রং পর্ব ২১

রং পর্ব ২১
তন্নী তনু

সকালের পরিবেশ শান্ত নিরব।সিনথিয়া সেই ভোর থেকে থেকে জানালার গ্রীল ধরে দাঁড়িয়ে আছে। ধেয়ে আসা কালো মেঘের অন্ধকারের চেয়েও মনটা অন্ধকারে ছেপে আছে। মন শুধু অশান্ত-ই নয় যেনো ক্লান্ত। ঐ মানুষটার কপাল ফেটে বের হওয়া র*ক্তমাখা মুখটা বহু চেষ্টায় ও মুছতে পারছে না সে।সাদা শার্ট জরানো পিঠটা রক্তে ভেজা। মানুষটা কি আদও বাসায় ফিরতে পেরেছেন? সব ঠিক আছে তো? এসব চিন্তায় মাথা ফেটে যাচ্ছে।
তার উপর আরেকটা চিন্তা চেপে বসেছে। কাল তার চোখে ঘুমের ছিটেফোটা ছিলো না। তবে হঠাৎ কি করে ঘুমিয়ে গেলো? আর এতোটা সময় পেরিয়ে গেলো সে জানলোও না? এর মধ‍্যে এতো বড় অঘটন ঘটলো অথচ কিচ্ছু বুঝতে পারলো না সে? প্রশ্নগুলো মাথার মধ‍্যে পোকার মতো কুটকুট করে কামড়াচ্ছে। তার চেয়ে বেশী অসহনীয় লাগছে,” মানুষটা বেঁচে আছে তো?” এই চিন্তা তার ভেতরে শূন‍্যতায় ভরিয়ে দিচ্ছে। তার মন,প্রাণ অধীর অপেক্ষায় বসে আছে! যদি একটা কল আসতো! যদি একটা সুসংবাদ পাওয়া যেতো! যদি ফোন করে তাকে বলা হতো- সব ঠিক আছে। ইসস! আর তো অপেক্ষা করতে পারছে না সে। অপেক্ষার প্রহর বড় কষ্টের। তবুও অপেক্ষা তাকে করতেই হবে….

তিথি বরাবর সাজসজ্জাহীন থাকতেই পছন্দ করে। তাদের বান্ধবীদের মধ‍্যে সিনথিয়া, রিমা, আর তিথি সবাই সাজসজ্জা বিষয়টা এড়িয়ে চলে। তবে তিথি তো আজ স্পেশাল কারো সাথে দেখা করতে যাবে! তার কি একটু প্রতিদিনের চেয়ে ব‍্যতিক্রমভাবে বাইরে বের হওয়া উচিৎ!এই নিয়ে ভেবে চলেছে সকাল থেকে। অনেক ভেবে চিন্তে সে সিদ্ধান্ত নিলো- সে যেমন তেমন ভাবে-ই যাবে। প্রতিদিনের মতোই নিজেকে তৈরী করলো। তবে এই প্রথমবার নিজের লম্বা চুলগুলোর জন‍্যে আফসোস হচ্ছে। ড্রেসিং টেবিলের সামনে ভুল করেও না আসা মেয়েটা আজ ড্রেসিংটেবিলের সামনে দাঁড়িয়ে নিজেকে একপলক দেখে নিলো। নিজের “বয়কাট” দেয়া চুলগুলো আজ কেনো যেনো ভিষণ বেমানান লাগছে। তবুও করার কিছু নেই। তিথি হ‍্যান্ড পার্সে মোবাইল ঢুকিয়ে নিয়ে বাসা থেকে বের হয়।

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

ড্রয়িং রুমের দেয়ালে লাগানো বিশাল টিভি। বাবার নিউজ দেখার সুবিধার্থে নিজের উপার্জনে দেয়া প্রথম উপহার। সিনথিয়ার বাবা টিভিতে খবর দেখছেন।এদিকে পায়ের উপর শরীরের ভর রাখতে না পেরে সিনথিয়া বিছানায় এসে বসে। ড্রয়িং রুম থেকে টিভির শব্দ আসছে। যদিও কোনো শব্দ”ই এখন তার সহনীয় লাগছে না। তার আত্মা ভেতর থেকে বলছে হাতের এই ফোনটা তুমুল শব্দে আত্মা কাঁপিয়ে বেজে উঠুক। একটা সুসংবাদ আসুক। এছাড়া এই মূহুর্তে সব অসহনীয়।দুশ্চিন্তায় গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে আসছে। এতোটা সময় পেরিয়ে যাওয়ার পরও কোনো কল আসলো না। চিন্তায় হাত পায়ের তলায় অসাড় হয়ে আসছে। সিনথিয়া বেড সাইড টেবিল হাতড়ে ওয়াটার পট হাতে নেয়। ওজন বলে “পানি শূন‍্য”। সিনথিয়া পানির জন‍্যে রুমের বাইরে আসে। টিভির পর্দায় চোখ পরে একবার। গতরাতে একটি ছেলে খু*ন হয়েছে। খু*নের রহস‍্য এখনো রহস‍্যের জট বেঁধে আছে। কে বা কারা এই মা*র্ডারের সাথে জড়িত তা খতিয়ে দেখছেন পুলিশ। এই খবর দেখতে দেখতে সিনথিয়ার বাবা একা একাই কথা বলে উঠলেন।

