আমি শুধু চেয়েছি তোমায় পর্ব ১০
suraiya rafa
হাড়হিম করা কনকনে ঠান্ডা পরিবেশ , আকাশে রোদের ছিটেফোঁটা ও নেই, কয়েক স্তর ঘন কুয়াশার চাদরে ঢেকে আছে চারিপাশ।নাক চিড়ে ভেতরে প্রবেশ করা শীতল বুনো বাতাসে যেন হৃদয় জমে যাচ্ছে, শক্ত বরফের খন্ডে রূপান্তরিত হচ্ছে হাত পা সহ শরীরের বাকি অংশ, এ যেন প্রাকৃতিক হিমাগার।
এই দেশে থাকলে বুঝি মানুষের হৃদয় এরীশের মতোই জমাট বেধে পাথর খন্ডের ন্যায় শক্ত অনুভূতিহীন হয়ে যায়? মনেমনে ভাবছে ঈশানী। গত পনেরো দিনের একটানা মহাসমুদ্রের যাত্রা শেষে আজই এক ছটাক বন্দরের মুখ দেখতে পেয়েছে ও। আশ্চর্যের বিষয় হলো এরীশের ক্রুজ শিপ টাও আজ তীরে ভিরেছে।
গত এক সপ্তাহ ধরেই সমুদ্রেপৃষ্ঠে প্রচুর ঠান্ডা অনুভূত হতো,তবে ঈশানী ভেবেছিল গভীর সমুদ্রে আবহাওয়ার তারতম্যের কারণেই এটা হচ্ছে, কিন্তু আজ বন্দরে নেমে চারিদিক পর্যবেক্ষন করতেই ঈশানী বুঝতে পারলো আসলে বাংলাদেশের সীমানার ধারে কাছেও নেই ওরা,এটা নিশ্চয়ই শীত প্রধান কোনো দেশ।কিন্তু কোন দেশ?
ভাবনার মাঝেই নিরেট চোখে আশেপাশে চোখ বোলালো ঈশানী, ওর দু’পাশেই স্ব গতিতে হাটছে কালো পোশাক পরিহিত বন্দুক ধারী বডিগার্ড’সরা, সামনেও তাদের সারি সারি অবস্থান।
গার্ড’সদের অন্যপাশে আরেকটু সামনে উঁকি দিতেই ঈশানী দেখতে পেলো এরীশকে, ওর বেশভূষা আজ ভিন্ন, পরনে ব্ল্যাক জেনিম জ্যাকেট,মাথায় ব্ল্যাক বেজবল ক্যাপ, চোখেও একই রঙের রোদ চশমা।
আজ প্রায় পনেরো দিন পরে আবারও এরীশকে দেখলো ঈশানী।সেদিন জিসানকে ছেড়ে দেওয়ার পর আর এক মূহুর্তের জন্যও দেখা হয়নি ওদের। এতে অবশ্য ঈশানীর ভালোই হয়েছে, ও স্বস্তি পেয়েছে খুব। তবে বর্তমানে এরীশকে রাগান্বিত দেখাচ্ছে, কারও সাথে ফোনালাপে ভীষণ ব্যস্ত সে,হাঁটতে হাঁটতেই সাবলীল গলায় ফোনের ওপাশের লোকটাকে হুকুম করে এরীশ বলছে,
আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন
—-জাস্ট কিল হীম।
— কি আশ্চর্য!এদের কাছে মানুষকে মে’রে ফেলা কতই না সহজ। আচ্ছা মানুষ হয়ে মানুষকে মা’রতে একটুও কলিজা কাঁপেনা এদের?
নিজের ভাবনায় নিজেই খানিকটা তাচ্ছিল্য করে হাসলো ঈশানী, পরক্ষনেই মনেমনে আওড়ালো,
— আমিই বা কাকে কি বলছি,এরীশ কি আদৌও মানুষের কাতারে পরে? ও তো স্রেফ একটা জানোয়ার।
এভাবেই এক পর্যায়ে ভবঘুরে ঈশানী হাঁটতে হাঁটতে খেয়াল করলো ও আসলে গার্ডদের থেকে কিঞ্চিৎ পিছিয়ে পরেছে, আশেপাশে তাকিয়ে দেখলো জায়গাটা লোকালয়হীন আর বেশ নির্জন।
এখন আর ও ক্রুজ শিপে নেই চাইলেই যেদিক ইচ্ছে সেদিকে দৌড় লাগাতে পারবে, ব্যাপারটা মস্তিষ্কে ভালোমতো ক্যাচ করতেই পালানোর বুদ্ধিটা মাথা চাড়া দিয়ে উঠলো ঈশানীর মনে।ও ঠিক করলো এবার ও পালাবে,কারন এই মূহুর্তে ঈশানীকে খোজার মতো স্থীর মন মানসিকতা এরীশের মধ্যে লক্ষ্যনীয় নয়।
ওইজন্যই যেই ভাবা সেই কাজ, ধীরে ধীরে গার্ড’সদের থেকে এক পা দু’পা করে সরে আসতে লাগলো ঈশানী, এভাবে সরে যেতে যেতে বেশ অনেকটা দূরত্ব বাড়িয়ে যেইনা পেছনে ঘুরে চোখ খিঁচে দৌড় লাগাবে ও তৎক্ষনাৎ পেছন থেকে কেউ শক্ত হাতে বাহু টেনে ধরলো ওর, আকস্মিক হ্যাঁচকা টানে দু’কদম পিছিয়ে এলো ঈশানী সেই সাথে গলায় অনুভব করলো সরু ধারালো কিছু একটার অস্তিত্ব।
