রাজবধূ পর্ব ৩৬

রাজবধূ পর্ব ৩৬
রেহানা পুতুল

“আমি যাইতাছি বড় চাচী। আপনে মাথা ঠান্ডা রাখেন। সমস্যার সময় মাথা গরম করলে ফলাফল ভালো না হইয়া খারাপ হয়।”
আত্মবিশ্বাসী সুরে দৃঢ় গলায় বলল বাদশা।
বাদশা জমির দিকে চলে গেলো। জয়নুল তালুকদার মসজিদ থেকে আছরের নামাজ পড়ে বাড়িতে আসলো। তাকে দেখেই সুফিয়া বিবি গজগজ সুরে জমির বিষয়টা জানালো। তালুকদার বলল,

“এখন সেদিক থেইকা আইলাম। হয়রান লাগতাছে। বাদশা আহুক। বিস্তারিত হুনি আগে।”
কিছুক্ষণ পর বাদশা ফিরে এলো বাড়িতে। বৈঠক খানায় ঢুকে দাঁড়ালো। নিজে থেকেই বলল,
“ঘটনা সত্য চাচী। সব জাইনা আইলাম। সেই জমি ছোট চাচায় তাদের কাছে বেইচা দিছে কয়মাস আগে। তো সেই জমিতে নাকি পাড়ে থাকা কয়েকটা নারকেল গাছের ছায়া পড়ে। তাই ধান ভালো ফলে না। এখন তারা মাটি ফালাইবো। দুই বছর বাদে হেরা বাড়ি করবো নাকি সেইখানে।”
তালুকদার ও সুফিয়া হতভম্ব হয়ে গেলো। তালুকদার বিচলিত গলায় বলল,

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

“সেই জমি খায়রুলের। সেইটা ঠিক। কিন্তু সেই লুকায়া জমি বেচলো ক্যান? টাকা কি কামে খাটাইলো? কিছুই তো জানিনা। কেমন গোলমাল লাগতাছে আমার কাছে। জুবায়ের আসুক বাড়িতে। কাইল সকালে তারে জিগাই। দেখি ওই জানে কিনা।”
তালুকদার দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে উঠে গেলো নিজের কক্ষের দিকে। বাদশা চলে গেলো তার কাজে। সুফিয়া একা একা কতক্ষণ হাউকাউ করলো। তার সঙ্গে সমব্যথী হয়ে সমবেদনা প্রকাশ করলো তার তিন ছেলের বউ।বাদশা নিত্যদিনের মতো ফুলবানুকে নিয়ে সন্ধ্যার পর নিজের বাড়ি চলে গেলো। এবার কি হবে? কি হতে পারে? সকালে জুবায়ের ভাইয়ের কানে যখন যাবে এটা, পরিস্থিতি অন্যরকম হয়ে যেতে পারে। রাজ ও জুবায়ের ভাই দুজনেই একই আদলের। ভালোর ভালো। খারাপের খারাপ! সেরা ভয়ংকর!এমন ভাবতেই দুঃচিন্তায় তার নাড়িভুঁড়ি বেরিয়ে আসার উপক্রম। রাতে বিছানায় গিয়ে ফুলের চুলে বিলি কাটতে কাটতে সে বলল,

“ফুল আমার লগে শহরে যাইবা?”
ফুল নেত্রপল্লব উল্টিয়ে বাদশার দিকে চকিতে চাইলো। বিষম খেয়ে চঞ্চল গলায় বলল,
” আপনার লগে আমি শুধু শহরে নয়,জাহান্নামেও যাইতে রাজী। কিন্তু প্রশ্ন হইলো হঠাৎ শহরে ক্যান যাইবেন? হেগো কোন কামে?”
“নাহ। নিজেগো সুখের জন্যই যামু। হেগো গোলামি আর করুম না। মন উইঠা গ্যাছে সেই বাড়ির মানুষজন থেইকা। কত কেলেংকারি হেগো সংসারে আর জীবনে। জমি বেচার টাকা আছে আমার কাছে। সেই টাকা দিয়া শহরে থাকুম। আর কাম যোগাড় কইরা নিমু। ছোটখাটো ব্যবসা করুম। আমার পরিচিত ভাই বেরাদার আছে শহরে। তোমারে নিয়া বুড়িগঙ্গা নদীতে ভাসমু নৌকায় কইরা। অন্ধকার সিটে বইসা সিনেমা দেখমু। পার্কে ঘুরমু তোমার হাত ধইরা।”
ফুল আধবোঁজা চোখে জানতে চাইলো,

