প্রেমপিপাসা পর্ব ১০

প্রেমপিপাসা পর্ব ১০
সুমাইয়া সুলতানা

শীতের দিনের সন্ধ্যায় শহুরে আবহাওয়া এক ধরনের নরম এবং শান্ত পরিবেশ তৈরি করে। দিনের আলো ম্লান হয়ে গিয়ে ধূসর আভা ছড়ায়। রাস্তার ল্যাম্পপোস্টগুলো একে একে জ্বলে উঠে, তাদের হলুদাভ আলোয় শহরটাকে আরও মায়াবী করে তোলে। শীতল হাওয়া শহরের রাস্তা, গলি, এবং উঁচু ভবনের ফাঁক গলে বয়ে যায়। চারপাশে মানুষের কোলাহল কিছুটা কমে আসে, তবে রাস্তার চায়ের দোকানগুলোতে জমে ওঠে আড্ডা। গরম চায়ের ধোঁয়া কুয়াশার সঙ্গে মিশে এক ধরনের নস্টালজিক পরিবেশ সৃষ্টি করে। কেউ ব্যস্ত জীবনের ধকল শেষে ঘরে ফেরার পথে, আবার কেউ সন্ধ্যাকে উপভোগ করতে বেরিয়েছে।

এরকম মনোমুগ্ধকর সন্ধ্যায়, রাহাত ব্যস্ত হাতে টাই ঠিক করছে। পরিপাটি পোশাক, সুট-বুট পরা অবস্থায় তাকে বেশ রূপবান দেখাচ্ছে। চুলগুলো জেল দিয়ে সেট করা। জরুরি কাজ পড়ে গিয়েছে। অফিসে নতুন দায়িত্ব নিয়েছে, সময়মতো পৌঁছাতে হবে। গ্যারেজ এর সামনে তার গাড়ি দাঁড়িয়ে আছে। পাশে রাহাত বুকে হাত গুঁজে সটান হয়ে দাঁড়িয়ে। হঠাৎ গাড়ি স্টার্ট হচ্ছিল না। ভাগ্য ভালো গ্যারেজ এর কাছাকাছি আসার পর খারাপ হয়েছে। নয়তো গাড়ি একা ঠেলে গ্যারেজ পর্যন্ত নিয়ে আসা যেতো না। আবার গাড়ি মাঝ রাস্তায় ফেলে চলে যাওয়া সম্ভব না। পারিবারিক গাড়ি নয়, এই গাড়ি অফিস থেকে দিয়েছে যাতায়াতের সুবিধার জন্য।

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

গাড়ি ঠিক হওয়ার পর, পেমেন্ট করে দেয়। গাড়িতে উঠতে যাবে, তক্ষুণি মিষ্টি হাজির। ভার্সিটি শেষে বান্ধবীর বাড়ি গিয়েছিল। ফিরতে ফিরতে সন্ধ্যা। পথিমধ্যে গ্যারেজে নজর পড়তেই, রাহাত’কে দেখতে পায়। মন পায়রা তখন উড়ু উড়ু করতে লাগলো। উড়নচণ্ডী চঞ্চল মেয়ের নেত্রদ্বয় চকচক করে উঠল। শুধু ক্রাশ না, পছন্দের তালিকায় রাহাত শীর্ষে। সেজন্য রাহাত’কে দেখা মাত্র দৌড়ে বড়ো ছোট গাড়ি পাড় করে, সামনে এসে দাঁড়ায়।
মিষ্টি’কে দেখে রাহাতের ভ্রু কুঁচকে গেল। রাশভারী কন্ঠে শুধাল,

