আমি শুধু চেয়েছি তোমায় পর্ব ১২
suraiya rafa
ঘড়ির কাঁটায় দু’বার ঢং করে ঘন্টা বাজিয়ে মাত্রই জানান দিলো রাতের প্রহর গিয়ে দু’টোতে ঠেকেছে, সন্ধ্যা হতে না হতেই প্রকৃতি তার চিরাচরিত রূপে ফিরে এসেছে, খোলা আকাশ থেকে ধুতরো ফুলের ন্যায় অবিরত ঝড়ে পড়ছে শুভ্র তুষারের কুঁচি। মধ্যরাতের হিমেল হাওয়ায় সেই পেজা তুলোর মতোন কোমল তুষারের বহর উড়ে এসে ঠায় জমিয়েছে ছাদ বারান্দার কাঁচের দেওয়ালে।
জঙ্গলের মাঝে অবস্থিত দশতলা ভবনের উপর এরীশের এই বিলাসবহুল ডুপ্লেক্স পেন্ট হাউজটি বছরের বেশিরভাগ সময়ই তুষারে ঢাকা পরে থাকে। স্টাফরা যদিও পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতায় সর্বক্ষন তৎপর তবে বহমান প্রকৃতি কি আর এতোকিছু মেনে চলে? সে তো বয়ে চলে তার আপন নিয়মে।
অথচ এতো তুষার পাতের মাঝেও ছাঁদ বারান্দার কাউচে গা এলিয়ে বসে সেই সন্ধ্যা থেকে এক নাগারে ড্রিংক করছে এরীশ, ওর পাশে অবস্থিত তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রক ফ্রায়ারপ্লেসের আগুন নিভে কখন যে কাঠ কয়লা গুলো তুষার জমে বরফ খন্ডে পরিনত হয়েছে সেসবে নজর নেই এরীশের, ও তো এখনও নিজের নিয়ন্ত্রণহীন কর্মকান্ড নিয়ে চিন্তিত।
এই প্রথম নিজের কঠোর সিদ্ধান্ত , নিজের এককথা থেকে সরে এসে কোনো কাজ করলো এরীশ ইউভান। তাও কিনা একটা মেয়েকে বাঁচানোর জন্য? ব্যাপারটাতে ভীষণ বিব্রত এরীশ। ওর বরফ খন্ডের ন্যায় কঠিন হৃদয়টা কিছুই অনুভব করেনা ঈশানী নামক মেয়েটার জন্য, তবুও কেন মেয়েটাকে বাঁচাতে এভাবে কট্রোললেস হয়ে পরলো এরীশ?
আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন
সকালের সেই মূহুর্তটার কথা ভাবতে গেলে এখনো নিজেকে বিশ্বাস করে উঠতে পারেনা ও। ওই মূহুর্তে ব্লাড ডায়মন্ড তো দূরে থাক ঈশুর কান্নার কাছে পুরো দুনিয়াটাই তুচ্ছ মনে হচ্ছিল এরীশের, ঈশানীর অসহায় অপারগ কান্না দেখে অযাচিত মন আগ্নেয়গিরির অগ্নুৎপাতের মতোই চড়াত ফুঁসে উঠলো যেন, আর এরীশের ইচ্ছে করলো ওকে কাঁদানোর বিনিময়ে পুরো দুনিয়া ধ্বংস করে দিতে।
এবং ও করলোও সেটাই, যে গার্ডটা ঈশুকে আঘাত করেছে, তাকে মে’রে ডেড বডি সমেত পাঠিয়ে দিয়েছে ডেনিয়েলের নিকট। কিন্তু কেন? এমনটা তো হওয়ার কথা ছিলনা কোনো কালেই?
আর ঈশানী? সেই বা কেন বারবার চরম বিপদের মুখে এরীশের দিকেই হাত বাড়িয়ে দেয়, কেন চায় এরীশ তাকে বাঁচাক? এরীশ তো কারও রক্ষাকবচ নয়, এরীশের সঙ্গে তো কেবল কঠোর শব্দগুলোই যায়, আর তা হলো ভক্ষক, হিংস্র, হার্টলেস ব্লাডিবিস্ট।
তাহলে কি চায় মেয়েটা? এরীশকে কট্রোল করতে? এরীশ ইউভানকে?
