প্রণয়ের বাঁধন পর্ব ৩৪
মুসতারিন মুসাররাত
সময়ের বাঁধনহারা স্রোতে, দিন- রাত্রির আবর্তনে চোখের পলকে কে’টেছে অনেকগুলো দিন। উল্টেছে বর্ষপঞ্জিকার পাতা। এসেছে নতুন মাস, নতুন ঋতু। শীতের রিক্ততা,শুষ্কতা পেরিয়ে আগমন ঘটেছে বসন্তের। কোকিলের সুমধুর কুহুকুহু কলরব। ফুলের মনমাতানো সুবাস। প্রকৃতির সাথে নব রুপে মানব হৃদয়েও জাগে এক অন্যরকম শিহরণ। এসকল কিছুই ঋতুরাজ বসন্তের আয়োজন। এমনই মনমাতানো ফাগুনে সেজে ওঠেছে গোটা মির্জা বাড়ি। জাঁকজমকপূর্ণ আভিজাত্যের ছোঁয়া বাড়িটির কোণায় কোণায়। পুরো বাড়ি ঝলমল করছে কৃত্রিম আলোয়। হরেক রঙের বাহারি মরিচ বাতির আলোয় নজর কাড়ছে মেইন ফটক। আভিজাত্য পূর্ণ লোকজনে গমগম করছে চারিদিক। সাঁঝের পর থেকেই বাড়ছে লোকসমাগম।
অনাকাঙ্খিতভাবে হুট করেই বাড়ির দুই ছেলের বিয়ে হয়। বিয়ের অনুষ্ঠানাদি তো দূর আত্বীয়-স্বজনকে জানানোর সময় অবধি মেলেনি। আত্বীয়-স্বজন তারপর সোসাইটি,অফিসসহ পরিচিত লোকজন শাহারিয়ার সাহেবকে খুব বলতো,
-‘মির্জা বাড়ির দুই-দুইটা ছেলের বিয়ে হলো। একটার বেলায়ও দাওয়াত পেলাম না। এখনো পুত্র বধূ দেখালেন না।’
লোকজনের বলা তারপর নুরজাহানেরও খুব শখ ছিলো অনুষ্ঠান করে লোকজনকে খাওয়ানো। বিভিন্ন ব্যস্ততা,ঝামেলায় সময় হয়ে ওঠেনি। ওদিকে তামান্নাও ঢের দিন মেয়েসহ বাড়ির সবার সাথে ঠিকমতো কথা বলতো না। সময়ের সাথে সাথে ইদানিং সেও অনেকটা পরিবর্তন হয়েছে। বাড়ির সদস্যদের সকলের সম্মতিক্রমে আজকের অনুষ্ঠানের আয়োজন।
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে সাজগোজে ব্যস্ত নিতি। সাজতে এতটা বিভোর যে আশপাশে তাকানোর ফুরসত নেই তার। তন্মধ্যে কক্ষে দিব্যর প্রবেশ ঘটে। নিচে ফ্রেন্ডদের সাথে ছিলো দিব্য। হঠাৎ প্রয়োজনে ফোনের তালাশ করতেই পকেট হাতড়ে মেলেনি ফোন। আচানক মনে ওঠে রেডি হয়ে ফোন বিছানায় রেখেই চলে আসা হয়েছে তো। বিছানার একপাশ থেকে ফোনটা হাতে তুলতে তুলতে আড়চোখে নিতির দিকে তাকায় দিব্য। পরনে গোল্ডেন কালারের গর্জিয়াস ভারী শাড়ি। শাড়িতেই মানায় বাঙালি নারী। এই কথাটার জলজ্যান্ত প্রমাণ দিচ্ছে সামনের শাড়ি পরিহিতা রমণী। ফর্সা,লম্বা, ছিমছিমে শরীরে শাড়িটা দারুণ মানিয়েছে। সাথে মানানসই গহনা আর কৃত্রিম প্রসাধনীর ছোঁয়ায় নিতিকে একদম অপ্সরা লাগছে। রুপকথার রাজ্যের ডানা কা’টা পরীর মতন লাগছে নিতিকে। দিব্যর চোখের পলক পরতে ভুলে যায়। আজকের নিতিকে দিব্যর কাছে অন্যরকম ঠেকছে।
