রাজবধূ পর্ব ৩৮

রাজবধূ পর্ব ৩৮
রেহানা পুতুল

মারতে হলে আগে ধরতে হবে। সেই মিশন যত দ্রুত সম্ভব শুরু করতে হবে।”
রোষপূর্ণ স্বরে বলল জুবায়ের।
সবাই বড় তালুকদারের রুমে চলে গেলো। রাজ ও জুবায়েরও গেলো তার রুমে। তিনি বেশ দূর্বল অনুভব করছেন। চোখে ঝাপসা দেখছেন। রাজ বরকতকে আদেশ দিয়ে বলল,
“জলদি বাজারে যা। কেশব ডাক্তারকে সঙ্গে নিয়ে আয়। ও এখন চেম্বারে আছে।”
বরকত লুঙ্গি হাঁটু অবধি তুলে প্রায় দৌড় দিলো বাজারের দিকে। কেশব ডাক্তার হলো মফস্বলের জনপ্রিয় ডাক্তার। চব্বিশ ঘন্টাই গ্রামবাসীর অসুস্থতায় সে নিরবিচ্ছিন্ন সেবা দান করে থাকে। কিছুক্ষন বাদে বরকত রিকশাযোগে কেশব ডাক্তারকে নিয়ে হাজির হয়ে গেলো। সে তালুকদারের গলা,কপাল ছুঁয়ে দেখলো। না জ্বর নেই। প্রেসার মেপে দেখলো হাই। মেডিসিন দিয়ে দিলো। এবং বলল,

“হঠাৎ প্রেসার হাই হলো কেন? উঁচুকণ্ঠে কথা বলছেন নাকি? যাইহোক, ঠিক হয়ে যাবে। ঔষধগুলো নিয়ম মেনে খাবেন। বয়স হয়েছে। বুঝেসুঝে চলবেন। লেবুর শরবত বা টক কিছু খেয়ে নেন।”
ডাক্তার চলে গেলো। তিনবউ ছুটাছুটি করে স্বশুরের সেবাযত্ন করল। গাছ পাড়া লেবুর শরবত বানিয়ে খাওয়ালো। বেশকিছু সময় পার হলে তালুকদার একটু স্বস্তিবোধ করলেন। মতির মায়ের সঙ্গে কাজে হাত লাগালো তিন জা রানী, সুমনা, ডলি। যদিও কারো হাতেই কাজ উঠছে না। সবার মন বড় বেশী খারাপ। হাত পা ভেঙ্গেচুরে আসছে সবার। অচিন্তনীয় কিছু কেন ঘটে যাচ্ছে এই পরিবারে। বারেবারে দৈত্যের ন্যায় একই প্রশ্ন হামলে পড়ছে মতির মা, হারিছা খাতুন,বরকত থেকে শুরু করে বাকি সবার মনে।

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

তালুকদার শোয়া থেকে উঠে বিছানায় হেলান দিয়ে বসলেন। তার গা ঘেঁষে বসে আছে সুফিয়া বিবি। সুফিয়া বিবি সচরাচর স্বামীর এত নিকটে বসে না। আজ সেও নুইয়ে গিয়েছে। রুমে আরো আছে আমেনা বেগম,জুবায়ের ও রাজ।
“বাবা এখন কেমন লাগছে?”
ক্লান্ত স্বরে পিতার পায়ে হাত রেখে জানতে চাইলো রাজ।
“আলহামদুলিল্লাহ, একটু ভালো লাগতাছে। আসলে আচম্বিতে এমন কিছুর ধকল নিতে পারেনাই আমার মস্তিষ্ক। তাই খারাপ লাগতেছিলো। রাজ আর জুবায়ের আমার কথা শোন।”
“হ্যাঁ কাকা বলেন। শুনছি।”