” তুমি এখানে কি করছো? ”
মিষ্টি নামের মতো মিষ্টি হেসে বলল,
” আগেই বলেছি, আপনি যেখানে মিষ্টি সেখানে।”
” ফলো করতে নিষেধ করেছিলাম না? ”
” সত্যি বলতে আজ ফলো করিনি। ভাগ্য আমাদের দেখা করিয়ে দিয়েছে। ”
মিষ্টি মোহনীয় স্বরে জানায়। অধরের চমৎকার হাসি দেখে মনে হচ্ছে, যেন কোনো বিশেষ সুখবর দিতে এসেছে।
রাহাত গম্ভীর গলায় আদেশ ছুড়ল,
” বাসায় যাও। কিছুক্ষণের মধ্যেই সন্ধ্যা বিলীন হয়ে রাত্রিতে রূপ নিবে। ”
মিষ্টি মাথার ওড়না ঠিক করতে করতে এগিয়ে এসে বলল,
” রাত হলে আমার সমস্যা নেই। আপনি আমাকে পৌঁছে দিবেন। ”
রাহাত বিস্ফোরণ চোখে তাকায়। কন্ঠে অবাক ঢেলে শুধায়,
” আমি কেন তোমাকে পৌঁছে দিবো? আমি কি তোমার গার্ডিয়ান? ”
মিষ্টি লাজুক হেসে জানালো,
” এর চেয়েও বেশি কিছু। ”

মিষ্টি’কে ইগনোর করে রাহাত গাড়িতে উঠতে উদ্যত হয়। কানে আবারও ভেসে আসে মিষ্টির সুরেলা আওয়াজ,
” যাবেন না কোথাও। আপনার সাথে আমার কথা আছে। সুট-বুট পরে একদম হিরোর মতো সেজে কোথায় যাচ্ছেন, শুনি? গার্লফ্রেন্ডের সঙ্গে দেখা করতে? এসব গার্লফ্রেন্ড বাদ দেন। তাদের জায়গায় আমাকে পাত্তা দেন। ”
রাহাত বিরক্ত হয়। মুহূর্তে অভিব্যক্তি বদলে যায়। সরু দৃষ্টি তাক করল মিষ্টির উপর। কন্ঠ খাদে এনে চিবিয়ে চিবিয়ে বলল,
” লিসেন মিষ্টি না তেঁতো? সে যাইহোক। তোমার উড়নচন্ডী বেলেল্লাপনা কাজকর্ম দেখলে মনে হয়, তুমি অন্য কোনো দুনিয়ায় থাকো। সহজ বাক্য মাথায় ঢুকে না। তোমার কথাবার্তা শুনে সত্যিই আমার ধৈর্য্য হারাচ্ছে। মেজাজ খারাপ হচ্ছে। ”
মিষ্টি সিরিয়াস গলায় ভ্রু নাচিয়ে জিজ্ঞেস করে,

” হায় আল্লাহ! ধৈর্য্য হারাচ্ছে কেন? আপনি কি এক্ষুনি আমার সাথে ই-য়ে করতে চাইছেন? ইম্পসিবল! আগে বিয়ে, তারপর ই-য়ে। আর আমি কোনো দুনিয়ায় থাকি, সেটা নিয়ে আপনার মাথা ঘামানোর দরকার নেই। ভাবতে ভাবতে আপনার মস্তক ক্ষয় হয়ে যাবে, তবুও উত্তর পাবেন না। তাই না ভাবাই ভালো। ”
রাহাত ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেল। হতবিহ্বল অক্ষিপট বড়ো বড়ো করে তাকায়। অবিশ্বাস্য গলায় চেঁচিয়ে বলে,
” হোয়াট! আর ইউ ম্যাড? হোয়াট আর ইউ সেইঙ? অ্যান্ড হোয়াট ডু ইউ মীন বাই ই-য়ে? ”
আড়ষ্টতায় সর্বাঙ্গ বুঁদ হলো মিষ্টির। কিন্তু দমে গেল না। একরাশ লজ্জা মিশ্রিত আঁখি তুলে চায়। দ্বিধাহীন জানায়,
” বুঝতে পারেন নি? আ রে ওই যে বাসর রাতে হয় না, ই-য়ে? সেই ই-য়ের কথা বললাম। ”
এবার রাহাত সত্যিই রেগে গেল। চোখ গরম করে বলল,

