রং পর্ব ১৩

রং পর্ব ১৩
তন্নী তনু

পৃথিবীতে অনেক ধরনের মানুষ আছে। তাদের মধ‍্যে কেউ রুপের প্রেমে পড়ে আর কেউ হয়তো ব‍্যক্তিত্বের।তবে রিমা তো ভালোবেসে ছিলো একজনের অসহায়ত্ত্ব দেখে।সেদিন……..এক ভয়াভহ দূর্ঘটনার সম্মুখীন হয় তারা।
সেদিন ঘুম থেকে উঠে সকাল সকাল বেড়িয়েছিলো রিমা।প্রথমে ব‍্যাংকে টাকা জমা দিবে তারপর সারাদিন তিন বান্ধবী মিলে পুরো শহর দাপিয়ে বেড়াবে। সেই উদ্দেশ‍্য সিএনজি তে উঠে বসে তিনজন। তিন জন একসাথে হলে পুরো দুনিয়া ভুলে বসে তারা। সেদিনও গল্পে গল্পে তোলপাড় অবস্থা।হঠাৎ সিএনজি চালকের ফোন আসে।ফোন রিসিভ করেন চালক। কথা বলার তালে অসাবধানতাবশত সামনে থাকা বাইককে ধাক্কা মারে।

ছেলেটি বাইক থেকে ছিটকে পড়ে। সিএনজি সামনে চলে যায়। পিছনে থাকা চলন্ত বাসের চাকায় পিষে যায় ছেলেটির পা। সিএনজি তে থাকা তিনজন-ই আঘাত পায়।সিএনজি চালক সিএনজি রেখে পালিয়ে যায়। রিমা সহ বাকিরা সিএনজি থেকে বের হয়। পড়ে থাকা ছেলেটির মুমূর্ষু অবস্থা,জ্ঞান নেই। মুখ দেখে চমকে যায় রিমা। রিমা ছেলেটিকে চেনে। ছেলেটির নাম শুভ্র। ভালো চিত্র আঁকে। রিমা দেখতে পারে না ছেলেটির এই অবস্থা।চোখ বন্ধ করে থাকে। রাস্তার মানুষ বাস চালককে টেনে নামায়।

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

কিছু মানুষ মিলে ছেলেটিকে হাসপাতালে নেন। রিমা,সিনথিয়া আর তিথিও যায় সাথে।শুভ্র’র কললিস্টের প্রথম নম্বরে কল দিলে কিছু ছেলে বন্ধু আসে। কিন্তু পরিবারের কেউ আসেনা। ছেলেটির ইমারজেন্সি অপারেশন করানো প্রয়োজন। কিছু ফরমালিটিস এর জন‍্যে ছেলেটির পরিবার’কে প্রয়োজন। কিন্তু তার বন্ধুরা জানায় ছেলেটির পরিবার নেই। একটা বোন আছে সেও দেশের বাইরে থাকে। রোগীর পরিবারের অনুপস্থিতি আর টাকা জমা না করার কারণে ফেলে রাখা হয় ওভাবেই ছেলেটিকে। রিমার নরম মনটা সেদিন হুহু করে উঠেছিলো। কেনো উঠেছিলো তার কারণ জানা নেই। একজন অসহায় ছেলের পাশে দাঁড়ানোর জন‍্যে মনটা ব‍্যাকুল হয়ে উঠেছিলো। প্রথম বারের মতো সে একটা বড় সিদ্ধান্ত নেয়। হাসপাতালের রিসিভশনে দাঁড়িয়ে রিসিভশনিস্ট কে বলে,

— একটু আগে এক্সিডেন্ট হওয়া পেশেন্ট’র ট্রিটমেন্টের জন‍্যে কি কি ফরমালিটিস আছে!
–জ্বি ম‍্যাম! পেমেন্ট করতে হবে আর বন্ডে সাইন করতে হবে।
— এমাউন্ট?
— ফিফটি কে দিলে ট্রিটমেন্ট শুরু হবে!বাকিটা পরে পেমেন্ট করা যাবে।
–এজ আ ফ্রেন্ড- আমি বন্ড এ সাইন করতে চাই। হবে?
— ওনার ফ‍্যামিলি’র সদশ‍্য প্রয়োজন।
–শুভ্র’র ফ‍্যামিলি নেই। পরিবারের পর সবচেয়ে কাছের মানুষ হলো বন্ধু। আমি শুভ্র’র বন্ধু,আমিই শুভ্র’র পরিবার। আপনি সব রেডি করুন। আমি পেমেন্ট করে দিচ্ছি।
সেদিন রিমার অন‍্য রুপ দেখা দেখেছিলো তিথি,সিনথিয়া। তারা তো অবাক হয়ে তাকিয়ে ছিলো। রিমা যা করছিলো তাতে মনে হচ্ছিলো সে ফিফটি থাউজেন না ফিফটি হান্ড্রেট টাকা পেমেন্ট করতে চাচ্ছে। সিনথিয়া রিমা’কে টেনে নিয়ে বলে,