—- অসম্ভব।
কথাটা উচ্চারণ করে হকচকিয়ে উঠে বসলো এরীশ। মনেমনে ভাবলো,
— একটা মেয়ের জন্য আমার সিদ্ধান্ত বদলাতে পারেনা, কিছুতেই না।
তৎক্ষনাৎ বক্ষগহ্বরের এককোণে গেড়ে বসে থাকা অতি সাধারণ মনটা বললো,
—- কেবল ওর পবিত্র সত্তাটাকে রক্ষা করার জন্যই তো আজ সকালে নিজের এতো বড় সিদ্ধান্তটা মূহুর্তে বদলে ফেললি, ভুলে গেলি মহামূল্যবান ব্লাড ডায়মন্ডের কথা। এর পরিনতি কি হবে সেটা একবারও ভাবার প্রয়োজন বোধ করলি না। ডেনিয়েলের মতো ওয়েম্যান হান্টার সবকিছু এতো সহজে ছেড়ে দেবে ভেবেছিস? এবার নিশ্চয়ই দিগুণ প্রতিশোধ পরায়ন হয়ে ফিরে আসবে সে।
ওদিকে হৃদয়ের সর্বস্ব জুড়ে বিচরন করতে থাকা হিংস্র পৈশাচিক মনটা সে কথা সঙ্গে সঙ্গে অগ্রাহ করে বললো,
— এরীশ ইউভান কাউকে ভয় পায়না। আর ওর মতো তুচ্ছ একটা মেয়ে আমাকে কন্ট্রোল করতে এলে ওর জীবন এখানেই নরক বানিয়ে ছেড়ে দেবো আমি, ভেঙে ফেলবো ওর এই ফা’কিং সরলতার সত্তা।
অন্য মনটা তীযর্ক হেসে বললো,
— মেয়েটা সরল বলেই তুই সেটা করতে পারবিনা,যেমনটা আজও পারিস নি। ওর ওই অসহায়, সরলতায় ঘেরা ঠান্ডা সমুদ্র জলের ন্যায় নীল চোখে কিছু তো একটা আছে, যা তোর মতো হৃদয়হীন ব্লাডিবিস্ট কেও এক নিমিষে বশ করে ফেলতে সক্ষম।
মনের কথায় বিরক্ত হয় এরীশ,মূহুর্তেই মুখের আদল বদলে গিয়ে চোয়াল শক্ত হয়ে ওঠে ওর,নিজের অজান্তেই হাত মুঠি বদ্ধ করে কাউচের হাতায় সজোরে ঘুষি মে’রে বিড়বিড় করে বজ্র কন্ঠে বলে ওঠে,
—- আমার মন মস্তিষ্কের নিয়ন্ত্রক শুধু মাত্র আমি, এই এরীশ ইউভান, লিডার অব পাইথন প্যারাডাইস।এখানে সরলতার কোন স্থান নেই,না নেই।
কন্ঠে আরও খানিকটা দৃঢ়তা টানে এরীশ, —- যে করেই হোক মেয়েটাকে মস্তিষ্ক থেকে তাড়াতে হবে।
— কাকে তাড়াতে হবে?
পেছন থেকে ভেসে আসা গমগমে পুরুষালী কন্ঠস্বরের আওয়াজে বাস্তবতায় ফিরে এলো এরীশ। অতঃপর সামান্য ঘাড় কাত করে তুষারের উপস্থিতি নিশ্চিত করে আগের ন্যায় গা এলিয়ে দেয় কাউচ চেয়ারে।
— ড্রিংক করছেন, আমাকে ছাড়াই?
কথা বলতে বলতে এরীশের নিকট এগিয়ে আসে তুষার। অপর পাশ থেকে এরীশের কোনোরূপ প্রতিক্রিয়া না পেয়ে ও পুনরায় বলে,
—- বাইরে বৃষ্টির মতো তুষার পড়ছে, অথচ আপনি ঘামছেন। নিশ্চয়ই অনেক বেশি ড্রাংক হয়ে আছেন।কথাগুলো কি এখন বলবো, নাকি সকালে,
— যা বলতে এসেছো বলো, আমি শুনছি।
তুষারের কথা পুরোপুরি শেষ হওয়ার আগেই আদেশ করে এরীশ। তুষার হ্যা সূচক মাথা নাড়িয়ে বলে,
—- আপনি আজ ডেনিয়েলের একজন গার্ডকে মে’রে ফেলেছেন। এর আগেও তার তার গার্ল ফ্রেন্ডকে,
আবারও মাঝপথে তুষারকে থামিয়ে দিয়ে এরীশ বলে,
—- কি বলতে চাইছো সোজাসাপ্টা বলো।
তুষার বললো,
— আই থিংক খুব শীঘ্রই ডেনিয়েল আমাদের উপর এ্যাটাক করতে পারে, এখন তো ব্লাড ডায়মন্ড ও আমাদের হাত ছাড়া,তাছাড়া…
— তাছাড়া? তুমি ভালো করেই জানো তুষার, যে কোনো মূল্যেই ব্লাড ডায়মন্ড আমি নিজের করেই ছাড়বো। আর আমি এও জানি ব্লাড ডায়মন্ড নিয়ে মোটেই চিন্তিত নও তুমি। তাই এই মূহুর্তে একজ্যাক্ট কি নিয়ে চিন্তিত সেটা বলে ফেলো।
এরীশের সঙ্গে ঘুরিয়ে পেচিয়ে কথা বলা মানে নিজের কথার ফাঁদে নিজেই গোলকধাঁধার মতোন ফেঁসে যাওয়া, তা আন্দাজ করতে পেরে ফোঁস করে নিঃশ্বাস ছাড়লো তুষার , অতঃপর ধাতস্থ কন্ঠে বললো,
—- আমার মনে হচ্ছে এবার আর ডেনিয়েল আপনাকে টার্গেট করবে না,আর নাতো পাইথন প্যারাডাইসে কোনো স্পাই ঢোকাবে। এবার ডেনিয়েলের টার্গেট হবে অন্য কেউ।
—- কার কথা বলছো?
এরীশের চোখে উৎকন্ঠার ছাপ স্পষ্ট। তুষার সটান দাড়িয়ে কিঞ্চিৎ ঠোঁট কামড়ে বলে ওঠে,
—- আমি যদি ভুল না করি, এবার ডেনিয়েলের টার্গেট হবে ঈশানী তুজ কর্ণিয়া। আপনি আজ ওভার রিয়েক্ট করেছেন এরীশ।
নিজের চুক্তি নিজেই ভঙ্গ করেছেন,নিজের তৈরী করা শর্ত নিজের হাতে খন্ডন করছেন, আজ আপনি সত্যিই একজনকে সেকেন্ড চান্স দিয়ে ফেলেছেন। এমনকি মেয়েটাকে আঘাত করার অপরাধে গার্ডটাকে মে’রে পর্যন্ত ফেলেছেন। আপনার কি মনে হয় এটা ওভার রিয়েক্ট নয়?