ধরা পরে গিয়েছে ব্যাপরটা বুঝতে পেরে হৃদয়ে আরেক দফা কাঁপুনি শুরু হলো ঈশানীর। ও আস্তে করে কাঁপতে কাঁপতে চোখ নামালো গলার কাছে, দেখলো ওর গলায় ধারালো চাকু ধরে রেখেছে কেউ। কেউ, বললে কথাটা ভুল হবে, কারণ এই মাস্কি স্নিগ্ধ সুঘ্রাণটা শুধুমাত্র এরীশের। জঙ্গলে এরীশের পরিহিত হুডি থেকে নির্গত এই একই রকম মাস্কি একটা ক্লোনের সৌরভে পাগলপ্রায় হয়ে গিয়েছিল ঈশানী, যা আজও স্পষ্ট মনে আছে ওর।
নিচে তাকিয়ে চাকুর অবস্থান দেখতে পেয়ে ভয়ে আঁতকে উঠলো ঈশানী, ওর গ্রীবাটা থরথরিয়ে কাঁপছে এই মূহুর্তে , ঈশানীর মতো একটা সহজ সরল অন্তর্মুখী স্বভাবের মেয়ের কাছে এখনকার পরিস্থিতি গুলো অত্যন্ত বেগতিক। ওর মস্তিস্কটা কখন কি করে বসে ও নিজেও তা ঠাওর করে উঠতে পারেনা,সেখানে পরিস্থিতি সামাল দেওয়া তো দূরের কথা।
তাই এই মূহুর্তে কিভাবে পুরো ব্যাপরটাকে আড়াল করবে আর কিভাবেই বা এই মর’ণঘাতী অ’স্রের হাত থেকে নিজেকে রক্ষা করবে কিছুই বুঝে উঠতে পারছে না ঈশানী। অগত্যা ভয়ে জর্জরিত হয়ে থরথর করে কাঁপছে শুধু মেয়েটা, ঈশানী এতো জোরে জোরে কাঁপছিল যে ওর গলায় চাকু ধরে রাখা এরীশও সেটা পুরোপুরি অনুভব করতে পারছে।
ঈশানীর এমন নাজেহাল অবস্থা দেখে মনেমনে ক্রুর হাসলো এরীশ, মেয়েটা অত্যন্ত ভীতু অথচ উপরে উপরে সাহসীকতার ভান ধরে থাকে সবসময়, আর এই ব্যাপারটাই বেশ ইন্টারেস্টিং লাগলো এরীশের নিকট। পরক্ষনেই ঈশুর কানের কাছে মুখ ঠেকিয়ে দাঁতে দাঁত চেপে ভ’য়ংকর হাস্কিস্বরে ও বলে উঠলো,
—- পালানোর চেষ্টাও করোনা, এটা এরীশের রাজত্ব, এখান থেকে পালিয়ে যাওয়ার মতো সাহস কিংবা সাধ্য কোনোটাই তোমার নেই,বুঝেছো?
এরীশের কথায় জোরে জোরে হ্যা সূচক মাথা নাড়ালো ঈশানী।
অতঃপর কথা শেষ করে গার্ডদের ইশারা দিয়ে ঈশানীকে ধরে ফেলতে বলে এরীশ। তৎক্ষনাৎ দু’জন গার্ড’স এগিয়ে এসে ঘিরে দাঁড়ালো ঈশানীকে। ঈশানী এখন পুরোপুরি নজরবন্দী,পালানোর আর কোনো রাস্তা খোলা নেই ওর কাছে , ব্যাপারটা নিশ্চিত হয়ে আবারও ফোনে কথা বলতে বলতে সামনে এগিয়ে যায় এরীশ।
এখন আর করনীয় কিছু নেই ভেবে সহসা গার্ড’দের নজরবন্দী হয়ে সামনে এগুচ্ছে ঈশানী, বন্দর ছাড়িয়ে কিছুদূর এগিয়ে আসতেই ঈশু দেখলো রান ওয়েতে হেলিকপ্টার দাঁড়িয়ে আছে, সেই সাথে কিছু ব্ল্যাক মার্সিডিজ আর রোলস রয়েস কারও রয়েছে ।
এতো কাছ থেকে চলন্ত হেলিকপ্টারের তীব্র ঘূর্ণনে সকলের নাজেহাল অবস্থা, রোগাপাতলা গড়নের ঈশানী তো হাওয়ায় উড়ে গেলো বলে,দু’দিক দিয়ে ওর দু’হাতের কব্জি শক্ত করে ধরে রেখেছে গার্ড’সরা,অথচ এতো তীব্র কনকনে বাতাসে এক চুল পরিমাণ ও নরছে না অন্যান্য গার্ড’সরা, তারা যে আদতে কতটা পেশাদার আর পারদর্শী সেই ভেবেই রীতিমতো অবাক হলো ঈশানী।
তবে ওর অবাকের মাত্রা চরম সীমানায় পৌঁছে গেলো তখনই যখন দেখলো কানে বিশাল সাইজের হেডফোন আর চোখে রোদচশমা লাগিয়ে হেলিকপ্টারের ককপিটে বসে আছে স্বয়ং এরীশ,এবং তার কয়েকমূহুর্তের মধ্যেই ওদের সকলের সামনে দিয়ে এরীশ নিজ হাতে সবকিছু কন্ট্রোল করে একাই উড়িয়ে নিয়ে গেলো হেলিকপ্টারটা।
এরীশ নিজেই হেলিকপ্টার নিয়ন্ত্রন করলো, তারমানে তো সে পাইলটদের অভিজ্ঞতা সম্পন্ন। আসলেই কি তাই?
