রাজবধূ পর্ব ৩৩

রাজবধূ পর্ব ৩৩
রেহানা পুতুল

রাজ সবার সম্মুখে আদুরীর গালে সপাটে চড় বসিয়ে দিলো। মুহূর্তেই থমথমে পরিবেশ আরো বিপজ্জনকভাবে থমথমে হয়ে গেলো। ভর দুপরেও প্রগাঢ় নৈঃশব্দতা বিরাজ করলো তালুকদার বাড়ির উঠানজুড়ে সবার মাঝে।
তা দেখে বাদশা তপ্ত স্বাস ছাড়লো। রাজের চৌকষ চাহনি স্থির হলো বাদশার মুখপানে।
সে তিন পা এগিয়ে বাদশার নিকটে গেলো। বরফ অথচ বলিষ্ঠ স্বরে বলল,

“বাদশা, আমরা তিনভাই গ্রামে থাকি না। বড় ভাই জীবিত নেই। আব্বা বয়স্ক মানুষ এবং তার ছোটভাইকে অনেক স্নেহ করে। ঘরের মহিলাদের কর্ত্রীগিরি বাড়ির দেয়াল পর্যন্তই। জুবায়ের সকালে যায় রাতে ফিরে বাড়িতে। আমার জানামতে চাচার কোন শত্রু নাই। বাড়ি ও বাইরে তুই সামলাস। আমার মনে হয় তুই একটু মাথা খাটালে অন্তত কিছুটা হলেও ধারণা করতে পারবি চাচার মৃত্যু রহস্য।”
বাদশার রুহ বেরিয়ে যাওয়ার উপক্রম। রাজের অলক্ষ্যে শুকনো ঢোক গিললো বার দুয়েক। নিজেকে স্থির রেখে জ্ঞানগর্ভের সুরে বলল,

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

“আপনের সব কথাই ঠিক ছোট ভাই। আগে রিপোর্ট পাই আমরা হাতে। দেখি না কি ধরা পড়ে। চাচার শত্রু নাই এইটা ভুল। উনার কিছু শত্রু আছে। উনার প্রথম শত্রু উনার স্ত্রীই। আপনি নিজ কানেই সেদিন শুনলেন কিছু কথা চাচীর মুখে। তাইলে কি তালুকদারির ক্ষমতা প্রয়োগ কইরা আরো দুই চাইরজন নারীর সঙ্গে কিছু করেনাই সে? বাকি রইলো জমির কথা। উত্তর পাড়ার খালের পাশের দুই কানি ফসলি জমি নিয়াতো গ্যাঞ্জাম বহুদিন ধইরাই। এইটা আপনার আব্বাও জানে। আপনি বাইরে থাকেন বইলা জানেন না। চাচাও আপনেরে এসবে জড়াইতে চায় না। তাই শুনায় না আপনারে। এছাড়াও কিছু মানুষের সাথে উনার হালকা পাতলা ঝামেলা ছিলো। ”
রাজ অবাক কন্ঠে বলল,

” কি বলিস? এসবই ত আমার অজানা। অবশ্য আমি নিজেই বাড়ির এসবে হস্তক্ষেপ করিনাই কখনো। জমি নিয়া কি গ্যাঞ্জাম? বুঝলাম না? আচ্ছা সেসব পরে শুনবো। কাকারে কে বা কারা হত্যা করতে পারে তুই এইটা নিয়া ভাব। তুই বাড়িতে থাকিস। তাই বাড়ির সব বিষয়ে তুই আমাদের চেয়ে বেশী অবগত।”
রাজের আদেশ শিরোধার্য বুঝিয়ে বাদশা মাথা দোলালো। রাজ ঘরে চলে গেলো। তাকে দেখে শিখাও এগিয়ে এলো। রাজ শিখার রুমে গেলো। বিছানার একপাশে বসলো পায়ের উপর পা তুলে। বিপুল উদ্বিগ্নতা ও উৎকন্ঠা তার মুখমন্ডলজুড়ে। শিখা নিরস ভঙ্গিতে বসলো একটি বেতের মোড়ায়। রাজ শিখার কাছে জানতে চাইলো,