তুষারের কথা শুনে পায়ে পা তুলে আরাম করো বসলো এরীশ,অতঃপর তুষারকে সুক্ষ্ম দৃষ্টিতে পরখ করে ধারালো কন্ঠে শুধালো,
—- তুমি আমার দিকে আঙুল তুলছো তুষার?
তৎক্ষনাৎ মাথা নিচু করে ফেললো তুষার ,এরীশ কে কুর্ণিশ করে সম্মান জানিয়ে বললো,
—-মাফ করবেন, সেই সাহস কিংবা শক্তি কোনোটাই নেই আমার এরীশ। কিন্তু আমি ধারণা করছি ব্লাড ডায়মন্ডকে পায়ে ঠেলে দিয়ে যে মেয়েকে আপনি বাঁচিয়েছেন, ডেনিয়েল এতো সহজে তার উপর থেকে কিছুতেই গিভ আপ করবে না।
তুষারের কথা শুনে এদিক ওদিক ঘাড় ফোটালো এরীশ,অতঃপর জিভ দিয়ে গাল ঠেলে নির্বিকার গলায় বললো,
—- আমি এতোটাও কাঁচা খিলাড়ী নই তুষার, আমার দু’চোখের সামনে দিয়ে আমার কোনো জিনিস কে ছিনিয়ে নিয়ে যাওয়া মুখের কথা নয়।
মনেমনে বললো,
—- আমার জিনিসের দিকে হাত বাড়ানোর স্পর্ধা দেখালে ডেনিয়েলের মাফিয়া সাম্রাজ্র্য এক থাবায় ধুলোয় মিশিয়ে দেবো আমি।
Bravta এর স্বরণে রাশিয়ার বাইরে গুরুত্বপূর্ণ কাজে গিয়েছে এরীশ। গত পনেরো দিন ধরেই পেন্ট হাউজে নেই সে। এরীশ না থাকার দরুন পুরো পেন্ট হাউজে সর্বক্ষন শান্তি বিরাজমান।
অন্তত ঈশানীর তো সেটাই মনে হয়। ও যে এই আকাশ চুম্বি পেন্ট হাউজের বন্দী জীবনটা খুব শান্তিতে উপভোগ করছে তেমন কিছুই নয়, কিন্তু ওর কাছে এরীশ মানেই অ’ত্যাচারী,হৃদয়হীন এক জানোয়ার । যে আশেপাশে থাকলেও ঘৃণায় রি রি করে ওঠে ওর শরীর মন সবকিছু।
এরীশ যতক্ষণ পেন্ট হাউজে অবস্থান করে সেই সময়টুকু প্রচন্ড ভয়ে কুঁকড়ে থাকে মেয়েটা। ওর ভয় হয় কখন আবার এরীশ রেগে গিয়ে শা’স্তিস্বরূপ ওকে জোরজবরদস্তি করে কোনো মাফিয়া ক্লাবে পাঠিয়ে দেয়। ঈশানী সারাজীবন বন্দী হয়ে থাকতে রাজি তবে কখনোই ওই নোংরা ক্লাবের পন্য হতে রাজি নয়।
যার ফলস্বরূপ ঈশানী আজকাল এরীশকে যতটা না ঘৃণা করে, তার চাইতেও বেশি ভয় পায়। যদিও বা এই ভয়টুকু ততক্ষণই স্থায়ী হয় যতক্ষণ এরীশ এই পেন্ট হাউজে থাকে।
যেহেতু সে বেশিরভাগ সময়ই রাশিয়ার বাইরে অবস্থান করে, তাই ফ্লোরার সঙ্গে মিশতে মিশতে এখন আগের চাইতে বেশ অনেকটা স্বাভাবিক ঈশানী।
ও আজকাল খিলখিলিয়ে হাসে,ফ্লোরার কথার জোয়ারে গা ভাসিয়ে দেয় অনায়াসে, মেয়েটার সঙ্গে খুনসুটিতে মেতে ওঠে ঠিক বাচ্চাদের মতোই।
আর তারপর যখন দিন শেষে রাতের পর্দা টেনে দেয় ধরনী, যখন আকাশের বুক চিড়ে তুষারের বেগ বেড়ে যায় দিগুণ হারে , তখন একা এক কামরায় শুয়ে নিজের বন্দী জীবনের প্রহর গুনতে গুনতে নীরব কান্নায় ভিজে ওঠে ঈশুর নীলাম্বর চোখের কোটর,আর রাতগুলো হয় নিদ্রাহীন।
নিদ্রাহীন রাতে ভবঘুরে ঈশানী কাঁচা হাতে চিরকুট লেখে,আপন মনের অপারগ ইচ্ছে গুলো গুটিগুটি অক্ষরে টুকে রাখে সাদা কাগজের সুক্ষ্ম ভাঁজে।
ঈশানী এখনো স্বপ্ন দেখে ও বাড়ি ফিরবে,কোনো না কোনো দিন এখান থেকে পালিয়ে গিয়ে আবারও নিজের দেশে পাড়ি জমাবে ও। নিজ বাড়িতে গিয়ে দক্ষিণ থেকে ভেসে আসা উত্তাল সমুদ্রের গর্জন শুনতে শুনতে আবারও শান্তির ঘুম ঘুমাবে। কিন্তু এরীশ ইউভান কি তা হতে দেবে আদৌও ? সে যে হৃদয়হীন নিষ্ঠুর মানব।তার সিদ্ধান্ত নড়চড় করার সাধ্য কি আর ঈশানীর মতো একরত্তি মেয়ের আছে?
