প্রেমপিপাসা পর্ব ১৫
সুমাইয়া সুলতানা
সূর্য তার রক্তিম আভায় প্রভাতকে স্নিগ্ধ করে তুললেও বাতাসে বিরাজমান শীতলতার স্থির স্পর্শ। শিশির বিন্দুগুলো ঘাসের ফলায় ঝলমল করছে। রুপোর গুঁড়ো ছড়িয়ে আছে প্রকৃতির গালিচায়। পূর্বাকাশে তুলোর মতো সাদা মেঘের চাদর একটানা বিস্তৃত হয়ে থেকে থেকে উজ্জ্বল আলোকে ঢেকে দিচ্ছে। বাতাসের গায়ে লেপ্টে রয়েছে একরকম নীরব চঞ্চলতার মৃদু প্রবাহ, অথচ দেহে কাঁপন ধরানোর মতো শীতল। পাখিরা জড়ানো স্বরে ডাকছে। ঠান্ডার কাঁপুনিতে তাদের কণ্ঠস্বরেও জড়তা লেগে আছে। রাস্তাঘাট এখনো কুয়াশার পাতলা আস্তরণে ঢাকা, যেখানে পথচারীদের ধীরগতির ছায়াগুলো আবছা হয়ে মিলিয়ে যাচ্ছে। ঘর থেকে বের হওয়া প্রতিটি মানুষ নিজেকে শীতের কঠোর করালগ্রাস থেকে মুক্ত করার ব্যর্থ চেষ্টা করছে। গলায় মাফলার, হাতে গরম কাপড়, মুখ থেকে বের হওয়া ধোঁয়ার মতো নিঃশ্বাস।
প্রভাতের এই সময়ে অরু সচারাচর তন্দ্রা আচ্ছন্ন হয়ে থাকে। বাবার বাড়ি যাবে শুনে মন পুলকে নেচে উঠেছে। ঘুম রানী লেজ গুটিয়ে পালিয়েছে অনেক আগে। অন্তরে আজ এক অনির্বচনীয় শিহরণ জাগ্রত। প্রতীক্ষার প্রহর পেরিয়ে সমগ্র সত্তা এক অপার আনন্দে উদ্বেলিত। তবু প্রস্তুতির তাড়নায় সে স্বস্তিহীন। দর্পণের সামনে দাঁড়িয়ে দেখছে নিজেকে। সেথায় স্বীয় মুখাবয়বে প্রতিফলিত হচ্ছে এক অভ্যন্তরীণ আলোড়ন। চোখে উচ্ছল দীপ্তি, ভ্রূর নিচে এক অদৃশ্য উদ্বেগের ছায়া।
অরুর অনিন্দ্য কুন্তল আজ যত্নে বিন্যস্ত। গ্রীবার কাছে খোঁপার বাঁধনে অলসভাবে জড়ানো রুপোর কাঁটা। বসনের পরতে পরতে পরিশীলিত নন্দন। গায়ে অরুণাভ শাড়ির কোঁচকানো ভাঁজে লেগে আছে শীত সকালের আর্দ্রতা।
প্রতিটি অনুষঙ্গ নিখুঁতভাবে সাজানোর পরও অরুর অন্তরে এক অজানা সঞ্চরণ, এক অদৃশ্য সঞ্চার। দ্বিধাবোধ স্নিগ্ধ বেদনা। হয়তো শৈশবের সেই প্রাঙ্গণে ফিরে যাওয়ার গোপন অস্থিরতা। বাইরে গৃহপ্রাঙ্গণে রোদ এখনো সম্পূর্ণ প্রসারিত হয়নি, কিন্তু অরুর অন্তর্লোকে স্মৃতির আলোকচ্ছটা জ্বলে উঠেছে পূর্ণ দীপ্তিতে।
ফুল হাতার শার্ট কনুই পর্যন্ত গোটাতে গোটাতে অরুর পাশে এসে দাঁড়ায় হ্যাভেন। ভ্রু কুঞ্চিত করে একপল দেখল অরু’কে। পরপর রাশভারী কন্ঠে বলে ওঠে,