একএক করে চুড়ি গুলো পরে আয়নার সামনে হাতটা ধরে নিতি। পরপর মুখে আলতো হাসি ফোটে মেয়েটার। গোলগাল চিকনা হাতে চুড়ি গুলো খারাপ লাগছে না। নিতি আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজের আপাদমস্তক দেখতে থাকে। ঠোঁটজোড়া এক করে কিঞ্চিৎ চোখা করে আয়নার দিকে দৃষ্টি তাক করে কপাল গুছিয়ে ফেলে। মনে হচ্ছে লিপিস্টিক লাগানো কম হয়েছে। ড্রেসিং টেবিলের উপর থেকে লাল-খয়েরি লিপিস্টিকটা হাতে তুলে নেয়। পরপর ঘষে ঠোঁটে গাঢ় রঙ করে। অতঃপর এপাশে ওপাশে দুলে শাড়িটা কেমন মানিয়েছে দেখতে নেয়। বাম দিকে ঘাড় কাত করতেই ভূ’ত দেখার মত চমকে ওঠে নিতি। মনে মনেই এক দফা বুকে থুতু ছিটিয়ে নেয়। কণ্ঠে অবাকতা নিয়ে প্রশ্ন ছুঁ’ড়’ল,
-” এমা..তুমি! তুমি কখন রুমে আসলে? আর এভাবে তাকিয়ে আছো যে?”
নিতির কথায় সম্বিৎ ফেরে দিব্যর। তড়িৎ গতিতে দৃষ্টি সরিয়ে নেয়। ঘনঘন চোখের পলক দু’বার ফেলে। হাতের ফোনটা পাঞ্জাবির পকেটে পুড়তে পুড়তে জবাবে বলে,
-” ফোন নিতে আসছিলাম।”
একহাত বুকের উপর রেখে ঠোঁট গোল করে বুকের উপর ফু দেয় নিতি। বলে,
-” উফ্ফ! ভ’য় পেয়ে দিয়েছিলে। আমি তো তোমাকে অন্যকিছু ভেবেছিলাম।”
দিব্যর কপালে সুক্ষ্ম রেখার সৃষ্টি হয়। ভ্রুজোড়া কিঞ্চিৎ কুঞ্চিত করে জিজ্ঞাসা করল,
-” অন্যকিছু মানে?”
কয়েক কদম এগোয় নিতি। চোখেমুখে ভয়ার্তের ছাপ টেনে আনে। সতর্ক চোখে এদিক-ওদিক তাকিয়ে মৃদুস্বরে বলল,
-” আরে শুনেছিলাম, সুন্দরী মেয়েদের উপর জীনে আছড় করে। সেই জীন আবার কারো রুপ ধরে আসে। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে আমি নিজেই নিজেকে দেখে ক্রাশ খাচ্ছিলাম। কখন চো’রের মতো চুপিচুপি রুমে ঢুকেছো কিছুই তো জানি না। তাই ভাবলাম তোমার রুপ ধরে কোন জীন আসেনি তো। শেষমেষ তোমার রুপ নিয়েই আমার ঘাড়ে চাপ..”
-” স্টুপিট কোথাকার! তোর ননস্টপ ব’ক’ব’কানি বন্ধ কর।”
দিব্যর ধ’ম’কে নিতির একনাগাড়ে বলা কথা থেমে যায়। এই মেয়ে একবার ভূ’ত বানাচ্ছে তো আরেকবার চো’র। দিব্য কটমট চোখে চেয়ে দাঁতে দাঁত চেপে ফের বলল,
-” নিজের রুমে নিজে প্রবেশ করতে আমাকে কী ঢাকঢোল পিটিয়ে আসতে হবে? আর অলওয়েজ এমন ধরণের লজিকলেস আ’জ’গু’বি চিন্তা ভাবনা একজনের মাথায় কী করে আসে! ও গড! আমি ভেবে পাই না।”
-” আরেহ আরে তুমি জানো না। নানুআপুর থেকে
কত ভয়ানক গল্প শুনেছি।”
দিব্য তপ্ত নিঃশ্বাস ফেলল। বলল,
-” তোর থেকে আমি সেসব আ’জা’ই’রা গল্প শুনতে চেয়েছি? বল চেয়েছি?”