“তাগোরে কি বইলবেন? কইলেই কি যাইতে পারবেন? তারা যাইতে দিবো?”
“সেসব আমি ম্যানেজ করমু। তুমি টেনশন কইরো না। তাগোরে বুঝায়া কমু। তারা না মানলে নাই। আমার কি। নিজে বাঁচলে বাপের নাম।”
“দেখেন তাইলে। মন কষাকষি যেন না হয়। আপোষে তারা যেন মাইনা নেয় আমগো দুইজনের কাম ছাড়নের বিষয়টা।”
“হুম। ঘুমাও। আসো।”

ফুল ও বাদশা তন্দ্রাঘোরে ডুবে যায়।
সেই রাত্রির দ্বিপ্রহরে রাজ বাড়ি এলো। বরাবরের মতো অনেক ফলমূল এটা সেটা নিয়ে এলো। তাকে দেখে পরিবারের সবাই কিছুটা চমকালো। সুফিয়া বিবি হতচকিত গলায় জিজ্ঞেস করলো,
“বাবা কোন সমস্যা? তুই এমন হুটহাট আসস না।”
রাজ মায়ের পিঠে ভালোবাসার হাত রেখে বলল,
“মা, আজ ম্যাট্রিক পরিক্ষার রেজাল্ট দিয়েছে। শিখা খুব ভালো ফলাফল করেছে। সামান্য মার্কের জন্য প্রথম স্থান লাভ করতে পারেনি।”

সুফিয়া বিবির মুখের চমকানোভাব মিইয়ে গেলো রোদে পড়া পুইঁয়ের ডগার ন্যায়। তিনি বিরস গলায় বললেন,
“হুদাহুদি এইটার লাইগা এই আন্ধার রাইত কইরা বাড়িত আওন লাগে? যদি তুই অহন ডাকাইতের কবলে পড়তি?”
“মা এটা হুদাহুদির বিষয় নয়। বিশাল বড় কিছু। একজন ছাত্রীর দশবছরের সাধনার ফসল এই রেজাল্ট। আমাদের পরিবারে প্রায় সবাই অশিক্ষিত। তাই আপনারা কেউই শিক্ষার গুরুত্ব বোঝেন না। বুঝেন শুধু তালুকদারি,সম্পত্তি,জমিজমা এসব।”
পাশ থেকে রাজের বাবা বলে উঠলেন,
“হায়! আমরাতো জানিও না। খুব খুশীর কথা এইটা। তুই তাইলে সকালেই মধুপুর চইলা যাইস।”
“তাই যাবো বাবা।”
কাজের সবাই সবার স্থানে ঘুমিয়ে আছে। তাই সুফিয়া বিবি নিজেই ছেলেরে ভাত দিলেন টেবিলে। রাজ দোতলায় গেলো। তালা খুলে তার রুমে ঢুকলো। ড্রেস চেঞ্জ করে ফ্রেস হয়ে নিলো। নিচে এসে ভাত খেয়ে আবার উপরে গিয়ে ঘুমিয়ে পড়লো।

সকালে বাদশা ও ফুলবানু চলে এলো। তারা তাদের কাজ করতে লাগলো। বাদশা হাত পা চালিয়ে কাজ করলেও মন পড়ে আছে পরিস্থিতির উপরে। কেননা রাজও বাড়িতে উপস্থিত এখন। পরিস্থিতি তার নাগালের বাইরে চলে যাবে মনে হচ্ছে। জুবায়ের দোকানে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে শার্ট প্যান্ট পরে। তখনই তালুকদার তার রুমে গেলো।
“কাকা বসেন। কিছু বলবেন?”
” হ কমু। তোর মায়েরে একটু ডাইকা আন।”
জুবায়ের মাকে ডেকে আনলো। আমেনা বেগম ভাসুরের সামনে জড়ো হয়ে দাঁড়ালেন।
“খায়রুল, মীর বাড়ির সামনের জমিন বেইচা দিছে। তোমরা মা,ছেলে জানো কিছু? বাদশা গিয়া যাচাই কইরা আইলো। ঘটনা সত্য।”
আমেনা অবাক কন্ঠে বলল,