” বেয়াদবির একটা লিমিট থাকে, মিস মিষ্টি। ”
মিষ্টি কথার মাঝে ফোড়ন কেটে তৎক্ষনাৎ বলে,
” মিস মিষ্টি না বলে, মিসেস রাহাত বললেও তো পারেন। ”
রাহাত তেতে উঠল। তেজি গলায় কাটকাট জবাব দেয়,
” তোমার এই দুষ্টুমি আমার ভালো লাগছে না। ইম্পর্ট্যান্ট কাজে যাচ্ছি, লেট হয়ে যাচ্ছে। তুমি এসে, সো কোল্ড লজিকল্যাস কথা বলে আরও লেট করে ফেললে। সোজা নিজের রাস্তা মাপো। আমার পেছনে ঘুরঘুর করো না। গেট ইট? ”
মিষ্টির কোনো ভাবান্তর ঘটল না। ভাবলেশহীন ভঙ্গিতে উত্তর দিল,
” আপনার কথা শুনতে আমি বাধ্য না। একশো বার ঘুরবো, হাজার বার ঘুরবো আপনার পিছে। দেখি আপনি কি করেন। ”
রাহাত এক মুহূর্ত দাঁড়াল না। মেয়েটা একটা সাইকো! এর সাথে কথা বাড়িয়ে লাভ নেই। মিষ্টির কথায় পাত্তা না দিয়ে গাড়ির দরজা খুলে সিটে বসে পড়ল। সাই-সাই করে ছুটতে লাগলো চার চাকা ওয়ালা গাড়ি। মিষ্টি রাস্তার মাঝখানে দাঁড়িয়ে গাড়ির ছুটে চলা চেয়ে চেয়ে দেখল।

বিশাল ড্রয়িংরুম জুড়ে হৈ-হুল্লোড়। টিভিতে ক্রিকেট ম্যাচ চলছে। পপকর্ন হাতে সায়র, টুটুল বসে খুব মনোযোগ সহকারে খেলা দেখছে। কিছুক্ষণ পর পর বাজখাঁই গলায় শব্দ তুলছে দুজন। প্রত্যাশ চশমা চোখে নিউজ পেপার পড়ছেন। রাতের খাবারের আয়োজন করতে রান্নাঘরে তোড়জোড় চলছে। সায়রা রান্না করছেন। তাকে সাহায্য করছেন রুবিনা।

এত এত চিৎকার চেঁচামেচিতে অরুর মাথায় যন্ত্রণা হচ্ছে। সে বিছানায় সটান হয়ে শুয়ে। কম আঘাত পাওয়া হাতে ভর দিয়ে, বালিশে হেলান দিয়ে উঠে বসলো। মাথাটা যন্ত্রণায় ছিঁড়ে যাচ্ছে। প্রকৃতির ডাক পড়েছে। ওয়াশরুমে যেতে হবে। পুরো রুম চোখ বোলালো। ঘাড় উঁচু করে দরজায় দৃষ্টি তাক করল। কাছাকাছি কেউ নেই। গলার স্বর মোটা করে কাউকে ডাকবে সেটাও সম্ভব না। এদিকে প্রকৃতির ডাকে সাড়া দেওয়া অত্যন্ত জরুরি। অরু আস্তে ধীরে বিছানা থেকে নামল। পায়ের গোড়ালিতে মট করে আওয়াজ হয়। তৎক্ষনাৎ ঠোঁট ফুঁড়ে বেরিয়ে এলো অস্পষ্ট ব্যথাতুর শব্দ,

” আহ্, আব্বু। ”
অরু ফুঁপিয়ে কেঁদে ওঠে। ব্যথায় চোখ, কপাল কুঁচকে ফেলল। সেই মুহূর্তে রুমে আসে হ্যাভেন। অরু’কে ঠোঁট চেপে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে, অস্থির হয়ে পড়ল। স্যুপ এর বাটি টেবিলে রেখে, তড়িঘড়ি করে অরু’কে ধরল। উদ্বিগ্ন কন্ঠে ধমকে বলল,
” একা বিছানা থেকে নেমেছো কেন? কাউকে ডাকতে পারতে। ”
অরু ক্ষীণ স্বরে আওড়াল,
” সবাই বিজি। আমার ডাক অতদূর যেতো না। ”
” কোথায় যাবে? ”
অরু দোটানা সংশয় নিয়ে মিনমিন করে জানালো,
” ওয়াশরুম। ”
” আমি নিয়ে যাচ্ছি। ”
অরু তৎক্ষনাৎ বাঁধা প্রদান করলো,
” আমি পারবো। ছাড়ুন। ”
ত্বরিত শক্ত চোখে চাইল হ্যাভেন। অরুর ঠোঁটে আঙুল চেপে চোখ রাঙিয়ে বলল,
” নো মোর টক! জাস্ট কিপ ইয়োর মাউথ শাট। ”
অরু চুপসে যায়। মৃদু কন্ঠে বলে,
” সত্যি পারবো। ”