–” অল্পের জন‍্যে আমাদের জিসান বেঁচে গেছে! সেদিন যদি মেয়েটা সাথে না থাকতো আজ আমরাও এভাবে শোক করতাম।
সিনথিয়ার কপাল জুড়ে ভাজ। ভ্রু কুচকে গেছে আপনাআপনি। এই ছেলের বাঁচা-মরা নিয়ে যদিও তার কোনো শোক আফসোস নেই। তবুও আজ জানার আগ্রহ মাথায় চেপে বসে। ‘জিসানের কবে কি হলো?’সিনথিয়া ড্রয়িং রুমের সোফায় বসে। তার বাবার টিভি দেখার তালে তালে একাই কথা বলছে। সিনথিয়া বলে,
— বাবা! কিছু একটা বললে মনে হয়?
সিনথিয়ার বাবা পাশ ফেরে। অনেকদিন পর মেয়েকে পাশে বসে থাকতে দেখেও বুকটা ভারী হয় তার। মেয়েটা না থাকায় পুরো বাসা শূন‍্য মনে হতো। কতো কষ্ট-ই না করলো মেয়েটা। সিনথিয়ার বাবা মেয়ের মাথায় হাত দেয়। নরম গলায় বলে,

— কি মা!
–একটু আগে কিছু একটা বললে,” ঐ জিসান ভাইয়া!”
— ওহ! তোকে তো বলা হয়নি।এই তো সেদিন জিসান অফিস থেকে বাসায় ফিরছিলো। এর মধ‍্যে ওর উপর এট‍্যাক হয়েছে। হাসপাতালে ভর্তি আছে এখনো। অল্পের জন‍্যে প্রাণে বেঁচে গেছে ছেলেটা। দেখনা টিভিতে যাকে দেখাচ্ছে! এতো সিকিউরিটি”র মধ‍্যেও বাসায় গিয়ে মা!র্ডা!র করা হয়েছে। আর জিসান তো বাইরে ছিলো।
সিনথিয়ার অস্পষ্ট করে বলে,
–ওহ!

তবে এই “ওহ” শব্দটার আড়ালে তার মন যেনো কিছু বলতে চায়। অজানা কিছু তার হৃদয় যেনো স্পর্শ করে। কিন্তু তা আদও হয়তো সম্ভব নয়। সিনথিয়া নিরবে উঠে দাঁড়ায়। তার বাবা দু”বার ডাকলেও সে ভাবলেশহীন ভাবে নিজের রুমে চলে আসে। অজানা এক শঙ্কা তার মনের দুয়ারে বার বার কড়া নাড়ে। তার মাথায় যা আসছে তা কি সত‍্যিই হওয়ার মতো! ‘জিসান’ এর সম্পর্কে তো সে ইরফাদকে বলেছিলো।তারপরেই জিসানের উপর এট‍্যাক! আবার আজ রাতেই ইরফাদের এমন বেহাল দশা। সকালে খু*ন হওয়ার নিউজ। রাতের পুরো ঘটনা ভাবাচ্ছে তাকে। গাড়িতে তার হঠাৎ করে ঘুমিয়ে যাওয়া! ইরফাদের র*ক্তে মাখা শরীর। আজকের সকালের মা!র্ড!রের নিউজ! এটা কিসের ইঙ্গিত দিচ্ছে ? কি!ন্তু একজন এসপি এসবে কেনো নিজেকে জড়াবে। তার চিন্তার কি আদও কোনো ভিত্তি আছে? নাকি মাথা উল্টাপাল্টা হয়ে গেছে।

