প্রেমপিপাসা পর্ব ১৬
সুমাইয়া সুলতানা
শহুরে রাস্তার অত্যাধিক পরিমাণের কোলাহল পেছনে ফেলে, হ্যাভেনের প্রাইভেট গাড়ি এগিয়ে যাচ্ছে অরুর শৈশবের উঠোনে। গাড়ি যত এগিয়ে চলেছে, চোখের সামনে একের পর এক চেনাপরিচয় দৃশ্যপট ঘুরে যাচ্ছে। ছোটবেলার রোদেলা দুপুর, বারান্দার দোলনা, আপনজনদের খুনসুটি, বাবার আদুরে হাতের গন্ধ মাখা উষ্ণতা।
অরু যখন শুনেছে বাবার বাড়ি যাবে। এই ‘যাবে’ শব্দটা যত সহজে উচ্চারণ করা যায়, এর অন্তর্নিহিত অনুভূতির ওজন ততটাই ভারী। হৃদয়ের সুগভীর প্রদেশে কোথাও এক অনির্বচনীয় ব্যাকুলতা, শেকড়ের প্রতি আকুল টান, আবার বাস্তবতার অদৃশ্য শেকলে বাঁধা এক নারীর নীরব সংযম, চাপা অভিমান।
গাড়ি থামল পরিচিত লোহার গেটের সামনে। পুরোনো লোহার গেট, যা যুগের পর যুগ ধরে দাঁড়িয়ে আছে এই বাড়ির স্মৃতির প্রহরী হয়ে। গেটের রং কিছুটা ফিকে হয়ে এসেছে, পুরোনো কাঠামোর গায়ে মরীচিকা ধরেছে। অরুর মনে হলো, এই লোহা আর মরীচিকার গন্ধেই আছে শৈশবের সুবাস।
গাড়ি হতে দু’জন নেমে দাঁড়াল। অরু চোখ ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখে চলেছে সবকিছু। অধরে হাসির ঝলক দেখা যাচ্ছে চঞ্চল রমণীর। হ্যাভেন পলকহীন দেখছে তার নববধূকে।
গলা খাঁকারি দিল হ্যাভেন, মনোযোগ আকর্ষণের লক্ষ্যে। শান্ত কন্ঠে বলে,
” ভেতরে যাও। আমি তেমাকে নিতে আসতে না পারলে, গাড়ি পাঠিয়ে দিবো। তুমি চলে এসো। ”
অরু ভ্রু কুঞ্চিত করে হ্যাভেনের দিকে দৃষ্টি তাক করল। ভাবুকতা সমেত জানতে চাইল,
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
” আপনি কি চলে যাবেন? ”
” হ্যাঁ। ”
” না, আপনাকেও আসতে হবে। চলুন। ”
” যেতে পারবো না। তুমি যাও। ”
ক্ষেপে উঠল অরু। তিরিক্ষি মেজাজ নিয়ে জানায় কঠিন বাক্য,
” তাহলে এসেছেন কেন? আমারও আসার প্রয়োজন ছিল না। আমি বিয়ে মানি বা না মানি সেটা পরের বিষয়। নতুন জামাই শ্বশুর বাড়িতে বউ রেখে, শেয়ালের মতো লেজ গুটিয়ে পালিয়ে যাবে ব্যাপারটা কেমন দেখায়? বাড়ির জামাই এভাবে এসে চলে যাবে, লোকে শুনলে কি বলবে? নাকি খরচাপাতি করতে হবে ভেবে ভয় পাচ্ছেন?”