এভাবেই আকাশ-পাতাল ভাবতে ভাবতে প্রতিবারই শেষ রাতে চোখ লেগে আসে ঈশুর। না চাইতেও অবচেতন মনে হারিয়ে যায় ঘুমের অতল গহ্বরে।
আজকাল ঈশানী আর ফ্লোরা প্রায়শই রক,পেপার,সিজার খেলে বিভিন্ন সিদ্ধান্ত নেয়। মূলত ঈশানীর কাছে সম্পূর্ণ নতুন এই খেলাটা ওর সমস্ত আকর্ষন কেড়ে নিয়েছে।
প্রথম প্রথম ফ্লোরা সব কাজের ক্ষেত্রেই রক, পেপার দিয়ে সিদ্ধান্ত নিতো, যা দেখে এখন ঈশানীও ওকে অনুসরণ করে। উঠতে, বসতে খেতে, ঘুমাতে যখন তখন এই রক পেপারের হাড্ডাহাড্ডি লড়াই চলে ওদের মাঝে। এই খেলা দিয়ে বড়বড় যুদ্ধের মতো কাজকেও পানির মতো সহজ বানিয়ে দেয় ফ্লোরা, মেয়েটার কাছে মন ভালো করার জাদু আছে মনে হয়।
সে যা-ই হোক, এই মূহুর্তে ফ্লোরার সঙ্গে রক পেপারে হেরে গিয়ে মহা বিপদে পরেছে ঈশানী। শর্ত ছিল যে হারবে সে কোনো একটা পারফর্ম করে দেখাবে। ঈশানী ভেবেছিল এই সুযোগে ফ্লোরাকে দিয়ে একটু বেলী ড্যান্স করানো যাবে। কিন্তু বিধিবাম, প্রতিবারের মতোই ফেঁসে গেলো ও নিজে।
—- এই জন্যই বোধ হয় জিসান আমাকে বোকা বলতো, সবসময় নিজের কর্মে ফেঁসে যাই আমি।
মুখ টিপে বিড়বিড়ালো ঈশানী।
কাউচের গায়ে হেলান দিয়ে মেঝেতে বসে আছে ফ্লোরা, ঈশানীকে এভাবে হাসফাস করতে দেখে ও চট করেই বললো,
— একটু নেঁচে দেখাও তো ঈশু।
তৎক্ষনাৎ চোখ বড় বড় করে ফেললো ঈশানী, ফ্লোরার কথায় অসম্মতি জানিয়ে বললো,
— পাগল তুমি? নেচে দেখাবো তাও এখানে?
— শোনো ঈশু, শর্ত ইজ শর্ত। আজ আমি হেরে গেলেও তুমি ছাড় দিতে না আমায়। সো এখানেই তোমাকে নাচতে হবে। তাছাড়া পেন্ট হাউজে তো আমি আর তুমি ছাড়া এই মূহুর্তে কেউ নেই।
কিন্তু ঈশানী তো অন্তর্মুখী স্বভাবের, ওর কাছে এসব কিছু যুদ্ধের মতো কঠিন আর শত্রুর তরবারির মুখে দাঁড়িয়ে হেরে যাওয়ার মতোই কষ্টসাধ্য । ওদিকে ফ্লোরা গো ধরে বসেছে, তার একটাই কথা,
—- তুমি হেরেছো মানে তোমাকে এটা করতেই হবে।
অবশেষে উপায়ন্তর না পেয়ে ভেতরে ভেতরে আত্নবিশ্বাসের পারদ টাকে খানিক ঝালিয়ে নিয়ে ঠাস করে মেঝে থেকে উঠে দাঁড়ালো ঈশানী। গার্ডারটা একটানে খুলে ফেলে চুল গুলো বাঁধন হারা করে, গলায় ঝুলানো ফিনফিনে শিফনের ওড়নাটা বেধে নিলো কোমড়ের একপাশে, এরপর হালকা কেশে গলাটা পরিষ্কার করে রিনরিনে মিষ্টি সুর তুলে গাইতে আরম্ভ করলো ও,
” udne laga kyun
Man bawala re…
Aaya kahaan se
Yeh hausla re….
O re piya..