“আচ্ছা শিখা, কাকার হঠাৎ মৃত্যুর রহস্য কি হতে পারে?”
শিখার নিঃসংকোচ জবাব।
“আমি তো আপনাগো এত তালুকদারি ও আগে পরের খবর জানি না। তবে আংটি নিয়া ঘটনার জন্য মনে হয় আপনের হাত আছে।”
“তাহলে ত আদুরীরও এমন মনে হওয়া অমূলক নয়। কিন্তু সত্যি কথা হলো আমিও সবার মতো কাকার মৃতদেহ দেখে হাইলি শকড হয়েছি। আমি কাকার হত্যাকারীকে খুঁজে বের করবই। দশবছর পরে হলেও।”
ম্লানমুখে বাক্যগুলো আওড়েই রাজ শিখার রুম হতে প্রস্থান নিলো।

এদিকে আদুরীকে চড় মারার জন্য কেউই রাজের সঙ্গে প্রতিবাদ করল না। তবে ঘরের কারো কারো কাছে আদুরীর বলা কথাটি বিশেষ গুরুত্ব পেলো। এমনকি শিখার কাছেও। সদ্য পরিস্থিতি তাই নির্দেশ করে।
আদুরী পিতাকে খুঁজে বের করলো। ভাইয়ের নামে নালিশ করলো। তার বাবা ক্ষুব্ধ কন্ঠে বলল,
“সেতো তোরে একগালে থাপ্পড় মারছে। আমি হইলে দুইগালে মারতাম। এত ব্যাক্কল হইলি কবে থেইকা তুই? এতগুলা মানুষের সামনে আপন ভাইরে খু* নী সাব্যস্ত করতে তোর কলিজা কাঁপল না? এখন মনে মনে অন্যসবাইও ভুল বুঝবো রাজেরে। যেহেতু তার বউরে নিয়া বিরাট ঝামেলা হইছে।”
আদুরী বাবার কাছে প্রশ্রয় না পেয়ে চলে গেলো চাচীর কাছে।
খায়রুল তালুকদারের লা*শ নিয়ে এলো পুলিশ বিকেলে। পুলিশ জানালো,

“ময়নাতদন্তের রিপোর্ট হাতে আসতে দুই তিনদিন সময় লাগবে৷ সেই অনুযায়ী আমরা তদন্তে নামবো আসামী ধরার। আপনারা দাফন সম্পন্ন করতে পারেন।”
আদুরী ঘরের ভিতর হতে এলোমেলো পায়ে বেরিয়ে এলো। পুলিশদের বাষ্পরুদ্ধ কন্ঠে জিজ্ঞেস করলো,
“কাকার লা*শ দেখে আপনাদের খবর দিলো কে?”
“রিপিট করতে পারব না। উনাদের থেকে জেনে নিন। আপনাদের পক্ষ থেকে কেউ কারো বিরুদ্ধে অভিযোগ আনল না। মামলা করল না। আমরাই মামলা করেছি। যেহেতু এটা নিশ্চিত হত্যাকাণ্ড!”
পুলিরেরা চলে গেলো। আদুরী ও তার ফুফু জাহানারা, জুবায়ের,সীমান্ত ও আসলামের দিকে প্রস্নাতীত চোখে তাকালো। তার সঙ্গে আশেপাশের বাড়ির মানুষগুলোও উৎসুক চোখে তাকিয়ে রইলো সব শোনার জন্য।জুবায়ের মায়ের কাছে চলে গেলো। সীমান্তও অন্যদিকে কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়লো। আসলাম বোনের মাথায় হাত দিয়ে শান্তনা দিতে দিতে বলল,