অরুর তেজি কথায় হ্যাভেন আলতো হাসল। সেই হাসি অরুর রাগ পূর্বের চেয়ে দ্বিগুণ বাড়াল। দাঁতে দাঁত চেপে কটমটিয়ে বলে,
” আপনি কি কখনো সিরিয়াস হবেন না? ”
হ্যাভেন বাঁকা হাসে। কন্ঠ খাদে এনে ভাব নিয়ে জবাব দেয়,
” আ’ম অলওয়েজ সিরিয়াস ম্যান। ”
অরু নাকের পাটাতন ফুলিয়ে ঝাঁঝালো গলায় বলল,
” বিনা তর্কে আমার সঙ্গে বাড়িতে আসুন। রাস্তায় দাঁড়িয়ে ঝগড়া করার বিন্দুমাত্র ইচ্ছা আমার নেই।”
হ্যাভেন ভাবলেশহীন ভাবে বলে ওঠে,
” যাব না। ”
অরু ফোঁস করে তপ্ত শ্বাস ফেলল। বলল বিরস মুখে,
” এমন করছেন কেন? ”
ওদের কথার মাঝে দু’জন লোক বড়সড় তিনটা বাক্স নিয়ে অরুর বাবার বাড়িতে প্রবেশ করল। পরপর গুটিকয়েক মহিলা মানুষ ট্রেতে সাজানো, উপরে পাতলা কাপড়ে আবৃত জিনিসপত্র গুলো নিয়ে হাজির হয়। অরু সরু চোখে চেয়ে থাকল সেদিকে। মৃদুস্বরে বিড়বিড়ালো,
” এরা কারা? এগুলো কি নিয়ে যাচ্ছে? ”
পরমুহূর্তে অরু তৎক্ষনাৎ লোক দু’জনকে পিছু ডাকল। লোক দু’জনের পদচারণ থামল। অরু কাছে গিয়ে শুধাল,
” বাক্সের ভেতর কি আছে? ”
একজন লোক জানালো বিনয়ের সঙ্গে,
” ছয় রকমের ফল। আঙুর, আপেল, পেঁপে, কলা, কমলা, ডালিম। পাঁচ ধরনের মিষ্টি, বিভিন্ন সুস্বাদু বিস্কুট, চানাচুর, চকলেট, আইসক্রিম। আর কিছু উপহার। ”
অরু টের পেলো মিষ্টির বিশাল এক বাক্সের ভেতর থেকে সন্দেশ, রসগোল্লা, লাড্ডু, আর কাঁচাগোল্লার সুবাস ভেসে আসছে।
অরু অবাক হয়ে ভ্রু উঁচিয়ে জিজ্ঞেস করলো,
” কে পাঠিয়েছে? ”
” হ্যাভেন স্যার। তিনি বলেছেন সব কিছু যেন ভালো করে দেখেশুনে পৌঁছে দেওয়া হয়। ”
লোক দু’জন চলে যায়। অরু ফিরে এলো হ্যাভেনের নিকট। বিহ্বলিত ফাটা নয়নে চেয়ে শুধায়,
” এসবকিছু কখন অর্ডার করেছেন? ”
হ্যাভেন নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে উত্তর করে,
” যখন সময় পেয়েছি তখন। এত প্রশ্ন করো কেন? খরচাপাতি করতে আমি নাকি ভয় পাই? এবার খুশি? ”
অরু কিছু বলল না। চুপ করে রইল। হ্যাভেন তাড়া দিল। পুনরায় একই ভঙ্গিতে বলে,
” প্রিয়জনদের সঙ্গে সময় কাটাও। আসছি। ”
অরু তৎক্ষনাৎ মুখ খুলল। একরাশ দ্বিধা সমেত চঞ্চল বুলি আওড়াল,
” আপনি আসলে আমার ভালো লাগবে। ”
হ্যাভেন মুহুর্তে অরুর একদম সম্মুখে এসে দাঁড়াল। অবিশ্বাস্য গলায় জিজ্ঞেস করে,
” কি বললে, শুনতে পাইনি? ”
অরু মুখ অন্য দিকে ঘুরিয়ে গম্ভীর কণ্ঠে বলল,
” আমার সাথে বাড়িতে চলুন। ”
হ্যাভেন ফোঁড়ন কাটল। সন্দেহী গলায় বলে ওঠে,