— তুই ওকে চিনিস?
— হুম!
— কি হয় তোর?কখনো তো বলিসনি?
–বন্ধু!
— কোথাকার বন্ধু! বলিস নি তো?আর এতো টাকা পাবি কোথায়?
–বাবার ভিসার ডেইট শেষ। ঐখানে টাকার প্রয়োজন তাই এই মাসে কোনো টাকা পাঠায়নি। গতবছর মামা”কে একলাখ টাকা দিয়েছিলো বাবা। সানডে মামা টাকা দিয়ে গেছে। আম্মুর কাছে গোছানো কিছু টাকা আছে। তাই বললো বাকি টাকা ব‍্যাংকে রেখে আসতে। টাকা নিয়ে বের হয়েছিলাম আজ। সামনেই তো ব‍্যাংক। ভেবেছিলাম নেমে জমা দিয়ে চলে যাবো।

–পাগল তুই! ঐ টাকা এখানে দিবি?
তোর মা তোকে মেরেই ফেলবে….
— আগে তো মানুষের জীবন। আমি শুধু ফিফটি কে দিবো! ওনার জ্ঞান ফিরলে ব‍্যাক নেওয়া যাবে….
— তুই আন্টিকে কি করে ম‍্যানেজ করবি? আর ছেলেটি যদি টাকা ব‍্যাক না দেয়? মানে না দিতে পারে….
— না দিলে নাই! নতুন টিউশন হয়েছে দুটো। টাকা পরিশোধ করতে দশ মাস লাগবে!
— আন্টি যদি বুঝে যায়?
— বুঝবে না। এতো কিছু সে বোঝে না। দশ মাসের মধ‍্যে টাকা জমা দিয়ে দিবো ব‍্যাংকে।

শুভ্র”র ট্রিটমেন্ট শুরু হয়। রিমা,সিনথিয়া,তিথি সারাদিন ওখানেই থাকে। রাতে বাসায় ফেরে। সারারাত ঘুম হয় না রিমার। ভোরের আলো ফুটতেই সে উঠে পড়ে। সিনথিয়া,তিথি কে নিয়ে দশটা নাগাদ হাসপাতালে যায়। ছেলেটির জ্ঞান ফিরেছে। তার ছেলে বন্ধুরা ইতিমধ্যে রিমার কথা বলেও ফেলেছে শুভ্রকে। রিমা প্রথমেই ডাক্তারের কাছে ছেলেটির কন্ডিশন জিজ্ঞেস করে। ডাক্তার বলেন,”বাম পা ঠিক হতে নাও পারে।” রিমা ছেলেটির সাথে দেখা করে। সেখান থেকে শুভ্র”র সাথে ভালোভাবে পরিচয়। পরিচয় থেকে প্রনয়।সেই সূত্র ধরে শুভ্র”র বাসায় কয়েকবার আসা যাওয়া করেছে সে। শুভ্র”র নিজের বাসা নয়। বাসাটা তার বোনের। বোন দেশের বাইরে। পুরো বাসা জুড়ে সে একাই থাকে।