” নাতো ভাইজান। কই কিছুই জানি না।”
জুবায়ের শুনে আকাশ থেকে পড়লো। বিস্মিত স্বরে বলল,
” কার কাছে বেচে দিলো কাকা? ”
“কাসেম আলীর বড় ছেলের কাছে।”
“আমি এখন মার্কেটে যাচ্ছি। এসে দেখতেছি বিষয়টা।”
খটোমটো স্বরে বলল জুবায়ের।
“আইচ্ছা। রাজ রাইতে বাড়িতে আইলো। এখন মধুপুর যাইবো। বউমার ফল বাইর হইছে। অনেক ভালো ফল করছে রাজ কইলো।”
” আজ ওর রেজাল্ট বের হয়েছে জানি। ভালো পাশ করেছে শুনে ভালো লাগলো।এটা আনন্দের সংবাদ। রাজ আসাতে ভালো হয়েছে।”

জমির জন্য বিষাক্ত মেজাজে জুবায়ের ঘর হতে বেরিয়ে গেলো উঠানে। তার মোটর বাইকে চড়ে বসলো তালা খুলে। শাঁই শাঁই গতিতে বাইক চালিয়ে সে চলে গেলো মার্কেটের দিকে। জয়নুল তালুকদারও বের হয়ে গেলো বাড়ির বাইরের দিকে।
সকাল সাড়ে দশটা। নূরী গৃহকার্যে ব্যস্ত। শিখা ও আরো দুজন মেয়ে মিলে তাদের উঠানে দড়ি লাফ খেলা খেলছে লাফিয়ে লাফিয়ে। কোমরে ওড়না গুঁজে রয়েছে তার। তাদের উঠানের একপাশে একটা বেবিট্যাক্সি এসে থামলো। রাজ ভিতরে বসা থেকেই শিখাকে দেখতে পেলো। ঠোঁটের কোণে তার এক টুকরো হাসি উদ্ভাসিত হলো।
“শিখা বু দুলাভাই। চাইয়া দ্যাখো।”

বলল একটি মেয়ে।
শিখা থমকালো। চমকালো। যদিও তার মন বলছিলো যেকোন সময়ে তার হিরোটা এসে পড়তে পারে। তবুও। সে বেবিট্যাক্সির দিকে তাকিয়েই ভোঁদৌড় দিলো। রান্নাঘরে গিয়ে মাকে বলল,
“আম্মা উনিই আইছে। উইঠা যাও”
“কে? জামাই?”
“হ। এখন আইলো ক্যান?”
“ধূর মাইয়া। এখন আইলে কি হইছে? কি সুরত তোর। তাড়া কইরা পুষ্করিণীতে যা। তিন ডুবে গোসল কইরা নতুন কামিজ একটা পিন্দা নে কইলাম।”
“যাইতাছি।”

শিখা উদাস উদাস মনে ঘরে গেলো। চুপিচুপি আলমারি থেকে নতুন জামা নিয়ে পুকুর ঘাটে চলে গেলো।
রাজ ঘরে গিয়ে নূরীকে সালাম দিলো। চেয়ারে বসলো। কাঁচা ফুলের তোড়াটি টেবিলের উপরে রাখলো। বাকি জিনিসপত্র নিজেই পিছনের রুমে নিয়ে রাখলো। নূরী ঝটপট শিখার বিছানা ঝেড়ে রাখলো। তারপর রাজকে গিয়ে বলল,