তিথি বাসা থেকে নেমে রিকশা ডেকে নেয়। উদ্দেশ্য অচেনা মানুষটাকে গত রাতে দেয়া লোকেশন। মাথার মধ‍্যে একটাই চিন্তা “ছেলেটা কে হতে পারে?” তার দেখা করাটা কি উচিৎ? কতো কি অঘটন হচ্ছে আজকাল। অচেনা মানুষটাকে কি এতোটা বিশ্বাস করা উচিত হচ্ছে?অন‍্যসময় হলে সিনথিয়া, রিমাকে সাথে নেওয়া যেতো। কিন্তু এই মূহুর্তে তা সম্ভব নয়।তারা কেউ- ই স্বাভাবিক অবস্থায় নেই। তাই একা যাওয়া ছাড়া কোনো উপায় নেই। অনেকটা রাস্তা পেরিয়ে রিকশার ভাড়া দিয়ে নামে তিথি। লিফটের লেভেল নাইন বাটনে চাপে। বুকের মধ‍্যে কাপন বাড়ছে। ভয় ভয় লাগছে। একবার মন সায় দিচ্ছে পরোক্ষণে মনে হচ্ছে পেছন ফিরে যেতে। তবে এতোটা কাছে এসে সত‍্যের মুখোমুখি না হয়ে সে ফিরতে চায় না। মুখোশের আড়ালের এই মানুষটা কে? তাকে না দেখে তো মন শান্ত হবে না। তিথি রেস্টুরেন্টে ঢুকে রাউন্ড টেবিলে চেয়ার টেনে বসে। হ‍্যান্ড পার্স থেকে ফোন বের করে চেক করতে থাকে কোনো মেসেজ এসেছে কি না? নতুন ম‍্যাসেজ না পেয়ে তিথি নিজেই লেখে,

” কখন আসবেন?”
ওপাশের কোনো উত্তর না পেয়ে ফোন স্ক্রল করতে থাকে। মিনিট পাঁচেক পর উত্তর আসে।
” এইতো চলে এসেছি প্রায়। লিফটে উঠবো এখন।”
মেসেজের প্রত‍্যেকটা ওয়ার্ড পড়ে তিথি কেঁপে কেঁপে ওঠে। এতো অশান্ত কখনো লাগেনি। পায়ের তলায় ঘেমে উঠছে। হাত ঘেমে উঠছে। তিথি নিজের হাতটা রুমালে মুছে নিচ্ছে বার বার। হৃদয়ের কাছে কেউ যেনো দায়িত্ব নিয়ে বসে সুক্ষ সূচালো সুই দিয়ে ক্রমাগত হৃদয় ফুটো করছে। এতো অশান্ত কেনো লাগছে!মিনিট দুয়েক পর কাচের দরজা ঠেলে কেউ ঢোকে। পরনে কালো শার্ট। লম্বা পায়ের গোড়ালির উপর ভাজ করে রাখা জিন্স প‍্যান্ট। ফর্সা হাতের কনুই পর্যন্ত গোটানো কালো শার্টের হাতা। একহাতে কাচের স্বচ্ছ দরজা ঠেলে দিচ্ছে। অপর হাতে কপাল ছুঁইয়ে থাকা চুল ঠেলে উপর দিক দিচ্ছে। হাতের কব্জিতে থাকা রুপালী শিকলটা নিচ দিকে নেমে যাচ্ছে। ফর্সা মুখে কালো মাস্ক জড়ানো। চোখদুটো চেনা। ভিষণ চেনা।
****
সিনথিয়া কল দিয়ে যাচ্ছে এখনো। কিন্তু ভোর থেকে একই উত্তর শুনতে শুনতে সে ক্লান্ত। কেনো যেনো ধৈর্য্যর বাধ ভেঙ্গে যাচ্ছে। ভেতর থেকে কাচের মতো ভেঙ্গে ভেঙ্গে পড়ছে সে। কখন একটা কল আসবে? আর কখন একটা সুসংবাদ আসবে। এমন অপেক্ষার প্রহর যে শেষ হয় না- এই যন্ত্রণা সেই বুঝবে যে জীবনে একবার অনুভব করেছে। “যদি মানুষটার খারাপ কিছু হয়ে যায়। এই জীবনে সে কি আর একবার বেঁচে থাকার সাহস দেখাতে পারবে?” অসহ‍্য অসহনীয় হয়ে বিছানায় শুয়ে থাকে সিনথিয়া। পুরো পৃথিবীকে অসহনীয় লাগছে। এমন সময় রিমার কথা মনে পড়ে সিনথিয়ার। প্রিয় মানুষকে হারিয়ে কেমন আছে মেয়েটা?কি করে সইছে এতো ব‍্যাথা! সিনথিয়া ফোন হাতে নিয়ে রিমাকে কল করে। ফোন বাজতে থাকে…..! অপর পাশ থেকে আর রিসিভ হয় না।