নিতি সরু চোখে চেয়ে নিরুত্তর দাঁড়িয়ে রইল। দিব্য নিজেই প্রত্যুত্তর দেয়,
-” চাইনি.. চাইনি তো। তাই দয়া করে মুখটা বন্ধ রাখ। তুই অযথা এত ব’ক’ব’ক করিস যে আমার ইচ্ছে করে তোর ঠোঁটে স্কচটেপ লাগিয়ে দিতে।”
নিতির রাগ হলো। মনের আকাশে কালো মেঘের আনাগোনা শুরু হয়। হাসি-খুশি মুখটা ঝট করে ম্লান হয়ে যায়। অভিমানের পাল্লা ভারী হতে লাগলো। রাগ-ক্ষোভে গাল দু’টো টমেটোর মতো ফুলিয়ে হাঁটা ধরল। হিলে খটখট শব্দ তুলে হাঁটছে। পিঠজুড়ে থাকা খোলাচুল জোরে হাঁটার দরুণ তরঙ্গের ন্যায় ঢেউ তুলেছে। যেতে যেতে ডান হাত দিয়ে পিঠ থেকে খোলা চুল কাঁধের উপর দিয়ে সামনে রাখে নিতি। নিতির যাওয়ার দিকে অবাক দৃষ্টিতে চেয়ে ছিলো দিব্য। কী এমন বলা হলো? তাতেই নিতি রেগে-মেগে একশা। ভাবনার মাঝেই আচানক দিব্যর দৃষ্টি নিতির পিঠের দিকে পড়তেই তড়াক পিছুন থেকে ডেকে উঠল,
-” অ্যাই নিতি, ওয়েট?”
নিতি পিছু ফিরে তাকায় না। শুনতে পায়নি এমন ভঙ্গিতে যেতে থাকে। দিব্য ডান হাতটা উঁচিয়ে ফের গলার স্বর চড়িয়ে ডাকল,
-” নিতি দাঁড়া। শোন?”
কে শোনে কথা! নিতি পণ করেছে কথা বলবে না। আজকের মতো এত সুন্দর দিনে! যেখানে বাড়ি ভর্তি মেহমানে। সবাই কত সুন্দর আনন্দ উচ্ছ্বাস, হৈহুল্লোড় করছে! এমন দিনেও খারসের মতো বিহেভ করলো। ধ’ম’কিয়ে কথা বলল। নিতির ছোট্ট সত্ত্বা এই ভেবে তীব্র অভিমানের জোয়ারে ডুব দেয়। কক্ষের দুয়ার পেরিয়ে করিডোরে কয়েক পা ফেলতেই অকস্মাৎ হাতে টান পরে নিতির। ঘাড় ফিরিয়ে কড়া চোখে চাইল নিতি। দিব্য পরোয়া করলো না সে চাহনী। আরেকটু শক্ত করে ধরল নিতির নরম তুলতুলে হাত। নিতি চোখমুখ শক্ত করে প্রশ্নাত্মক চোখে তাকায়। দিব্য উত্তর না দিয়ে হেঁচকা টানে নিতিকে রুমের দরজার ওপাশে নিয়ে যায়। তৎক্ষণাৎ নিতির হাতটা ছেড়ে দেয়। এক আঙুলে কপাল চুলকিয়ে নিয়ে ঠান্ডা প্রগাঢ় স্বরে বলল,
-” লাল তিলটা দেখা যাচ্ছে।”
খোলা আকাশে তারকা যেমন জ্বলজ্বল করে , তেমনি ফর্সা পিঠে লাল তিলটা স্পষ্ট দেখা যাচ্ছিল। দিব্যর কথাটা কর্ণকুহরে ঢুকতেই সেকেন্ডে মস্তিষ্কের নিউরনে নিউরনে সাড়া জাগে। আপনাআপনি ডান হাতটা বাঁকিয়ে পিছনে পিঠের উপর নেয় নিতি। হাতটা পিঠে রাখতেই ধ্বক করে উঠে বুক।
-” এইরে কী করে খুলল হুক?” তড়াক উদয় হয় প্রশ্নের। লজ্জায় আড়ষ্ট হয়ে মাথাটা নুইয়ে নেয় মেয়েটা। দিব্য একহাতে চুলগুলো ব্যাক ব্রাশ করতে করতে চলে যেতে নেয়। নিতি দুইহাতের সাহায্যে ব্লাউজের হুক লাগানোর চেষ্টা করতে থাকে। পিছনে হুক হওয়ার জন্য নিতি লাগাতে ব্যর্থ হচ্ছিলো। সমস্ত রাগ-ক্ষোভ গিয়ে নৃত্যর উপর বর্তায়। মনেমনে বকতে থাকে নৃত্যকে।