এই পুরো ব্যাপার খানা ছোট্ট মস্তিষ্কে বোধগম্য হওয়ার আগেই ঈশুকেও টেনেটুনে গাড়িতে বসালো গার্ড’স রা।
এতোক্ষণ যাবত বিস্ময়ে কোনোকিছুই মাথায় ঢুকছিল না ঈশানীর, তবে এই মূহুর্তে যখন গাড়িটা চলতে শুরু করলো, তখনই হঠাৎ ওর মনে হলো,
— এটা আসলে কোন দেশ? আর আমি যাচ্ছিটাই বা কোথায়?
মনের খচখচানিটাকে দমিয়ে রাখতে না পেরে ভেতরে কিছুটা সাহস সঞ্চার করে,ওর পাশে বসে থাকা দানবীয় চেহারার কালো পোশাকধারী গার্ডটাকে আমতাআমতা করে জিজ্ঞেস করেই বসলো ঈশানী, খানিকটা শুষ্ক ঢোক গিলে ভাঙা ভাঙা ইংরেজিতে শুধালো,
—- হোয়েয়ার আর উই গোইং?
প্রশ্নটা শোনা মাত্রই কালো পোশাক পরিহিত গার্ডটা ভ্রুজুগল কুঁচকে তীক্ষ্ণ চাহনি নিক্ষেপ করলো ঈশানীর পানে, যেন প্রশ্নটা জিজ্ঞেস করে মহাভারত অশুদ্ধ করে ফেলেছে ঈশানী। লোকটার এহেন চাহনির বিপরীতে আবারও ঠোঁটের আগায় মিথ্যে হাসি ঝুলিয়ে শুষ্ক ঢোক গিললো ও, লোকটা এবার ঈশানীর দিক থেকে চোখ সরিয়ে সামনে দৃষ্টিপাত করে থমথমে আর গম্ভীর আওয়াজে বলে ওঠে,
— মস্কো।
নামটা শোনা মাত্রই বুকের ভেতর ধক করে ওঠে ঈশানীর, মনের মাঝে হাজাও শঙ্কা নিয়ে একাই বিড়বিড়ায় ও,
— মস্কো তো রাশিয়ার রাজধানী, তারমানে মাফিয়া বস টা আমাকে রাশিয়াতে নিয়ে এলো? হায় খোদা এখান থেকে আমি পালাবো কি করে? কি করেই বা ফিরবো বাড়ি? নাকি সারাজীবনের জন্য এই এরীশ নামক গোলকধাঁধায় আটকা পরে যাবো আমি? কি করলে মুক্তি মিলবে আমার?
নিজের চুল নিজে খামচে ধরে অসহায়ের মতো কেঁদে ওঠে ঈশানী, সারা জীবন অভ্যাস বশত ঘরকুনো হয়ে মায়ের কড়া শাসনে থেকেও কোনোদিন ওকে এটা কল্পনা করতে হয়নি যে,
—আমি বন্দী আছি, আমি মুক্ত কবে হবো? সবার মতো অবাধে বুক ভরে শ্বাস কবে নেবো?
অথচ আজ মূহুর্তেই কেমন ওলট-পালট হয়ে গেলো ঈশানীর চিন্তা ধারা, ওর দম বন্ধ হয়ে আসছে,কেমন যেন শ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে,হুট করেই নিজেকে আজ খাঁচায় বন্দী পাখি ছাড়া আর কিছুই অনুভব করাতে পারছে ও, ক্রমশ মনে হচ্ছে এই জায়গাটা একটা ব্ল্যাকহোল এখানে আশেপাশে থাকা সব মানুষগুলো ভ’য়ংকর দানবীয়, জানোয়ারের চেয়েও অধম এরা।
আর ঈশানী, যে কিনা একমাত্র ভুক্তভোগী, ও এই জায়গাটা থেকে মুক্তি চায়, যে কোনো মূল্যে এখান থেকে বের হতে চায়। নয়তো অতিরিক্ত মানসিক চাপে পাগল হয়ে যাওয়া ছাড়া আর কোনো উপায়ই থাকবে না ওর জন্য।
তুষার আবৃত আকাবাঁকা পাহাড়ি রাস্তা ছাড়িয়ে, মূল শহর থেকে অনেকটা দূরে, গহীন জঙ্গলের মাঝে বিশাল বড় পেন্ট হাউজে সন্ধ্যা নাগাদ নিয়ে আসা হলো ঈশানীকে।
পেন্ট হাউজের ভেতরে পা রাখা মাত্রই বিস্ময়ে হতবিহ্বল হয়ে গেলো ঈশানী, কারণ এই পুরো পেন্ট হাউজে কোথাও কোনো রঙের ছিটেফোঁটাও নেই, পুরো পেন্ট হাউজ জুড়ে শুধুই কালো থীমের পেইন্টিং। বাইরের ভেতরের প্রতিটি দেওয়াল থেকে শুরু সমস্ত আসবাবপত্র কুচকুচে কালো, কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় হলো কালো রঙেই যেন ঝিল দিচ্ছে চারিদিক, যে কেউ দেখলে নিঃসন্দেহে বলে দেবে, ভীষণ মানিয়েছে রঙ টা।
তবে এই গহীন জঙ্গলের মাঝে গোলকধাঁধাঁর মতো বিশাল রাজকীয় পেন্টহাউজ দেখে কেমন যেন মাথা ঘুরে উঠলো ঈশানীর, তৎক্ষনাৎ নিজেকে খানিকটা স্বস্তি দিতে কাঁচের দেওয়াল ভেদ করে বাইরে দৃষ্টিপাত করে ও, সন্ধ্যা হতে না হতেই পেঁজা তুলোর মতো শুভ্র তুষারে ভরে গিয়েছে ফ্রন্ট ইয়ার্ড। পার্কিং লটে রাখা গাড়িগুলোর ও ঠিক একই অবস্থা, সেগুলোও ঢাকা পরেছে সফেদ বরফ কুচির আড়ালে।