হ্যাভেন বিরক্তিতে ‘ চ ‘ সূচক শব্দ তুলল। অরু’কে কোলে করে ওয়াশরুমে দিয়ে আসে। সরে গেল না। দরজার বাইরে ঠায় দাঁড়িয়ে। অরু বেরিয়ে আসলে, পুনরায় কোলে করে বিছানায় বসায়৷ স্যুপের বাটি হাতে নিয়ে চামচ নাড়াতে নাড়াতে অরুর দিকে হাস্যোজ্জ্বল মুখে তাকায়। খানিকক্ষণ পর অভিব্যক্তি বদলে যায়। হাসি মাখা মুখবিবর নিমেষে কাঠিন্য রূপ ধারণ করে। পুরুষালী চোয়ালদ্বয় শক্ত হয়ে উঠে হঠাৎ। অক্ষিপটে ফুটে ওঠে রাগের বহিঃপ্রকাশ। শব্দ করে স্যুপের বাটি টেবিলে রাখল। অরু চকিতে তাকায়। হ্যাভেন দাঁত পিষে হিস হিস করতে করতে থাবা মেরে, অরুর গায়ের বুকের নিকট লেডিস টি-শার্ট এর কাপড় খামচে ধরল। আকস্মিক ঘটনায় অরু হতভম্ব। হরিণী আঁখি যুগল বড়ো বড়ো করে ফেলল। চোখের মণিতে এখন লজ্জা নয়, ভীতি এসে ভর করেছে৷ আতঙ্কে ছেয়ে গিয়েছে মুখমন্ডল জুড়ে।

কাঁপা গলায় ছ্বলাত হৃদয়ে শুধায়,
” কি করছেন? স….”
কথা সম্পূর্ণ করতে দেয় না হ্যাভেন। গলা হতে টি-শার্ট এর কাপড় নামিয়ে নিলো। ঘাড়, গলা, বুকের দিকে তর্জনী স্পর্শ করে ছুঁয়ে ছুঁয়ে কিছু দেখাল। রক্তিম চোখে চেয়ে চিবিয়ে চিবিয়ে বলল,
” এগুলো কিসের দাগ? আমার আগে কে তোমার গায়ে দাগ বসিয়েছে? আমার জিনিস আমি এখন পর্যন্ত ছুঁয়ে দেখলাম না! অন্য জন ফ্রী তে লুফে নিলো? আর সেই দাগ তুমি গায়ে মেখে ঘুরে বেড়াচ্ছো, তাও আমারই চোখের সামনে? ভয় করছে না? অ্যাই, ভয় পাও না আমাকে? এত বড়ো স্পর্ধা দেখানোর শাস্তি কতটা ভয়ংকর হতে পারে, জানো? ডু ইউ হ্যাভ দ্য স্লাইটেস্ট আইডিয়া? ”

অরুর এতক্ষণের ভীতিকর দৃষ্টি বিলুপ্ত হয়ে কাঠিন্যে রূপ নেয়। ঝাড়া মেরে হ্যাভেনের হাত সরিয়ে দেয়। ঘৃণার দৃষ্টি নিক্ষেপ করে। এতে হ্যাভেন আরও ক্ষেপে উঠল। খেই হারিয়ে, রাগের বশিভূত হয়ে, অরুর ব্যথা পাওয়া কোমল থুতনিতে সজোরে শক্ত কামড় বসিয়ে দিল। লেপ্টে দিল দাঁতের সুক্ষ্ম চিহ্ন! অরু তৎক্ষনাৎ থুতনিতে হাত রেখে, শব্দ করে কেঁদে ওঠে। ব্যথায় জান যায় যায় অবস্থা। আঘাত পাওয়া স্থানে পুনরায় আঘাত! যন্ত্রণা হবে না? হ্যাভেন আরও কিছু করার আগে, অরু ঠোঁট ফুলিয়ে ডুকরে উঠল। বলতে লাগলো হড়বড় করে,
” ডোন্ট ব্লেইম মি উইদাউট নোইং। এটা আপনার কাজ। কেউ আমাকে স্পর্শ করে নি। এসব কামড়ের দাগ আপনি নিজেই বসিয়েছেন। সেদিন গাড়িতে কি করেছিলেন, ভুলে গিয়েছেন? এখন আমার দোষ দিচ্ছেন? ”