-” এই নৃত্যটাকে হাতের কাছে আগে পাই। ও ব্যাগার দিয়েছে আমায়। কীরকম করে লাগিয়ে দিয়েছে; যে এক ঘন্টা নাই হতে আপনাআপনি খুলে-টুলে একাকার। আরেকটু হলেই মানসম্মানের দফারফা হয়ে যেতো। ইয়া আল্লাহ! বাঁচিয়েছো।”
বারবার চেষ্টা করেও ব্যর্থ হয় নিতি। অতঃপর দরজার ওপাশে দাঁড়িয়ে বকের মতো গলা লম্বা করে করিডোরে নজর বুলায়। উদ্দেশ্য মাম্মা বা মামীর হেল্প নেওয়া। কিন্তু বিধিবাম! করিডোর ফাঁকা। সবাই নিচে হয়তো। নিতির এবার রাগে দুঃখে প্রচন্ড কান্না পাচ্ছে। সবাই রেডি হয়ে নিচে গিয়ে আনন্দ করছে। আর সাজগোজ করতে করতে নিজেই পিছিয়ে পরেছে। তার উপর এখন উটকো ঝামেলা। দরজা থেকে দু’পা বাইরে এসে এদিক-ওদিক তাকাতে নজর পরে ফোন কানে চেপে দিব্য ওপাশ থেকে আসছে। নিতি উপায়ান্তর না দেখে দিব্যকে ডেকে বলল,
-” মাম্মাকে বা মামীকে একবার ডেকে দিবে প্লিজ। দরকার ছিলো।”
দিব্য কয়েক পা এগিয়ে ফোনটা হোল্ড করে জবাব দেয়,
-” ফুপি, মাম্মা নিচে। নিচে গেস্টদের আপ্যায়নে ব্যস্ত আছে। কেনো কী দরকার?”
নিতি শুকনো ঢোক গিলল। মুখটা কাঁচুমাচু করে বলল,
-” আমি একা পারছি না। হেল্প লাগবে।”
দিব্য বুঝতে পারে। কয়েক সেকেন্ড চুপ থেকে বলল,
-” মাম্মা তো খুব ব্যস্ত, ফুপিও। আমি বরং নৃত্যকে ডেকে দিচ্ছি।”
-” এই না না। নৃত্য নয়। ও কোনো কাজেরই নয়। কাজ তো নয়, যেন ফ্রি সেবা দেয়। যার ফলাফল ভয়াবহ। আচ্ছা তুমি এক কাজ করো ভাবিমণি বোধহয় উপরেই আছে। তাকেই ডেকে দাও। মাম্মা, মামী থাক। এই ছোট্ট একটা কাজের জন্য তুমি গিয়ে তাদের ডাকলে; বিষয়টা বাজে হবে। তখন সন্দেহ হবে তোমার আমার সম্পর্কটা আর সবার মতো নয়।”
নিতির কথায় লজিক আছে তাই দিব্য বাড়তি কথা বলল না। তনুজার বিষয়টা এড়িয়ে যেতে দিব্য আগ বাড়িয়ে বলল,
-” ওয়েট আমি হেল্প করছি।”
বিস্ময়ে নিতির চক্ষু চড়কগাছ। বিস্ময়ে ঠাসা নিতি উপরে স্বাভাবিক আবরণে নিজেকে আবৃত করে মাথা নাড়িয়ে -‘ঠিক আছে ‘ বোঝায়। পরপর দরজা থেকে দু’কদম ভেতরে প্রবেশ করে। দিব্য কল কে’টে ফোনটা পকেটে রাখে। উল্টোদিক পিঠ করে নিতি দিব্যর সামনে দাঁড়িয়ে। মেয়েটার দৃষ্টি জমিনে। পিঠের উপর থাকা চুলগুলো একহাতে সরাতে থাকে দিব্য। আচমকা দিব্যর হাতটা মৃদু কাঁপছে। ওদিকে উষ্ণ স্পর্শে নিতির কণ্ঠনালী শুকিয়ে চৈত্রের