রাজবধূ পর্ব ৩২
রেহানা পুতুল
পরেরদিন সকাল সাড়ে আটটার দিকে রাজ ফ্রেস হয়ে দোতলা থেকে নিচে নেমে আসলো। জোছনাকে ডেকে বলল,
“তোর ভাবির রুমে আমাদের দুজনের জন্য নাস্তা নিয়ে আয়।”
বলে রাজ শিখার রুমের চাপানো দরজা ঠেলে ভিতরে প্রবেশ করলো শব্দহীনভাবে। শিখা একপাশ হয়ে শুয়ে আছে। পরনের শাড়ি অবিন্যস্ত। রাজ শিখার পিঠে আলতো ছোঁয়ায় হাত রাখলো। কিন্তু ডাকল না। শিখা চকিতে চাইলো ঘাড় ঘুরিয়ে। এবং ধড়মড়িয়ে উঠে বসলো। শাড়ির আঁচলটা বুকের উপর মেলে দিলো। পায়ের গোড়ালি থেকে উপরে উঠে থাকা শাড়ির কুচিগুলোকে টেনে নিচে নামিয়ে দিলো।
দৃষ্টি অন্যদিকে রেখে অনুযোগ তুলে লাজুক স্বরে বলল,
“আপনে হঠাৎ আইসা পড়লেন?”
রাজ সুমিষ্ট হাসলো। শিখার পাশে বিছানার উপরে বসল। লাউয়ের ডগার ন্যায় শিখার সরু কচি হাতখানা ধরলো। বলল,
“বউয়ের রুমে জামাইয়ের আসা নিষেধ? ঘুম ভেঙ্গেছে প্রজাপতি?”
“না,তা হইবো ক্যান। এই দুইদিন ত এমন টাইমে আসেন নাই। ঘুম ভোরেই ভাঙ্গছে। নামাজ পইড়া আবার শুইলাম।”
“এই দুইদিন এই সময়ে আসিনি। পরে এসেছি। আজ এখন এলাম কারণ সকালে নাস্তা খেয়েই ঢাকায় চলে যাবো।”
রাজ শিখার মুখের অভিব্যক্তি পর্যবেক্ষণ করলো ডিটেকটিভের ন্যায়। শিখার অভিব্যক্তিজুড়ে ভর করলো প্রগাঢ় অভিমান ও শূন্যতা। এখন আর নেই কোন অনুযোগ।
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
“আমি আম্মার কাছে চইলা যামু। এই বাড়ি থাকুম না। ভালো লাগেনা আমার।”
দুঃখী দুঃখী গলায় বলল শিখা।
দরজায় আওয়াজ দিয়ে নাস্তার ট্রে নিয়ে আসলো ফুলবানু। সে চলে গেলো বাইরে থেকে দরজা চাপিয়ে দিয়ে।
“পরে বাকি কথা বলব। আসো একসঙ্গে নাস্তা খাই। তোমার হাতে আমাকে খাইয়ে দাও। তুমিত নিজের হাতেই খেতে পছন্দ করো।” বলল রাজ।
শিখা রাজের মুখে রুটি ও ডিম ভাজা তুলে দিলো। ছোট্ট করে বলল,
“বুঝি না। নিজের হাত ছাড়া অন্যের হাতে খাইতে কি মজা?”
” সেটা তোমার বুঝতে হবে না। আমি বুঝলেই হবে। অন্যের হাত কই পেলে? বউয়ের হাতে খাচ্ছি। আমার বউয়ের শুধু হাত নয় মুখ থেকেও খেতে পারবো আমি। ঠিক যেমন করে পাখি তার সঙ্গীকে ঠোঁট থেকে খাইয়ে দেয়।”
রাজের এহেন বাক্যে শিখার সর্বাঙ্গে শিহরণ জেগে উঠলো। সে ক্ষণকাল থামলো। রাজ শিখার ভ্রমর কালো ডাগর দুটো আঁখির দিকে নির্নিমেষ চাইলো। শিখা বাকি খাবার গুলো রাজকে খাইয়ে দিলো। তারপর নিজেও খেলো। রাজ একটু রুটি ছিঁড়ে নিয়ে শিখার মুখে তুলে দিলো।
বলল,
“এবার বলো কি ভালো লাগছে না? আমাকে? অন্যদেরকে? না আমাদের বাড়িকে? না সবকিছু মিলিয়ে?”