“বাবারে, যেহেতু খায়রুল তোর পিতা,তাই যন্ত্রণাটা আমাদের সবার চাইতে তোর অধিক হইতাছে। এইটা আমি বুঝতাছি। একবার ভাইবা দেখ,বাদশা তোর মতো আনন্দের ও আরামের জীবন পায়নাই। সারাটাজীবন আমাদের গোলামি কইরা গ্যাছে। তালুকদার ঘরের নিয়মের ফান্দে পইড়া তার মারে এই ঘরে আনতে পারেনাই তোর বাপে। এখন প্রাণের ভয়ে বাদশা পলাইছে। তুই পোলাটারে মাফ কইরা দে। কিসের জেলে দিবি? কিসের মারবি? ওইতো ভুক্তভোগী। ওর কি দোষ? ওইতো নিরপরাধ আমার বিচারে!”
জুবায়ের শান্ত গলায় বলল,
“কাকা আপনার কথা আমারও কথা। হুট করে এমন অনাকাঙ্ক্ষিত কিছু শুনে মাথায় জেদ চেপেছে। নিজেকে স্থির রাখা যায়নি। আমিতো রক্তে মাংসে গড়া মানুষ। ফেরেশতা নয়। রা * গ,ক্রোধ, ঘৃণা, হিংসা এসব মানুষের মাঝে থাকবেই। এবং থাকাটাই স্বাভাবিক। বাদশার প্রতি আমার কোন জে* দ বা ঘৃণা নেই। যার উপরে আছে সে এই মাটির উপরে নেই।”

পাশ থেকে রাজ ঠান্ডা গলায় বলল,
“বাবা, জুবায়ের ও আপনার কথা এবং লজিক শতভাগ রাইট। বাদশার উপরে আমারও এখন কোন অভিযোগ বা ক্রোধ নেই। কিন্তু বাবা কথা হলো, আমরা মানুষ। তাই আমরা দিনশেষে সম্মানটুকু নিয়েই নিঃশ্চিন্তে ঘুমাতে যাই। সেই সম্মান যদি নষ্ট হয়ে যায়, তখন ভালোভাবে বেঁচে থাকার আর পথ রইলো কই? আপনি যেটা বলছেন সেটা হলো বাদশার প্রতি আমাদের সহানুভূতি, ও মানবিকতার কথা। কেউ দোষী হোক আর নির্দোষই হোক,তার জন্য যখন আপনার সামাজিক মর্যাদা তলানীতে পৌঁছাবে বা শূন্যের কোঠায় গিয়ে ঠেকবে। তখন আর সেই মনুষ্যত্ববোধ বলেন আর সহানুভূতিশীল বলেন, কাজ করবে না। আপনার কাছে কোনটা বড়? তালুকদার বংশের মর্যাদা? না বাদশার প্রতি সহানুভূতি?কাল সকাল হলে জুবায়ের সমাজের কাছে এটা প্রকাশ করতে পারবে? আমাদের বাড়ির চাকর বাদশা আমার পিতার জন্মদেওয়া সন্তান? পারবে না। আপনি আমি কেউই পারব না বাবা। আবেগ নয়,বিবেক আর বাস্তবতার কথা ভাবলে এটাই সত্যি। আমার ভয়টা এখানেই। সম্মান হারানোর। এর বাইরে কিছুই না।

” তোর যুক্তিও একেবারে ফালাই দেওন যায় না। তাইলে কি করতে চাস তোরা? তার নামে থানায় মিথ্যা মামলা দিবি? যেন সে কোনদিন জেল থেইকা না বাইর হইতে পারে। আর সত্য ফাঁস না হইতে পারে,এইটা?”
“দেখি কি করা যায়। তবে তাকে খুঁজে বের করা জরুরী। জানাতে হবে আমরা তাকে কিছুই করব না। এবং সে যেন তার বাড়িতেই থাকে। শর্ত হলো, বিষয়টা সে সারাজীবন গোপন রাখবে। তবে আমাদের পরিবার থেকে সে সুযোগ সুবিধা সবই পাবে। অন্তত আমার পক্ষ হতে। পাশাপাশি তার মাকে কবে বিয়ে করলো কাকা,কিংবা আরো কোন কিন্তু জড়িত আছে কিনা কোনভাবে,তাও জানা দরকার৷ আমরা তার চিঠির উপরেই বিশ্বাস করে আছি। তার মুখ হতে সব জানতে হবে। নাকি বলিস জুবায়ের?”
“হ্যাঁ। তোর কথাই আমার কথা। তাকে এতটুকু ফিজিক্যালি টর্চার আমরা করব না। কিন্তু ঘটনার আদ্যোপান্ত জানার জন্য তাকে খুঁজে বের করতে হবে। সেজন্যই থানায় মামলা করতে হবে। পত্রিকায় তার ছবি ছাপিয়ে প্রচার করতে হবে। এছাড়া বাদশাকে খুঁজে পাওয়ার বিকল্প কোন অপশন নেই।”
বলল জুবায়ের।