খরার ন্যায় চৌচির হয়। শ্যাম্পুর ঘ্রাণটা মাদকতার ন্যায় ঠেকছে। দিব্য দুই হাতের সাহায্যে হুকটা লাগিয়ে দিতে থাকে। দিব্যর নিঃশ্বাস স্বাভাবিকের তুলনায় বাড়ছে। বার দুয়েক ফাঁকা ঢোক গিলে নেয়। কম্পিত হাতে কাজটা সম্পন্ন করে দিব্য। উন্মুক্ত ফর্সা পিঠ, মেয়েলি অবয়ব। দিব্যকে সম্মোহিত করে। সামনের রমণী চুম্বুকের ন্যায় আকর্ষণ করছে। পরপর নিতি ঘুরে দাঁড়ায়। দিব্যর দিকে তাকিয়ে অস্ফুটে বলে,
-” থ্যাংকস।”
দিব্যর চোখ-মন সবটাই নিজের সাথে বেইমানি করছে। চোখের পলক নিবদ্ধ হয়েছে নিতির মুখশ্রীতে। মনটা যেন কোথায় অজানায় ডুব দিয়েছে। মনের বাতায়নে নাম না জানা অনুভূতির স্রোত বইছে। কোনো একটা ঘোরের মধ্যে আছে দিব্য। নিতির রক্তিম কৃষ্ণচূড়ার রঙে রাঙানো আকর্ষণীয় ওষ্ঠজোড়া দিব্যকে বিমোহিত করেছে। বারবার বেপরোয়া অবাধ্য করে তুলতে চাইছে। দিব্যর ঘোর লাগা দৃষ্টি নিতির বুকের ভেতর সমুদ্রের ঢেউ তোলে। রীতিমত দুরুদুরু বুক কাঁপছে। নিতি দু’পা পিছায়, পিঠ গিয়ে দেওয়ালে ঠেকে। দিব্য দু’পা এগিয়ে একহাত নিতির কাঁধের উপর দিয়ে দেওয়ালে রাখে। অন্যহাতটা নিতির কোমড়ের কোল ঘেঁষে দেওয়ালে রাখে। বসন্তের প্রেমময় বাতাস রুমজুড়ে বইতে থাকে। এক টুকরো স্বর্গীয় সুখের অনুভুতির স্রোতে হারিয়ে গিয়েছে দিব্য। নিতির ঠোঁট দুটো গাছের কচি পাতার মতো তিরতিরিয়ে কাঁপছে। যা দিব্যকে বেশি উন্মাদ করছে। দিব্য যেন হুঁশে নেই। নিতি কম্পিত গলায় বলল,
-” স-সরো।”
দিব্যর কানে মনেহয় না কথাটা ঢুকেছে। দিব্য যেন কোন আকর্ষণ বলয়ের বেষ্টনীতে আবদ্ধ পড়েছে। সামনের শাড়ি পরিহিতা রমণী ক্ষণিকেই তাকে অস্থির করে তুলেছে। দিব্যর নয়নজোড়া সম্মোহিত হয়ে আছে নিতির দিকে। নিতির শ্বাস প্রশ্বাস ক্রমশ উঠানামা করছে। দিব্য মাথাটা নিতির মুখের দিকে নুইয়ে নেয়। দিব্যর খাঁড়া নাক নিতির নাক ছুঁইছুঁই। দিব্যর উষ্ণ নিঃশ্বাসে নিতির দম বন্ধ হয়ে যাওয়ার জোগাড়। মেয়েলি মিষ্টি গন্ধটা দিব্যকে বেসামাল করছে। আবেশে আবেশিত হয়ে দিব্য চোখদুটো বুঁজে নেয়। অতঃপর নিতির দিকে মুখটা এগিয়ে নেয়। নিতি শাড়ি মুঠো করে ধরে; অতঃপর দিব্যর হাতের ফাঁক গলিয়ে বেরিয়ে আসে। ওদিকে মুখটা এগিয়ে নিতেই কেমন একটা ফাঁকা ফাঁকা ধাক্কা লাগে দিব্যর। অল্পের থেকে মুখটা গিয়ে দেওয়ালে ঠেকতে ঠেকতে নিজেকে সামলে নেয়। পরপর সম্বিৎ পেতেই হাতের আঙুল মুষ্টিবদ্ধ হয়। দিব্য দাঁত কিড়মিড় করে অস্ফুটে বলে,
-” ওহ্ শিট!শিট!”