“আপনারে নিয়া কোন সমস্যা নাই আমার৷ কিন্তু অন্যসবাই জানি কেমন। সব আজিব আজিব লাগে আমার কাছে। আমি রেডি হইয়া লই। আপনে আমারে মধুপুর দিয়া ঢাকা চইলা যাইয়েন। আমার পরিক্ষার ফল প্রকাশ হইলে তারপর আবার আসুম।”
রাজ ভাবুকের মতো একটু থামলো। শিখার চিবুক ছুঁয়ে মাষ্টার মশাইয়ের মতো করে বলল,
“ছেলেমানুষী করো কেন বালিকা? তুমি যেতে চাও যাবে। তবে একটা কথা জেনে রাখো। তুমি এই সংসারে ক্ষণিকের অতিথি হয়ে আসনি যে বেড়ানো শেষে চলে যাবে৷ কোথায় কি হচ্ছে বা কে কি করলো সেটা তোমার দেখার বিষয় নয়। এটা একদম নয়। তুমি এখানে তোমার যোগ্যতায় চিরদিনের জন্য স্থায়ী বাসিন্দা হয়ে এসেছে। যেখানে মানুষ বেশি,সেখানে কথা বেশি। সংঘাত বেশি। ভুলত্রুটি বেশি। সুতরাং আমাদের একান্নবর্তী পরিবারে তোমার অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে হলে,নিজেকে মজবুত অবস্থানে নিতে হলে, তোমার এই বাড়িতেই থাকতে হবে শিখা। আমি চাই তুমি আজকের এই দূর্বল শিখা শক্তিশালী শিখাতে পরিণত হও৷ প্রজ্বলিত হও স্বমহিমায়। তোমার গৌরবে গৌরবান্বিত হোক এই উজানপুর গ্রাম। আমাদের পরিবারের অন্য ঘরনিদের মতো তুমিও গর্ব করে মাথা উঁচিয়ে চলতে পারো যেন। ফুলশয্যা রাতে তোমার থেকে একটা কমিটমেন্ট নিব।”
রাজ থামলে শিখা কোমল স্বরে বলল,
“আমারও কিছু কথা বলার আছে আপনাকে। তারপরেই কমু। এখন নয়।”
“ঠিক আছে,আমিও তখন শুনবো। কিছুক্ষণ পরে আমি তোমার কথা সবাইকে ডেকে বলব। যেন তোমার সঙ্গে বিরূপ আচরণ না করে কেউ। আর তুমি এখন আমার সাথে চলে গেলে বিষয়টা অশোভনীয় দেখায়। দু’চারদিন পর চলে যেও না হয়।”
“আইচ্ছা। তাইলে আপনের আব্বারে বইলা যাইয়েন যেন আমারে যাইতে দেয় আমাগো বাড়ি। চিঠি দিয়েন মধুপুরের ঠিকানায়। ”
“আপনের আব্বা কি শিখা? আমার বাবা,মা তোমারও বাবা, মা। চিঠি দিতে ভুল হবে না আমার। তবে জবাব ও যেন দ্রুত পাই।”
শিখা ঘাড় হেলিয়ে রাজের কথায় সম্মতি জানালো। রাজ বের হয়ে তার রুমে চলে গেলো।
কিছুক্ষণ পর ব্রিফকেস হাতে নিচে নেমে এলো রাজ। খালেদ, আসলামও তার সঙ্গে চলে যাবে ঢাকায়। রানী ও খালেদ দুজন দুজনের সঙ্গে প্রয়োজন না হলে কথা বলে না। নিদিষ্ট দূরত্ব বজায় রেখে চলে দুজন। খালেদ রানীকে এড়িয়ে চলে রা*গে ও বিরক্তিতে। রানী খালেদকে এড়িয়ে চলে তার উদ্দেশ্যে হাসিল করার লক্ষ্যে।