” এর আগে কি বলেছো আবার বলো? ”
অরু বিরক্তিকর চাউনী নিক্ষেপ করল। ক্ষিপ্ত হয়ে চওড়া কন্ঠে বলে,
” আসবেন কি না? ”
হ্যাভেন ঝুঁকে আসে। অরুর বাহু আঁকড়ে গাড়ির সাথে চেপে ধরল। অরু চকিতে তাকাল। ভীতিকর এলোমেলো দৃষ্টি ঘোরালো। আশেপাশে তেমন মানুষের আনাগোনা নেই। থাকলেও হ্যাভেনের কিছু যায় আসে না। হ্যাভেনের ভাসা ভাসা সুগভীর আঁখি যুগল তীক্ষ্ণ দৃষ্টি, অরুর ভড়কানো মুখশ্রী জুড়ে বিরাজমান। অরু শুষ্ক ঢোক গিলল। হ্যাভেন তাকিয়ে রইল অরুর গলার ভাঁজে।
অরু ধাক্কা দিয়ে হ্যাভেন’কে দূরে সরাতে চাইছে। বিন্দু পরিমাণ সরাতে পারলো না। নিমিষে চিবুক শক্ত হয়ে ওঠে। কন্ঠনালী ভেদ করে বের হয় বিরক্তিকর বাক্য,
” এটা আপনার বেডরুম না, এটা পাবলিক রাস্তা।”
হ্যাভেন ভ্রু কুঁচকে ফেলল।
” সো হোয়াট? ”
” কেউ এসে পড়বে। দূরে সরুন। ”
” তখন কি বলেছিলে আবার বলো। ”
” কিছু বলিনি। ”
” সরবো না। ”
” প্লিজ সিনক্রিয়েট করবেন না। ”
” তাহলে বলো। ”
” কি বলবো? ”
” আমি না আসলে তোমার খারাপ লাগবে? ”
অরু প্রত্যুত্তর করল না। মাথা নিচু করে রাখল। দাঁত পিষে কাঠিন্য রূপ বানিয়ে রেখেছে মুখশ্রী। হ্যাভেন আলতো করে চিবুক স্পর্শ করে মুখটা তুলল। নজরে নজর মিলিয়ে নিরেট স্বরে আওড়াল,
” রেগে গেলে তোমায় দারুণ লাগে, অরু পাখি। ”
অরু বিস্মিত হলো। ঠান্ডা মৌসুমে হ্যাভেনের ভারিক্কি উষ্ণ গরম নিঃশ্বাস মুখবিবরে আছড়ে পড়ায়, শিহরিত হচ্ছে মেয়েলী নাজুক কায়া। মৃদুভাবে কেঁপে উঠছে শরীর। রাগ লাগছে ভীষণ। এই লোক কি সবসময় ফুরফুরে মুডে থাকে? সামান্য একটা কথার রেশ ধরে বাড়াবাড়ি করছে! কোথায় দাঁড়িয়ে আছে, দিন কাল ভুলে যায় অবলীলায়। পাত্তা দেয় না কোনো কিছুর!
” আর কথা বাড়াবেন না। চলুন। ”
হ্যাভেন ঠায় দাঁড়িয়ে। কোনে হেলদোল নেই। অরু হতাশ চোখে তাকায়। বিরস মুখে ফের বলে,
” আপনি বাড়িতে গেলে আমার, আব্বুর ইভেন সবার ভালো লাগবে। ”
হ্যাভেন চকচকে দন্তপাটি বের করে একপেশে হাসল। গ্রীবা বাঁকিয়ে এদিক ওদিক নজর বোলালো। অরু কিছু বুঝে ওঠার পূর্বে একজোড়া উষ্ণ ওষ্ঠপুট তেড়ে এসে আলতো ভাবে ছুঁয়ে গেল, অরুর কোমল থুতনি। অকস্মাৎ ঘটে যাওয়া ঘটনায় অল্পস্বল্প ভড়কালো মেয়েটা। আকস্মিক ঘটনায় কি রিয়াকশন দিবে মস্তিষ্ক বুঝলো না।
ফ্যালফ্যাল করে হ্যাভেনের দিকে চেয়ে, নিস্প্রভ গলায় জানতে চাইল অরু,
” এক্ষুনি কি করলেন? ”