গভীর নজরে সেগুলো দেখতে দেখতেই ঈশানীর দৃষ্টি আকর্ষন করলো অদূরে ল্যামপোস্ট থেকে নির্গত একফালি নিয়ন রোশনাই, যা দেখে ঈশু মনেমনে চিন্তা করলো,
—তারমানে ওখানটায় রাস্তা রয়েছে।
আর তারপরেই নজরে এলো উঁচুনিচু একাধিক পর্বতমালা, সবকিছুই ঢাকা পরে আছে শুভ্র বরফের আড়ালে।কালো পেন্ট হাউজের চারিদিকে শুধুই শুভ্রের সমারোহ, এ যেন স্বর্গের পৃথিবীতে এক বিশাল মরীচিকার সাম্রাজ্য, যেই সাম্রাজ্যের নির্দয় কলুষিত সম্রাট হলো মাফিয়া বস এরীশ ইউভান। এরীশের নিষ্ঠুর কর্মকান্ডের কথা ভাবতে গিয়ে আরেকদফা ঘৃণায় পরিপূর্ণ হয়ে উঠলো ঈশানীর হৃদয়। গত পনেরোটা দিনে এরীশের প্রতি ভালোবাসা তো দূরে থাক,বক্ষপিঞ্জরে জমিয়ে রাখা দূর্বলতাটাও উবে গিয়েছে কোথাও, পাছে এসে জড়ো হয়েছে বিন্দু বিন্দু ঘৃণার অস্তিত্ব , আর এখন এই মূহুর্তে দাড়িয়ে সেই বিন্দু বিন্দু ঘৃণাদের অস্তিত্ব বৃদ্ধি পেয়ে হয়েছে হাজার গুন, যার বিস্তৃতি পাহাড় সমান।
ঈশানী কি চাইলেও কোনোদিন এই অত্যাচারী,নিষ্ঠুর, পাথর হৃদয়ের মানুষটাকে ক্ষমা করতে পারবে আর? মনেমনে হাসলো ঈশানী, ভাবলো,
—- যেখানে আমি তার হাতের বন্দী এক পুতুল মাত্র, সেখানে তাকে উল্টো ক্ষমা না করার চিন্তাটাও তো বিলাসিতা। এরীশ ইউভান নিজের কর্মকান্ডের জন্য কোনোদিন আমার নিকট ক্ষমা চাইতে আসবে না নিশ্চয়ই? কিন্তু
এর শেষই বা কোথায়? কিইবা লেখা আছে আমার ভাগ্যে ? একঝাঁক বিশ্রী মানুষ দিয়ে ভর্তি রংচঙে মাফিয়াদের কোনো ক্যাসিনো ক্লাব নয়তো?
প্রশ্নটা মাথায় আসার সঙ্গে সঙ্গে চকিতে ভাবনা থেকে ছিটকে বেড়িয়ে এলো ঈশানী, এসব কথা ভাবনাতে এলেও আতঙ্কে কেমন কলিজা শুকিয়ে কাঠ হয়ে যায় ওর,দরকার হলে ম’রে যাবে ও, তবুও ওইসব খারাপ নোংরা জায়গাতে যাওয়ার কথা কল্পনাও করতে চায়না ঈশু।
—- ও ঈশানী, কিছুদিন এখানেই থাকবে।আশা করি ওকে তুমি সাহায্য করবে।
হঠাৎ অচেনা কারও মুখে নিজের নাম শুনতে পেয়ে ভাবনা থেকে বেরিয়ে সামনের দিকে নজর দিলো ঈশানী, দেখলো কানে এয়ারপড লাগিয়ে মাত্রই লাউঞ্জে প্রবেশ করেছে তুষার। তার শার্ট, ওভার কোট এমনকি চুলের ভাঁজে ভাঁজে এখনো বরফ জমে আছে,দেখেই বোঝা যাচ্ছে বাইরে থেকে এসেছে মাত্র।
আর এসেই কিচেন কাউন্টারের ওখানে পা দুলিয়ে বসে থাকা রুশ মেয়েটাকে উদ্দেশ্য কথাগুলো বললো তুষার।
হাটু সমান ফ্রক পরিহিত এই সুন্দরী সোনালী চুলের রুশ মেয়েটার নাম “ফ্লোরা”। মেয়েটা ভালোই বাংলা জানে, কথার ধরন একটু নড়বড়ে তবে বুঝতে অসুবিধা হয়না করোরই।
তুষার লাউঞ্জে এসে হুকুম করার সঙ্গে সঙ্গে ভদ্র মেয়ের মতো তার কথায় মাথা নাড়িয়ে সায় জানালো ফ্লোরা, এরপর এগিয়ে গেলো ঈশানীর দিকে। তবে ঈশানীর কি জানি কি হলো, ও ফ্লোরাকে উপেক্ষা করে খালি পায় তুষারের পিছু পিছু দোতলার দিকে ছুটে গেলো, তুষার তখনও কানে এয়ার পড গুঁজে কারও সঙ্গে কথায় ব্যস্ত।
ও ফোন কলে এতোটাই মগ্ন ছিল,যে কখন থেকে ঈশু ওর পেছন পেছন একেবারে ওর ঘরের সামনে চলে এসেছে সেটা ওর ধারণার ও বাইরে। ঈশানী তুষারের ঘরেই ঢুকে যেত, হয়তো বা সাহায্য চাওয়ার জন্য, কিন্তু ভেতর থেকে ভেসে আসা অযাচিত কিছু কথপোকথন শোনার সঙ্গে সঙ্গে সেখানেই থমকে গেলো ওর পা দু’টো, আবারও সেই অজানা আতঙ্কে শরীরের র’ক্ত ঠান্ডা হয়ে গেলো ঈশানীর, ঘরে ঢোকার আগ মূহুর্তে ও শুনতে পেলো তুষার কাউকে আস্বস্ত করে বলছে,
—- আরে মাফিয়া রিইউনিয়ন টা পোসপোন করা হয়েছে, তাই নিলাম টাও পিছিয়ে গিয়েছে, আর বড় কোনো প্রোগাম ছাড়া এরীশ মেয়েটাকে ছাড়বে না।মেয়েটা ব্লু আইড তারউপর অসম্ভব সুন্দরী,অল্পস্বল্প দামে ছাড়বে ভেবেছো?
