কে নিয়ে যাওয়া হবে!
“আমি কাঁদবো না আপু, আমি কাঁদলেই মা চলে যাবে।”
নিকি ঠোঁট কা’মড়ে’ নিজের কান্না আটকানোর চেষ্টা করছে। ঐশ্বর্য এসে বসলো উৎসার পাশে, হাত দুটো শক্ত করে ধরে বলে।
“ইউ লাভ মাম্মা?”
“হুঁ খুব বেশি তো।”
“তাহলে যেতে দাও।”
উৎসার নিঃশ্বাস ভারী লাগছে ,সে ঘামতে লাগলো।
“চলে গেলে আর ফিরবে না তো।”
“প্লিজ রোজ।”
সময় প্রবাহ মান, নিজের মতো করে পেরিয়ে যায়।
আজ দু’দিন ধরে উৎসা নিজেকে সামলাতে পারছে না, কেমন ঘো’রে চলে গিয়েছে। কিন্তু তা কত দিন? মানুষ তো আর চিরঞ্জীব চিরস্থায়ী না,ঠিক সময় মতো সেও সব ছেড়ে ছুড়ে চলে যাবে।উৎসা সেটা মেনে নিয়েছে, নিজেকে নরমাল করার চেষ্টা করে চলেছে।
“অ্যাংরি বার্ড লিসেন!”
অফিসের জন্য বের হয়েছে নিকি, কিন্তু আশ্চর্যের ব্যাপার জিসানও তার গাড়িতে উঠে বসেছে।
“আপনি কী করছেন গাড়িতে?”
“প্রেম করতে এসেছি।”
জিসানের কথায় কপালে ভাঁজ পড়লো নিকির।
“এই নামুন তো দেরী হচ্ছে আমার।”
জিসান নামলো না উপরন্তু অসহায় গলায় ডাকলো।নিকি ভ্রু কুঁচকে শুধোয়।
“কী?”
আচমকা জিসান নিকির দিকে কিছুটা ঝু কে গেল। চমকে উঠে নিকি।
“এ কী করছেন?”
“তেমন কিছু না একটু দেখছি!”
নিকির ঠোঁট জোড়া কিঞ্চিৎ ফাঁক হয়ে গেল,কী দেখছে? তৎক্ষণাৎ দৃষ্টি গেল নিজের শরীরের দিকে, না সব কিছু তো ঠিকই আছে। তাহলে!
“ছিহ্ অশুদ্ধ পুরুষ!”
জিসান ভ্রু নাচিয়ে বলে উঠে।
“আমি কিন্তু শুদ্ধ পুরুষ।”
“হ্যা সেটা তো দেখতেই পাচ্ছি।”
নিকি অনেকটা খোঁ’চা মেরে বললো কথাটা! জিসান আবারও অসহায় চোখে তাকায় তার দিকে।
“এই শুনো না।”
“কী বলবেন তাড়াতাড়ি বলুন অফিস যেতে হবে!”
জিসান কিছুটা ফিসফিসিয়ে বললো।
“আমরা আজকে লং ড্রাইভে গেলে কেমন হয়?”
“খুববব বাজে হয়।”
নিকির উত্তরে মন বি”ক্ষি’প্ত হচ্ছে জিসানের,এই মেয়েটা এত ফিলিংসলেস কেন?
“ঠিক আছে যেতে হবে না।”
জিসান এক প্রকার রেগে গাড়ি থেকে বেরিয়ে গেলো ,নিকি ঠোঁট টিপে দুষ্টু হাসলো। অতঃপর গাড়ি নিয়ে অফিসের উদ্দেশ্যে বেরিয়ে গেল , জিসান ড্যাব ড্যাব করে তাকিয়ে আছে!সে ভাবলো হয়তো নিকি রাগ ভাঙাতে আসবে, কিন্তু না এ মেয়ে তো চলে গেছে!
জিসান এগিয়ে গিয়ে বাগানের চেয়ারে বসলো।
“ছে ব্রো-ই ঠিক আছে, না অশুদ্ধ পুরুষ একটা।এই পুরুষ কেই সবাই ভালোবাসে, এদিকে তার মতো শুদ্ধ পুরুষের কোনো মূল্য নেই!”