” সকালে আমাদের গদির সামনে দিয়ে যাওয়ার সময় কে যেন গদির গেট খোলা দেখলো। তার কৌতুহল জাগলো। এই সময় গদির গেট খোলা থাকবে কেন? গদির লেনদেন শুরু হয় দশটা থেকে। ম্যানেজার গদির তালা খোলে নয়টার দিকে। সেই লোক ভিতরে গিয়ে কাউকেই দেখল না। গদির পিছনের রুমের মেঝেতে বস্তাবন্দি একজন মানুষকে আবিষ্কার করলো সে। তখন সে হন্তদন্ত হয়ে বাইরে গিয়ে কাকে যেন বলল। তারাও ভিতরে গিয়ে দেখলো বস্তার ভিতরে একজন মানুষ। মৃত ও শক্ত হয়ে আছে। তারা কেউ থানায় গিয়ে পুলিশকে জানালো। পুলিশ গিয়ে বস্তার বাঁধন খুলে ফেলল। তখন তারাই বলল এটা খায়রুল তালুকদার। পুলিশ প্রাথমিক তদন্ত করে ধারণা করলো, হয় পারিবারিক দ্বন্দ্বের জের ধরে পরিবারের কেউ মেরেছে উনাকে। নয়তো তার চেনা কোন শত্রু মেরেছে তাকে। দুর্বৃত্তরা নয় তবে। তারা হলে গলা কেটে বা কুপিয়ে হত্যা করতো। কিন্তু এখানে উনার মারার সিমটমসগুলো ভিন্ন ধরনের।”

আদুরী দপ করে মাটিতে বসে পড়লো। রাজ বাদশাকে পাঠালো মধুপুর গ্রামে নূরীকে নিয়ে আসার জন্য। তাদের পারিবারিক বিপদে শাশুড়ীর উপস্থিতি জরুরী। নয়তো চারপাশ থেকেই কথা উঠবে। বাদশা নূরীকে তালুকদার মৃত্যু নিয়ে উৎকন্ঠিত সুরে বলল,
“যদি ধরা পইড়া যাই আপনে, আমি?”
“আমার সমস্যা নাই এতে। দুই মাইয়ারে দুই বান্দার হাতে তুইলা দিছি। এবার ফাঁসীর কাষ্ঠে ঝুলতেও রাজী আছি। তবুও এক ইতর,বর্বরকে মারতে পারছি এইটাই শান্তি। তোমার চিন্তা কি? রেকর্ড কইরা নিছো সব। প্রমাণ ত যথেষ্ট আছেই। তবুও একটু গা ঢাকা দিয়া চইলো তুমি। অন্য জায়গায় ঘুমাইও।”
“তা ঠিক কইছেন খালাম্মা। কিন্তু গা ঢাকা দিয়া চলতে গেলে সন্দেহ বাড়বো সবার। আমি আগের জায়গায় ঘুমামু। রক্ষা করার মালিক আল্লাহ। তিনি ভালো বুঝেন। ”

নূরী এলে শিখা তাকে আংটি নিয়ে কাহিনীটা সব বলল। নূরী নাক সিঁটকে ভ্রুকুটি করব বলল,
“আল্লাহ উত্তম ফয়সালাকারী মা। এজন্য কোন মানুষ স্ত্রীরে তালাক দেয়? একটা মাত্র ছেলে তারেও ত্যাজ্যপুত্র ঘোষণা দিলো? তুই দরকার না পড়লে কারো গায়ে পইড়া বেশি কথা কইস না। জামাইয়ের লগেও বুইঝা চলিস।”
“হ আম্মা। বুইঝাই চলি।”
রাতের এশার নামাজের পর ছোট তালুকদারের দাফন সম্পন্ন হয়ে গেলো। তবে তার পূর্বেই আমেনা বিবির বৈধব্য বেশ নিয়ে নিয়ে প্রশ্ন উত্থাপন হলো। মসজিদের বড় হুজুর সব শুনে বললেন,

“যেহেতু আক্রোশে সবার সম্মুক্ষে তালুকদার সাহেব মুখে তিন তালাক উচ্চারণ করে ফেলেছে বিবির উদ্দেশ্যে। সুতরাং তালাক শরিয়াহ অনুযায়ী কার্যকর হয়েছে। সেই হিসেবে উনি তালুকদার সাহেবের স্ত্রী নয় এখন। কেবল তার সন্তানের জননী। তাই উনার গোসল,সাদা কাপড় পরিধান, শরীলের অলংকার খোলা,এসব একেবারেই নিঃষ্প্রয়োজন।”