এটুকু শোনা মাত্রই ঈশানীর আর বুঝতে বাকি রইলোনা না যে, ওপাশে তুষার ওকে নিয়েই কথা গুলো বলছিল, তারমানে এরীশ খুব শীঘ্রই ওকে বিক্রি করে দেওয়ার পরিকল্পনা করছে।
—- এখন আমি কি করবো? ককোথায় যাবো?কার কাছে সাহায্য চাইবো আমি? এরা তো সবাই এক। এখান থেকে পালানো ছাড়া আর কোনো রাস্তা নেই, বাঁচতে হলে আমাকে পালাতেই, যে করেই হোক পালাবো আমি,এই মূহুর্তে পালাবো।
হঠাৎ শুনতে পাওয়া অযাচিত কথাগুলো ভীতসন্ত্রস্ত ঈশানীকে মূহুর্তের মধ্যে এমন ভাবেই কাবু করে ফেলেছে যে খালি মুখে বিড়বিড় করতে করতে একছুটে পেন্টহাউজ থেকে দৌড়ে বেরিয়ে যায় ঈশানী। এই মূহুর্তে ওর কোনো দিকে হুশ খেয়াল কিচ্ছু নেই, ওর ধ্যান শুধু একটাই ওকে এখান থেকে যে করেই হোক পালাতে হবে, যেদিকে দু’চোখ যায় ছুটতে হবে।
সবচেয়ে আশ্চর্যের ব্যাপার হলো সন্ধ্যা বেলায় এরীশের উপস্থিতি না থাকায় পেন্ট হাউজের আশেপাশে তেমন কোনো গার্ড ও ছিল না, আর সেই সুযোগটা কাজে লাগিয়েই সবার দৃষ্টির অগোচরে পালিয়ে যায় ঈশানী।
কিন্তু এই কনকনে ঠান্ডায় স্নো ফলের রাতে একা একটা মেয়ের জঙ্গলের মধ্যে হারিয়ে যাওয়াটা যে ঠিক কতটা সহজ সে বিষয়ে বিন্দুমাত্র জ্ঞান কিংবা ধারণা কোনোটাই নেই ঈশানীর। ও তো শুধু এরীশের হাত থেকে পালাতে চায়, ওর এই বি’ষাক্ত কালো দুনিয়া পরিত্রান চায়, কারন এই মূহুর্তে ঈশানীর কাছে পৃথিবীর সমগ্র বি’পদ একদিকে আর এরীশ ইউভান অন্যদিক।
ওদিকে পেন্ট হাউজে ফিরে এরীশ যখন জানলো ঈশানী পালিয়েছে তখন ওর মস্তিষ্কের নিউরনে নিউরনে ছড়িয়ে পড়লো এক তীব্র প্রতিহিংসার আ’গুন, এই মেয়েটা এতো বোকা কেন? কেন বারবার এরীশ কে টেক্কা দিতে যায় সে? ঈশানী কি বোঝেনা এরীশ চাইলে সব পারে, নাকি বিশ্বাস করেনা?
তবে এভাবে যখন তখন এরীশের মাফিয়া পেন্ট হাউজ থেকে পালিয়ে যাওয়ার সাহস দেখানোর মূল্য তো এবার ঈশানীকে চোকাতেই হবে, হবেই হবে।
লাউঞ্জের মাঝ বরাবর সাজিয়ে রাখা কাঁচের টি-টেবিলের উপর দু’পা রেখে বিলাসবহুল কাউচে গা ছড়িয়ে বসে আছে এরীশ। ওর একহাতে রয়েছে রিভলবার, আপাতত সেটার দিকে তাকিয়েই গভীর ভাবনায় নিমজ্জিত এরীশ, তার পাশেই সটান দাড়িয়ে আছে তুষার, এরীশকে ভাবতে দেখে তুষার ওকে খানিকটা আস্বস্ত করে করে বললো,
— চারিদিকে গার্ড’স বেড়িয়ে পরেছে আজ রাতের মধ্যে খুঁজে নিয়ে আসবে আশা করছি।
তুষারের পানে র’ক্তচক্ষু নিক্ষেপ করে রাশভারি আওয়াজে এরীশ বললো,
— কিন্তু ওকে আমার পাঁচ মিনিটের মধ্যেই পেন্ট হাউজে চাই। এই যে এখানে, আমার সামনে।
এরীশের কথায় খানিকটা বিরক্তি প্রকাশ করে তুষার বলে ওঠে,
— বাট হাউ ইজ ইট পসিবল এরীশ? মেয়েটা অলরেডি পালিয়ে গিয়েছে।
তুষারের কথায় ঠোঁট বাকিয়ে হাসলো এরীশ, এবং সেই কপট হাসিটা মুখে ঝুলিয়ে রেখেই গলা উঁচিয়ে ডেকে উঠলো কাউকে,
— বোজো… চু চু… কাম হিয়ার।
এরীশ ডাকতেই ভেতরের কোনো একটা ঘর বেরিয়ে এলো দানবের মতো দেখতে ধবধবে সাদা একটা মাং’সাশী নেকড়ে।নেকড়েটার শরীরের গঠন বিশাল আকৃতির, চোয়ালের একেকটা দাঁত ম’রণঘাতী অ’স্রের চাইতেও বেশি ধারালো তার, ছোটছোট কুটিল চোখ গুলোতে ভেসে আছে ভ’য়ানক হিং’স্রতা, সব মিলিয়ে সাদা নেকড়েটা দেখতে এতোটাই ভ’য়ানক যে দূর থেকে দেখলেও ভয়ের চোটে গলা শুকিয়ে আসে সবার।
অথচ এই দানবীয় হিং’স্র প্রানীটিকে বহু বছর ধরে পরম আদরে লালন-পালন করে আসছে এরীশ, যেন এটা কোনো পোষ মানা নিরিহ কুকুর বিড়াল।