“যেহেতু তার উপরে আমাদের কোন ক্ষোভ নেই এখন। আমি কাল সকালে চলে যাবো। তারপর আস্তেধীরে কাজগুলো করবো। কারো থেকে পরামর্শ নিতে হবে। অন্যকোন উপায় আছে কিনা বাদশাকে খুঁজে বের করার।”
“হুম তাই কর তাহলে।”
এভাবে দুপুর হয়ে গেলো। রান্নাও শেষ। পুকুরে গিয়ে রাজ, জুবায়ের গোসল করে এলো। সবাই একসঙ্গে বসে দুপুরের খাওয়া সারলো। শেষ বিকালে রাজ মধুপুর গেলো। তার অপেক্ষাতেই ছিলো নূরী ও শিখা। রাজের চিন্তিত মুখ দেখে নূরী জিজ্ঞেস করলো,
“বাবা মন খারাপ কেন? তোমাদের বাড়িতে সব ঠিকঠাক?”
“বাবার শরীরটা খারাপ আম্মা। দোয়া করবেন।”

“আল্লাহ রহমত দান করুক। ভাইসাহেব সাদা দিলের মানুষ। একমাত্র উনার ব্যবহার দেইখাই শিখারে তোমার কাছে বিয়া দিলাম। শিখা ঘরেই ছিলো। ডাইকা আনি।”
রাজ “জ্বি” বলে শিখার রুমে গেলো। সু জোড়া খুলে মোজাও খুলে নিলো। বিছানায় উঠে সোজা হয়ে শুইলো। শিখা অন্যদিকে গিয়ে গল্প করছে। নূরী গিয়ে মেয়েকে ডেকে আনলো। শিখা রুমে পা রেখেই রাজকে সালাম দিলো। রাজ সালামের উত্তর নিলো ম্লান মুখে। বলল,
“কেমন আছো প্রজাপতি?”
“আলহামদুলিল্লাহ ভালো আছি। আপনার মন খারাপ?”
“খুউব।”
নিমিষেই শিখার মুখের চঞ্চলতা মিইয়ে গেলো। শান্তস্বরে বলল,
“বলা যাইবো আমার কাছে?”
রাজ শিখার কাজল কালো আঁখিদুটির পানে নিষ্পলক তাকালো। আত্মবিশ্বাসী সুরে বলল,

” তুমি আমার এক পৃথিবী বিশ্বাস। তোমাকে বলা যাবে না,এমন কিছুই নেই আমার। এত ইচ্ছে করছে তোমার কোলে মাথা রেখে সব বলি। কিন্তু তাতে আমার নিজেরই সমস্যা হবে। বসো। বলছি।”
শিখা লাজুক ভঙ্গিতে বসলো বিছানার একপাশে। ফুলকে নিয়ে বাদশার নিরুদ্দেশ হওয়ার বিষয়টা রাজ সব বললো। চিঠির বিষয়টাও বলল। তাদের প্ল্যান কি বাদশাকে নিয়ে তাও জানালো শিখাকে। কিন্তু বাদশা তার ছোট চাচার জন্ম দেওয়া সন্তান। এই বিষয়টা গোপন রাখলো। পাছে নিজেই না ছোট হয়ে যায় এই শংকায়।
শিখা এক সমুদ্র বিস্ময় নিয়ে রাজের দিকে চাইলো। চোখ কপালে তুলে বলল,

“এতো ভারি ভয়ানক কাণ্ড ঘটে গেলো? কাজ করতে ভালো লাগে না বইলা চিঠি লিখা নিরুদ্দেশ হইয়া গ্যালো তারা দুজন? অবশ্য ঠিকই আছে। বাড়িতে থাকলে আপনারা ধইরা আনতেন দুইজনরে। আপনাগো বাড়ি কাজ করার জন্য চাপ সৃষ্টি করতেন। বাধ্য করতেন। তাইতো কাজ না করার ভয়ে পালাইছে দুজন।”
“এজন্য পালাবে? কেমন যেন খটকা লাগছে আমাদের। আর তাইতো খুঁজে বের করার চেষ্টা করবো।”
শিখা একটু জোরে স্বাস ছাড়লো। বলল,

