ধরিয়া রাখিও সোহাগে আদরে পর্ব ১৮
জেনিফা চৌধুরী
“যাকে ভালোবাসেন তাকে এভাবে অপমান করতে পারলেন, সায়র?”
সায়র বিধ্বস্ত স্বরে জবাবে বলল,
“অপমান! আমি আপনাকে অপমান করেছিস, মেহরিশ? কিভাবে?”
মেহরিশ ছোটাছুটি থামিয়ে দিল। অশ্রুসিক্ত নয়ন রাখল সায়রের নয়নে। বলল,
“আমাকে স্বাভাবিক হতে না দিয়ে, আমার অসহায়ত্বের সুযোগ নিয়েছেন আপনি। আপনি একজন ব্যক্তিত্বহীন পুরুষ।”
সায়র শুধু নিষ্প্রাণ হাসল৷ শান্ত স্বরে বলল,
“ব্যক্তিত্ব মানুষের সম্পূর্ণ আবরণ বহন করে না। ব্যক্তি নিজেকে যেভাবে উপস্থাপন করবে, অনুরুপভাবে ব্যক্তিত্বও সেভাবেই প্রকাশ হবে। তাই মানুষকে জাজ করার আগে মস্তিষ্ককে
মিনিট খানেক সময় দিও।”
বলেই বেরিয়ে যাওয়ার জন্য পা বাড়িয়েও থেমে গেল। নিষ্প্রাণ বাক্যে বলে উঠল,
“এতটা ভুল বুঝবেন না, মেহরিশ। সত্যিটা সামনে আসলে নিজেকে সামলাতে পারবেন না।”
বলেই বেরিয়ে গেল। সায়র চলে যেতেই মেহরিশ ধপ করে নিচে বসে পড়ল। সায়র কি বলে গেল? কোন সত্যি? এমন কি আছে যা মেহরিশের অজানা? সায়রের হঠাৎ বিয়ে করার পেছনে কারণ কি? আনায়া নিখোঁজের পর হঠাৎ মাঝরাতে দরজার বাইরে কি করে আসল? সবপ্রশ্ন মাথায় ঘুরপাক খেতে লাগল। মেহরিশ কী কোনোদিন সুখের মুখ দেখবে না? মাথায় যন্ত্রণা শুরু হলো। চিৎকার করে উঠল। দুই হাতে মাথা চেপে ধরল। কী বিষাক্ত যন্ত্রণা! মুহূর্তেই মন, মস্তিষ্ক দুটোই ব্যাথায় জর্জরিত হয়ে উঠল।
আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন
“স্যার, মেহরিশ বিয়ে করেছে।”
কথাটা আবির সাহেবের কানে যেতেই তিনি বসা ছেড়ে উঠে দাঁড়ালেন। চিৎকার করে বললেন,
“হোয়াট? মেহরিশ বিয়ে করেছে? কি বলছো তুমি?”
ফোনের ওপর প্রান্ত থেকে লোকটা পুনরায় বলে উঠল,
“জ্বি, স্যার। মেহরিশ সায়র নামে এক ছেলেকে বিয়ে করেছে। ছেলেটা বোধহয় আপনাদের পরিচিত কেউ।”
আবির সাহেব নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারছেন না। ভুল শুনছেন? নাকি ভুল ইনফরমেশন দিচ্ছে? মেহরিশ ওর বাবাকে না জানিয়ে বিয়ে করে ফেলবে___এটা কি আদৌ সম্ভব? আবির সাহেব কল কেটে দিলেন। ধপ করে বসে পড়লেন। সায়রের উপর রাগে ফেটে পড়লেন। চিৎকার করে উঠে ফোন ছুঁড়ে মা°রলেন দেয়ালে। বাজখাঁই স্বরে বলে উঠলেন,
“আমি কাউকে ছাড়ব না। মেহরিশের মৃ°ত্যু আমার হাতেই লেখা আছে। সবাইকে দেখে নিব আমি।”
বলেই বড় বড় পা ফেলে রুম থেকে বেরিয়ে গেলেন।
আবির সাহেব তৃষ্ণার্ত কাকের ন্যায় অন্ধকারে এদিক সেদিক চোখ বুলিয়ে যাচ্ছেন৷ গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে আছে। এক ফোঁটা পানির জন্য ভেতরের সবকিছু শুকিয়ে যাচ্ছে মনে হয়। করুন স্বরে বলে উঠলেন,
“পানি! পানি! আমাকে একটু পানি দাও। কেউ একটু পানি দাও।”
আর বলতে পারলেন না। গলা আরো শুকিয়ে আসতে লাগল। আবির সাহেবের মনে হচ্ছে এক্ষুনি বোধহয় তার দম বেরিয়ে যাবে৷ কিন্তু পানি না পেলে সে হয়তো সত্যি সত্যি মা°রা যাবে। তাই পুনরায় বলতে লাগল,