নিতি বড়বড় শ্বাস টেনে নেয়। বুকের উপর একটা হাত রেখে বলল,
-” থ্যাংক গড! অল্পের থেকে লিপিস্টিকটা ন’ষ্ট হয়নি। আরেকটু হলেই এতক্ষণ ধরে করা সাজগোজ মাটি হচ্ছিলো।”
এমন মেয়ে কোন সিনেমা,গল্প-উপন্যাসেও দেখেনি দিব্য। এমনি সময় তো আনরোমান্টিক বলে খুঁচিয়ে বেড়ায়। আজ যখন কোনো একটা ঘোরের মধ্যে পরে কিস করতে.. সেখানে এই মেয়ের কাছে ঠোঁটের লিপস্টিকই আগে। নিতির কথা তারপর সবকিছু ঠাহর করতেই দিব্যর নিজের উপর নিজেরই চরম রাগ হয়। ভেতরে ভেতরে লজ্জায়ও পরে। নিতি সহসাই বলে উঠল,
-” বাব্বাহ! আজকাল দেখছি আবহাওয়ার মতো তোমার মুড চেঞ্জ হচ্ছে। চোখের পলকে..”
এতটুকু বলে জিভ কা’টে নিতি। দিব্য বেচারা অস্বস্তিতে পরে। মাথাটা কিঞ্চিৎ নিচু করে পিছুনের চুলে হাত বুলিয়ে লম্বা পা ফেলে বেড়িয়ে যায়। নিতির সামনে থেকে সরে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে। দিব্য বেরিয়ে যেতেই নিতি মুখে বাঁকা হাসি ফুটিয়ে তোলে। শাড়ির আঁচল আঙুলে পেচাতে পেচাতে ঠোঁট টিপে হাসে। বিড়বিড় করে বলে,
-” বলবো না আর ভালোবাসি। করবো না তো কভু জোর। মন থেকে যেদিন ভালোবাসবে, সেদিন আমায় পাবে।”
তনুজা আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে শাড়ির কুঁচি কেমন যেনো একটা উঠেছিলো। সেটা দেখার পর উবু হয়ে ঠিক করতে নিবে, এমন সময় ইভানের গলার স্বরে থেমে যায় তনুজা। দরজার নব ঘুরিয়ে ভেতরে ঢুকছিলো ইভান। তনুজাকে উবু হতে দেখে বলল,
-” এই তনুজা দাঁড়াও, আমি করে দিচ্ছি।”
তনুজা ঘাড় ঘুরিয়ে বিনিময় স্মিত হাসল। ইভানের পরনে সাদা পাঞ্জাবি। পাঞ্জাবির গলার কাছে গোল্ডেন কালারের রেশমি সুতার কারুকাজ খচিত। পাঞ্জাবির হাতা কনুই অবধি গোটানো। হাতে কালো হাতঘড়ি। সুঠাম দেহে আঁটসাঁট পাঞ্জাবিতে দারুণ আকর্ষণীয় লাগছে ইভানকে। তনুজা মুগ্ধ চোখে কিছুপল চেয়ে রইল। ইভান এগিয়ে তনুজার সামনে হাঁটু গেড়ে বসে ঠিক করে দেয়। অতঃপর জিজ্ঞেস করল,
-” ঠিক আছে।”
-” হুঁ।”
ছোট করে জবাব দেয় তনুজা। ইভান উঠে দাঁড়ায়। তনুজার আপাদমস্তকে নজর বুলায়। গোল্ডেন কালারের গর্জিয়াস শাড়ি। একসাথে দুইভাই আর তাদের বউয়ের জন্য সেইম পোশাক কেনা হয়। ইভান প্রশ্ন করলো,
-” তুমি রেডি। সব কিছু কমপ্লিট?”