হ্যাভেনের টনক নড়ে। সহসা সম্বিত ফিরল। খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে জহুরি চোখে পরখ করল। আসলেই দাগগুলো পুরোনো। না জেনে আবেগের বসে কি বলে ফেলল, আর কি করে বসলো? হ্যাভেনের খারাপ লাগছে। আহত চোখে অরু পানে তাকায়। অরু কেঁদে কেটে নাকমুখ লাল করে ফেলেছে। ঠোঁট ভেঙে কেঁদেই যাচ্ছে। হ্যাভেন ত্বরিত জাপটে ধরল বুকে। ঘুরিয়ে প্যাঁচিয়ে ক্ষমা চাওয়ার ভঙ্গিমায়, অথচ গমগমে স্বরে জানায়,
” তোমাকে আমি সরি বলবো না। কারণ, এখন দোষ তোমার। আমি যখন জানতে চেয়েছি, তুমি সাবলীল উত্তর দিলেই হতো। তা না করে তেজ দেখাচ্ছিলে। দুইদিন আগের দাগ এখনো থাকবে, আমি কি জানতাম নাকি? একে তো তোমার শরীরে দাগ দেখে মাথা খারাপ হওয়ার যোগাড়! তারউপর তোমার ওরকম বিহেভিয়ার। কন্ট্রোল হারিয়ে ফেলে ছিলাম। টলারেট করতে পারিনি।। সো সরি। ”

বুক থেকে মুখ তুলে, চোখের জল মুছে দিল হ্যাভেন। থুতনিতে আঙুল বুলিয়ে হতাশ কন্ঠে শুধাল,
” বেশি ব্যথা পেয়েছো? ”
ফুঁসে উঠল অরু। দাঁত কিড়মিড় করে ওঠে। ব্যথা দিয়ে জিজ্ঞেস করছে, ব্যথা পেয়েছে নাকি? বজ্জাত লোক! হ্যাভেনের বুকে ধুপধাপ কিল, ঘুষি বসিয়ে দিল। হাতের কাজ জারি রেখে বলতে লাগলো,
” রাক্ষস একটা! শয়তান লোক! টাচ করবেন না আমাকে! ”
হ্যাভেন হাসল। অরুর হাত নিজের হাতের মুঠোয় নিয়ে শান্ত গলায় বলল,
” মেডিসিন নিতে হবে। স্যুপ খেয়ে নেও। না খেলে শক্তি পাবে কোথায়? শক্তি না থাকলে আমার সাথে ঝগড়া, মারামারি করবে কিভাবে? ”
অরু মুখ ঘুরিয়ে নেয়। তেজি স্বরে বলে,

” খাবো না। ”
হ্যাভেন চামচে স্যুপ উঠাতে উঠাতে বলল,
” নিজের জন্য না হলেও আমার জন্য খেতে হবে। রাত হচ্ছে। আস্তে ধীরে গভীর রাত্রি হবে। সেই সাথে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে ঠান্ডা। আর ঠা…. ”
অরু তৎক্ষণাৎ তাকে থামিয়ে দিয়ে রুষ্ট গলায় কটাক্ষ করে বলল,
” আর ঠান্ডায় আপনার নিউমোনিয়া শুরু হয়। তখন বউ দরকার, শরীর গরম করে নিউমোনিয়া কাটানোর জন্য। ”
হ্যাভেনের চোখ দুটো চকচক করে উঠল। অরুর গাল টিপে হেসে বলে,
” এই না হলে আমার বউ? বলার আগে মনের কথা বুঝে ফেলে। তাড়াতাড়ি হা করো, অরু পাখি।”
” আপনার হাতে খাবো না। আমাকে দিন। আমি নিজে খেতে পারবো। ”
” শশশ! কোনো কথা না। ”