“প.প.প.প.পানি! কেউ একটু পানি দ…।”
আর বলতে পারলেন না। তার আগেই দরজা খোলার শব্দ কানে ভেসে আসল। কোনোমতে উপরে তাকিয়ে দেখলেন কেউ ভেতরে প্রবেশ করছে। আবির সাহেব অন্ধকারে ঠিক ঠাওর করতে পারলেন না কে এসেছে? তবুও তাকিয়ে থাকলেন সেখানে। ব্যক্তিটি অন্ধকারের মাঝেই আবির সাহেবের সামনে এসে দাঁড়ালেন। কোনো শব্দ করছে না । আবির সাহেব ভয়ার্ত বাক্যে জিজ্ঞেস করলেন,
“ক.ক.ক.কে এখানে?”
কোনো উত্তর আসল না। আবির সাহেবের ভয় বাড়ল। তবুও উত্তরের আশায় বসে রইলেন। মিনিট খানেক পর আলো জ্বলে উঠল। বেশ অনেক মাস পর এমন ঝমকাল আলোর দেখা পাওয়ায় আবির সাহেব চোখ বন্ধ করে ফেললেন। চেয়ে থাকতে পারছেন না। আলো চোখে বসছে। আচ্ছা সে কি অন্ধ হয়ে গেছেন? নাকি অন্ধকারে থাকতে থাকতে আলোর স্বাধ নিতে ভুলে গেছেন? খুব কষ্টে আস্তে আস্তে চোখ খুললেন। সামনে থাকা ব্যক্তিটি মুখ এখনো অস্পষ্ট। কিছুক্ষণ চেয়ে থাকার পর ব্যক্তিটির মুখ স্পষ্ট হলো। বহু পরিচিত ব্যক্তিটিকে দেখে মুখে হাসি ফুটল। সোনার খনি পাওয়ার মতো খুশি মুখশ্রীতে ফুটে উঠল। আবেগে জর্জরিত স্বরে বলতে লাগলেন,
“স.স.সাবির! সাবির ভাই! ভাই! তুই? তুই এসেছিস? আমি সত্যি দেখছি? নাকি স্বপ্ন দেখছি?”
সাবির সাহেব হালকা হেসে বলে উঠলেন,
“হ্যাঁ, ভাই! সত্যি! আমি এসেছি।”
আবির সাহেবের হাসিটা আরো প্রস্তর হলো। তৃষ্ণা বোধহয় মুহূর্তেই উবে গেল। হাসতে হাসতে বলে বলতে লাগলেন,
“ আমাকে নিতে এসেছিস? সত্যি! আমি জানি তুই আমাকে ছাড়া থাকতে পারবি না। জানতাম তো, আমাকে তুই এখান থেকে একদিন ঠিক বের করে নিয়ে যাবি। আমার এতদিনের অপেক্ষা বুঝি শেষ হলো। আমি আবার বাইরের আলো বাতাস দেখতে পারব। আমার প্রাণ ভোমরাগুলোর দেখা পাব। আমার ব্যবসা, আমার বাড়ি, আমার স্ত্রী, আমার মেয়ে! সবাইকে দেখতে পারব। আল্লাহ! আল্লাহ বুঝি আমাকে এই দিনের জন্যই বাঁচিয়ে রেখেছেন।”
খুশিতে আবির সাহেব খুশিতে আত্মহারা হয়ে আছেন। সাবির সাহেব এবার শব্দ করে হেসে উঠলেন। হাসতে হাসতে বলে উঠলেন,
“ভাই, ঘুমিয়ে স্বপ্ন দেখা ভালো। কিন্তু জেগে জেগে স্বপ্ন দেখা বোকামি। তোমাকে আমি এখানে নিয়ে যেতে নয়, বরং দুনিয়া থেকে বিদায় দিতে এসেছি।”
নীলুফা বেগম ছটফট করছেন৷ ড্রয়িং রুমের এ মাথা থেকে ওমাথা হেঁটে বেড়াচ্ছেন। একবার বসছেন তো আরেকবার উঠছেন। এক হাতে কফির মগ, অন্য হাতে মোবাইল। কাউকে কল দিচ্ছেন কিন্তু ওপাশ থেকে রিসিভ হচ্ছে না। তার চেহারায় ভয়ংকর দুশ্চিন্তার ছাপ দেখতে পারছে মেহরিশ। বিয়ের পর মাঝে কেটে গেছে দুইদিন। সায়র এইদুইদিন এই বাসায় ফিরেনি। নিজেদের বাসায় থাকছে। মেহরিশও রাগ, অভিমান, ক্ষোভে খোঁজ নেয়নি। আজ সকাল থেকে উঠে নীলুফা বেগমকে এমন ছটফট করতে দেখছে। কিছুক্ষন খেয়াল করে এবার প্রশ্ন করেই বসল,
“কী হয়েছে, মা? এনিথিং রং?”