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
” সবসময় নিজ মর্জিতে চলো। আজ কি হলো? ”
শাড়িতে পিন লাগাতে লাগাতে অরু ব্যস্ত হয়ে জোরালো কন্ঠে জবাব দেয়,
” বুঝলাম না। ”
” শাড়ি খোলো। ”
অরুর হাত থেমে যায়। পিন লাগানোর কথা ভুলে তড়িৎ গতিতে ঘাড় ঘুরায়। নেত্রদ্বয়ে বিস্ময় ঢেলে তাকায় হ্যাভেনের মুখমন্ডলে। চক্ষুদ্বয় বড়ো হয়ে কোটর ছেড়ে বেরিয়ে আসার উপক্রম। বিহ্বলিত ফাটা চক্ষু চড়কগাছ। কন্ঠে অবিশ্বাস নিয়ে শুধায়,
” হোয়াট আর ইউ সেইঙ? ”
হ্যাভেন শান্ত, স্থির। তার ভাবভঙ্গি স্বাভাবিক। জানায় সাবলীলভাবে,
” শাড়ি পড়ায় অভস্ত্য না, তাহলে পড়েছো কেন? আমি কি বলেছি শাড়ি পড়তে? ”
অরু পিটপিট করে চায়। গোমড়া মুখ থমথমে। কন্ঠ নিচুতে নিয়ে মিনমিন করে জানালো,
” কাকীমা বলেছেন, বিয়ের পর বাবার বাড়ি প্রথম গেলে শাড়ি পড়ে যেতে হয়। ”
হ্যাভেন অবাক সহিত ভ্রু উঁচিয়ে জিজ্ঞেস করলো,
” তুমি কারো কথায় কর্ণপাত করো? ওহ্ মাই গড! ডিড আই হিয়ার করেক্টলি? ”
অরু মুখ বাঁকায়। কথাটা গায়ে লাগলো। আসলে, ও কেন সায়রার কথা শুনতে যাবে? ইদানীং কি যে হয়! অরু বিরস মুখে বলে,
” জাস্ট ট্রেডিশনাল। ”
” চেঞ্জ করে ফেলো। মন থেকে না চাইলে, সবচেয়ে দামী গোর্জাস ড্রেস পড়লেও কাউকে সুন্দর লাগে না।”
হ্যাভেনের কন্ঠে কেমন তাচ্ছিল্য ভাব। অরু বেশি ভাবল না। মুখ কালো করে বলে,
” কি পড়বো? ”
ফোঁস করে তপ্ত শ্বাস ছাড়ল হ্যাভেন। ভেসে আসে কন্ঠনালী ভেদ করে গমগমে স্বর,
” তোমার অন্য কোনো ড্রেস নেই? অবান্তর কথা বলো! আলমারি ভর্তি জামাকাপড়। সেগুলো না হলে আমার ড্রেস পড়ো। ”
অরু মৃদু চোটে গেল। বাজখাঁই গলায় বলল,
” একদম ধমকে আমার সাথে কথা বলবেন না। কথাটা সুন্দর ভাবেও বলা যেত। ”
” তুমি ভালো কথার মানুষ? ”
অরু রাগান্বিত দৃষ্টি নিক্ষেপ করল। হ্যাভেন ঘড়িতে নজর বুলিয়ে ভরাট স্বরে আওড়াল,
” হয় কাকীমা’র কাছে গিয়ে ঠিকঠাক ভাবে শাড়ি পড়ে এসো। নয়তো দ্রুত অন্য ড্রেস পড়ো। তোমার কাছে সময়ের ভ্যালিউ না থাকলেও আমার কাছে আছে। সো হারি আপ। ”
অরু গেল না। ত্যাড়ামি করে ঠায় দাঁড়িয়ে। হ্যাভেন মৃদুস্বরে ধমকে চেঁচিয়ে বলল,
” কথার অবাধ্য হলে কিভাবে তোমাকে মানাতে হয়, সেটা খুব ভালো করে জানা আছে আমার। মেজাজ খারাপ হওয়ার আগে যা বলছি শোনো। ”