হ্যাভেন তৎক্ষনাৎ মুখ এগিয়ে নিলো অরুর মুখের অতি নিকটে। বিলম্ব করল না। পুনরায় অধর স্পর্শ দিল অরুর থুতনিতে। এবারের স্পর্শ গাঢ়। প্রগাঢ় ভেজা চুম্বন লেপ্টে রয়েছে সেথায়।
অরুর বুকের ধুকপুকানি বাড়ছে। ঘনঘন শ্বাস টানছে। বারকয়েক পলক ঝাপটায়। পিটপিট করে তাকিয়ে থাকল। পীবর রক্তজবা ঠোঁট নেড়ে শুধায়,
” আপনি আ……”
হ্যাভেন সরে দাঁড়ায়। পরিপাটি শার্টের কলার ঠিকঠাক করে। গোছানো চুলে হাত দিয়ে ব্রাশ করে। দুর্বোধ্য হেসে রাশভারী কন্ঠে বলে,
” চুমু খেয়েছি উপলব্ধি করতে সক্ষম হওয়ার পরও, বাচ্চাদের মতো জিজ্ঞেস করছো কি করেছি? সেজন্য আবার চুমু খেয়ে দেখালাম। দ্যাটস ইট। ”
একটু থেমে লম্বা শ্বাস টানল। অরুর এক গালে হাত রাখল সন্তর্পণে। জিভ দ্বারা ঠোঁট ভিজিয়ে শান্ত কন্ঠে জানায়,
” কাজ আছে, তাই যেতে পারছি না। অন্য সময় কোনো একদিন যাব। তোমার বাবা জানে। আর তোমার চাচ-চাচী বা অন্য সদস্যরা কিছু বললে, আমাকে ইনফর্ম করবে। ”
হ্যাভেন থেকে বিদায় নিয়ে অরু পা বাড়াল শৈশবের নীড়ে। গেট খুলতেই অরুর শরীর দিয়ে অদ্ভুত এক শীতল স্রোত বয়ে গেল দ্বিধাগ্রস্তে। ধীর কদমে এগিয়ে যাচ্ছে। শ্বশুর বাড়ি যাওয়ার সময় বড়ো মুখ করে বলে গিয়েছিল আর ফিরবে না এখানে। সেই কথা কি অব্যাহত থাকল? ইগো হার্ট হবে না? কিন্তু প্রিয়জনদের দেখার লোভ সামলাতে ব্যর্থ সে। ছোটবেলার সব স্মৃতি জোয়ারের মতো ফিরে এলো। এক দৌড়ে বারান্দায় উঠতে ইচ্ছে করছিল। কারণ অরুর বাবা বারান্দায় হুইলচেয়ারে বসে রয়েছেন। সাদা পাঞ্জাবির ওপর নরম সুতি চাদর। বয়সের তুলনায় জামশেদের চামড়ায় বার্ধক্যের চিহ্ন দেখা যাচ্ছে না। না দেখাটাই স্বাভাবিক। অরুই বড়ো এবং একমাত্র সন্তান। মাথার চুল আর ঘন দাঁড়িতে অল্পকিছু চুল পেকেছে। এতে তেমন বয়স বোঝা যায় না।
মেইন দরজা খোলা। হয়তো বাড়ির মানুষ জানতো, আজকে এই সময় অরু আসবে। অরু ছুটে গেল বাবার রুমে। পায়ের দুপদাপ আওয়াজ কর্ণগোচর হতেই সেদিকে দৃষ্টি তাক করলেন জামশেদ। বিষণ্ণতায় ঘেরা মুখাবয়বে মুহূর্তে সুখে উল্লাসে দোলা দিয়ে উঠল। চমৎকার হেসে, স্বস্তির নিঃশ্বাস ছাড়লেন। দুহাত বাড়িয়ে দিলেন, অভিমানী রাজকন্যার নিকট। বিলম্ব না করে দৌড়ে বাবার বুকে ঠাঁই নিলো অরু। ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠল অবলীলায়। জামশেদ মেয়ের মাথায় আদুরে সহিত হাত বুলিয়ে দিলেন। ভদ্রলোকের অক্ষিকোটরে পানি চিকচিক করছে। আজ সপ্তাখানেক ধরে মেয়েটাকে দেখেন না। কষ্ট হবে না? খুশি লাগবে না?