একপর্যায়ে দুজনের মনে একটা ভয় ছিলো। যদি রিমার পরিবার না মানে? বাবা মা কখনোই চাইবে না তার মেয়েকে এমন মানুষের হাতে তুলে দিতে।সেই জায়গা থেকে রিমা জোরাজুরি করে গোপনে বিয়ে জন‍্য।বাকিটা সে দেখে নিবে। রিমা”র জেদের কাছে হেরে গিয়ে শুভ্র রিমাকে গোপনে বিয়ে করে। সেই সূত্রে এই বাসা তার ভিষন চেনা।প্রাইভেট আর ভার্সিটি ফাঁকি দিয়ে- অনেকবার ই তো এই বাসায় এসেছে সে। এই সাইড ঢেবিলের ড্রয়ারে রাখা ফটোফ্রেম তো তাদের বিয়ের দিনের। শুভ্র”র ফোনে শুভ্র”র ক্লিকে তোলা ছবি। তারপর ফ্রেম বন্দি করা হয়েছে।রিমা যখন এখানে আসতো, ফ্রেমটা সাইড টেবিলে রাখতো। আবার যাওয়ার সময় ড্রয়ারে রেখে যেতো। কতো স্মৃতি কত ভালোবাসার মূহুর্ত এই চারদেয়ালের মাঝে জমে আছে। রিমা কি সেই রুম চিনতে ভুল করতে পারে?বুকের মধ‍্যে হঠাৎ করেই উথালপাতাল ঝড় শুরু হলো রিমার। এতো বিশ্বাস এতো ভরসা এতো ভালোবাসার মানুষটা শেষ পর্যন্ত তাকে কিডন‍্যাপ করলো? কিন্তু কেনো! রিমা ধীর পায়ে আবার আগের জায়গায় ফিরলো।এতোক্ষণের বেঁধে রাখা যে হাত দু’টো প্রাণপণে চেষ্টা করে খুলেছিলো।সে বাঁধনে পেঁচিয়ে নিলো নিজের হাত। ভালোবেসে যে মানুষ তাকে ঠকালো তার হাতে মরার জন‍্যে সে প্রস্তুত।

ইরফাদ গাড়ির স্পিড বাড়াচ্ছে আবার লুকিং গ্লাসে চোখ রেখে প্রয়োজন বুঝে কমিয়ে নিচ্ছে। বারবার বাইরে তাকানো,হাতের রিভলবার খেয়াল করে সিনথিয়া। ইরফাদর দৃষ্টির দিকে লক্ষ করতে থাকে। কিছুক্ষণ পর বুঝতে পারে পেছনের গাড়ি তাদের লক্ষ করছে। সিনথিয়া চুপচাপ পুরো বিষয়টা বোঝার চেষ্টা করে। তারপর ধীর গলায় বলে,

— কোনো প্রবলেম?
অভিজ্ঞতা আর কৌশলে একটানে দাপিয়ে ছুটে চলে ইরফাদের গাড়ি।পিছু নেয় পেছনের গাড়িটি। আজকে যেনো লুকোচুরি নেই। সামনাসামনি খেলা। ইরফাদ গাড়ির স্পিড বাড়ায়। পেছনের গাড়িও ছুটে আসে বাঘের মতো। যেনো এখন-ই গিলে খাবে।নিজের কৌশলে গাড়িটি শহরের বাইরে নিয়ে যায়। জনমানহীন সোজা রাস্তা। সিনথিয়া ধীর গলায় বলে,
— কোথায় যাচ্ছি আমরা?
ইরফাদ দক্ষ হাতে গাড়ি রাস্তার পাশ ঘেঁষে নেয়। পেছনের গাড়ি তাদের ছুঁইছুঁই। ইরফাদ তার সূচালো দৃষ্টি রাখে লুকিং গ্লাসে। সাইড গ্লাসের কাচ নামিয়ে দেয়। পাশাপাশি বলে,

— কেউ ফলো করছে আমাদের!
সিনথিয়া তড়িঘড়ি করে পেছনে তাকায়। পেছনের গাড়ি তাদের গাড়ি ছুঁই ছুঁই। ইরফাদ গাড়ির স্পিড কমায়। পেছনের গাড়ি তালসামলাতে না পেরে সামনের গাড়ির মাঝামাঝি আসে। ইরফাদ দক্ষ হাতে গাড়ির চাকা বরাবর রিভলভার তাক করে। সাইল‍্যান্সার লাগানো রিভলভারের-নিশানা মিস করে।পেছনের গাড়ির লোকগুলো গাড়ি চালাতে ভালোই দক্ষ। না হলে কি করে বিপদ বুঝে গাড়ি পিছিয়ে নিতে পারতো না। ইরফাদ আবারো গাড়ির স্পিড বাড়ায়। রাস্তার পাশ ঘেঁষে থাকা গাছগুলো যেনো নিজেরাই ছুটে পেছনে চলে যাচ্ছে। ইরফাদ সবকিছুর ফাঁকে সিনথিয়ার দিকে তাকায়। মুখটা ভারী থমথমে। যেনো বিশেষ কিছু নিয়ে ভাবছে। ইরফাদ গাড়ি চালানোর ফাঁকে একবার বলে,