অরু ঠোঁট ফুলিয়ে, ফুঁসতে ফুঁসতে আলমারির নিকট পা বাড়াল। পেছন থেকে শুনতে পেলো হ্যাভেনের শান্তিপূর্ণ মনোমুগ্ধকর বুলি,
” কোনো সাজগোছ করবে না। পাগলামি করলে সেটার দহন তখন সহ্য করতে পারবে না। শুধু চাইলে কপালে টিপ আর চোখে কাজল দিতে পারো। ”
অরু সহসা মাথা এদিকে ফেরায়। হ্যাভেনের এত রসালো বুকে ধাক্কা লাগার মতো কথায় কর্ণপাত করল না। চোখ ছোট ছোট করে চেয়ে ভ্রু উঁচিয়ে কাটকাট জবাব দিল,
” সাজগোজ যদি ভালো না লাগে, তবে কপালের টিপ আর চোখের কাজল কেন ভালো লাগে? এগুলো কি সাজের বাইরে?
হ্যাভেন তেতে উঠল। কন্ঠ খাদে এনে চিবিয়ে চিবিয়ে জানায়,
” যা মন চায় করো। অ্যাজ ইউর উইশ। মাতাল করার পায়তারা চালালে, যখন শরীরে জখম করবো? তখন বুঝবে কত ধানে কত চাল! ”
অরু কটমট করে তাকায়। দাঁতে দাঁত পিষে টপস আর লং স্কার্ট নিয়ে ওয়াশরুমে ঢুকে পড়ল।
দিগন্তরেখায় সূর্যের রশ্মি যখন কুয়াশার পর্দা ভেদ করে ছড়িয়ে পড়ে, তখন মনে হয়, প্রকৃতি এক অনন্য শিল্পকর্ম এঁকে দিচ্ছে এই শীত সকালকে মোহময় করে তুলতে। তবু হিমেল বাতাসের নির্মম কামড় থেমে নেই। সে আপন অস্তিত্বের জানান দিচ্ছে অবিরত। শহরের ব্যস্ত রাস্তা, ঝলমলে হালকা সোনালি রোদ্দুর চোখ ধাঁধিয়ে দিচ্ছে।
হ্যাভেনের গাড়ি দ্রুত গতিতে ছুটে চলেছে আপন গন্তব্যে। জানালার কাঁচ নামানো। বাতাসে অরুর চুল উড়ছে অস্থিরভাবে। হাওয়ার প্রকোপে এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে ঝরঝরে কেশবহুল। অরু নয়ন ছোট করে, অল্প ঘেমে যাওয়া নাক কুঁচকে, বিরক্ত হয়ে উড়ন্ত চুল ঠিক করছে। ড্রাইভিং করার ফাঁকে আড়চোখে চেয়ে হ্যাভেন অবলোকন করছে এসব। ইচ্ছে করছে নিজের হাতে অরুর ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কেশবহুল যত্ন নিয়ে কানের পিঠে গুঁজে দিতে। চাইলেই কি সবসময় সেটা সম্ভব? মোটেই কাম্য নয়। বিধিবাম ইচ্ছা দমন করল অবলীলায়।
অরু নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে স্বীয় মনে চুপচাপ বসে। হ্যাভেনের দিকে একবার ফিরেও দেখছে না। নজর বাইরের চলন্ত গাড়ি, পথচারীদের চলাচলের উপর। হঠাৎ দৃষ্টি আটকে গেল রাস্তার ওপারে দাঁড়িয়ে থাকা এক পরিচিত মুখাবয়বে। নিখিল!