সবাই আলহামদুলিল্লাহ বলে স্বস্তির স্বাস ছাড়লো। আমেনা হাহাকার জাগানিয়া দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো। সেতো এমন কিছু কখনোই প্রত্যাশা করেনি স্বামীর কাছ থেকে। জুবায়ের মাকে আষ্ঠেপৃষ্ঠে বুকে লেপ্টে নিলো। মায়ের নিজের হাতের রুমাল দিয়ে বারবার মায়ের অশ্রুসজল দুটো আঁখি মুছে দিতে লাগলো। নূরী পরেরদিন চলে গেলো।
জয়নুল তালুকদার ও জাহানারার অন্তিম ইচ্ছায় বেশ ঘটা করে ছোট তালুকদারের তিনদিনের কুলখানি সম্পন্ন হলো। নূরী ও তার বড় মেয়ে আলোর পরিবারের সবাই এলো সেদিন। রাজের অনুরোধ তারা রয়ে গেলো শিখার কাছে। সেই সন্ধ্যায় শিখা রাজের সঙ্গে দেখা করলো। নম্রস্বরে বলল,
“আমি বুবু ও আম্মার লগে কাইল চইলা যাইতে চাই। এখানে আমার মন টিকতেছে না।”
“কি করলে মন টিকবে?”
“জানি না।”

শিখার কন্ঠে অভিমান চুইয়ে চুইয়ে পড়ছে। রাজ তা উপলব্ধি করতে পারলো। বলল,
“আমরা তিনভাই সকালে চলে যাবো। তুমি যেও আম্মার সাথে। তবে বিকালে।”
শিখার গোলাপি আভার অধর প্রান্তে হেমন্তের সোনাঝরা মিঠে রোদের ন্যায় এক চিলতে হাসি ফুটে উঠলো।
“ধন্যবাদ আপনাকে।” বলল শিখা।
“যার থেকে আরো বেশিকিছু প্রাপ্য আমি। তার থেকে শুধু ধন্যবাদ পেলে আমার পোষাবে না। বাকি থাকুক। সময় হলে তোমার সকল ঋণ পরিশোধের ব্যবস্থা করে দিবো। ও হ্যাঁ, বসে না থেকে সময়কে কাজে লাগিও। ইংলিশ ডিকশনারির ওয়ার্ডগুলো যথাসম্ভব আয়ত্তে নিয়ে এসো। পথ চলায় এটার বিকল্প নেই। আমি বাড়ি এসে ধরবো সব।”

রাজ চলে গেলো বরাবরের মতো নবাবী স্টাইলে হেঁটে। শিখা পিছন দিয়ে দুষ্টমির ছলে ভেংচি কেটে বলল,
“ইসসইরে.. আইছে আমার শহুরে মাষ্টারসাব। ফ্রি হইয়া গ্যালে এমন জ্বালা দিমু আমি,জ্বালার চোটে পাগল হইয়া যাইবেন।”
পরেরদিন সকালে নাস্তা খেয়ে রাজ আমেনার রুমে গেলো। জুবায়েরকে ডাক দিলো। জুবায়ের এলে সে আমেনা ও হারিছা খাতুনের সামনে তাকে বলল,

“শোন ভাই, আমরা বড় দুঃসময় পার করছি। জেদ ধরে রাখিস না আর। তোর বাবার ইতিহাস ক্লোজ হয়ে গিয়েছে। তাই তুই আর বাইরে থাকিস না। বাড়ির চারপাশ বড় ভাই, চাচা দেখতো। দুজনই বেঁচে নেই। আমাদের বংশগৌরব টিকিয়ে রাখতে হলে তোর মজবুত হতে হবে। বলিষ্ঠ হাতে সব মোকাবিলা করতে হবে। বাবা বেশ নরম হয়ে গিয়েছে। ভাইকে হারিয়ে মানসিকভাবেও বিপর্যস্ত উনি। চাচী ও নানুর দিকে ভালোভাবে খেয়াল রাখিস। আমার মায়ের দিকেও খেয়াল রাখিস। আমি চলে যাচ্ছি। ”
জুবায়ের রাজের কাঁধে হাত রেখে আস্বস্ত করলো বাড়িতে থাকবে বলে।