অত্যন্ত নরম গলায় ডাকলেন জামশেদ,
” আম্মা? ”
অরু কান্নার দরুন কথা বলতে পারছে না। গলা দিয়ে কোনো শব্দ বের হলো না, শুধু চোখ দিয়ে নীরব বারিধারা গড়িয়ে পড়ল। গলা শুকিয়ে আসছে। ঠোঁট ভেঙে বাঁধনহারা জলের স্রোত বয়ে দিচ্ছে।
” মায়ের কান্না যে এই অধম ছেলের বুক কাঁপছে, ব্যথা করছে, সেই খেয়াল কি কেউ রাখে? ”
অরু এবারেও নিশ্চুপ। গুনগুন শব্দ শোনা যাচ্ছে শুধু। জামশেদ সময় দিলেন। বেশ কিছুক্ষণ পর, অরু ফ্যাসফ্যাসে গলায় আওড়াল,
” মিস ইউ আব্বু। ”
জামশেদ মলিন হাসলেন। প্রত্যুত্তরে নিরব ব্যথাতুর বাক্য জানান দিলেন,
” আমরা সবাই তোমাকে মিস করেছি। ”
” আমি বেশি করেছি। ”
জামশেদ শব্দ করে হাসলেন। অরু ভোঁতা মুখ অন্ধকার করে রাখল।
” হ্যাভেন’কে আসতে বলতে। ”
অরু নাক ঝামটি মারলো। আরেকটু বাবার উষ্ণ বুকে সেটে গিয়ে রুষ্ট ভরাট কন্ঠে ব্যঙ্গাত্মক ভঙ্গিতে জানালো,
” হারে বজ্জাত লোক আব্বু। নিজের মর্জি ছাড়া কারো কথা শোনে না। কতবার বললাম বাড়িতে এসে গুরুজনদের সঙ্গে দেখা না করে ফিরে যাবেন, বিষয়টি ভালো দেখায় না। আমার কথা শুনলে তো! এ্যাটিটিউড দেখিয়ে চলে গিয়েছে। অথচ, আমাকে সর্বদা ধমক দেয়, জবরদস্তি নিজের কথা মতো কাজ করতে বলে। শয়তান লোক! ”
মেয়ের তিক্তমিষ্টি অভিযোগ জামশেদ মন দিয়ে শুনলেন। অরুর দৃষ্টির অগোচরে ঠোঁট টিপে কিঞ্চিৎ মুচকি হাসলেন। দেখে নিলে কেলেঙ্কারি বাঁধিয়ে দিবে। মেয়ের চোখের জল মুছে, কপালে স্নেহময় প্রগাঢ় চুমু এঁটে দিলেন।
অরু’কে আশ্বস্ত করে জামশেদ শান্তিপূর্ণ সুমধুর বাক্য আওড়ালেন,
” আমি হ্যাভেন’কে কড়া গলায় শাসিয়ে দিবো। ”
ক্ষুব্ধ হলো অরু। কটাক্ষ করে মৃদূ চটে গেল,
” মিথ্যা আশ্বাস কেন দিচ্ছো? বজ্জাত লোকটাকে শাসানো তো দূরে থাক, তুমি তার সামনে গলা উঁচু করে একটা কথাও বলো না। অন্তত আমি যতদিন দেখেছি। ”
সহসা জিভ কাটলেন জামশেদ। উড়নচণ্ডী মেয়েটা ভালোই কথা শিখেছে। কিভাবে মুখের উপর কাটকাট জবাব দিল? না বাবা, আর কিছু বলার দরকার নেই। ক্ষিপ্ত হলে এক্ষুনি বাড়ি থেকে চলে যাবে। মেয়ের ইগো বেশি কি না! হুটহাট রেগে যায়।
অরু বাবার বুকে মুখ গুঁজে পড়ে রইল। চোখ বুঁজে আছে। এই বুক, এই উষ্ণত, এখানে কোনো বিধিবহির্ভূত মাথা রাখা না রাখার কঠিন শর্ত নেই। বিনিময়ে কোনো দাবি নেই, কেবল নিঃস্বার্থ ভালোবাসা।
হঠাৎ ছোট ছোট ঠান্ডা হাত অরুর সংস্পর্শে আসতেই, অরু ঘাড় ঘুরিয়ে তাকায়। তুবা অরুর কোমর জড়িয়ে আছে। পরপর অরুর চাচাতো বোন তিশা দৌড়ে এসে জড়িয়ে ধরল কাঁধ। অরু এক হাতে বোনদের আগলে নিলো। জামশেদ সন্তোষ হেসে তিন মেয়েকে জড়িয়ে ধরলেন।
তুবা হেঁচকি তুলে কাঁদো কাঁদো গলায় অভিযোগ জানায়,
” কথা বলবে না তুবা, দুষ্টু অরুর আপুর সাথে। আমায় মিথ্যা বলেছে। বাড়িতে আসে না, আসে না। দুষ্টু অরু। ”
আবারও জলে টইটম্বুর অশ্রুসিক্ত নয়ন জোড়া ভরে উঠেছে অরুর। কতদিন পর এমন নির্মল ভালোবাসার অনুভূতি পেলো!