চোখের শিরা দপ করে উঠে অরুর। রাগে শ্বাস ভারী হয়ে এলো। অতীতের প্রতিটি প্রতারণা, প্রতিটি মিথ্যা কথা এক মুহূর্তে আগুনের ফুলকি হয়ে জ্বলে উঠল বুকের ভেতর। মুহূর্তের দেরি না করে চিৎকার করে উঠলো,
” স্টপ দ্য কার! ”
হ্যাভেন চমকে ওঠে, ব্যস্ত ভঙ্গিতে ব্রেক কষলো। অরুর ছটফট কণ্ঠে ঘাবড়ে গিয়েছে কিছুটা। ব্রেক চাপতেই গাড়ি ধাক্কা খেয়ে স্থির হলো। অরু স্থির হয়ে বসে থাকেনি। তৎক্ষনাৎ হনহন করে গাড়ি হতে নেমে গেল। সারা শরীরে তীব্র ঘৃণার আগুন জ্বলতে লাগলো। চোখ দুটো কিঞ্চিৎ রক্তলাল। ফোঁস ফোঁস শব্দ করে নিখিলের দিকেই এগিয়ে গেল সে। পেলব হস্ত মুষ্টিবদ্ধ। সারা শরীর কাঁপছে ক্রোধে।
নিখিল চোরা নেত্রদ্বয়ে মণি ঘোরাচ্ছে চারপাশে। হাতে একটা ডাক্তারি কালো ব্যাগের মতো। অধীর আগ্রহে কারো জন্য প্রতীক্ষা করছে হয়তো! অকস্মাৎ নরম হাতের শক্তপোক্ত থাপ্পড় গালে পড়তেই ভড়কে গেল সে। তখনো বুঝতে পারছে না কী ঘটেছে। পরমুহূর্তে পুনরায় আগের তুলনায় বিকট তীব্র শব্দ বাতাস কেটে গিয়ে ধাক্কা খেলো অপর গালে। অরু তাকে আবারও থাপ্পড় মেরেছে। এক মুহূর্ত স্তব্ধতা। রাস্তায় গুমোট বাতাবরণ থমথমে রূপ নিয়েছে। চারপাশের কোলাহল মুহূর্তেই নিরবতায় ছেয়ে গিয়েছে, এই দুই মুখোমুখি দাঁড়িয়ে থাকা মানুষের সামনে। গালে জ্বালাপোড়া করছে নিখিলের। রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকা মানুষেরা তাকিয়ে রইল বিস্ময়ে। নিখিল নিজেও বিশ্বাস করতে পারছে না এমনটা! অরুর হাত নিখিলের টি-শার্টের কলারে। নিখিলের গালে লাল ছাপ স্পষ্ট হয়ে ফুটে উঠেছে। চোখেমুখে হতবিহ্বল, অপমান আর ক্ষোভের ছাপ। অবাক হয়ে ফ্যালফ্যাল নিস্প্রভ চাহনিতে তাকিয়ে রয়েছে।
কিন্তু অরু চুপ করে থাকল না। কলার শক্ত করে চেপে ধরল। চোখ থেকে আগুন ঝরিয়ে কর্কশ আওয়াজে বলে উঠলো,
” তুমি একটা নোংরা, নীচ, পঁচা রক্তের কীট! আমার জীবনে তোমাকে জায়গা দিয়ে আমি নিজেকেই অভিশপ্ত করেছি! কতটা বিকৃত মস্তিষ্ক একজন মানুষ হলে তুমি এমন প্রতারণা করতে পারো? এরকম নোংরামি করে ধরা পড়ো! কী ভেবেছিলে, তোমার মিথ্যার বাঁধনে আমি আজীবন বন্দী থাকব? তোমার মতো নোংরা প্রাণীকে ভালোবেসে আমি নিজেকে ধিক্কার দেই আজ! ”
নিখিল নিজেকে সামলে নিলো। আলগোছা কলার ছাড়িয়ে নেয়। ঠোঁটের কোণে বিদ্রূপের হাসি ফুটিয়ে বলল,
” প্রতারণা কোথায় করেছি? আমি কি কখনও নিজের মুখে তোমাকে ভালোবাসি কথাটা বলেছিলাম? বলিনি। তুমি এতটা নির্বোধ ছিলে, তাই নিজের ভুল ভাবনার দরুন প্রতারিত হয়েছো! এখন এই ড্রামা করে কি প্রুফ করতে চাইছো?”