তাদের চলে যাওয়ার সময় ঘরের সবাই একত্রে জড়ো হলো। রাজ মা, বাবার থেকে বিদায় নিলো। শিখার প্রসঙ্গ টেনে পরিবারের সবাইকে অনুরোধ করলো যেন শিখার সঙ্গে ভালো আচরণ করে তারা। সবাই বিরক্ত মুখে চুপ রইলো। রাজকে কিছুই বলল না। এবং কোন টু শব্দটিও করল না। কেননা সংসারে অর্থনৈতিক সাপোর্ট বড় দুই ভাইয়ের চেয়ে রাজের বেশী। রাজ মাকে পা ছুঁয়ে সালাম দিলো। তবুও সুফিয়া বিবি গোমড়া মুখে দাঁড়িয়ে রইলো। ছোট ছেলের উপর থেকে তার মনঃক্ষুণ্নতা কিছুতেই কাটছে না। বরং এমন এমন ঘটনা ঘটে, তার মৌনোকষ্ট আর বেড়ে যাচ্ছে তার উপর।
বড় তালুকদার ছেলেকে বললেন,
“তুই বউরে নিয়া টেনশন করিস না। আমি আছি। তারে পাঠায়া দিমু তাদের বাড়ি।”
সেই সকালেই নূরী জুলফাকে বাড়ি পৌঁছে দিলো। ফিরে এলো নিজের বাড়িতে। বোরকা খুলে বিছানায় গিয়ে গা এলিয়ে দিলো। নিজের ধর্ষক ও স্বামী হত্যার খু* নীকে চিহ্নিত করে নিজের হাতে কঠিনতম সাজা দিতে পারলো বলে স্বস্তির দম ছাড়লো। কাঠের ফ্রেমে বাঁধাই করা মকবুলের ছবিটির উপরে হাত বুলাতে লাগলো অসীম ভালোবাসায়। দু’চোখ গড়িয়ে অবিরাম অশ্রু ঝরছে। সে মনে করেছে সেদিন সত্যি ডাকাত ঢুকেছে তাদের ঘরে। জিনিসপত্র না পেয়ে তাকে ধর্ষণ করছে তিন ডাকাত মিলে। কিন্তু তার জানা ছিলো সম্পূর্ণ ভুল। যেটা কিনা গতরাতে নিশ্চিত হলো নূরী। ডাকাতেরা ডাকাতি করে, খোঁজ খবর নিয়ে সচ্ছল ও ধনী পরিবারে। এরা হলো ধর্ষক গ্রুপ। তালুকদারের দোসর। যাদের কাজই হলো রাতের আঁধারে নারীদের সম্ভ্রমহানি করে নিজেদের কামুকতার স্বাদ উপভোগ করা। তাদের টার্গেটে থাকতো, পাশ্ববর্তী গ্রামের সুন্দরী যুবতী স্ত্রী,বিধবা স্ত্রী, প্রবাসীদের স্ত্রী। বাদশার মাও ছিলো তার অন্যতম শিকার। কোন ধর্ষকের স্থান এই পৃথিবীতে হতে পারে না। নূরী মনের আশ মেটাতে পারলো বলে তালুকদারের উদ্দেশ্যে বিকৃত হাসি হাসলো।
বাদশা সকালে অন্যদিনের মতই তার দায়িত্বের কাজগুলো করে যাচ্ছে। রাত্রির দ্বিপ্রহরে যখন সে কাচারি ঘরে ফিরলো। বরকত তখন নিদ্রায় বেহুঁশ। আর দেখলেও সে বাদশাকে কিছু বলত না। কিছু মনেও করত না। বরকত স্বভাবে সহজ সরল। চোখের সামনের সবকিছুকে সরলরেখার মতো দেখে। বরকতের এই সারল্যতাকেও পুঁজি হিসেবে ব্যবহার করেছে বাদশা। নয়তো তার মতো ধুরন্ধর কেউ হলে প্রশ্নের বেড়াজালে ফেঁসে যেতো বাদশা।
রাজ চাচীর ঘরে গেলো। চাচীর মাথায় হাত বুলিয়ে শান্তনা দিলো। বলল,
“চাচী আমি চলে যাচ্ছি। আপনার ও নানুর দায়িত্ব নিলাম। তার আশা বাদ দেন। আর জুবায়েরের বিষয়ে চিন্তা করবেন না। আমি খবর নিয়েছি। জুবায়ের একটা মেসে উঠেছে। দোকানে আসা যাওয়া করছে। কিছুদিন গেলে ঠিক বাড়িতে চলে আসবে। ”
“বাবা তাই যেন হয়। এই ছেলেই আমার সব। যাও আল্লার হাওলা।”