হ্যাভেন স্যুপের চামচ অরুর মুখের সামনে ধরে। অরু দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল। চুপচাপ খেয়ে নিলো। খাওয়া শেষ করে ঠোঁট মুছে দিল। অরু শুয়ে পড়ল। হ্যাভেন পাশে বসে, আলতো করে মাথায় হাত বুলিয়ে দেয়। স্বল্প সময়ের পলকে অরুর তন্দ্রা লেগে যায়। শরীর কেমন মেজমেজ করছে। জ্বর আসবে আসবে ভাব। গা হালকা গরম। অরুর ঘুমন্ত মুখশ্রীতে মায়াভরা চাহনিতে নজর বুলায় হ্যাভেন। দীর্ঘক্ষণ ঠোঁট কামড়ে ধরে কান্না করায়, গোলাপি কোমল কোষের ন্যায় ঠোঁট রক্তিম বর্ণ ধারণ করেছে। সেথায় চোখ পড়তে, হ্যাভেনের ঘোর লেগে যাচ্ছে। ঝুঁকে আসে সহসা। ঠোঁটে ঠোঁট ছুঁবে, কিছু মনে পড়তেই তৎক্ষনাৎ নিজেকে গুটিয়ে নেয়। কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিস করে আওড়ায়,

” কন্ট্রোল সিস্টেমের ডেট ফেল হয়ে যাচ্ছে, অরু পাখি। নিষিদ্ধ ইচ্ছা দমন করা ভীষণ কষ্টসাধ্য, যন্ত্রণাদায়ক। কবে ভালোবাসবে আমায়? কবে ধরা দিবে? কবে নিজেকে আমার নিকট সমর্পণ করবে? কবে তোমাতে নিবিড় ভাবে বিলীন হতে পারবো? তুমি না চাওয়া পর্যন্ত, তোমার ওই নেশা ধরানো পদ্মকুড়ির ন্যায় ঠোঁট গ্রাস করতে পারবো না। সেই দিন কবে আসবে? অ্যাকচুয়ালি, আই ক্যান্ট কন্ট্রোল মাইসেল্ফ! ”

তপ্ত শ্বাস টেনে, হ্যাভেন ফটাফট উঠে জানালার পাশে দাঁড়ায়। জানালার বাইরে তাকিয়ে থাকল অনিমেষ। টিমটিমে সোডিয়াম লাইট জ্বলছে। রাস্তায় কতশত গাড়ি, চেনা পরিচিত মানুষের আনাগোনা। ব্যস্ত মানুষের ভীড়ে দৃষ্টি তাক করে, মস্তিষ্কের ভেতর দাপাদাপি করছে হাজার প্রশ্ন। সঠিক উত্তর মিলছে না। একদিকে নিজের লক্ষ্য, অন্যদিকে টানপোড়া দোনোমোনো সম্পর্ক। দুটো এডজাস্ট করতে হিমশিম খাচ্ছে হ্যাভেন। কখনো মনে হয়, নিজের অনিশ্চিত ভবিষ্যতের সাথে নিষ্পাপ চঞ্চল অরু’কে জড়িয়ে ভুল করেছে। আবার কখনো মনে হয়, যদি মিশন সাকসেসফুল হয়, তাহলে একটা হ্যাপি ফ্যামিলি মেকিং করতে পারবে। ভালোবাসা তো দোষের কিছু না।

প্রেমপিপাসা পর্ব ৯

একটা সম্পর্কের গভীরে থাকা অভিযোগ আর আর্থিক সমস্যার বিষবৃক্ষ কখন যে বড় হয়ে ওঠে, তা বুঝে ওঠা যায় না। হ্যাভেন আর অরু নামক দুই চড়ুইয়ের সম্পর্কটা তেমন। তাদের মাঝে যে ভুল বোঝাবুঝি আর হতাশার গভীর দেয়াল তৈরি হয়েছে, সেটা ভাঙতে হয়তো আরও অনেকটা সময় লাগবে। কিংবা আজও ভাঙবে কিনা নিশ্চিত না! আচ্ছা, ততদিনে যদি দুই নাদান চড়ুইয়ের মধ্যে একটি চড়ুই অচিরেই হারিয়ে যায়? অপর চড়ুই তো তখন নিমিষেই ধূলিসাৎ হয়ে যাবে। ফুলের কলি পুরোপুরি ফোঁটার আগে ঝড়ে পড়লে কি মেনে নেওয়া যায়? কালের নিয়ম বদলানোর ক্ষমতা কারোর নেই। কে জানে, সকালে নতুন সূর্য উদয়ের সাথে সাথে, মানুষের জীবনে নতুন ভাবে, নতুন রূপে কি হানা দেয়?

প্রেমপিপাসা পর্ব ১১