অরুর শরীর আবার কেঁপে উঠল ঘৃণায়। রক্তিম চোখে রক্তজবা ফুল ফুটছে যেন! তিরতির করে কাঁপছে ঠোঁট আর শরীর থরথর করছে রাগে। নিখিলের কণ্ঠে এতটাই বিষ, যে বাতাসও ভারী হয়ে উঠল।
রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকা মানুষের পরোয়া না করে, অরু ক্ষেপে উঠে বাজখাঁই গলায় বলে,
” ড্রামা? তুমি ড্রামার কথা বলছো, নিখিল? তুমি! যার নোংরা মন আর কালো হৃদয় কেবল প্রতারণা আর মিথ্যার কারখানা! কতটা ফালতু হলে একটা মানুষের বিশ্বাস নিয়ে খেলতে পারে দিনের পর দিন। ভালো মানুষের মুখোশের আড়ালে থেকে ধোঁকা কিভাবে দিতে হয়, সেটা তোমার থেকে শেখা উচিত। আর তুমি আমাকে বলছো আমি ড্রামা করছি? দ্যাটস গ্রেট! তুমি খুব ভালো করে জানতে আমি তোমার প্রতি ইন্টারেস্ট। তবুও আমার সাথে কাজকর্মে, কথাবার্তায় অবলীলায় ভালোবাসার ড্রামা করে গিয়েছো। আমার সাথে এমন ভাবে ট্রিট করতে, যেন তুমিও আমায় ভালোবাসো। তোমার মতো নোংরা মস্তিষ্কের জীবাণুকে ভালোবেসে আমি আমার আব্বুর সাথে মিস-বিহেভ করেছিলাম। নিজের পছন্দ আর অস্তিত্বকে ঘৃণা হচ্ছে আমার!”
নিখিল তাচ্ছিল্য হাসে। ব্যঙ্গ করে বলে,
” এসব সো কোল্ড ড্রামা জাস্ট অফ করো, অরু! তুমি জানো, তুমি এখন ঠিক কোথায় দাঁড়িয়ে আছো? আমার সামনে! আমি চাইলে তোমার এই অহংকার এক মুহূর্তেই গুঁড়িয়ে দিতে পারি!”
অরুর মুখ শক্ত হয়ে গেল। ক্ষুব্ধ হয়ে চিবিয়ে চিবিয়ে বলল,
” গুঁড়িয়ে দিবে? কি করবে তুমি? একটা পঁচা রক্তের কীট, যার অস্তিত্বই কেবল মিথ্যার ওপর দাঁড়িয়ে! আমি তোমার সামনে দাঁড়িয়ে আছি। ভয় পাচ্ছি না, আর কোনোদিন পাবোও না! তোমার প্রতারণার মুখোশ আমার সামনে উন্মুক্ত। ”
নিখিল চোয়াল শক্ত করে, চোখ রাঙিয়ে এগিয়ে এলো। কণ্ঠে খাদে টানল সহসা। জানান দিল একপ্রকার ক্রুর হুমকি,
” চুপচাপ নিজের রাস্তা মাপো। আমি যদি সত্যি আমার রাগ দেখাই, তাহলে তুমি…. ”
অরুর কণ্ঠে বজ্রপাতের মতো ঝাঁঝালো তীব্রতা। রুষ্ট গলায় মৃদূ চটে গেল। তিরিক্ষি মেজাজে জানতে চাইল,
” তাহলে কী? আমাকে মারবে? আবারও প্রতারিত করবে? আবার মিথ্যে বলবে? আমাকে ভাঙতে চাও? এবার আর পারবে না! কারণ আমি সেই অরু নেই, যে তোমার মিষ্টি মিথ্যায় গলে যাবে!”