রাজ বাকি দুইভাই সহ ঢাকায় চলে গেলো। বিকেলে শিখা চলে গেলো বোন ও মায়ের সঙ্গে। তাদেরকে এগিয়ে দিলো কেউ কেউ । সবাই নয়। তালুকদার বাড়ির মুখরিত পরিবেশ শোকাতুর! বিষন্ন! ঘোলাটে! ধূসর! নিরানন্দ পরিবারটিতে দাস দাসীসহ সবাই ঝিমিয়ে ঝিমিয়ে থাকে এখানে ওখানে। কারো মুখে এতটুকু হাসি নেই। আবশ্যক না হলে কেউ কারো সঙ্গে কথাও বলে না। সুফিয়া বিবি ও তার একমাত্র মেয়ে আদুরীর মনের অবস্থাও বেহাল। অপরদিকে তাদের মনে বেজায় ক্ষোভ শিখাকে নিয়ে। তাদের ভাষ্য, শিখা তাদের সংসারে আসার পর হতেই নানাধরণের বিপদ হতে লাগলো তাদের জীবনে। শিখা একটা কুফা! অলক্ষী! অপয়া! সর্বনাশী মেয়ে! শিখাকে কিছু একটা করতে হবে
তার পরেরদিন বাদশা,ফুলবানু ও বরকত বাগানের অন্দরে প্রবেশ করলো। এই ভিতরে বাদশার আসা হয়নি। আজও আসত না। যদি না মতির মা তাকে বাগানের কাজের তাড়া না দিতো। বরকতকে বাদশা আদেশ দিয়ে বলল,
“আমিও আসিনাই। তুইও আইলিনা। দেখ কতগুলান ডালপালা,সুপারি পাতা পইড়া আছে। নাইয়েল শুকায়া পইড়া রইছে গাছের গোড়ায়। এগুলা নিয়া যা তুই।”

বরকত তার কাজ শেষে বাগান হতে বেরিয়ে গেলো। ফুলবানু বাগানের ভিতরে একাজ ওকাজ করছে আর আড়চোখে বরকতকে দেখছে। বরকত চলে এলে, সে পা চালিয়ে বাদশার কাছে এলো। দুঃখিত গলায় বলল,
“আসলেই বাদশা ভাই। রাজ ভাই বিয়া করনের পর থেইকাই ক্যামুন জানি সব ওলট-পালট হইয়া যাইতাছে এদের ঘরদুয়ারে।”

“সেটাই ত দেখতাছি রে ফুল। তাদের যা হওয়ায় হউক। আমি তোমারে নিয়া বাঁচতে পারলেই সুখী।”
বাদশার কন্ঠে আকুলতা দেখে ফুল লজ্জা লজ্জা স্বরে জিজ্ঞেস করলো,
“আমিও এই বাড়ির ছায়া থেইকা মুক্ত হইতে চাই। কবে লাল শাড়ি কিনবেন আমার লাইগা?”
বাদশা ফুলকে জড়িয়ে ধরে। ফুলের কোমল ঠোঁটে নিজের শুকনো দুই ঠোঁটের ঈষৎ উষ্ণ ছোঁয়া দিয়ে বলল,
“এই বাড়ির কাহিনীর জন্যই ত সিদ্ধান্ত নিতে পারতেছি না। প্রস্তুতির দরকার আছে যে। দেখি এইমাসের শেষের দিকে তোমারে আমার ঘরে নিয়া যামু হয়তো। লও বাড়িত যাই।”