“আরেকটা কাজ করা যায়। ধরেন সে নিজের বাড়ি একদিন না একদিন আসবই। তো তার ঘরের সামনে বড় একটা কাগজে সাইন পেন দিয়া কিছু কথা লিখা রাখতে পারেন। যেন সে ধরা দিতে বাধ্য হয়। লেমিনিটিং কইরা রাখলে ভালো। ঝড় বৃষ্টিতেও ছিঁড়ব না। নষ্ট হইব না।”
“আইড়িয়া টা মন্দ নয়। এইই তোমার মাথায় ত দেখি বুদ্ধি আছে। কি লিখে রাখলে ভালো হয়।”
“সেইটা আমি ভাইবা জানামু।”
“জানাতে হবে না। সেই ফ্রিডম আমি তোমায় দিলাম। তুমি বরকত বা কারো সহযোগিতা নিয়ে কাজটা করতে পারো। আমি সকালে চলে যাবো। তুমি কলেজে ভর্তি হয়ে আমাদের বাড়ি চলে যেও। স্বশুরবাড়িটাকে নিজের করে নিতে শেখো। তাছাড়া তোমার কলেজ আমাদের বাড়ি হতে নিকটে। ”
“আচ্ছা যাবো।”

কথা শেষে দুজন একসঙ্গে নাস্তা করল। রাতের খাবারও খেলো দুজন একসঙ্গে। রাজ চলে গেলো। বিদায় লগ্নে শিখা নিচু গলায় জানতে চাইলো,
“আপনি আবার কবে আইবেন?”
রাজ শিখার কানের লতিতে ঠোঁট ছুইঁ ছুঁই করে হিসহিসিয়ে বলল,
“এরপর আমাদের দেখা হবে আজ হতে চারমাস পরে। দোতলায় আমার রুমে। অর্থাৎ বাসর ঘরে।”
রাজ চলে গেলো। শিখা দপ করে বিছানায় বসে পড়লো। লজ্জায়,শিহরণে বিছানার চাদর খামচে ধরলো। মনে পড়ে গেলো বিয়ের প্রথম রাতেই তার শ্বাশুড়ি বাসরঘর নিয়ে তাকে কটু কথা শুনিয়েছিলো।

রাজ চলে গেলে শিখা তার মাকে বাদশার বিষয়টা জানালো। নূরীর কলিজা ধক করে উঠলো। কারণ সেতো জানে আসল রহস্য কি হতে পারে। তবুও সে মনে মনে বেজায় খুশী হয়েছে। নয়তো কোন না কোনভাবে তার প্রসঙ্গ চলে আসতোই। সে বাদশার যাওয়ার পক্ষে সাফাই গাইলো। এবং তালুকদার পরিবারের ঢাল হয়ে দাঁড়ানোর জন্য মেয়েকে সাহস ও ইন্দন দিতে লাগলো। মায়ের যুক্তিগুলো শিখার অতি পছন্দ হলো। মননে, মগজে সুঁই সুতার ফোঁড়ের মতো গেঁথে গেলো মায়ের উপদেশমূলক কথাগুলো।

তার পরেরদিন রাজ চলে গেলো। তালুকদার ও জুবায়ের দেখে শুনে বাদশার স্থানে আরেকজন ছেলে নিয়োগ দিলো। নাম নিজাম। সুফিয়া নিজামকে নিজের বশে রাখার চেষ্টা করছে এটা ওটা দিয়ে। শিখা ও কুসুম এস এ কলেজে ভর্তি হয়ে গেলো। পূর্বের ন্যায় দুজন মানবিক শাখায় ভর্তি হলো। প্রথম কয়েদিন শিখা নিজের বাড়ি থেকেই কলেজে যাওয়া আসা করলো। কুসুম, তার ও সীমান্তের প্রেম কাহিনীর ইতিবৃত্ত শোনালো প্রাণের সই শিখাকে।
শিখা বলল,
“কুসুম তোরে তার পরিবার কোনদিন মাইনা নিব না। আমার ফুফুশাশুড়ী জাহানারা সাক্ষাৎ যম। ওরেব্বাপস!”
“না মাইনা নিলে গলায় ফাঁস দিমু। সীমান্ত বলছে যেমনেই হোক ম্যানেজ করবো তার মা বাপরে। তুইও পারলে হেল্প করিস বইন।”