— ভয় পাচ্ছো?
ঐটুকু কথাতেও সিনথিয়া কেঁপে ওঠে। সে ইরফাদের দিকে তাকায়। ইরফাদের দৃষ্টি আবারও লুকিং গ্লাসে। সিনথিয়া অবাক চোখে তাকায়। এই মানুষটা কি মন পড়তে জানে। এতো সব কি করে ধরা পড়ে তার চোখে? চুপচাপ বসে সে সে মাথা নাড়ায়। ইরফাদ এর ফাঁকে আবারও বলে,
— ভয়ের কিছু নেই!
সিনথিয়া জানে একজন এসপি পাশে থাকা মানে সে যতেষ্ট নিরাপদ!তবে পেছনের মানুষগুলো কেনো পিছু নিচ্ছে? কারণ কি? ইরফাদ! নাকি সে! ইরফাদ পাশ ফিরে সিনথিয়ার দিকে। তারপর বলে,
— ব্রেক! রেডি?

সিনথিয়া ইরফাদের চোখের দিকে তাকায়। এখন ব্রেক কেনো দিবে? থেমে গেলে তো পেছনের লোকগুলো এসে ধরবে। তাহলে? প্রশ্ন গুলো মনে মনে ভাবে। আর মাথা নাড়িয়ে সম্মতি দেয়। চলন্ত গাড়ি সাইড করে ব্রেক চেপে দেয় ইরফাদ। পেছনের গাড়ি ছুঁইছুঁই। দূর্ঘটনা এড়াতে সাইড কেটে সামনে চলে যায় পেছনের গাড়ি । ইরফাদ গাড়ি স্টার্ট দেয় আবার। গাড়ির চাকা পাঞ্চার করার জন‍্যে গাড়িটি”কে সামনে আনা দরকার।পেছনের গাড়িতে কতজন আছে কি উদ্দেশ্য বোঝা যাচ্ছে না। গাড়ি থামিয়ে মুখোমুখি হওয়ার আগে ভালোভাবে পর্যবেক্ষণ করা দরকার। একা হলে তার কোনো চিন্তা ছিলো না। তবে পাশে থাকা মেয়েটি এখন তার দায়িত্বে। ইরফাদ গাড়ি-র স্পিড বাড়ায়। পাশাপাশি হয়ে দেখার চেষ্টা করে গাড়িতে ঠিক কত জন। থাই গ্লাসের কারণে পেছনের সব আবছা।সামনের গাড়ির চাকা বরাবর রিভলবার তাক করে। এইবার নিশানা বরারব লাগে। গাড়ি থেমে যায়।নিজের গাড়ির দরজা ঠেলে বের হয় ইরফাদ। সামনের গাড়ির লোকগুলো গাড়িতেই বসে আছে। ইরফাদ জানালায় দাঁড়িয়ে নিচু হয়ে উঁকি দেয়। ভেতরে সিনথিয়া চুপচাপ বসে আছে। ইরফাদ বলে,

— “শুয়ে পড়।”
গাড়ির ওপাশ থেকে গলার স্বর শোনা না গেলেও ইশারা ঠিক-ই বোঝে। ইরফাদ এখনো জানালায় দাঁড়িয়ে। ইরফাদের সিটে মাথা রাখে সিনথিয়া। জানালায় দাঁড়িয়ে থাকা ইরফাদ উঁচু স্বরে বলছে,
— গাড়ি থেকে নামবে না! ও..কে?

সিনথিয়া মাথা ঝাঁকায়। ইরফাদ চলে যায়। তবে বেশীক্ষণ তার মন শায় দেয় না। কেনো যেনো শুয়ে থাকতে পারে না সে। কি হচ্ছে দেখার আগ্রহে চোখে তৃষ্ণা জেগে যায়। সে উঠে বসে। সামনের গাড়ি থামানো। ইরফাদ কৌশলে এগিয়ে যাচ্ছে। সামনের গাড়ির লোকগুলোকে দেখা যাচ্ছে না। আবার গাড়ি থেকে নামছেও না। ইরফাদ ঐ গাড়ির জানালার কাছে যায় সাবধানে। রিভলবারের দু’টো বুলেট অলরেডি শেষ। বাকি চারটা সে বিনা কারণে ব‍্যবহার করবে না। রিভলভার তাক করে রেখে সামনের গাড়ির দিকে যায় ইরফাদ। জানালায় টোকা দেয়। রিভলবার তাক করা দেখে সাইড গ্লাস নামিয়ে দেয় গাড়ির ভেতরের কেউ। ইরফাদ গমগমে গলায় বলে,