বড়সড় একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল জিসান।
“কী রে শুদ্ধ পুরুষ কী হয়েছে?”
কেয়া কে দেখে চুপসে যাওয়া মুখশ্রী আরো খানিকটা চুপসে গেল।
“আজকাল শুদ্ধ পুরুষের দাম নেই রে কেয়া।দেখ রিক কে! ওর মতো শেইম লেস ম্যান কে সবাই কত ভালোবাসে! অথচ আমাদের মত শুদ্ধ পুরুষ কে কেউ খুঁজেও দেখে না!ইজ দিস হিউম্যানিটি? এটাই কি মানবতা?”
কেয়া শব্দ করে হেসে উঠলো।
“উপ্স সো স্যাড।”
“কেয়া নট কিডিং অ্যাট অল!”
কেয়া আবারো হেসে ফেলল।
বাইরে ঝিরিঝিরি বৃষ্টি পড়ছে, প্রকৃতি ম্লান হয়ে আসছে। অদ্ভুত সুন্দর সেই দৃশ্য খানি, মেঘের ভেলারা উড়েছে আকাশে।মাঝে মাঝে দূরে কোথাও বা’জ পড়ছে হয়তো!
ড্রয়িং রুমে বসেছে বড়সড় সমাবেশ, আলোচনার মুখ্য বিষয় হলো উৎসা আর মিহির এই বাড়িতে আসা। এমনিতেই আগে শহীদ ভীষণ চিন্তিত থাকতেন সাবিনা পাটোয়ারী আর ওনার দুই মেয়ে কে।যত যাই হোক সাবিনা পাটোয়ারী তার চাচাতো বোন হয়।সে বরাবরই তাকে নিজের আপন বোন বলে মেনেছে। আজ সেই মানুষটি নেই,তার মেয়েদের দেখাশোনার দায়িত্ব তো ওনাদের।
সোফার এক কোণে কানে হেডফোন গুঁজে আই প্যাড নিয়ে বসে আছে ঐশ্বর্য।কে কী বলছে তা শোনার বিন্দুমাত্র আগ্রহ নেই বলে মনে করছেন শহীদ।
“আচ্ছা বাবা এটা আবার জিজ্ঞেস করতে হয়? মিহি আর উৎসা আমাদের সঙ্গে থাকবে এর থেকে ভালো কিছু হতে পারে?”
নিকিও সহমত পোষণ করলো।
“হ্যা বাবা আমরাও চাই না ওরা ওই বাড়িতে একা থাকুক!”
শহীদ এমনটাই আশা করেছিলেন, যাক কারো সমস্যা নেই ওদের এখানে থাকা নিয়ে।
“তাহলে আর কী কাল উৎসা আর মিহি কে এখানে নিয়ে আসা হবে।”
“আমার আপত্তি আছে!”
বেশ গম্ভীর স্বরে বলে উঠলেন আফসানা। শহীদ অবাক হয়।
“আফসানা কী বলছো? তোমার আপত্তি আছে মানে?”
আফসানা বেশ কাট কাট কন্ঠে বলে উঠলো।
“হ্যা আমার আপত্তি আছে, আমি চাই না বাইরের কেউ আমাদের বাড়িতে থাকুক!আর ওই উৎসা আর মিহি তো একদম নয়।”
রুদ্র দীর্ঘ শ্বাস ফেলল,সে প্রথম থেকেই আন্দাজ করছিল।
“কিন্তু কেন কী হয়েছে?”
শহীদের প্রশ্নে যেনো আরো তে’তে উঠল আফসানা।
“কারণ আমার স’হ্য হয় না ওদের। প্রথমে তোমার বোন কে স’হ্য হতো না এখন ওর মেয়েদের কে!তাই আমি চাই না ওরা এখানে থাকুক!”
আফসানার এমনতর আচরণে কেয়া ফিসফিসিয়ে বললো।
“জিসান উনি এমন করছে কেন বল তো?”