নীলুফা বেগম গোমড়া মুখে বলে উঠলেন,
“আমার বুকের ভেতরটা কেমন যেন করছে রে, মা। মনে হচ্ছে কোনো বিপদ আসতে চলেছে আমাদের পরিবারের উপর। তোর বাবাও সকাল থেকে ফোন ধরছে না। মানুষটা দূরে আছে। ঠিক আছে কিনা জানাবে তো।”
মেহরিশ সাথে সাথে বলে উঠল,
“মা, বাবা ঠিক আছে। চিন্তা করো না। হয়তো ব্যস্ত আছে তাই ফোন ধরছে না। পরে ব্যাক করে নিবে দেখো। আর তা ছাড়া বাবার সাথে তো, আরিফ আছে। এসব উল্টাপাল্টা চিন্তা বাদ দিয়ে কফিটা শেষ করো। ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছে৷”
মেহরিশের কথা শুনেও নীলুফা বেগম শান্ত হতে পারলেন না। নিশ্চুপে এসে মেহরিশের পাশে বসলেন। শান্ত বাক্যে বলে উঠলেন,
“জানিস, আমার এই ফিলিংশটা বহু বছর আগে যেদিন আবিরের এক্সিডেন্ট হলো সেদিন হয়েছিল। আজ আবার এতগুলো বছর এমন ফিলিংশ হচ্ছে। তাই ভয় হচ্ছে।”
মেহরিশ এবার একটু অবাক হলো। অবাক পানে জিজ্ঞেস করল,
“বাবার, এক্সিডেন্ট! কবে হয়েছিল, মা? আমি কোথায় ছিলাম? আমি জানিনা কেন? আমার মনে নেই কেন?”
নীলুফা বেগম থমকে গেলেন। মুখ ফস্কে কথাটা বের হয়ে গেছে। তাই কথা এড়াতে বলে উঠলেন,
“আরে ধুর কি বলতে কি বললাম ঠিক নেই৷ তুই বস আমি একটু রান্নাঘর থেকে আসছি।”
বলেই উঠে চলে গেলেন। মেহরিশের মনে খটকা লাগা শুরু হয়ে গেছে ততক্ষণে।
নীলুফা বেগম রান্নাঘরে গিয়ে হাঁফ ছাড়লেন। নিজে নিজে বলে উঠলেন,
“যে সত্যের মুখোমুখি আমি হয়েছে, সে তিক্ত সত্যটা তোরা জানার চেষ্টার করিস না, মা। সহ্য করতে পারবি না। আমি এক ভুলের সাথে নিজের জীবন বেঁধেছি, যে ভুল আমাকে ঘুন পোকার মতো খেয়ে ফেলছে তিলে তিলে।”
ধরিয়া রাখিও সোহাগে আদরে পর্ব ১৭
“সায়র, আবির সাহেবের খোঁজ পাওয়া গেছে। তবে জীবিত নয় মৃ°ত।”
কথাটা সায়রের কানে যেতেই সায়র স্তব্ধ হয়ে গেল। তারমানে কি শেষ রক্ষ হলো না?