— হ‍্যান্ডস আপ!
ওদের কাছে কোনো অস্ত্র নেই। যা আছে তা দিয়ে রিভলবারের সামনে টিকতে পারবে না। তারা সকলেই হাত উপরে তোলে। একহাতে রিভলবার ধরে থাকে সাথে গাড়ির দরজা খুলতে বলে ইরফাদ। সাথে সাথে দরজার লক খুলে ভেতরের কেউ। সাথে সজোড়ে লাথি মারে গাড়ির দরজায়। ইরফাদের হাতের রিভলবার ছিটকে পড়ে নিচে। পাশের দরজা দিয়ে বাকিরা বেড়িয়ে সামনে দিকে প্রাণপণে ছোটে। রাস্তায় ছিটকে পড়া রিভলবার তুলে তাদের পিছনে ছোটে ইরফাদ। এদিকে সিনথিয়া একা গাড়িতে বসে থাকে।জানালায় তাকিয়ে দেখে নেয় পুরো পরিবেশ। চারপাশটা প্রায় জনমানবশূন‍্য,কোনো গ্রাম‍্য পরিবেশ। মাঝখান দিয়ে রাস্তা দুপাশে কোনো ক্ষেত হবে। আশে পাশে কোনো বাড়ি-ঘর নেই। রাস্তায় নেই কোনো লাইট। একা জনমানবশূন‍্য জায়গায় গাড়িতে বসে তার ভয় লাগতে শুরু করে। তবে অপেক্ষা করা ছাড়া তার তো কোন উপায় নেই। সে সামনে তাকিয়ে অধীর আগ্রহে তাকিয়ে থাকে। কেনো লোকগুলো পিছু নিলো? ধরার চেষ্টা করলো? আবার পালিয়েও গেলো।

রিমা অঝোরে ঝড়া বৃষ্টির মতো চোখের জল ফেলে। বুকের মধ‍্যে ঠকে যাওয়ার এক নির্মম ব‍্যাথা তাকে ঝাঝড়া করে দিচ্ছে। যে মানুষটা’কে অসহায় ভেবে পুরো পৃথিবীকে বাদ করে তার পাশে দাঁড়ালো আর সেই মানুষটা তাকেই বাদ দিয়ে দিলো। পুরো চার সপ্তাহ”র পিরিয়ড মিস। গত সোমবার শুভ্র”কে বলতে চেয়েও বলতে পারেনি সে। শুভ্র অন‍্য একটা বিষয় নিয়ে আপসেট ছিলো। এর মধ‍্যে অন‍্য কোনো প্রেশার দিতে চায়নি সে! আচ্ছা যদি নতুন প্রাণ তার মধ‍্যে এসে থাকে? তাহলে এই জীবনের কি হবে? আর নতুন প্রাণটার কি হবে? ভাবতেই ফুঁপিয়ে ওঠে সে!
সিনথিয়া”র অপেক্ষা শেষ হয় না। ইরফাদের জন‍্যে ভিষণ চিন্তা হচ্ছে।এতোগুলো মানুষের সাথে পেরে উঠবেন তো তিনি? রাতের আধারে শুকনো পাতার মরমরে শব্দে বুকের মধ‍্যে যেমন ধিরিম ধিরিম বাজে।সিনথিয়ার বুকের মধ‍্যে ধিরিম ধিরিম শব্দ হচ্ছে। হঠাৎ দূরে থেকে কোনো মানুষের আকার দেখা যাচ্ছে। সিনথিয়া চোখ বসিয়ে দেখে। ওরা একজন নয়।পুরো ছয় জন। তারা যেনো বাঁধ ভাঙা জলের ন‍্যায় তেরে আসছে তার দিকেই।সোজা হয়ে বসে সিনথিয়া। দরজা লক চেক করে। ভয়ংকর আকৃতির মানুষগুলো দরজার গ্লাস হকিস্টিক দিয়ে আঘাত করে। সিনথিয়া চুপচাপ গুটিশুটি মেরে বসে। সাহসের সঞ্চয় করে বলে,