“বাবা বিশ্রাম নাও। নাস্তা খাইছো? আমার ভাই, আপা,বাকিরা কেমন আছে? শিখার ফল ত দেখছ পত্রিকায়। না?”
“হ্যাঁ আম্মা। এইজন্যই ত চলে এলাম। আমি রেস্ট নিচ্ছি। সমস্যা নাই। সবাই ভালো আছে। নাস্তা খেয়েই আসছি।”
নূরী রান্নাঘরে চলে গেলো। হাত চালিয়ে কাজ করতে লাগলো।
রাজ ফুলের তোড়াটি নিয়ে শিখার রুমে চলে গেলো। খাটে হেলান দিয়ে বসলো। জানালা দিয়ে বাইরে দৃষ্টি ফেলল। শিখা গোসল করে এলো। রশিতে ভেজা কাপড় মেলে দিচ্ছে। অপ্রত্যাশিতভাবে ওড়নাবিহীন শিখার মাঝে এই প্রথম রাজের তীক্ষ্ণ নজর বিঁধে গেলো তীরের ফলার ন্যায়।
উফফস! এত স্নিগ্ধ! এত মোহনীয়! এত কমনীয়! এত লোভনীয়! এত রাজকীয় রূপ তার রঙিন প্রজাপতিটার। আফসোস! আজ যদি সে চিত্রশিল্পী হতো, তাহলে এই শিখার অবয়বখানিকে সে রঙতুলির আঁচড়ে বন্দী করে নিতো।
শিখা উঠানে রোদে একটুখানি দাঁড়িয়ে গামছা দিয়ে চুলের পানি ঝেড়ে নিচ্ছে বারবার। রাজকে সে দেখেনি। শিখা ঘরের ভিতর এসে ওড়না মেলে দিলো বুকের উপর। নিজের রুমের দরজায় দাঁড়িয়ে রাজকে সালাম দিলো আন্তরিক গলায়।

“আসসালামু আলাইকুম।”
ওয়ালাইকুম আসসালাম, বলে রাজ ফুলের তোড়াটি শিখার দিকে বাড়িয়ে ধরলো দুহাত প্রসারিত করে। প্রাণোচ্ছল গলায় বলল,
“কংগ্রাচুলেশনস মাই ডিয়ার লাভ বার্ড!”
থ্যাংক ইউ, বলে শিখা উচ্ছল মুখে ফুলের তোড়াটি গ্রহণ করলো। বলল,
“আমার জন্য?”
“এখানে আমার আর কোন বউ আছে নাকি?”
শিখা মুচকি হেসে বলল,
“লাভ বার্ড সুন্দর নাম।”
” ইয়েস প্রিয়া। প্রজাপতি সব সময়ের জন্য। আজ স্পেশাল করে লাভ বার্ড বললাম। হ্যাপি?”
শিখা মৌন রইলো নমনীয় চোখে। রাজ শিখার এক হাত ধরে রুমের ভিতরে টেনে নিলো। রুমের দরজা বন্ধ করে দিলো। শিখার এক গালে শুষ্ক দু’ঠোঁট বসিয়ে আলতো চুমু খেলো। ভেজা চুলের গোছায় নিজের নাক ডুবালো। আকুতিভরা কন্ঠে শুধালো,

“দিঘির স্বচ্ছ শীতল জলের মতো তুমি! তোমার ছোঁয়া পেলে প্রাণ জুড়িয়ে যায়।”
নিমিষেই শিখার হৃদয় কেঁপে উঠলো আকস্মিক পুরুষালী স্পর্শ পেয়ে। বুকের ভিতর উত্তাল ঝড় শুরু হলো। যেটা রাজ দেখতে পাচ্ছে। সে শিখাকে তার মুখোমুখি বসালো। নরম স্বরে জিজ্ঞেস করলো,
“তোমার কাঁপা-কাঁপি কবে বন্ধ হবে প্রজাপতি? শুরুই ত করিনি কিছু। প্রতিক্ষা বাসরের।”
শিখা নিশ্চুপ।

” ওকেহ! এটার আনসার দাও তবে? তুমি উঠানে ছিলে ওড়না ছাড়া। অথচ বরের সামনে রুমে এলে ওড়না দিয়ে পুরো গা ঢেকে। হওয়ার কথা ছিলো এর বিপরীতটা। বৈষম্য হলো না আমার প্রতি? হিসাবটা বুঝাও? কেউ দেখলে বুঝবে তুমি হুজুর বা ভাসুরের সামনে এলে পর্দা করে।”
লজ্জায় শিখার ধবধবে ফর্সা নাকমুখ রক্তিম হয়ে উঠলো। এত কঠিনতম বিব্রতকর পরিস্থিতিতে সে এর আগে কবে পড়েছে মনে করতে পারছে না। রাজ বুঝে প্রসংগ পাল্টালো। শিখাকে সহজ করতে রেজাল্টের প্রসঙ্গ টানলো। শিখা সব বলল। শুনে রাজ বলল,