তনুজা মাথা নাড়িয়ে বলল,
-” হ্যাঁ।”
-” দাড়াও কিছু বাকি আছে।”
এই বলে ইভান আলমারি খুলে একটা প্যাকেট বের করে। তনুজা বোকা বোকা চোখে চেয়ে থাকে। লাল বক্স থেকে একটা বিছা বের করে ইভান। ফের হাঁটু ভেঙে বসে। একহাতে শাড়ির আঁচলটা সরিয়ে তনুজার কোমড়ে পরিয়ে দিতে দিতে বলল,
-” সেদিন একসাথে সব গহনা কেনার সময়, এটা দেখে পছন্দ হয়। সবার মাঝে বলা হয়নি, ওরা সবাই ছিলো ছোটরা। তাই পরে আলাদা করে এটা নেই।”
তনুজা অবাক বনে যায়। তন্মধ্যে পেটে উষ্ণ স্পর্শে গোটা শরীর কেঁপে ওঠে তনুজার। সারা শরীর শিহরিত হয়। ইভান তনুজার পেটে ঠোঁট ছোঁয়ায়। পরপর পেটের উপর কানটা রেখে বলল,
-” হ্যালো বেবি! আজকের দিনটা তোমার পাপা-মাম্মাসহ গোটা মির্জা বাড়ির জন্য স্পেশাল। আর এই স্পেশাল দিনটা তোমার আগমনের জন্য আরো বেশি বেশি স্পেশাল করেছে আমার জন্য। তুমি জলদি চলে এসো তো। পাপা তোমার প্রতিক্ষায় দিনগুনছে। চাতক পাখির মতো অপেক্ষায় আছে।”
পরপর আরো দু’টো চুমু খেয়ে উঠে দাঁড়ায় ইভান। ইভানের পা’গ’লা’মি দেখে তনুজার ঠোঁটের কোণের হাসি চওড়া হয়। তনুজার প্রেগন্যান্সির তিনমাস চলছে। ইভানের কেয়ার তারপর বাড়ির সবার আদর-যত্নে তনুজা আবেগাপ্লুত। আনন্দের আতিশয্যে মাঝে মাঝে চোখ জল চলে আসে। আর অসংখ্য শুকরিয়া জ্ঞাপন করে সৃষ্টিকর্তার উপর।
সোফায় থাকা একটা ব্যাগ হাতে নেয় ইভান। ব্যাগ থেকে একটা রজনীগন্ধা ফুলের গাজরা বের করে। তনুজা ইভানের দিকে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকায়। ইভান উত্তর না দিয়ে সরাসরি তনুজার চুলের খোঁপায় এঁটে দেয়। তারপর একহাতে তনুজাকে নিজের দিকে ঘুরিয়ে নেয়। চোখে কাজলের গাঢ় প্রলেপ, ঠোঁটে পিংক কালারের লিপবাম মুখে হালকা প্রসাধনী। সাধারণ সাজেই তনুজাকে বেশি অসাধারণ লাগছে। ইভানের আঁখি জোড়া শীতলতায় ছেয়ে যায়। মুখে প্রশান্তির হাসি ফুটে আছে ইভানের। ঠোঁটের কোণের হাসি প্রশস্ত করে অস্ফুট স্বরে বলল,
-” মাশাআল্লাহ! কাজল কালো চোখে তোমাকে ভারী মিষ্টি আর স্নিগ্ধ লাগছে। মিসেস ইভানকে অনিন্দ্য সুন্দরী লাগছে। আমার চোখের পাতা নড়তে ভুলে যাচ্ছে। উচাটন মনটা নির্নিমেষ নিষ্পলক চেয়ে থাকতে চাইছে।”
তনুজা হেসে বলল,
-” জানি আপনি বাড়িয়ে বলছেন। একটু-আকটু নয় অনেক বেশিই বাড়িয়ে বলছেন। কারন আমি জানি, আমি দেখতে সুন্দরী নই।”
ইভান তীব্র প্রতিবাদ করে বলল,
-” ইউ রং। তুমি সম্পূর্ণ ভুল জানো। আমি মোটেই বাড়িয়ে বলছি না। ইভানের দু’চোখেতে তার বউ সবচেয়ে বেশি সুন্দরী। ইভানের কাছে ইভানের মিসেস বেস্ট।”
তনুজার কোমড় পেঁচিয়ে ধরে কাছে এনে দূরত্ব ঘুচায় ইভান। তনুজার চোখে চেয়ে বলে,
-” সৌন্দর্য তো সময়ের সাথে সাথে মলিন হয়। কিন্তু ভালো মন, সততা তো আজীবন অমলিন রয়ে যায়।”
থেমে তনুজার চোখে চোখ রেখে জিজ্ঞেস করে,
-” এই পৃথিবীতে সবচেয়ে দামী গিফট কী? জানো তুমি?”