জামশেদের পায়ের নিকট হাঁটু ভেঙে বসে পড়ল অরু। হাত বাড়িয়ে তুবা’কে উরুর উপর বসিয়ে দিল। গালে টপাটপ চুমু খেয়ে হেসে বলল,
” তুবা বুড়ি রাগ করেছে? এই যে কান ধরলাম। সরি।”
অরু কানে হাত দিয়ে, ঠোঁট ফুলিয়ে রেখেছে। তুবা টলমলে চোখে চেয়ে। গোল গোল নিস্প্রভ দৃষ্টি তাক করে, অরুর হাত কান থেকে সরাতে বলল। এই সহজ, সরল অনুভূতি অরুকে অদ্ভুত এক প্রশান্তি দিল। বিয়ের পর থেকে অনেক কিছু নাকি বদলে যায়, কিন্তু কিছু সম্পর্কের গাঁথুনি এতটাই শক্ত যে সময়ের ধুলো সেগুলোকে মলিন করতে পারে না।
অরুর গালে চুমু খেয়ে, তুবা আবদার ছুঁড়ল,
” এখন থেকে এখানেই থাকবে। কোথাও যেতে পারবে না। বলো যাবে না? ”
অরু মন খারাপ করে আহত চোখে তাকায়। দীর্ঘশ্বাস ফেলে ব্যাকুল হয়ে বলে,
” বিয়ে হলে কি বাবার বাড়ি থাকা যায়? তোর মাকে দেখ, চাচি’কে দেখ। তোর মা কি নানা বাড়ি থাকে? ”
তুবা সরল স্বীকারোক্তি করে মাথা নাড়লো। তুবার গাল টিপে হেসে অরু শুধায়,
” তাহলে আমি কিভাবে থাকি? ”
অরুর গলা জড়িয়ে ধরল তুবা। মলিন মুখে জানায়,
” ঠিক। ”
রান্নাঘর থেকে এলাচ-দারুচিনির গন্ধ নাসারন্ধ্রে ভেসে আসছে। হয়তো রান্নাঘরে ব্যস্ত চাচি। অরু ভঙ্গুর কন্ঠে জানতে চাইল,
” কি রান্না হচ্ছে? ”
তিশা হাস্যোজ্জ্বল মুখে উত্তর দেয়,
” ক্ষীর। ”
অরুর জিভে লালা চলে এসেছে। ক্ষীর ওর বরাবরই পছন্দ। ইউটিউব ভিডিও দেখে কয়েকবার রান্না করেছিল। উৎফুল্ল চিত্তে বলে,
” ছোট চাচি রান্না করছে, রাইট? ”
তিশা চনমনে কন্ঠে জানালো,
” অবশ্যই। ”
” আমি এসেছি জানে? ”
” জানে। দুধ পাতিলে লেগে যাবে, বুদবুদ করে ফুলে পড়ে যাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। নাড়া দেওয়া জরুরি। তাই আসতে পারছে না। ”
প্রেমপিপাসা পর্ব ১৫
জামশেদ’কে বলে অরু রান্নাঘরে ছুটে গেল চাচির সাথে দেখা করতে। ওর পিছু পিছু তুবা, তিশা গেল। অপরিচিত লোকজনদের দেখে, জামশেদ গ্রীবা উঁচু করে, উঁকি দিলেন ড্রয়িংরুমে। পদে পদে সাজিয়ে রাখা জিনিসপত্রগুলো একবার চোখ বুলিয়ে নিয়ে মৃদু হাসলেন। এসবকিছু হ্যাভেন পাঠিয়েছে বুঝতে বেগ পেতে হলো না। শুধু অনিমেষ প্রকটভাবে দৃষ্টি নিমজ্জিত করলেন নীল রঙের কাপড়ে আবৃত ট্রেটার দিকে।