“আমার যদি কিছু করার থাকে,তাইলে তা করণের কোন কমতি হইব না কুসুম। মনে রাহিস।”
খালেদ বাড়িতে এলো তাদের জমিসংক্রান্ত কাজে। সে বাড়িতে গেলে সবসময় রানী যথাসম্ভব নিজেকে পরিপাটি আকর্ষণীয় করে রাখার চেষ্টা করে। আজও তার ব্যতিক্রম ঘটল না। আগের চেয়ে তালুকদার পরিবার নিরিবিলি থাকে এখন বেশি। বাদশা নেই। ফুল নেই। রাশেদ ও খায়রুল তালুকদার প্রয়াত। আদুরী শ্বশুরবাড়ি। দূরে বিধায় তার সচরাচর আসা হয় না। এক পরিবারে পাঁচজন মানুষের অনুপুস্থিতি মানে বিশাল ফাঁকা।
এমন এক বিকালে রানী পুকুর ঘাটে বসে গুনগুনিয়ে গান গাইছে। তাকে দেখেই খালেদ এগিয়ে এলো। ভাবলো,কতটা দিন ভাবির সাথে কথা হয় না। যত যাই হোক আমাদের পরিবারে তার কায়িক শ্রমের অবদান অন্য বউদের চেয়ে বেশী। যাই একটু খোঁজ খবর নেই তার। সেতো বড় নিঃসঙ্গ! একলা! স্বামী, সন্তানহীন ধূসর জীবন তার। যেন ফাগুনের বিষন্ন ঝরাপতা। খালেদ গিয়ে রানীর সামনে দাঁড়ালো। সরু চোখে রানীর আপাদমস্তক পরখ করে দেখলো ম্যাগনিফাইং গ্লাস দিয়ে দেখার মতো করে। রানীর পুরু কোমরটা উদাম হয়ে আছে। পায়ের গোড়ালির উপর পর্যন্ত নিরাবরণ। ঠাসা বুকটা বের হয়ে আছে। খালেদ গলা খাঁকারী দিয়ে বলল,

“কেমন আছো তুমি?”
“হঠাৎ আমার ভালোথাকার খবর জিগাইতাছেন ক্যান?”
“জিগাইলে সমস্যা?”
“না কিয়ের সমস্যা? একজনের একটু পরশ পাইলেই ভালো থাকি অনেক। কিন্তু এইসব পুরান কথা। এখন এইসব ভাবি না। আশাও করি না। খালি খালি অন্তরে ব্যথা জাগে।”
খালেদ পা ঘুরিয়ে চলে যায়। সেই রাতে সে স্ত্রী সুমনার বুকের ভাঁজে হাত বুলাতে বুলাতে বলে,
“এইভাবে কতদিন উপোস থাকুম আমি। পুরুষ মানুষ চায় কি নারীর কাছে? কত ইচ্ছা ছিলো আরেকটা মেয়ে সন্তান হইবো আমাগো।কিন্তু…”

খালেদের মুখের কথা কেড়ে নেয় সুমনা। আহত সুরে বলল,
“কি করবো কন? পরপর দুইটা বাচ্চাই হইলো আমার সিজার কইরা। শেষে ত জরায়ু কাইটা ফালাইতে হইছে আমারে বাঁচানোর লাইগা। এখন ত দুনিয়া এক করলেও আমার গর্ভধারণ সম্ভব নয়। আর মেলামেশা করতে গ্যালেও আমি ব্যথা পাই। অসুস্থ হইয়া পড়ি। আপনার চাহিদা মেটাইতে পারি না। এই দায় আমি মাইনা নিলাম। আপনে চাইলে মেয়ে শিশুর জন্য ও আপনার চাহিদার জন্য বিয়া করতে পারেন।”
“এখন বলো। তখন ঠিকই ঝামেলা করবা।”
সুমনা নিরুত্তর। চোখের পানি নিরবে ঝরে পড়ে তার।
“তুমি ঔষধ খাইছো?”
” নাহ।”

খালেদ সুমনাকে তার ঔষধগুলো দেয়। সুমনা আধবোঁজা চোখে খেয়ে নেয় সব ঔষধ। খেয়াল করেনি যে, ঘুমের অতিরিক্ত ডোজের একটা ট্যাবলেটও ছিলো। সুমনা গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন হয়ে পড়ে। তারপর খালেদ উঠে আসে রানীর রুমে। ভিতর থেকে দরজা বন্ধ করে দেয়। বহুদিন ধরে তারা দুজনই অভুক্ত! তীব্র ক্ষুদার্ত! রানীর স্বামী নেই। আর খালেদের স্ত্রী থেকেও নাইর মতো। তাকে চূড়ান্ত সুখ দিতে ব্যর্থ তার স্ত্রী। খালেদ ও রানী মাসের পর মাস পিপাসিত। তাই দুজন দুজনকে একান্তে পেয়ে বন্য হয়ে উঠে। ঘন্টাব্যাপী চলে তাদের অভিসার ও প্রমোদতরী। শেষ রাতের দিকে খালেদ ক্লান্ত মাঝির মতো বেরিয়ে যায় নিজের রুমে। তার পরের রাতেও খালেদ রানীর কাছে আসে। একই রকম সুখভোগে দুজন বেপরোয়া হয়ে উঠে। কেউই কিছু টের পেল না। পরেরদিন খালেদ ঢাকা চলে যায়।
তারপর এক সকালে সুমনা রানীর কাছে দুঃখ প্রকাশ করে বলে,