নিখিলের দেরি হচ্ছে। মেজাজ খারাপ হয়ে যাচ্ছে চরম ভাবে। গ্রীবা বাঁকিয়ে একপাশে মুখ ঘুরিয়ে ফুঁ দিয়ে বিরক্তিকর গরম বাতাস বের করল। পরপর কঠিন গলায় বলল,
” ড্রামা শেষ হলে এবার যেতে পারো। নয়তো সত্যি থাপ্পড় এর জবাব এই ভরা শোরগোল রাস্তায় দিবো। তোমার স্বামীর কাছে ফিরে যাও! আমার সামনে এসে এই বাজে ড্রামা করার মানে কী? নাকি স্বামী তাড়িয়ে দিয়েছে? তাই এখানে এসে এসব ঢং করছো? ”
অরুর চোখমুখ বিদ্যুতের মতো ঝলসে উঠল।
” আমার স্বামীর কথা তোমার কুৎসিত মুখে উচ্চারণ করবে না। তুমি তার নখের যোগ্য না। তুমি নিজেকে কী ভাবো? তোমার কাছে ফিরে আসার জন্য বসে আছি? তোমাকে থাপ্পড় দেওয়ার জন্য হাতটা নিশপিশ করছিল, তাই এসেছি। তোমার মুখটা দেখলে আমার শরীরে আগুন ধরিয়ে দেয়। তোমার নাম আমার মুখে ঘৃণা এনে দেয়! ”
নিখিল ক্রোধের দাবানলে বশিভূত হয়ে হাত উঠিয়ে, অরু’কে মারতে উদ্যত হয়। সেই মুহূর্তে হ্যাভেন এসে হাতের কব্জি চেপে ধরে। ভাসা ভাসা সুগভীর চোখে ভয়ানক শীতল দৃষ্টি। হ্যাভেনের উপস্থিতি আর নিগূঢ় চোখের চাহনি পুরো পরিবেশটা জমে গেল। মানুষজন যে যার গন্তব্যে প্রস্থান করছে। হ্যাভেন’কে দেখে নিখিল শুষ্ক ঢোক গিলল। পিছিয়ে গেল দু’কদম। হাতের কব্জি বন্দী হয়ে আছে হ্যাভেনের বলিষ্ঠ হাতের বেড়াজালে।
হ্যাভেন ঠোঁটে দুর্বোধ্য হাসি টেনে নরম কন্ঠে বলে ওঠে,
” এত নীচে নেমে যেও না, নিখিল। অরুকে অপমান করার অধিকার তুমি হারিয়েছো অনেক আগেই। শুধু অরু না, যেকোনো মেয়েকে সবার আগে সম্মান করতে শেখো। তাহলে এভাবে জনসম্মুখে মেয়েদের হাতে থাপ্পড় খেতে হবে না।”
হ্যাভেন হাত ছেড়ে দিল। নিখিল কপালের ঘাম মুছে আরেকটু পিছিয়ে গেল। হ্যাভেনের চোখের দৃষ্টিতে চোখ বোলালো একবার। সেই ধারালো তীক্ষ্ণ দৃষ্টি নাড়িয়ে দিল নিখিলের ভীতিকর সত্তা। গুরুগম্ভীর দৃষ্টির অন্তরালে লুকায়িত কাঠিন্য চাউনী, যেন তাকে ইশারা করে বলছে,
” নিখিল যদি আর একটাও কটুবাক্য উচ্চারণ করে অরু’কে কিছু বলো, তাহলে পরিণতি ভয়ানক হবে। ”
নিখিল চলে যাওয়ার জন্য পা বাড়ায়। তক্ষুণি পেছন থেকে শুনতে পেলো অরুর রাগান্বিত ঘৃণামিশ্রিত চওড়া বাক্য,