O re piya hayeee
গানের সাথে তাল মিলিয়ে নাচের মূদ্রা অনুসরণ করছে ঈশানী, এখন আর সেই লাজুক অন্তর্মুখী ঈশানীকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। গানের মন মাতানো সুর আর নাচের ঝঙ্কারে পুরো পেন্ট হাউজ মাতিয়ে তুলেছে মেয়েটা। ওর একেকটা নাচের ভঙ্গিমা মুগ্ধ হয়ে দেখার মতোই সুন্দর আর মোহনীয়। হৃদয়ে তোলপাড় শুরু করে দেওয়ার মতোই অসম্ভব মিষ্টি গলার সুর । খালি গলার গানের সুরও যে এতোটা আকর্ষনীয় হয় তা আগে জানা ছিলনা রুশ বালিকা ফ্লোরার।
গানের সুর আর নাচের ছন্দে বিমোহিত আজ রাশিয়ান পেন্ট হাউজ।
আজ প্রথমবারের মতো কান্না, হাহাকার, র’ক্ত সবকিছুকে ছাপিয়ে, সরলতার মিষ্টি সুরেলা কণ্ঠস্বর আর নৃত্যরত নুপুরের রিনঝিন আওয়াজে মুখরিত মাফিয়া বস এরীশ ইউভানের কালো দুনিয়া।
টানাটানা নীল চোখের এলোমেলো চাহনি,হিমেল ঠান্ডা হাওয়ায় উড়তে থাকা রেশমের মতো খোলা চুল,নাচের তালে ঢেউ খেলানো কোমল লতানো নারী দেহের সুক্ষ্ম ভাঁজ, সবকিছুই একনজরে দেখলে মনে হবে এ যেন শিল্পীর যত্নে আঁকা জীবন্ত কোনো শৈল্পিক চিত্রকর্ম।
সেই কখন থেকে হাঁটু ভাজ করে তাতে চিবুক ঠেকিয়ে মুগ্ধ নয়নে তাকিয়ে ঈশুর নৃত্যে মগ্ন হয়ে আছে ফ্লোরা।তবে তার কয়েক মূহুর্ত পরেই আচমকা কিছু একটা দৃষ্টিগোচর হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ফর্সা মুখটা চুপসে গিয়ে এইটুকুনি হয়ে যায় ওর।
হঠাৎ এহেন ঘটনায় হকচকিয়ে যায় মেয়েটা । তাড়াহুড়োয় কি করবে বুঝতে না পেরে মুখ কাচুমাচু করে ভয়ার্ত দৃষ্টিতে একনজর সদর দরজায় পরখ করলো ফ্লোরা। অতঃপর শুষ্ক ঢোক গিলে চোখ দিয়ে অনবরত ঈশুকে কিছু একটা ইশারা করতে শুরু করে ও।
কিন্তু ঈশানী তো এই মূহুর্তে নাচের ছন্দে হারিয়ে গিয়েছে ভিন্ন এক জগতে।
যে জগতে নেই কোনো প্রতিহিংসার দাবানল,আর না আছে কোনো নৃশংস মাফিয়ার কালো দুনিয়া। এটা কেবল সুখ, শান্তি,আর ভালোবাসায় মোড়ানো এক স্বপ্নের জগত। যেই জগতে ঈশুকে সবাই ভালোবাসে,কেউ ঠকায়না, সেই ভালোবাসার পরিধি দুনিয়ার সব ভালোবাসার মাপকাঠির উর্ধ্বে। সত্যিই যদি কেউ পুরো দুনিয়ার উর্ধ্বে গিয়ে ওকে এভাবে ভালোবাসতো?মুগ্ধ হতো ওর গভীর নীল চোখে? নিজ ভাবনায় আপন মনে হাসে ঈশু।
কল্পনার জগতে সবাই সুখি। ঈশানীর ক্ষেত্রেও তার ব্যতিক্রম নয়।
স্বপ্নের জগতে বিচরণ করতে করতেই ঈশানী পুনরায় গাইলো,
saazish mey saamil
Sara jahan hai…..
Har zarre zarre ki ye
Llteja hain…..
Ore piya
Ore piya hayeeee
গানের সাথে তাল মিলিয়ে অনবরত ঘুরছিল ঈশানী। ঘুরতে ঘুরতেই হুট করে, একদম হুট করে অকস্মাৎ ওর চোখ দুটো আটকে যায় সদর দরজার সামনে সটান দাঁড়িয়ে থাকা মানুষটার চোখের পাতায়।
তৎক্ষনাৎ বিষম খেয়ে থমকে যায় ঈশানী, অবচেতন মন আর ভয়ার্ত চোখে সেদিকে চেয়ে নিজের অবস্থান থেকে দু’কদম পিছিয়ে গিয়ে শক্ত হাতে পরনের জামাটা খামচে ধরে মাথা নিচু করে নেয় ঈশু।
মাত্রই যে লোকটার সঙ্গে চোখাচোখি হলো তাকে চেনে ঈশানী, ওই পিয়ার্সিং করানো শৈল্পিক ভ্রুজুগলের সাথে এটে থাকা নিস্প্রভ ধূসর বাদামী চোখ জোড়া ঈশানীর ভালো করেই চেনা। যদিও বা ভালোবাসাটা ঘৃণা আর ভয়ে রূপান্তরিত হয়েছে, তবুও আজ আরও একবার কয়েক মূহুর্তের জন্য ঈশানীর নজর কেড়েছিল এরীশের অধর তলার সেই সুন্দর কুচকুচে কালো তিলক।
যা সবসময়ের মতোই তার গৌড় পুরুষালী চিবুকে শুকতারার মতোই জ্বলজ্বল করতে থাকে । অথচ তার চোখ দুটো ছিল অনুভূতিহীন শূন্য, সে চোখে মায়ার জোয়ার নয় বরং আক্রোশের দাবানল দেখতে পায় ঈশানী। আজকাল এরীশের চোখ দুটো দেখেই ভয়ে অন্তরাত্মা কেঁপে ওঠে ঈশানীর।