“ভাবি কি করমু? একটা বুদ্ধি দেন না? সে কয় আরেকটা বিয়া করবো। তার একটা কন্যা সন্তান চাই। আর কত খালিমুখে থাকবো। আমিতো দিতে পারি না তার চাহিদামতো।”
“তুই চিন্তা করিস না। মাইজ্জা ভাই বাড়ি আইলে আমার রুমে পাঠাইস। দেহি বুঝায়া থামান যায় কিনা। অন্যদিকে মুখ দিব ক্যান সে? ঘরের মধ্যেই ত মানুষ আছে। বাচ্চা ফয়দা দিলে ঘরেই দিতে পারবো।”
“ভাবি কি কও, বুঝলাম না কিছুই?”
ঘাবড়ানো কন্ঠে বলল সুমনা।
“আরেহ দূর! ঠাট্রা করছি। তোরে ভড়কাইয়া দিলাম।”

বলেই রানী উঠে গেলো সুমনার সামনে হতে। তার ঠোঁটের কোণে ঝুলে পড়লো দুর্বোধ্য হাসির ফোয়ারা।
একদিন শিখা কলেজ শেষে বের হয়ে মাঠ অতিক্রম করে। তখন মাঠের একপাশে থেকে রোজ বসা আইসক্রিম বিক্রেতা তারে আপামনি বলে ডাক দেয়। শিখা ঘাড় ঘুরিয়ে তাকে দেখে এবং এগিয়ে যায়।
“কি কন?”
বিক্রেতা শিখার হাতে একটি চিরকুট ধরিয়ে দেয়। শিখা চমকানো চোখে বলল,
“কে দিলো?”
“চিনিনা। আপনে যখন কলেজে ঢুকতাছেন,তখন আপনারে দেখায়া একটা জোয়ান পোলা কইলো এইটা আপনারে দিতে।”

রাজবধূ পর্ব ৩৭

শিখার কৌতুহল দিগুণ হলো। সে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে সেই অচেনা ছেলের বর্ণনা জিজ্ঞেস করলো বিক্রেতাকে। কিন্তু বিক্রেতার বর্ণনা অনুযায়ী শিখা চেনা কোন ছেলের মিল খুঁজে পেল না। সে বিক্রেতাকে বলল,
“এরপর আর এমন কিছু দিলে নিবেন না। বলবেন আমার বিয়ে হয়ে গ্যাছে। আমি অন্য ছেলের বউ।”
বিক্রেতা কাঁধ ঝাঁকায় সম্মতি জানিয়ে।
শিখা ভ্রুজোড়া কুঞ্চন করলো। চিরকুটটি মেলে পড়লো বার দুয়েক।
“আমি দূর হতে তোমাকেই দেখিবো।
আর মনে মনে তোমাকেই চাহিবো।
পাই বা না পাই তবু স্বপ্ন বুনে যাই।
কল্পলোকে শুধু তোমাকে নিয়ে হারাই।
জানি পাব না তোমায় কোনদিন।
তবু ভালোবেসে যাবো চিরদিন।”
পড়া শেষে শিখা চিরকুটটি যত্ন করে রেখে দিলো বইয়ের ভাঁজে। মনে মনে ওয়াদা করে, রাজ বাড়ি এলে তাকে অবশ্যই দেখাবে এটা। আগের চিরকুটগুলোর কথাও জানিয়ে দিবে। নয়তো এই অযাচিত উটকো যন্ত্রণা থেকে হয়তো তার নিস্তার নেই। সে হেঁটে পথের একপাশ ধরে সামনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। তখনই তার পাশে এসে দাঁড়ালো…

রাজবধূ পর্ব ৩৯