— এরীশ বলেছে মানে সবই সম্ভব।
চোখ দিয়ে বোজো কে ইশারা করে দেখিয়ে তুষারের উদ্দেশ্যে কথাটা বললো এরীশ।
বোজো এতোটাই হিং’স্র যে ওকে দেখামাত্র তুষার সহ আশেপাশের অন্যান্য গার্ড’সরাও কয়েক কদম পিছিয়ে দাঁড়ালো সবাই, এমনিতে এরীশ যখন পেন্ট হাউজে না থাকে তখন খাঁচাতেই বন্দী করে রাখা হয় বোজো কে, শুধুমাত্র এরীশ যতক্ষণ আশেপাশে অবস্থান করে ততক্ষণই নিরীহ হয়ে থাকে সে, এছাড়া অন্যান্য সময় গুলোতে বোজোর কর্মকান্ড গুলো খুবই ভ’য়ানক আর ম’র্মান্তিক। তাই বোজোর সামনে সকলেই নিজেদের আত্নরক্ষা নিশ্চিত করে তবেই চলাফেরা করে।
বোজো কাছাকাছি এগিয়ে আসতেই ওর গলায় আদুরে হাত বুলিয়ে দেয় এরীশ, অতঃপর ঈশানীর ব্যবহৃত একটা কাপড়ের টুকরো এগিয়ে দেয় বোজোর নাকের কাছে, কয়েক সেকেন্ড সময় নিয়ে নাক টেনে কাপড়টা থেকে গন্ধ শুকলো বোজো এবং তারপরই ছুটে বেড়িয়ে গেলো জঙ্গলের দিকে। বোজো চলে যেতেই এরীশ ঠোঁট কামড়ে নীরবে হাসতে হাসতে তুষারের উদ্দেশ্য বললো,
— গার্ড’সদের বলো বোজো কে ফলো করতে, তাহলেই কাজ হয়ে যাবে।
কনকনে ঠান্ডার মাঝেও শরীরের র’ক্ত যেন টগবগিয়ে ফুটছে ঈশানীর, লাউঞ্জের মাঝখানে কাউচের সামনে এরীশের মুখোমুখি হয়ে দাঁড়িয়ে সে। বাইরে তুষার পাত বেড়েছে, টুকরো বরফ গলে গিয়ে শিশির কণার মতোই চুয়িয়ে চুয়িয়ে পরছে কাঁচের দেওয়াল বেয়ে।
ভেতরে অবশ্য এই কনকনে শীত অনুভব করার মতো কোনো সুযোগই নেই, কারণ লাউঞ্জের এককোণে দাউদাউ করে জ্বলতে থাকা ফায়ারপ্লেসের আ’গুনের তাপে আরামদ্বায়ক উষ্ণতায় ছেয়ে আছে পুরো পেন্ট হাউজ। ফায়ারপ্লেসের থেকে কিছুটা দূরে সবস্থানে পায়ে পা তুলে বসে ঈশুর পানে বাজ পাখির মতো তীক্ষ্ণ চোখে চেয়ে আছে এরীশ। ওদিকে এরীশের দিকে চেয়ে রাগে ফুঁসছে ঈশানী। এলোমেলো চুল,শুকিয়ে যাওয়া ফ্যাকাসে মুখশ্রী,বনবিচুডির আ’ঘাতে জায়গায় জায়গায় কেটে ছিঁড়ে যাওয়া র’ক্তাক্ত শরীর, সবকিছুকে ছাঁপিয়ে ওর নীলাম্বর চোখ দুটো সব আকর্ষন কেড়ে নিচ্ছে এরীশের, ফায়ারপ্লেসে জ্বলতে থাকা আ’গুনের প্রতিবিম্বের রহস্যে ঈশুর দু’চোখ যেন জ্বলন্ত আগ্নেয়গিরির মতোই উত্তপ্ত হয়ে উঠেছে।
কয়েক মূহুর্তের জন্য এরীশের মনে হলো এগুলো চোখ নয় বরং পুরো দুনিয়া, যা ওকে চৌম্বকের মতোই টেনে ধ্বং’সের দিকে নিয়ে যেতে চাইছে। কিন্তু এরীশ তো হার্টলেস, ওর মধ্যে অনুভূতি বলে কোনো কিছুর অস্তিত্বই নেই, অগত্যা ঈশানীর জ্বলন্ত চোখে নিজের নি’ষ্ঠুরতম চোখ দুটো তাক করিয়ে ক্রোধান্বিত কন্ঠে এরীশ বলে ওঠে,
—- আগেই বলেছিলাম পালিয়ে কোথাও যেতে পারবে না, পালাতে পালাতে ক্লান্ত হয়ে পরবে তুমি, তবুও এই জায়গা থেকে কোনোদিন মুক্তি পাবেনা। ভালোয় ভালোয় প্র’স্টিটিউড ক্লাবে যাওয়ার জন্য প্রস্তুত হও, কারণ ওটাই তোমার ডেসটিনি।
এরীশ কথা শেষ করতে না করতেই তীব্র ক্রোধ আর ঘৃণার বশবর্তী হয়ে ওর গাল বরাবর সপাটে চ’ড় বসিয়ে দেয় ঈশানী।এরীশকে থাপ্পড় মে’রে জিদের তোপে কাঁপতে কাঁপতে মুখ দিয়ে একটা শব্দ উচ্চারণ করে শুধু,
—- জা’নোয়ার।
ওদিকে ঈশানীর হাতের চড় খেয়ে চোয়াল শক্ত করে ফেললো এরীশ, মূহুর্তেই কপালের রগ গুলো ফুলে দৃশ্যমান হয়ে উঠলো ওর। এরীশ এখনো চুপচাপ থমথমে মুখে বসে আছে, তবে ওর অগ্নিস্ফুলিঙ্গের মতো দু’চোখে অকস্মাৎ নিজের সর্বনাশ আবিষ্কার করলো ঈশানী। এরীশ নিশ্চয়ই রেগে আ’গুন হয়ে আছে, এবার কি করবে সে? নিশ্চয়ই মাত্রাতিরিক্ত খারাপ কিছু, কিন্তু কি?