তনুজা ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইল। ইশারায় প্রশ্ন করে,
-” কী?”
তনুজার দিকে ঝুঁকে কপালে কপাল ঠেকায় ইভান। শান্ত শীতল গলায় বলল,
-” এই পৃথিবীতে সবচেয়ে দামী গিফট হলো একজন উত্তম জীবন সঙ্গী। যা টাকা-পয়সা, ধনদৌলত, ঐশ্বর্য দিয়ে কেনা যায় না। ভাগ্য দিয়ে কিনতে হয়। আমার ভাগ্যকে আমি সুপ্রসন্ন মনেকরি, আমি তোমাকে পেয়েছি। তুমি আমার জীবন সঙ্গী। আমার অর্ধাঙ্গিনী।”
আবেগে আপ্লুত হয়ে তনুজার কাজলটানা মৃগ আঁখিজোড়া চিকচিক করে ওঠে। নিজেকে ওর ভাগ্যবতী মনে হয়।
ইভান-তনুজা পাশাপাশি আবার দিব্য-নিতি পাশাপাশি দাঁড়িয়ে। গেস্টদের সাথে কুশলাদি বিনিময় করছে। অদূরে দাঁড়ানো নুরজাহান নাতি আর তাদের বউদের পাশাপাশি দেখে মন ভরে দোয়া করলেন। বৃদ্ধার চোখ জুড়িয়ে আসে।
সোসাইটিতে কিছু আন্টি থাকে যাদের কাজই পরনিন্দা পরচর্চা করা। আর সব কিছুতেই একটা না একটা খুঁত ধরা। একসাথে তিনচারজন প্রৌঢ়া মহিলা দাঁড়িয়ে। তামান্নার সাথে কুশলাদি বিনিময় করছে। বিভিন্ন আলাপের এক ফাঁকে এক ভদ্রমহিলা ঠোঁট বাঁকিয়ে বলল,
-” বড় ছেলের বউটা আরেকটু ফর্সা হলে মানাতো। দু’জনেই শ্যাম বর্ণের। না জানি বাচ্চা কাচ্চা কেমন রঙের হয়। একজন ফর্সা থাকলে তাও ফর্সা হওয়ার সম্ভাবনা ছিলো।”
আরেকজন ফোড়ন কাটলেন,
-” ছোট ছেলের পাশে আপনার মেয়েকে খুব মানিয়েছে আপা। খুব সুন্দর লাগছে দু’জনকে।”
নিজ মেয়ের প্রশংসা শুনে খুশিতে গদগদ হয় তামান্না। যাক নিজের মেয়ে একধাপ হলেও এগিয়ে আছে, এই ঢের তামান্নার কাছে। মহিলাটি বলতে থাকে,
-” মির্জা বাড়ির ছোট ছেলের পাশে তার বউকে দারুণ মানিয়েছে! তবে বড় ছেলের পাশে তার বউকে তেমন মানায়নি।”
প্রণয়ের বাঁধন পর্ব ৩৩
শিরিন খানিকটা দূরত্বেই ছিলো। কথাগুলো তার কানে পৌঁছায়। ভদ্রতার খাতিরে চুপ ছিলেন। তবে এবার ধৈর্য্যর বাঁধ হারা হয়ে এগিয়ে এসে মুখ খুললেন,
-” কাকে কার পাশে কেমন মানায় এটা জরুরী নয়। কে কার সাথে কতটা হ্যাপি এটাই জরুরী। শো অফের থেকে আসল তো মানসিক প্রশান্তি, সুখ, শান্তি।