“ওহ হো! তাহলে রেড়ি হয়ে নাও। তুমিসহ স্কুলে গিয়ে স্যারদের মিষ্টি খাইয়ে আসি। নতুন জামাতো তোমার পরাই আছে। যথেষ্ট সময় আছে। মাত্র সাড়ে এগারোটা বাজে। ‘শ্রীকৃষ্ণ মিষ্টান্ন ভাণ্ডারে’র মিষ্টি খুব ভালো। সেখান থেকে নিবো।”
শিখা এতে দ্বিমত করল না। বরং খুশী হলো। নূরীর কাছে বলে দুজন বেরিয়ে পড়লো। নূরী পিছন দিয়ে ডেকে বলল,
“বাইরে বেশি কিছু খাইস না তোরা। বাড়িতে আইসা দুপুরের খাওন খাইবি।”
“আইচ্ছা আম্মা।” বলল শিখা।
রাজ ও শিখাকে মিষ্টিসহ দেখে স্কুলের শিক্ষকগণ সন্তুষ্ট হলো বেশ। শিখা নিজ হাতে দপ্তরী নমিতার সাহায্য নিয়ে সব স্যারদের মিষ্টি বিতরণ করে দিলো। মিষ্টিমুখে শিক্ষকেরা রাজের কাছে শিখার প্রশংসা করলো। বলল,
” সঠিক গাইডলাইন পেলে এবং পড়াশোনা করার উপযুক্ত পরিবেশ পেলে শিখা অনেকদূর এগিয়ে যেতে পারবে। এখন যুগের সাথে সাথে মেয়েরাও অগ্রসর হচ্ছে। ওর পথ চলায় বিয়ে নামক ছোট্ট শব্দটা যেন দেয়াল না হয়ে দাঁড়ায়। সেদিকে সজাগ দৃষ্টি রেখো।”

“জ্বি স্যার। ইনশাআল্লাহ। আপনারা আমাদের জন্য দোয়া করবেন।”
রাজ ও শিখা বাড়িতে চলে গেলো। নূরী সব আগেই বেড়ে রেখেছে। শিখা সব নিজের রুমে টেবিলে নিয়ে নিয়ে রাখলো। পানি ছাড়া সম্পূর্ণ নারকেলের দুধ দিয়ে তৈরি পোলাও,ঘরের পালা মুরগী রান্না, পালা হাঁসের ডিম ভাজা, পুকুর থেকে তোলা রুই মাছ ভাজা। রাজ শিখার হাতে খেতে চাইলো। শিখা হেসে বলল,
“আপনি কি ছোট শিশু। আমার হাতে খেতে চান যে?”
“ছোট শিশু হলে অন্য কিছু খেতে চাইতাম। বড় বলেই ভাত খেতে চাচ্ছি।”
দুষ্টমিষ্ট স্বরে বলল রাজ।
“অন্যকিছু আবার কি?”
“কিছু না। আসো খাই।”

দুজন দুজনের হাতে খেয়ে উঠলো। রাজ শাশুড়ীর রান্নার ভূয়সী প্রশংসা করলো। শিখাকে বলল,
“আম্মার কাছ থেকে এমন দুধ দিয়ে তৈরি পোলাও শিখে নিও। দেখলে দুধ দিয়ে তৈরি জিনিস খেতে কত সুস্বাদু হয়। আর এতে সব ধরনের ভিটামিনও পাওয়া যায়। একের ভিতর সব।”
রাজের কথা শুনে শিখার মনে শিরশির অনুভূত হলো। খাওয়ার পরে রাজ শিখার বিছানায় একপাশে সোজা হয়ে শুয়ে পড়লো। শিখা সব রান্নাঘরে মাকে দিয়ে এলো।
“দরজা বন্ধ করে দাও।”
শিখা বন্ধ করে দিয়ে চেয়ারে গিয়ে বসলো। রাজ অনুনয় করে বলল,
“প্রজাপতি একটু শোবে আমার পাশে?”
শিখা নারাজ চোখে চাইলো অন্যদিকে। রাজ বলল,
” ভয় পাচ্ছো নিজের মানুষটাকে?
এইযে দেখো মাঝখানে বালিশ দিলাম। এতটুকুও ছোঁব না তোমায়। প্রমিজ। কেবল দুজন পাশাপাশি শুয়ে কিছু কথা বলব। ”