এরীশ কে এভাবে চুপ হয়ে যেতে দেখে খানিকটা ভরকে গেল ঈশানী, তখন রাগের মাথায় কাজটা করলেও ও যতক্ষণে ঠাওর করতে পারলো যে ওর কপালে ভীষন দুঃখ লেখা রয়েছে , ততক্ষণে অনেকটা দেরী হয়ে গিয়েছে। কারণ ইতি মধ্যে ঈশানীর হাতের কব্জি চেপে ধরে ওকে টেনে হিঁচড়ে দোতলায় নিয়ে যাওয়ার জন্য পা বাড়িয়েছে এরীশ।
ঈশানী নিজের হাত ছাড়ানোর বৃথা চেষ্টা করছে ক্রমাগত, কিন্তু ওইটুকুনি পুঁটিমাছের মতো একরত্তি মেয়ের কি আর মাফিয়া বস এরীশের সঙ্গে পেরে ওঠার সাধ্যি আছে? এরীশ ঈশানীকে এমন ভাবে টানছে যেন কোন জড়বস্তুকে টেনে উপরে তুলছে ও, কোনো দয়ামায়া কিচ্ছু নেই।
এক পর্যায়ে সিঁড়ির রেলিং খামচে ধরে মেঝেতে হুমড়ি খেয়ে পরে যায় ঈশানী,সেখান থেকে কোনমতে হাতের তালুতে ভর করে মাথা তুলে কাঁদতে কাঁদতে এরীশকে মিনতি করে বলে,
—- দয়া করে ছেড়ে দিন, আর কখনো এমন হবেনা, আমার লাগছে।
এরীশ পেছনে ঘুরে ঈশানীর জামার কলারটা চেপে ধরে ওকে দাড় করায়, অতঃপর রাগে গজরাতে গজরাতে আগুনঝরা কন্ঠে বলে ওঠে,
—- সেটা আমাকে থা’প্পড় মা’রার আগে ভাবা উচিৎ ছিল তোমার।
কথা শেষ করে আবারও টানতে টানতে উপরের একটা ঘরে নিয়ে গিয়ে খাটের উপর ঈশানীকে ছুড়ে মা’রে এরীশ।
অত্যন্ত ক্ষুব্ধতায় ছুড়ে মা’রার দরুন ব্যথায় কুঁকড়ে ওঠে ঈশানী। ঈশানীকে খাটে ফেলে ওর থেকে কয়েক হাত দূরত্বে সাজিয়ে রাখা কাউচ চেয়ারে গিয়ে পায়ে পা তুলে বসে পরে এরীশ।
অতঃপর দরজার কাছে দাঁড়িয়ে থাকা দু’জন বিদঘুটে দেখতে রাশিয়ান পুরুষকে আঙুলের ইশারায় ভেতরে আসতে বললো ও। এরীশের কর্মকান্ড ঠিক বুঝে উঠতে পারছে না ঈশানী, তবে লোক গুলোর দিকে দৃষ্টিপাত করতেই আতঙ্কে শিরদাঁড়া বেয়ে শীতল স্রোত নেমে গেলো ঈশানীর, ও খেয়াল করলো লোক দু’টোর চাহনিতে বিশ্রী লালসা, অস্থিরতায় দু’ঠোঁটের ফাঁক দিয়ে বেরিয়ে আসা জিভ গুলো কেমন লকলক করছে তাদের, যেন অনুমতি পেলেই ঝাপিয়ে পড়ে একেবারে শকুনের মতোই ছিড়েখুঁড়ে খাবে ঈশানীর নরম তুলতুলে শরীরটা।
এতোক্ষণে নিজের সর্বস্ব হারানোর ভয়ে মুখ থেকে র’ক্ত সরে গিয়েছে ঈশানীর, ও উপায়ন্তর না পেয়ে বিছানার নরম চাদরটা খামচে ধরে আতঙ্কিত দৃষ্টিতে চেয়ে আছে লোক দু’টোর পানে, ঠিক এমন সময় লোক দু’টোকে উদ্দেশ্য করে এরীশ বলে ওঠে,
—- গাইস, দ্যা গার্ল ইজ ইওর’স টুনাইট,জাস্ট এনজয় এজ ইউ ক্যান উইশ।
এরীশ অনুমতি দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ঈশানীর উপর ঝাপিয়ে পড়লো লোক দু’টো, বারংবার হাত বাড়িয়ে ঈশানীর শরীরকে স্পর্শ করতে চাইছে তারা, একজন তো ওর জামা নিয়ে টানাটানি শুরু করে দিয়েছে, ওদের চেহারা,হাসি, এমনকি চোখ সবকিছুই ভ’য়ংকর রকম বিশ্রী।