আজ প্রায় পনেরো দিন বাদে বিনা নোটিশে আমেরিকা থেকে রাশিয়া ফিরেছে এরীশ। ওকে বড্ড ক্লান্ত আর নির্ঘুম দেখাচ্ছিল, একটু বিশ্রাম নেওয়ার উদ্দেশ্যেই সন্ধ্যা নাগাদ পেন্ট হাউজে ফিরেছিল সে।
এরীশ সচারাচর কাউকে জানিয়ে ফেরে না, আজকেও তেমনটাই হয়েছিল, এলিভেটর থেকে বেরিয়ে মেইন ডোরের পাসওয়ার্ড খুলে কখন যে লাউঞ্জে ঢুকে গিয়েছে তা আর বোধগম্য হয়নি কারোর।
ওদিকে ভেতরে প্রবেশ করার সঙ্গে সঙ্গে নৃত্যরত ঈশুকে দেখে কখন যে নিজের অজান্তেই দাঁড়িয়ে পরেছে তা স্বয়ং এরীশের ও অজানা। সেই কখন থেকে সদর দরজার কাছে দাঁড়িয়ে নিস্প্রভ অনুভূতিহীন একজোড়া শূন্য চোখে তাকিয়ে আছে নৃত্যরত্য মেয়েটার দিকে। অথচ নাচের ছন্দে পুরো পেন্ট হাউজ মাতিয়ে তোলা মেয়েটা একবারের জন্য ও লক্ষ্য করলো না সেই নিস্প্রভ শীতল চাহনি।
যেই মূহুর্তে লক্ষ্য করলো তৎক্ষনাৎ নৃত্য থামিয়ে ভীত স্বতন্ত্র হরিণীর ন্যায় পিছিয়ে গিয়ে দাঁড়িয়ে পরলো ফ্লোরার আড়ালে ।
যেন এরীশকে ও জনম জনম ধরে ভয় পায়। এরীশ তো এটাই চেয়েছিল অবাধ্য মেয়েটার আত্নবিশ্বাসের দেওয়াল টাকে ভেঙে গুড়িয়ে দিতে,আর ও সেটাতে সফলও হয়েছে বটে।
অথচ এই মূহুর্তে হুট করেই ঈশানীর এমন ভয় পেয়ে পিছিয়ে যাওয়াটা মোটেই পছন্দ হলোনা এরীশের। ওর এহেন কান্ডে আবারও সেই চিরাচরিত শক্ত কঠিন রূপে ফিরে এলো এরীশ। অক্ষি জুগল ছোট ছোট করে দু’হাত মুঠি বদ্ধ করে নিলো অজানা ক্রোধে।
ঠিক এমন সময় বাইরে থেকে লাউঞ্জে প্রবেশ করে তুষার। তুষারের আগমনে চারিদিকের থমথমে পরিবেশটা খানিক হালকা হয়, তুষার এক নজর এরীশকে পরখ করে ফ্লোরার দিকে তাকিয়ে ওকে নির্দেশ দিয়ে বলে,
—- আমরা আজ পেন্ট হাউজে ডিনার করবো।
ফ্লোরা তৎক্ষনাৎ নির্নিমেশ মাথা ঝাঁকিয়ে ঈশানী সমেত জায়গা ত্যাগ করে কিচেন কাউন্টারের দিকে চলে যায়।
ওরা চলে গেলে তুষার ও দোতলার উদ্দেশ্যে সামনে এগোয়। অথচ এরীশ এখনো নিস্প্রভ চোখে চেয়ে আছে কাউচের সামনে সেন্টার টেবিলের পাশে ওই জায়গাটাতে যেখানটায় একটু আগেও নাচের তালে তাল মিলিয়ে বিভিন্ন মূদ্রায় ঘুরছিল ঈশানী। চোখের সামনে এমন দৃশ্য বোধ হয় এর আগে কখনো দেখেনি এরীশ।
ওই জন্য কি এই ঘোর? নাকি অন্য কিছু? ঈশানীকে আজ নাচ করতে দেখে আবারও একটা শব্দই মাথায় এলো এরীশের, আর তা হলো হোয়াইট চেরিব্লোসম। চেরিব্লোসমের যের ধরে নিজের অজান্তেই ভ্রু কুঁচকে বিড়বিড়ালো এরীশ,
— সাকুরা!
—- কোথায় সাকুরা? কেবল শীতের শুরু সাকুরা আসতে এখনো ঢের দেরি ।
তুষারের কন্ঠস্বর কর্ণগহ্বর ভেদ করতেই সম্বিত ফিরে পেলো এরীশ। চট করেই নড়েচড়ে উঠে বললো,
—- কোথাও না।
ছোট্ট করে উত্তর দিয়ে তৎক্ষনাৎ মস্তিষ্ক থেকে এসব সাকুরা ফাকুরা বের করে দিয়ে, বড়বড় পা ফেলে এগিয়ে গেলো অফিস রুমের দিকে।
— আচ্ছা ফ্লোরা, এই পেন্ট হাউজটা তো দশ তলার উপরে, তাহলে বাকি নয় তলায় আছে টা কি?
রাতে সবার জন্য ডিনারের আয়োজন করায় মহা ব্যস্ত ফ্লোরা। কিচেনে তার এক দন্ড ফুরসত নেই, একহাতে মাংস কষাচ্ছে তো অন্য হাতে পাউরুটির ডো বানাচ্ছে আবার মাঝেমধ্যেই ঢাকনা উল্টে দক্ষ হাতে সুপের হাঁড়িতে নাড়া দিচ্ছে । ফ্লোরার এতো ব্যস্ততা দেখে ঈশুও আর হাত গুটিয়ে বসে থাকতে পারেনি, এগিয়ে এসেছে ফ্লোরাকে সাহায্য করতে।
এরীশ আবার পেন্ট হাউজে থাকলে রাতে শুতে যাওয়ার আগে এক কাপ ব্ল্যাক স্প্রেসো পান করে। ঈশানী যেহেতু কফি ভালো বানায় তাই আপাতত সেই দ্বায়িত্বটুকুই ওর নিকট হস্তগত করেছে ফ্লোরা।
আর তখনই কি ভেবে যেন ফ্লোরার উদ্দেশ্যে প্রশ্নটা করে বসে ঈশানী।
ঈশানীর কথায় একটুও বিরক্ত হয় না ফ্লোরা, বরং ডাইনিং এ খাবার সার্ভ করতে করতে হাসিমুখে বলে,
—- কেন তুমিতো বেশ কয়েকবার নিচে নেমেছো কিছুই লক্ষ্য করো নি?