রাজ বালিশ রাখাতে শিখা ভরসা পেলো। বিছানায় উঠে গিয়ে জড়োসড়ো হয়ে একপাশে শুইলো।
“সোজা হয়ে শোও। আমার মতো। সিনেমায় দেখনা নায়ক নায়িকা এভাবে সোজা হয়ে পাশাপাশি শোয় খোলা প্রান্তরে। আশা জাগানিয়া গল্প করতে করতে বেলার পর বেলা ফুরিয়ে যায় তাদের। তবুও কথা ফুরোয় না ওদের।”
” আপনে কবে যাইবেন ঢাকায়?”
“আমি পরশু চলে যাবো। তুমি কোন কলেজে ভর্তি হতে চাও? কোন বিভাগ? ফিউচার এইম নিয়ে কিছু ভাবছ?”
” সরকারি এস এ কলেজেই ভর্তি হমু। ওইটা দূরে হইলেও ভালো বেশি। বিভাগ মানবিক। এইম নিয়া আপাতত ভাবিনাই। পরে।”

” বুঝলাম। হ্যাঁ এই কলেজ খুব ভালো। জুবায়ের,সীমান্ত এই কলেজ থেকেই পড়াশোনা করেছে। তাহলে সেখানেই ভর্তি হয়ে যেও। আমি জুবায়েরকে বলে যাবো? নাকি এদিকে তোমার কেউ আছে?”
“আছে। উনারে কওন লাগব না। কুসুমের চাচাতো ভাই আছে। সে আমাগোরে ভর্তি করায়া দিবো। ”
“তোমাকে উপহার দিতে চাই ভালো ফলাফলের জন্য। বলো কি নিবে?”
“আমাদের চিঠি আইনা দেয় যে ডাকপিয়ন দাদা। উনারে একটা সাইকেল কিনা দিবেন। উনি পায়ে হেঁটে হেঁটে চিঠি বিলি করে। এটা আমারে পীড়িত করে।”
“অবশ্যই দিবো। কিন্তু তুমি কি নিবে?”
“এটাই আমার চাওয়া। এটাই আমার পাওয়া। আর কিচ্ছু না।”

শিখার হৃদয়ের ঔদার্যতায় রাজ মুগ্ধতার শিখরে পৌঁছে গেলো। এমন নির্লোভ, নিঃস্বার্থবাদী,পরোপকারী, মানবিকবোধের একজন মানুষকে জীবন দিয়ে ভালোবাসা যায়। সর্বস্ব বিলিয়ে দেওয়া যায় তার জন্য। রাজ তার মানিব্যাগ বের করলো। শিখার হাতে পাঁচ হাজার টাকা দিলো। শিখা চমকে উঠে বলল,
“এত টাকা! আমি কি করমু?”
“যত টাকাই হোক তোমার চেয়ে তুচ্ছ। পিয়ন দাদাকে সঙ্গে নিয়ে তুমি সাইকেল কিনতে যাবে। আমার পক্ষ হতে উনার পছন্দমতো সাইকেল উপহার দিবে। কলেজে ভর্তি হবে। তোমার যা প্রয়োজন কিনে নিবে। এবং আম্মা ও তুমি শপিং করবে। এরপর আর টাকা তেমন থাকবে না।”

“উনার সাইকেল আমি কিনতে পারমু?”
অবোধের মতো করে বলল শিখা।
” উনি, তুমি মিলে কিনবে। তোমাকে পারতেই হবে। পড়ালেখা করতেছো। বড় হচ্ছো। উপচেপড়া তারুণ্য তোমার মাঝে। সেই তারুণ্যকে কাজে লাগাও। একটু একটু করে তুমি দায়িত্ববান হতে শেখো। আমাদের পরিবারে আমার অবর্তমানে তোমার নেতৃত্ব দিতে হবে একসময়।”
গুরুগম্ভীর গলায় বলল রাজ।
“আমি? ক্যামনে? এইটা অসম্ভব?”
“সম্ভব ও সম্ভাবনার পৃথিবীতে অসম্ভব বলে কিছুই নেই। তোমার জ্ঞান,গুণ, মহিমা আমাকে ছাড়িয়ে যাবে।”
শিখা শোয়া থেকে উঠে দাঁড়ালো। টেবিলের উপর হতে পকেট ডিকশনারিটা হাতে নিলো। রাজের দিকে এগিয়ে ধরে বলল,