— কি চাই!
ওপাশের শয়তান এর মতো দেখতে মানুষ গুলো বলে ওঠে।
–বের হ…..
সিনথিয়া”র হালকা কেঁপে ওঠে। ইরফাদের কোনো ক্ষতি হয়নি তো? সিনথিয়া চেঁচিয়ে ওঠে,
— কি চান আপনারা?
— দরজা খোল….
সিনথিয়া কিছুক্ষণ আগের কথা মনে পড়ে। ইরফাদ তাকে নামতে নিষেধ করেছিলো। সে তাই চুপচাপ বসে থাকে। ওপাশ থেকে শয়তানগুলো বলে ওঠে,
— নামবি না? ঐ ভাঙ দরজা!
সিনথিয়া তবুও দরজা খোলে না। ওপাশ থেকে কেউ একজন বলে ওঠে।

— “থাক থাক! এসপি”রে সাইজ কর! যা চাচ্ছি তা যদি না পাই আজ জান’এ মেরে ফেলবো।” সিনথিয়া বুক ধুক ধুক করে ওঠে। সাথে সাথে ফিরে তাকায়। দরজার লক খুলে দেয়। শয়তানের দল সিনথিয়া”কে টেনে নামায়। গাড়ি সার্চ করে। কাঙ্ক্ষিত বস্তু না পেয়ে সিনথিয়া”র হাত ধরে। সিনথিয়া চোখ শক্ত করে বলে,
— আমাকে ধরেছেন কেনো?ইরফাদ সাহেব কোথায়?
— বেঁধে রেখেছি! আমরা যা চাই তা না দিলে আজ ওকে মরতে হবে!

সিনথিয়া”র ভেতরে একটা শূন‍্য অনুভূতি হয়। আজ যদি মা”য়ের জন‍্য না কাঁদতো আজ এমন দিন আসতো না।সব তার জন‍্যেই হলো। সিনথিয়া চুপচাপ তাদের সাথে হাঁটে। চোখদুটো ইরফাদ”কে খুঁজে বেড়ায়। তার নিজের জন‍্যে আজ অন‍্যজন বিপদে। এতো এতো মানষিক প্রেশার আর নিতে পারছে না সে। সিনথিয়া”কে নিয়ে আসা হয় একটি বিল্ডিং এর নিচে। সে শুধু ইরফাদকে খোঁজে। একটি ভাঙাচোরা পরিত্যক্ত বিল্ডিং। চারপাশে ক্ষেত গুলো ঠিক কোথায় শেষ হয়েছে তা আন্দাজ করা যাচ্ছে না। একটা শক্তপোক্ত কাঠের চেয়ারে আঁটসাট করে বেঁধে রাখা হয়েছে ইরফাদ”কে। সিনথিয়ার চোখে রক্ত জমে যাচ্ছে। মন চাইছে সব বিলিন করে দিতে।

আশেপাশে অনেকগুলো শয়তান ওত পেতে আছে। লোকগুলো ইরফাদের কাছে কিছু চাইছে! ইরফাদের শক্ত চাহুনি বলে দিচ্ছে জীবন গেলেও সে জিনিস তারা পাবে না।সকলের হাতে হকিস্টিক! তারা পায়চারী করে যাচ্ছে। সিনথিয়া স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে! চোখ এপাশ ওপাশ ঘুড়িয়ে ফন্দি আটছে যেনো। সিনথিয়া দেখলো ইরফাদ বসে আছে মাথা নিচু করে। হকিস্টিক নিয়ে দাঁড়িয়ে দুজন ইরফাদের পিছনে আড়াআড়ি বাবে পায়চারি করছে। এর মধ‍্যে নতুন কারো আগমন। মানুষটাকে খুব চেনা লাগছে। সিনথিয়া ভ্রু কুচকে পর্যবেক্ষণ করে। ওনাকে তো থানায় দেখেছিলো সিনথিয়া। ইরফাদের আ‍্যসিস্ট‍্যান্ট! নামটা মনে করার চেষ্টা করে সিনথিয়া। বুকের ওপর লাগানো প্লেটে সে কয়েকবার দেখেছিলো। ছেলেটির নাম জাবির! সিনথিয়া অবাক হয়ে যায়। এ এখানে কেনো? আর ইরফাদের বিপক্ষেই বা কেনো? কেনো তাকে এভাবে বাঁধলো। জাবির ইরফাদের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। গমগমে বজ্রপাতের ন‍্যায় উচু গলায় বললো,