—- কি করে দেখবো? প্রতিবারই তো গার্ড’সরা টেনে হিঁচড়ে তুলে এনেছে, তাও এলিভেটরে।
ফ্লোরা মৃদু হাসে, অতঃপর ঈশানীকে আস্বস্ত করে বলে,
—-পাইথন প্যারাডাইসের সমস্ত গার্ড’স মাফিয়াদের একটা বড় অংশই এই ভবনে থাকে ঈশু। নিচে যতগুলো ফ্লোর আছে তার প্রত্যেক তলায় আলাদা করে জিমনেসিয়াম,পার্কিংলট,পুল সাইড, এমনকি গেমিং সেন্টার ও রয়েছে।
এছাড়া এই পেন্ট হাউজে শুধু মাত্র এরীশ আর তুষার থাকে, এটা ডুপ্লেক্স। উপরের তলায় তাদের ঘর আর এরীশের অফিস রুম।
ফ্লোরার কথার মাঝপথে ঈশানী কিঞ্চিৎ কৌতুহলী হয়ে শুধালো,
— তারমানে তুমি বলতে চাইছো বাকি নয়টা ফ্লোরে গার্ড’সরা থাকে তাইতো?
ফ্লোরা এবারও মুচকি হাসলো, এই মেয়েটার কৌতুহলের শেষ নেই।
— কি হলো হাসছো যে?
—- তিন থেকে নয় তলা পর্যন্ত গার্ড’সরা থাকে।
ফ্লোরার কথার পাছে ঈশানী প্রশ্ন ছুড়লো আবারও,
—- তাহলে ফার্স্ট ফ্লোর আর সেকেন্ড ফ্লোরে কারা থাকে?
ফ্লোরা এবার একটু থমকালো,বুকের গহ্বরে খানিকটা ঠান্ডা বাতাস ভরে নিয়ে জবাব দিলো,
—- ওটা এরীশের টর্চার….
ফ্লোরার কথাতে খেয়াল দিলোনা ঈশানী,ওকে মাঝপথে থামিয়ে দিয়ে উল্টো শুধালো,
—- এরীশ তো অনেক বড়লোক, কালো টাকার কোনো অভাব নেই তার,তারপরেও নিজের ম্যানসনে না থেকে গার্ডস’দের সঙ্গে এই পেন্ট হাউজে কেন থাকেন তিনি ?
—- এরীশ কোনো সাধারণ মানুষ নয় ঈশু, আর না তো তার জীবন যাপন অন্য দশ জনার মতো স্বাভাবিক সুগম। এটাই তার রাজত্ব, একজন রাশিয়ান মাফিয়া কখনো স্বাভাবিক মানুষের মতো পরিবার পরিজনকে একসঙ্গে নিয়ে বাড়ি কিংবা ম্যানসনে বসবাস করতে পারেনা, তাহলে তাকে নিঃশেষ হয়ে যেতে হবে। তাছাড়া…
মুখের কথা শেষ করতে পারলো না ফ্লোরা, তার আগেই সিঁড়ি ভেঙে নিচে নেমে লাউঞ্জের দিকে এগিয়ে এলো তুষার। ওর কিছুটা পেছনে এরীশ ও ছিল।
ফ্লোরার দৃষ্টি অনুসরণ করে উপরের দিকে তাকাতেই ঈশানী দেখতে পেলো এরীশ নেমে আসছে। তার পরনে সফেদ ওভার সাইজ কার্গো প্যান্ট আর সফেদ ফুল স্লিভ টিশার্ট। হঠাৎ করেই আজ এতোগুলা দিন বাদে প্রথমবারের মতো এরীশ কে কালো ব্যাতীত অন্য কোনো রঙে আবিষ্কার করলো ঈশানী। এর আগে ও কখনোই কালো কিংবা ধূসর কালো ছাড়া অন্য কোনো রঙে দেখেনি এরীশকে। আজই প্রথমবার তাই অবাক হলো বেশ।
এই ধবধবে সাদা রঙে বেশ সুদর্শন লাগছে তাকে,কথাটা ভাবতে গেলেই আপসোস হয় ঈশানীর, মনেমনে উপহাস করে বলে,
—- সৌন্দর্য দেখে সবকিছু বিচার করা ঠিক নয় ঈশু। এই সফেদ রঙে তাকে বাইরে থেকে দেখতে যতটা না সুদর্শন লাগছে,ভেতর থেকে তার মনটা ঠিক ততটাই কুৎসিত আর কালো।
ঈশানীর ভাবনার মাঝেই তুষার আর এরীশ এগিয়ে এসে বসে পরে চেয়ার টেনে। ফ্লোরা তাদের দিকে খাবার এগিয়ে দিয়ে এক সাইডে এসে দাঁড়ায়, ঈশানী ওর পাশেই মুখ কাচুমাচু করে দাঁড়িয়ে হাতের মধ্যে হাত রেখে কচলাচ্ছে।
আজ টেবিলে মজাদার সব খাবারের বহর, পেলিমেনি, বিলিনি,বিফ স্ট্রর গানফ,পিরোগি, আপেল পাই, আস্ত কবুতরের রোস্ট,মাশরুম স্যুপ আর সবশেষে ডেজার্ট। এতো খাবার একসঙ্গে দেখে অভিভূত হলো তুষার , প্লেটে খাবার তুলতে তুলতে ফ্লোরাকে জিজ্ঞেস করলো,
— এতো আইটেম একসঙ্গে তুমি করেছো নাকি?