রাজ ও তার বাকি দুই ভাই ঘরের দাওয়া ডিঙিয়ে উঠানে পা রাখলো। তাদের বিদায় জানাতে পুরো ঘরের সবাইও উঠানে নামলো। শিখা সংকোচে ঘরের ভিতরের মাঝ বরাবর চৌকাঠে দাঁড়িয়ে রইলো। রাজ এক সবার দৃষ্টিকে ফাঁকি দিয়ে শিখাকে এক পলক দেখে নিলো।
তক্ষুনি জোছনা সবার সামনে এসে তার স্বভাবসুলভ চঞ্চল কন্ঠে বলে উঠলো,
“ছোট চাচাত তার রুমে নাই। নাস্তা নিয়া ফিরা আইলাম।”
“হয়তো বাইরের টাট্টিখানায় গ্যাছে বা বাগিচায় গ্যাছে। দেখ গিয়া।” বলল সুফিয়া বিবি।
সেদিন রাতে খায়রুল তালুকদারের হাতের আংটি নিয়ে যে জঘন্য স্মরণীয় ঘটনা ঘটে গিয়েছে, তারপর হতেই সবাই মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে তার থেকে। কেউই তার সঙ্গে কথা বলে না। সে বাড়িতে না বাইরে, সে খবরও কেউ রাখেনি। সেও আর ডাইনিংয়ে খেতে আসে না। চায়না কারো সাথে তার দৃষ্টি বিনিময় হোক। কাজের লোকেরা তার রুমে বেলায় বেলায় খাবার দিয়ে আসে। সেও থাকে চোরের মতো। আমেনার সঙ্গেও কথা বলা বন্ধ করে দিয়েছে। একইভাবে আমেনা ও তার মা হারিছা খাতুনও তার সাথে কথা বলে না। ঘৃণায়,ক্রোধে,ব্যথায় আমেনার অন্তর ক্ষতবিক্ষত হয়ে গিয়েছে।
খালেদ ও আসলাম, বরকতকে আদেশ দিলো,
“পুকুর পাড়ে দেইখা আয়তো।”
বরকত এক দৌড়ে গিয়ে দেখে আসলো।বলল,
“না ভাইজান। নাইতো।”
রাজ তার জিপে উঠে বসলো ড্রাইভিং সিটে। বড় দুই ভাইকে তাগিদ দিয়ে বলল,
“আপনারা আসবেন? না আমি চলে যাবো একাই? কোথাও না কোথাও আছে। পাপের প্রায়শ্চিত্ত করছে হয়তো। উনার কথা চিন্তা করতেও আমার রূচিতে আটকায়। অথচ তাকে পিতার মতই শ্রদ্ধা করতাম। গুরুত্ব দিতাম। ভালোবাসতাম।”
খালেদ ও আসলাম ধীর পায়ে গাড়ির পিছনের সিটে গিয়ে বসলো।
তালুকদারের মনে খচখচানি শুরু হলো। ছোট ভাইটাকে তিনি অনেক স্নেহ করতেন। কি থেকে কি ঘটে গেলো। ভেবেই তিনি বরকতকে বললেন,
“দক্ষিণ ক্ষেতের আইলে আছে নি। দেইখা আয় তাড়া কইরা। যা।”
আমেনা স্থাণুবৎ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে বরই তলায়। তার পাশে হাঁটু ভেঙ্গে বসে আছে তার মা। রাজ গাড়ি স্ট্রাট দিলো। তক্ষুনি তাদের বাড়িতে প্রবেশ করলো একটি পুলিশের গাড়ি। তাদের পাশাপাশি এলো গ্রামের আরো বহুমানুষ।
তালুকদার বাড়ির সবাই স্তব্ধ হয়ে গেলো। রাজ,খালেদ ও আসলাম গাড়ি থেকে নেমে গেলো। সবাই গাড়ির দিকে এগিয়ে গেলো। একজন পুলিশ নির্দেশ দিলো উঠানে বড় একটি পাটি বিছানোর জন্য। ফুলবানু উড়ে গিয়ে পাটি এনে উঠানে বিছিয়ে দিলো। কনস্টেবল দুজন ভিতর থেকে একটি মৃতদেহ বের করে উঠানে সেই পাটির উপরে রাখলো। লা* শের মুখমণ্ডলসহ আপাদমস্তক আবৃত একরঙা একটি কাপড় দিয়ে। বরকত এসেই থমকে গেলো মানুষের জটলা দেখে। সে আর বলতে পারল না,কোথাও ছোট তালুকদার নেই।