— কোথায় রেখেছিস বল!
ইরফাদ রক্তচক্ষুতে তাকায়। জাবির বলে,
— ঐ চোখ দেখিয়ে কোনো লাভ নেই। বল কোথায় রেখেছিস?
ইরফাদের চোখ মুখ আরও শক্ত হয়ে ওঠে। জাবির আচমকা শক্ত কঠিন হাতে সজোড়ে থাপ্পর বসায় এসপি”র গালে। সিনথিয়ার শরীরে বিদ‍্যুৎ খেলে যায়। ধ‍্যান জ্ঞান সব ভুলে পাশের লোকের হাত থেকে কেড়ে নেয় হকিস্টিক! ইরফাদ চোখ তুলে তাকায়। ঘুড়ে দাঁড়ায় জাবির! একি কান্ড। এই টুকু পুঁচকে মেয়ে দশ বারোজনের সামনে হকস্টিক নিয়ে দাঁড়িয়ে। একজন লোক তেড়ে যায় সিনথিয়ার দিকে।কেড়ে নিতে চায় স্টিক। সিনথিয়া শক্ত করে ধরে স্টিক। শান্ত-নরম সিনথিয়া হিংস্র বাঘিনীর ন‍্যায় ফুলে ফেঁপে ওঠে।একজন হাতের হকিস্টিক তার দিকে সজোড়ে আঘাত করার জন‍্য তুলতেই সিনথিয়া এগিয়ে আসে। রক্তচক্ষু, শক্ত চাহুনী।

নিরব সিনথিয়া এই প্রথম যেনো তার খোলস ছাড়ে। এগিয়ে দাঁড়িয়ে একহাতে ধরে ফেলে লোকটির স্টিক। অন‍্য হাতে কাঁধ ও মাথার সাইডে সজোড়ে আঘাত করে। লোকটি কাত হয়ে যায়। সিনথিয়া নিজের পায়ের সাহায‍্যে লোকটির পা’ প‍্যাঁচ দিয়ে ফেলে দেয়। লোকটি পুরো শুয়ে পড়ে। লোকটির হাতের স্টিক কেড়ে নিয়ে। শক্ত হাতে কনুই দিয়ে আঘাত করে হৃদপিণ্ডের উপর। লোকটি জ্ঞান হারায়। চারপাশে বাকি লোকগুলো গোল হয়ে দাঁড়ায়। মাঝখানে দাঁড়ায় সিনথিয়া। চারপাশে লোকগুলো গোল হয়ে ঘুড়ছে সিনথিয়া চোখ পাকিয়ে তাদের ফাঁদ বোঝার চেষ্টা করে।

তাদের আঘাত পড়ার আগেই সিনথিয়া পাশের লোকটির বাহু ও বুকের সাইডের ফাঁকা জায়গায় পা শূন‍্য তুলে লাথি মারে। অপর পা”সহ নিজেকে ঘুড়িয়ে কান গলার মাঝামাঝিতে লাথি মারে। লোকটি ধপাস করে পড়ে। মার্সাল আর্ট এর প্রশিক্ষণ প্রাপ্ত মেয়েদের মতো মিনিটের মধ‍্যে কাত করে ফেলে বাকিদের! জাবির ততোক্ষণে রিভলবার ধরে ইরফাদের পেছনে দাঁড়ায়। বাকি একজন কৌশলে সিনথিয়ার পেছন থেকে গলা পেঁচিয়ে ধরে। রিভলবার ঠেকায় সিনথিয়ার মাথায়। সিনথিয়া চুপ করে থাকে ত্রিশ সেকেন্ড।হাত দুটো উপরের তোলার ভঙ্গিতে একহাতের মুষ্টি শক্ত করে। আড় চোখে দেখে নেয় রিভলবার। তারপর মারে থুতনি বরাবর। অন‍্যহাতে কেড়ে নেয় রিভলবার। ঝড়ের গতিতে বাতাসেরও আগে ছোটে সিনথিয়া। জাবিরের কপাল বরাবর ধরে রিভলবারের নল। ট্রিগারে রাখে আঙ্গুল। এই জলজ‍্যান্ত অগ্নিশিখা সিনথিয়া”কে দেখে নিজেই অবাক হয় ইরফাদ। কতোগুলো পুলিশের সাথে লড়ে এখনো টিকে আছে সে? সিনথিয়া অগ্নিমূর্তি ধারণ করে মূহুর্তেই। বজ্রকন্ঠে বলে,