ফ্লোরা হ্যা সূচক মাথা নাড়িয়ে সম্মতি জানিয়ে বলে,
— হ্যা, ঈশুও হেল্প করেছে।
ঈশু নামটা বুলেটের মতোই মস্তিষ্কে গিয়ে বিধলো এরীশের। তৎক্ষনাৎ কি ভেবে যেন ঈশানীর দিকে সামান্য ঘাড় ঘোরালো ও, সেদিনের মতো আজও সবার আগে চোখ গেলো মেয়েটার পায়ের দিকে, কনকনে ঠান্ডায় এখনো খালি পায়ে মেঝেতে দাঁড়িয়ে আছে মেয়েটা। তীব্র ঠান্ডায় র’ক্ত জমাট বেঁধে লাল হয়ে আছে কোমল পা দু’টো। শরীরে একটুকরো গরম কাপড়ের অস্তিত্ব নেই,ফ্লোরার কাছ থেকে পাওয়া ফিনফিনে একটা হাটু সমান ফ্রক পড়ে আছে শুধু।
ভীত স্বতন্ত্র টানাটানা চোখ গুলো এখনো মেঝেতেই নিবদ্ধ তার। মেয়েটাকে দেখলেই কেমন বুকের ভেতরটা দাউদাউ করে জ্বলে ওঠে এরীশের। কালো দুনিয়ার সম্রাট হয়ে এতো পবিত্র একটা সরল মেয়েকে কি করে নিজের হেফাজতে রেখেছে ও? কি করেই বা ওরই পেন্ট হাউজে অক্ষত অবস্থায় দাঁড়িয়ে আছে মেয়েটা?
পবিত্র আর পাপী সত্তা তো কখনোই সমঝোতা করে একই ছাদের নিচে থাকতে পারে না, এতে দু’জনার মধ্যে একজনার ধ্বংস অবধারিত। সে’সব জেনে শুনেও মেয়েটার পবিত্র সত্তায় পাপের আঁচ পর্যন্ত লাগতে দেয়নি এরীশ।
কিন্তু কেন? সেই ভেবেই হঠাৎ হঠাৎ দিশেহারা হয়ে যায় এরীশ। মস্তিষ্কটাও যেন তখন পুরপুরি কর্মক্ষম হয়ে ঝিমিয়ে পরে এককোণে।
—- কফি টা আজ অসাধারণ হয়েছে, স্বাধ গন্ধ দুটোই বেশ স্ট্রং।
তুষারের কথায় ধ্যান ভাঙে এরীশের। ভাবনা থেকে বেড়িয়ে ভারী মস্তিষ্কটাকে একটু হালকা করার প্রয়াশে নিজেও চুমুক দেয় কফির কাপে। ঠিক তখনই ফ্লোরা বলে ওঠে,
—- কফিটা ঈশু বানিয়েছে।
ফ্লোরার কথার পাছে ঈশানীর দিকে দৃষ্টিপাত করে তুষার বললো,
—- খুব ভালো কফি বানাও তুমি।
জবাবে হ্যা না কিছুই বলেনা ঈশানী, মাথা নিচু করে শুনে যায় শুধু।
এরীশ কফির কাপে দ্বিতীয় বারের মতো চুমুক দিয়ে আবারও কয়েক সেকেন্ডের জন্য আড় চোখে পরখ করে ঈশুর দিকে,
অতঃপর ঘাড় ঘুরিয়ে তুষারকে উদ্দেশ্য করে বলে ওঠে ,
— আই থিংক ফ্লোরার কিছু জামাকাপড় প্রয়োজন, আগামীকাল সময় করে ওদের নিয়ে শপিং মলে ঘুরে এসো একটু।
এরীশের কথার সম্মতি জানিয়ে কফি খেতে খেতে হ্যা সূচক মাথা নাড়ায় তুষার।
আমি শুধু চেয়েছি তোমায় পর্ব ১১
তখন মাঝরাত, হাতের সব কাজ শেষ করে মাত্রই শুতে এসেছে ঈশানী, তবে ওর চোখের পাতায় একরত্তি ঘুম নেই আজ। একটু আগের শপিং মলে জাওয়ার অনুমতিটা মেঘ না চাইতে জলের মতোই অবিশ্বাস্য লেগেছিল ওর নিকট ।
এটাই একমাত্র সুযোগ এখান থেকে পালানোর। যে করেই হোক এই সুযোগ কাজে লাগাবেই ঈশানী।
আগামীকাল সকালের অপেক্ষায় বারবার হৃদয়টা নেচে উঠছে ওর। কখন কাটবে এই ঘুটঘুটে আঁধার রাত? কখনই বা এই বন্দী পেন্ট হাউজ জীবনের ইতি ঘটাবে ঈশানী?