মৃতের মুখ অনাবৃত করলো একজন পুলিশ কনস্টেবল। একমাত্র ভাইয়ের বিভৎস মৃতদেহ দেখে জয়নুল তালুকদার হায় হায় করে বসে পড়লেন। সুফিয়া কেঁদে উঠলো। বরকতরে পাঠিয়ে দিলো ননদ জাহানারার বাড়ি। আমেনার নির্বাক চোখজোড়া স্বামীর মুখের উপর নিবদ্ধ। তার দুচোখে কোন অশ্রু বর্ষণ হচ্ছে না। তবে থরে থরে নীল বিষাদেরা দলা পাকিয়ে তার গলায় আটকে আছে। সে না পারছে তার যন্ত্রণাগুলোকে গিলে ফেলতে। না পারছে উগরে দিতে।
শিখা মাথায় আঁচল টেনে লা* শের পাশে এসে দাঁড়ালো। তার অবাক চাহনিতে খেলা করছে কিছু প্রশ্ন। বাদশাও বাগিচার কাজ শেষ করে এসে পড়লো। সবাই পুলিশদের নানা সন্দেহজনক প্রশ্ন করে করে কান ঝালাপালা করে ফেলেছে। রাজ বাদশাকে বলল,
“তুই মার্কেটে চলে যা। জুবায়েরকে খবর পৌছানোর চেষ্টা কর।”
বাদশা যেন প্রাণে বাঁচল। তড়িঘড়ি করে বাড়ির প্রাঙ্গণ ছাড়লো সে।
রাজ পুলিশদের বলল,
“আমরা তিনভাই চলে যাচ্ছি ঢাকায়। এখানে আমার বাবা আছে। ফুফাতো ভাই সীমান্তও চলে আসবে। কাকার একমাত্র ছেলের জন্য লোক পাঠালাম। সেও এসে পড়বে। এবং আপনাদেরকে হেল্প করবে।”
“আপনারা এখন যেতে পারেন না। উনাকে হ*ত্যা করা হয়েছে। তদন্তের স্বার্থে আপনাদেরকে আমাদের প্রয়োজন। এমনওতো হতে পারে পারিবারিক কলহের জের ধরে আপনারা কেউ একজন এই হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছেন। নতুবা আপনাদের হাত রয়েছে এতে।”
রাজের দিকে দৃষ্টি তাক করে কড়া নির্দেশ দিয়ে বলল একজন পুলিশ কর্মকর্তা।
রাজ দোতলায় গিয়ে তার ব্রিফকেস রেখে আবার নিচে নেমে আসলো। পুলিশ কর্মকর্তা, লাশ কিভাবে, কোন অবস্থায়,কোথায় পাওয়া গেলো তা পূঙ্খানুপুঙ্খভাবে সবাইকে অবহিত করলো। বরকত চলে এলো। তাকে পাঠানো হলো আদুরীকে নিয়ে আসার জন্য।
তালুকদারের নিজের মেয়ে ছিল না বলে ভাতিজি আদুরীকে কন্যাসম স্নেহ করতো। এই ভিতরে বাদশাও চলে এলো। তার পিছন দিয়ে জুবায়েরও চলে এলো। তাকে জড়িয়ে ধরে আমেনা পাগলের মতো কাঁদতে লাগলো। জুবায়েরেরও চোখ ভিজে উঠলো। অন্যের সঙ্গে হয়তো তার পিতা খারাপ চলেছে। কিন্তু পিতা হিসেবে তার প্রতি দায়িত্ব ও ভালোবাসার নূন্যতম কার্পণ্য করেনি। জাহানারা এসে ভাইয়ের বুকের উপর আছড়ে পড়লো। স্বল্প কয়েকজন ছাড়া পরিবারের কারোই অশ্রুসজল হলো না তালুকদারের জন্য। এর অন্যতম কারণ আংটি নিয়ে সদ্য ঘটে যাওয়া ন্যাক্কারজনক ঘটনাটি।
পুলিশ কর্মকর্তা বলল,