— রিভলবার নামান!
ইরফাদ দুজনের কান্ডগুলো উপভোগ করে।জাবির রিভলবার ইরফাদের থেকে তুলে তাক করে সিনথিয়ার কপালে! দুজন মুখোমুখি। গেম এখানে থামালেও চলবে। তবে ইরফাদ চুপচাপ দেখে। জাবির যদিও নিজের ফর্মে নেই। নেই রিভলবারে বুলেট।বানানো প্ল‍্যান অনুযায়ী সে একটু বাজিয়ে দেখবে সিনথিয়া কে। সিনথিয়ার এই রুপে কতদূর যেতে পারে দেখা দরকার। সিনথিয়া নিজের হাতের রিভলভার ছুড়ে ফেলে। জাবির ছোড়া রিভলবারের দিকে তাকাতেই নিজের কপালের উপর তাক করা রিভলবার কৌশলে ছিনিয়ে নেয়। পূনরায় তাক করে জাবিরের দিকে। ইরফাদ তখন–ই বলে উঠে,

— “ব্রিলিয়ান্ট!ব্রিলিয়ান্ট!” নিজের পেছনে নাটকীয় ভাবে বাঁধা হাত তুলে হাত তালি দেয় ইরফাদ। তারপর বলে,
— তা ম‍্যাডাম! মার্সাল প্রশিক্ষন প্রাপ্ত হয়েও- সেদিন নিজেকে বাঁচাতে আমাকে কেনো কল দিলেন?
সিনথিয়া হালকা কেঁপে ওঠে। একজন এসপি কতটা চালাক হলে এমন গেম খেলে!জাবির হাসি চাপিয়ে রাখতে পারে না। খানিকটা উঁচুস্বরেই হাসে। তারপর বলে,
— “স‍্যার! কি অবস্থা করেছে দেখেছেন? সবগুলোকে হসপিটালে নিতে হবে।” ইরফাদ আরেকপলক সামনে তাকিয়ে থাকে। তারপর বলে,
— “ওদের তোলো।” জাবির ইরফাদের দিকে তাকায়। গালটা লাল হয়ে আছে ইরফাদের। শরীরের বেঁধে রাখা দড়িগুলো খুলে দেয় জাবির। তারপর বলে,
— স‍্যার! ক্ষমা করবেন। থাপ্পরটা বেশী জোড়ে লেগেছে।
— আমি-ই তো দিতে বললাম! সরি বলার কি দরকার?
জাবির বললো,

— “তাহলে আপনি আসুন। ওদের গাড়িতে তুলছি আমি।” ইরফাদ মাথা নাড়ায়। জাবির চলে যায়। ইরফাদ নিজের পকেট থেকে মার্সাল আর্টের একটা সার্টিফিকেট বের করে। নিজের রিভলবার সিনথিয়ার কপালে তাক করে বলে,
— প্রথমত আপনাকে গাড়ি থেকে আনতে যাওয়া হলো-আপনি কি করে নিজেকে বাঁচান ঐটা দেখার জন‍্যে। নাহ! আপনি তো তা করলেন না। উল্টো তাদের সাথে এখানে এলেন।পাঁচ মিনিটের মধ‍্যে প্ল‍্যান চেঞ্জ করা হলো। নাটক কেমন হলো জানাবেন!সকল প্রশ্নের উত্তর তো আপনি নিশ্চয়-ই দিবেন! তবে আগে বলুন! আপনি আমাকে বাঁচাতে এতো মরিয়া কেনো হলেন!

রং পর্ব ১২

সিনথিয়ার চোখদুটো টলমল করে উঠলো। আজ সে ভয়ংকর ভাবে ফেঁসে গেছে। এই ফাঁস থেকে পৃথিবীর কেউ তাকে বাঁচাতে পারবে না।এসপি ইরফাদ”কে সে কেনো বাঁচাতে চাইছে সে তো জানে না! শুধু ইরফাদের তাক করা রিভলবার তার নরম হাতে ধরে।। ইরফাদের বলিষ্ঠ হাত পেঁচিয়ে নিয়ে- রিভলবারের নল নিজের বুকের বা পাশে ঠেকায়। তারপর ভেজা গলায় বলে,
— ওখানে না এখানে শ‍্যুট করুন!

রং পর্ব ১৪