“শব্দ ধরবেন না? মুখস্থ করেছি ‘বি’ পর্যন্ত।”
“ভেরি গুড! নাহ। ধরব না। তুমি বলেছ আমি বিশ্বাস করেছি। তোমার মুখ নিসৃত প্রতিটি বাক্য আমার কাছে মূল্যবান! গুরুত্বপূর্ণ! তোমার সেই মুরগীটা কই?”
শিখা বের হয়ে গেলো উঠানে। একটু পর কোলে করে সাদা, কালো ও বাদামি ছিটের একটি মুরগী নিয়ে রুমে ঢুকলো। রাজ দেখেই হোঃহোঃহোঃ! করে হেসে উঠলো।
“মাই গড! শিখা তুমিও না। ছেড়ে দাও।”
“ক্যান? আমার মুরগী না দেখতে চাইলেন?”
বলে মুরগীটাকে ছেড়ে দিলো শিখা। রাজ বিছানা থেকে নেমে দাঁড়ালো।
“সন্ধ্যা হয়ে যাচ্ছে। আসো বাইরে একটু হাঁটবো।”
শিখা ও রাজ তাদের বাড়ির পিছনের দিকে কিছুক্ষণ পাশাপাশি হাঁটলো। শিখা বাড়ির এদিক সেদিক রাজকে দেখালো। নূরী সন্ধ্যার জন্য চা নাস্তা তৈরী করলো। রাজ ও শিখা একসঙ্গে নাস্তা খেলো। এবং নৈশভোজও একত্রে খেলো দুজনে।
রাজ শিখাকে বলল,

“আমি আসি। কাল আবার আসবো তোমাকে দেখতে। তোমাকে ছুঁলে নিজের উপর নিয়ন্ত্রণ রাখা কষ্টকর! তাই বাসরের আগে আর ছোঁব না তোমায়। অবশ্য এরপর আসবই বাসরের দিন ঠিক করে।”
নূরীর থেকে বিদায় নিয়ে রাত নয়টার পরে রাজ বাড়িতে চলে গেলো। গিয়েই জুবায়েরের সঙ্গে দেখা করলো। শিখার রেজাল্ট জানালো বন্ধুরূপী চাচাতো ভাইকে। জুবায়ের অভিনন্দন জানালো রাজকে শিখার ভালো ফলাফলের জন্য। রাজ জুবায়েরের মুখাকৃতি পরখ করে বলল,

“কিরে, শিখার রেজাল্ট শুনে তুই খুশী হসনি মনে হলো?”
“অনেক খুশী হলাম দোস্ত। অনেক। শিখা আমাদের পরিবারের গর্বিত ছোটবধূ এবং রাজবধূ!”
“তাহলে তোর মুখের অভিব্যক্তি অস্বাভাবিক লাগছে কেন?”
” আমি এখন যেই হট নিউজ তোকে দিবো। সেটা শুনলে তোর মুখের আকৃতি আমার চেয়েও অস্বাভাবিক হবে।”
“হিন্টস দে। কাকে নিয়ে? কি বিষয়ে?”

রাজবধূ পর্ব ৩৫

চাপাস্বরে বলল রাজ।
“আমাদের সবার প্রাণপ্রিয় ও বিশ্বস্ত বাদশাকে নিয়ে। কোচার ধারালো ছুরি দিয়ে পেট কিভাবে কাটা যায় আজ টের পেলাম।” বলল জুবায়ের।
তক্ষুনি রাজ ও জুবায়েরের চোখ দু’জোড়া একসঙ্গে দপ করে জ্বলে উঠলো একশো চুল্লীর ন্যায়।

রাজবধূ পর্ব ৩৭