শুনে ফুলের সারাগাল ঝিলিক মেরে উঠলো জ্বলজ্বলে মুক্তোর দানার মতো।
তার তিনদিন পরের কথা। ঊষালগ্ন পেরিয়ে গেলো। গাছের ডালে ডালে এক ঝাঁক পাখির কিচিরমিচির ডাক শুরু হলো। একটি ক্ষুর্ধাত কাক গলা ফাটিয়ে কা কা রবে উড়ে গেলো দিগন্তের পানে। রবির কিরণ মাত্রই তার অস্তিত্ব জানান দিলো। তক্ষুনি কাচারিঘরের দরজায় ঠকঠক আওয়াজ হলো। কিন্তু কেউ কথা বলছে না। বরকত চোখ র* গড়াতে র*গড়াতে দরজা খুলে দিলো। তার পাশাপাশি হাই দিতে দিতে বাদশাও বিছানা হতে নেমে এলো।
একজন পুলিশ, বাদশার হাত মুরগী ধরা চোরের মতো খপ করে ধরে ফেলল। বাদশাকে তারা লা* শ নিয়ে আসার দিনই চিনে গিয়েছে। বাদশার দুই হাত একত্র করে হ্যান্ডকাফ পরিয়ে নিলো। বরকত তাদের পাশ কাটিয়ে চিলের মতো উড়ে গেলো ঘরের ভিতর। ব্যথিত গলায় উদভ্রান্তের মতো সবাইকে বলল,

“বাদশা ভাইরে পুলিশ হাতকড়া পরাইয়া থানায় নিয়া যাইতাছে। আসেন ত্বরাতরি।”
তালুকদার,জুবায়ের ও ঘরের বাকি সবাই হন্তদন্ত হয়ে ছুটে গেলো কাচারিঘরের সামনে। ফুলবানু ফ্যালফেলিয়ে কেঁদে ফেলল ছোট বাচ্চার ন্যায়। সেও সবার পিছনে গুটিসুটি মেরে দাঁড়িয়ে রইলো। জুবায়ের কড়া গলায় পুলিশদের অনুরোধ করে বলল,
“আশ্চর্য! আপনারা কিসের ভিত্তিতে তাকে এরেস্ট করেছেন? আমার জন্মদাতা পিতা খু *ন হলো। কিন্তু আমার বা আমাদের কারোই বাদশার উপরে কোন সন্দেহ নেই। তাকে ছেড়ে দিন।”
জুবায়েরের কথার সঙ্গে সুর মিলিয়ে একই কথা বলল জয়নুল তালুকদার ও ঘরের অনান্য মহিলারাও। কিন্তু পুলিশ তাদের কারো কথায় কর্ণপাত করল না। ধীর কন্ঠে বলল,

” ময়নাতদন্তের রিপোর্ট হাসপাতাল হতে আমাদের কাছে পৌঁছেছে। সেই সূত্র ধরেই
আমরা এই কয়দিন আপনাদের গদির বাজারে গিয়ে তদন্ত করেছি। নানানভাবে জিজ্ঞাসাবাদ করেছি অনেকেরেই। কেউই কাউকে দোষী করে কিছু বলল না। তবে একটা কথা জোর দিয়ে সবাই বলেছে। বাদশাকে নিয়ে জেরা করলে কোন ক্লু পাওয়া যেতে পারে। আপনারা চিন্তা করবেন না। বাদশা নির্দোষ প্রমাণ হলে বেকসুর খালাস পাবে। আপনারাও যা বলার তার পক্ষে থানায় গিয়ে বলবেন। আমরা উপরের নির্দেশ পালন করেছি মাত্র।”

রাজবধূ পর্ব ৩২

কথাগুলো বলেই তারা এক মুহূর্ত বিলম্ব করল না। বাদশাকে তাদের গাড়িতে তুলে নিয়ে গেলো। বাদশা কিছুই বলল না কাউকে। কেবল অবসন্ন বিকেলের মরা রোদের মতো তার ফুলের দিকে অপলক চেয়ে রইলো।

রাজবধূ পর্ব ৩৪