জিসান নিজেও কিছু বুঝতে পারছে না!এই মহিলা বরাবরই এমন এটুকু জানে, কিন্তু এতটা পাষাণ এটা আজ জানালো।
“অবজেকশন মিসেস মহিলা!”
সবার মাঝখান থেকে বলে উঠলো ঐশ্বর্য , এতক্ষণ ধরে সবার মনে হচ্ছিল হয়তো ঐশ্বর্য কিছুই শুনেনি বা শোনার আগ্রহ রাখছে না। কিন্তু এদিকে হেডফোন জাস্ট শো অফ ছিল, এতক্ষণ ধরে ঐশ্বর্য সবটাই শুনেছে।
বেশ আরামছে কানের হেডফোন আর আই প্যাড পাশে রেখে বলে উঠলো ঐশ্বর্য।
“মিসেস মহিলা এত কিসের প্রবলেম আপনার?”
আফসানা কপাল কুঁচকে চিবিয়ে চিবিয়ে বলেন।
“আমি তোমার সঙ্গে কথা বলছি না বেয়াদব কোথাকার!”
ঐশ্বর্য ফিচলে হাসে।
“আদবের ছিলাম কবে?”
আফসানা রাগে ফুসে ফেঁপে উঠছেন।
ঐশ্বর্য ভ্রু উঁচিয়ে বললো।
“কিন্তু কথা তো আমি আপনার সঙ্গেই বলছি মিসেস মহিলা!বাই দ্যা ওয়ে আপনি আমার সঙ্গে কথা না বললেও আমার বাড়ি নিয়ে কথা বলছেন।”
আফসানা তাচ্ছিল্য করে আওড়াল।
“এটা তোমার বাড়ি?”
“বিশ্বাস না হলে বাবা কে জিজ্ঞেস করে নিন! আহ্ আই সি উনি হয়তো আপনাদের বলেই নি বিয়ের আগে তাই না?”
আফসানার মুখ খানি মূহুর্তে চুপসে গেল।
“মানে?”
ঐশ্বর্য এবারে উঠে দাঁড়ালো। মুখশ্রী জুড়ে গাম্ভীর্য ভাব।
“দিস ইজ ফার্স্ট অ্যান্ড লাস্ট ওয়া’র্নিং আমার বাড়িতে কে থাকবে আর কে থাকবে তা নিয়ে অন্তত আপনি নাক গলাতে আসবেন না।আই রিপিট নাক গলাতে আসবেন না!”
শহীদ কিছুটা অস্বস্তিতে পড়ে গেলেন, এবার কী ঐশ্বর্যও উৎসা আর মিহি কে আনতে মানা করে দেবে? হ্যা এটা ঐশ্বর্যের বাড়ি, মূলত যখন মনিকা ছিল তখন দু’জনে মিলে ঐশ্বর্যের নামেই সব কিছু লিখে দিয়ে গেছেন। ঐশ্বর্য ছিল ওদের এক মাত্র আদরের ছেলে।
আফসানা চেয়েও কিছু বলতে পারলেন না,ঘো’র অপ’মান বোধ করলেন।রাগে শরীর জ্ব’লে উঠল।
ঐশ্বর্য সিঁড়ির দিকে এগুতে গিয়েও থেমে গেল। রুদ্র কে উদ্দেশ্য করে বলল।
“আহ্ রুদ্র তোকে দায়িত্ব দিলাম ওদের সেইফলি নিয়ে আসা।”
রুদ্র অধর বাঁকিয়ে হেসে ফেলল, ব্যস্ত কন্ঠে বলে উঠে।
“ওকে ভাইয়া আমি দেখে নিচ্ছি।”
রেড রোজ ২ পর্ব ২০
ঐশ্বর্য আর অপেক্ষা না করে উপরে নিজের রুমে চলে গেল। আফসানা গঢগঢ করে চলে গেল পাশের রুমে। শহীদ কিছুটা স্বস্তি বোধ করলো,আর যাই হোক ছেলেটা এ ব্যাপারে তার সাথে সহমত পোষণ করছে।