ঈশানী কোনোমতে আড়াআড়িভাবে নিজেকে আড়াল করার চেষ্টা চালাচ্ছে, কিন্তু এটা আদৌও সম্ভব নয়, তাই কোনো উপয়ান্তর না পেয়ে এবার এরীশের দিকে অসহায়ের মতো হাত বাড়িয়ে চিৎকার করে ডেকে উঠলো ঈশানী। কাঁদতে কাঁদতে বললো,
—- অরন্য আমাকে বাঁচান, ওরা আমাকে স্পর্শ করতে চাইছে দয়াকরে ওদের আটকান।আমি সহ্য করতে পারছি না, আমি আপনার কাছে মিনতি করছি, আপনি যা বলবেন আমি তাই শুনবো, আর কখনো পালানোর মতো দুঃসাহস দেখাবোনা, আপনার গায়ে হাত তুলবো না,তবুও দয়া করে ওদের থামান আপনি।আমি পবিত্র, আপনি এটা হতে দিতে পারেন না, কিছুতেই না,অরন্য….
লোক দু’টোর মাঝখান থেকে ঈশানীর বাড়িয়ে দেওয়া হাত, কাঁদতে কাঁদতে বলা প্রত্যেকটা কথা,অরন্য নামে ডেকে ওঠা, সবশেষে এরীশের কাছেই নিজের সুরক্ষার জন্য আকুতি, এই প্রত্যেকটা জিনিস হুট করেই ভেতর থেকে ধাক্কা দিতে শুরু করে এরীশকে।
হাসফাস শুরু হয়ে যায় ভেতরে, কিছু একটা ক্রমশ ভেতর থেকে রাগান্বিত করে তুলছে ওকে। ঈশানীর এই চিৎকার, এই কাকুতি মূহুর্তেই যেন সব আনন্দ কেড়ে নিতে শুরু করে এরীশের। কেন যেন এই মূহুর্তে কোনো পৈশাচিক আনন্দই ছুতে পাচ্ছে না এরীশকে, ভেতরে ভেতরে অজানা এক দহন অনুভব করছে ও,
— সামথিং ইজ বার্নিং ইন মাই চেস্ট।
কিছু একটা বিড়বিরিয়ে সামনের লোক দুটোর উপর তরতরিয়ে বেড়ে ওঠা তীব্র রাগে তৎক্ষনাৎ ভীষণ জোরে গর্জন করে ওঠে এরীশ,
—-স্টপ ইট রাইট নাও।
অকস্মাৎ কাউচ ছেড়ে দাঁড়িয়ে পরে এরীশ।ভয়ের তোরে লোক দুটো তাড়াহুরো করে সরে যায় ঈশানীর কাছ থেকে, এরীশ ওদেরকে চোখ রাঙিয়ে পুনরায় গর্জে উঠে বলে,
—- গেট আউট ফ্রম হিয়ার।
এরীশের আদেশ পাওয়া মাত্রই জীবন নিয়ে পালিয়ে যাওয়ার মতোই জলদি রুম ত্যাগ করে লোক দুটো। ওরা চলে গেলে এরীশ ঘাড় ঘুরিয়ে তাকায় ঈশানীর পানে, যে এই মূহুর্তে দু-হাত বুকের উপর শক্ত করে চেপে ধরে ভয়ে ঠকঠক করে কাঁপছে। যদিও লোক গুলো ঈশানীকে ছুঁতে পারেনি তবে চেষ্টা করার দরুন ওর গলার আশেপাশে নখের আঁচড় লেগে ফর্সা কন্ঠ নালির জায়গায় জায়গায় র’ক্ত জমাট বেঁধে গিয়েছে।
কিছুক্ষন তীক্ষ নজরে পরখ করে, ধীর কদমে ঈশানীর নিকট এগিয়ে গিয়ে, কিঞ্চিৎ মুখের কাছে ঝুঁকে ওর ক্ষতস্থানে এক নজর চোখ বোলালো এরীশ , অতঃপর ওর চিবুকটা আলতো হাতে চেপে ধরে দাঁতে দাঁত পিষে বললো ,
—- আজকে যা দেখলে আমি এর চাইতেও বেশি খারাপ, ইভেন আমি যে কতটা হার্টলেস সেটা তোমার ধারণার ও উর্ধ্বে, তাই দ্বিতীয়বার আমার গায়ে হাত তোলার মতো স্পর্ধা দেখানোর আগে এই রাতের কথা খুব ভালোমতো স্বরন করে নিও।
আমি শুধু চেয়েছি তোমায় পর্ব ৯
শান্ত অথচ রাশভারি আওয়াজে ঈশানীর মুখের উপর কিছু কঠিন হু’মকি ছুড়ে দিয়ে গটগটিয়ে জায়গা ত্যাগ করে এরীশ। আর ঈশানী নিজের চরম ভুলের মাশুল দিতে দিতে ক্লান্ত শরীরে কাঁদতে কাঁদতে নিস্তেজ হয়ে পরে থাকে সেখানেই।