” আমি তোমার এই অভিশপ্ত মুখ আর দেখতে চাই না! ভুলেও আর কখনো আমার সামনে আসবে না। ইউ ব্লাডি চীটর! ”
অরুর বুক জ্বলছে ক্ষোভে, ঘৃণায়, হতাশায়। কিছুক্ষণ পরপর ঢকঢক করে পানি পান করে গলা ভেজাচ্ছে। হ্যাভেন চুপচাপ দক্ষ হস্তে ড্রাইভিং করছে। পাশে বসে অরু নিরবে নিভৃতে অশ্রু বিসর্জন দিচ্ছে। গাড়িতে এক বাক্স টিস্যু ছিল। সবটা শেষ অরুর নাকের আর চোখের জল মুছে। গাড়ির সম্মুখের মিররে একপল চেয়ে, হ্যাভেন সর্বশেষ টিস্যুটা অরুর নিকট এগিয়ে দিল। অরু নিলো। থেমে থেমে নাক টেনে পরিষ্কার টিস্যু চোখের পলকে অপরিষ্কার করল মুহূর্তে।
হ্যাভেন ঠোঁট কামড়ে মিটিমিটি হাসল। মুখবিবর সিরিয়াস করে, স্থুল ভরাট কন্ঠে বোঝানোর স্বরূপ বলে ওঠে,
” সর্বদা একটা কথা মাথায় রেখো। যে তোমাকে ভালোবাসবে, সে তোমার সম্মানকে রক্ষা করবে। আর যে তোমাকে ঘৃণা করবে, সে তোমার সম্মানে আঘাত করার চেষ্টা করবে। ”
অরু লাল আভায় ছেয়ে যাওয়া মুখশ্রী, হ্যাভেনের দিকে তাক করল। নিস্প্রভ গলায় সচকিত হয়ে প্রশ্ন ছুঁড়ল,
” আপনি কি আমার সম্মানে আঘাত করেন নি? ”
হ্যাভেন’কে অবাক কিংবা উদ্বিগ্ন দেখা গেল না। লম্বা শ্বাস টেনে ভারিক্কি নিঃশ্বাস ছাড়ল। ড্রাইভিং করায় মনোযোগ দিয়ে ঠাণ্ডা অথচ ধ্রুব গলায় বলল,
” এক বাচ্চার বাবাকে বাধ্য হয়ে বিয়ে করেছো, সেজন্য ভাবছো আমি তোমার সম্মানে আঘাত করেছি? ”
প্রেমপিপাসা পর্ব ১৪
অরু হোঁচট খায়। কাঠিন্য মুখটা চুপসে গেল। ও এরকমটাই ভাবছিল। থমথমে বিরস মুখে ভাঙা গলায় আওড়াল,
” আমাকে বিয়ে করার কারণ জানতে পারি? আপনাকে বিয়ে করার জন্য হাজারো মেয়ে, মেয়ের বাবা-মা অতি আগ্রহে বসে আছে। বড়োলোক বাড়ির ছেলে কে-ই বা হাত ছাড়া করতে চাইবে? পৃথিবীতে সুন্দরী মেয়েদের অভাব নেই। তাহলে আমিই কেন? ”
অরু এই নিয়ে দুইবার প্রশ্নটা করেছে। বিনিময়ে হ্যাভেন মৃদু হাসল। প্রতিবারের ন্যায় এবারেও নিশ্চুপ থাকল। প্রত্যুত্তরে কিছু বলল না। কোনো প্রতিক্রিয়া দেখাল না। অরু হতাশার দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল। গাল ফুলিয়ে, গোমড়া মুখে বসে রইল।