” স্পষ্টত যে উনি হত্যার শিকার হয়েছেন। প্রচলিত ধারা অনুযায়ী ফৌজদারি কার্যবিধিতে উনার মৃত্যুর ময়না তদন্ত করা হবে। লা *শের শরীরে বহু ফোলা ফোলা দাগ পাওয়া গিয়েছে। অর্থাৎ স্বাভাবিক মৃত্যু হয়নি বলে সন্দেহের অবকাশ থাকলেও সেখানে মৃত্যুর কারণ জানার জন্য পোস্টমর্টেম করতে হবে। আমরা লা* শ মর্গে নিয়ে যাচ্ছি। একটি সুরতহাল প্রতিবেদন তৈরি করবো। আপনারা কি পরিবারের পক্ষ হতে থানায় মামলা বা সাধারণ ডায়রি করবেন? ”
কেউ কিছু বলছে না। এমনকি জুবায়েরও না। বাকিরাও সবাই নিরব। একে অপরের মুখ চাওয়াচাওয়ি করছে। পুলিশ কিছু বুঝলো। এবং বলল,
“ওকেহ! তাহলে আমাদেরই সাধারণ ডায়েরি করতে হবে। আপনারা সঙ্গে আসুন ময়নাতদন্ত শেষে লা* শ বুঝে নেওয়ার জন্য।”
পুলিশ পূনরায় ছোট তালুকদারের মৃতদেহ তাদের গাড়িতে তুলল। এবং জেলা সদর হাসপাতালের মর্গের উদ্দেশ্যে রওনা দিলো। তাদের পিছন দিয়ে গেলো জুবায়ের,সীমান্ত ও আসলাম।
রাজ,খালেদ, বাদশা,বরকত ও অন্যরা ব্যস্ত হয়ে পড়লো খাটিয়া আনা,বাঁশ কাটা,কবর খোদা,লাশের গোসল, ও দাফনের কাপড় কেনার কাজে। এই ভিতরে আদুরী এসে পড়লো। সে চাচীর গলা ধরে ছোট চাচার নানান স্মৃতিচারণ করতে করতে কেঁদে বুক ভাসিয়ে ফেলল। তাকে সবাই ঘটনার আদ্যোপান্ত বলল। বাদ গেলনা আংটি নিয়ে হাঙ্গামার বিষয়টিও।
ততৎক্ষনাৎ আদুরী সরে গিয়ে শিখার মুখোমুখি হলো। গলায় বিষ ঢেলে বলল,
“তুমি যে তালুকদার পরিবারের জন্য একটা অভিশাপ এইটা উপলব্ধি করতে পারছো? আমি তোমারে ছাড়ুম না। ”
শিখা নিরুত্তর রইলো। এবার আদুরী গিয়ে বাদশার দিকে চাইলো। ফোঁফানো স্বরে বলল,
“কিরে বাদশা,তুই না বিচক্ষণ? খুব ব্রেইন তোর? কাকাকে কে বা কারা মারলো সেইটা বাইর করার চেষ্টা কর। এই কাকায় তোরে আমাদের বাড়িতে আইনা আশ্রয় দিছে। তোদের মা ছেলের ভাত,কাপড়ের ব্যবস্থা করছে। তোরে কত মায়া করতো। দুই হাত ভইরা জিনিসপত্র দিতো,এইসব আমি নিজচোখে দেখছি।”
বাদশা আদ্র কণ্ঠে শান্তনার বাণী শোনালো আদুরীকে। বলল,
“আপনার সব কথাই ঠিক আপা। অস্বীকার করার সুযোগ নাই। আমি পুলিশের চাইতে বেশিকিছু হইনাই। ময়নাতদন্তের রিপোর্ট আসুক। তারা কি বলে আগে আমরা সেইটা শুনি। একটু সবুর করেন আপা।”
আদুরী এবার গিয়ে রাজের মুখোমুখি দাঁড়ালো। পূর্ণ অভিযোগে আঙ্গুল তুলে বলল,
রাজবধূ পর্ব ৩১ (২)
” ছোট ভাইয়া, সব শোনার পর আমার মন বলছে কাকাকে হয়তো তুমি মেরে ফেলছ লোক লাগিয়ে?”
রাজ সবার সম্মুখে আদুরীর গালে সপাটে চড় বসিয়ে দিলো। মুহূর্তেই থমথমে পরিবেশ আরো বিপজ্জনকভাবে থমথমে হয়ে গেলো। ভর দুপরেও প্রগাঢ় নৈঃশব্দতা বিরাজ করলো তালুকদার বাড়ির উঠানজুড়ে সবার মাঝে।
তা দেখে বাদশা তপ্ত স্বাস ছাড়লো। রাজের চৌকষ চাহনি স্থির হলো বাদশার মুখপানে।