তিথি বিস্মিত নয়নে তাকিয়ে থাকে। এই সুদর্শন পুরুষটিকে সে চেনে। শুধু চেনেই না ভালোভাবেই চেনে। ছেলেটি সামনাসামনি হতেই আপনা আপনি উঠে দাঁড়ায় তিথি। চোখের পলক পড়ে না। তিথি স্বপ্নেও ভাবেনি ফোনের অপর প্রান্তের মানুষটা “সে” হবে। অসম্ভাব‍্য, অকল্পনীয় মানুষটিকে চোখের সামনে দেখে পাতলা ওষ্ঠযুগল আপনা-আপনি ফাঁকা হয়ে যায়। পৃথিবী কিছুক্ষণের জন‍্যে থেমে যায় যেনো। গলায় কেঁপে কেঁপে উঠে বিস্ময় মাখা শব্দ,
— তুমি!
অপর পাশের মানুষটা মুখের মাস্ক খোলে। ওষ্ঠজোড়া প্রশস্ত করে বলে,
— চিনে ফেললি?
তিথি স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। হিসেব মিলছে না। এসপি”কে দেওয়া মেসেজ কি করে এই মানুষটার কাছে যেতে পারে। এই কি সেই! নাকি দু”জনের অলৌকিভাবে দেখা হলো। তিথি থমথমে গলায় বলে,

— তুমি-ই কি…..
— সুহাসিনী! এখনো কনফিউসড!
–কিন্তু তোমার সাথে তো ফোনে কথা বলেছি। তোমার দেয়া ভয়েজ গুলো এমন ছিলো না।
ছেলেছি উঠে দাঁড়ায়। একটুখানি দূরত্ব নিয়ে তিথিকে কল করে। তারপর বলে,
— “ভালোবাসি।”

একই মানুষের দুরকম স্বর শুনে নিজেই হতবাক।তিথি চোখ জোড়া নামিয়ে নেয়। কি থেকে কি হলো! যা স্বপ্নেও ভেবে দেখেনি- তা কি করে হতে পারে। ছোট বেলা থেকে এই মানুষটাকে রগচোটা, রাগী,গম্ভীর দেখতে দেখতেই অভ‍্যস্ত সে। এক বাসায় বড় হয়েও কখনো সামনাসামনি প্রয়োজনের বাইরে কথা বলা হয়নি। বরং মামির পাশাপাশি শিশির ভাইকেও সে যমের মতো ভয় পেতো। আজ “শিশির ভাই” তাকে ভালোবাসতে চাচ্ছে! এ কি করে সম্ভব!কি থেকে কি হলো। সব মাথার উপর দিয়ে যাচ্ছে। অপর পাশের মানুষটার হাসি মাখা মিষ্টি গলা,

— মন খারাপ যে! আমি কিন্তু মন ভালো করার জন‍্যে এসেছিলাম….
তিথি অজানা অনুভূতির কারণে চোখ তুলে তাকাতে পারে না। বিষাদের রঙে নিজেকে মাখতে মাখতে আর কোনো কিছু হৃদয় ছিড়ে দিতে পারে না। শেষ অবধি এই মানুষটা তাকে ভালোবাসলো নাকি তাকে নিয়ে খেললো? কিন্তু কেনো?
শিশির চেয়ার টেনে বসে। আদেশ সূচক গলায় বলে,
— বস!
তিথির জীবন কেটেছে সকলের আদেশ- পালন করতে করতে। বিশেষ করে শিশিরের মায়ের আদেশ। শিশিরের কথা মত তিথি চেয়ারে বসে। তবে চোখ তুলে তাকায় না। শিশির হাতদুটো টেবিলে রাখে। তিথির নিচু মুখটার দিকে তাকিয়ে বলে,

— আমি এসে কি মনটা আরও খারাপ করে দিলাম!
তিথি মুখ তোলে না। চোখের জল অকারণে চোখে ফেটে বেরিয়ে আসতে চায়। তবে তার কাঁদা বারণ। টেবিলের উপর হাত রেখে কপাল ঠেকায় তিথি। চোখের জল আড়াল করতে চায়। শিশির অবাক হয়ে যায়। তিথি তাকে এতোটা অপছন্দ করে! সে তো জানতো না? শিশিরের নিজের কাছেই অপ্রস্তুত লাগে নিজেকে। শিশির ধীর গলায় বলে,

— তুই কি অন‍্য কাউকে পছন্দ করিস?
তিথি হাতের উপর মাথা ঠেকিয়ে রেখেই মাথা দুদিকে নাড়ায়। যার অর্থ “না”। শিশির বলে
— তাহলে? এমন করছিস কেনো?
তিথি কোনো উত্তর দেয়না।
— তিথি সবাই তাকিয়ে আছে। আমাকে সবার কাছে ফানি করে তুলিস না।
তিথি ধীরে ধীরে মাথা তুলে বসে। চোখ দুটো লাল হয়ে আছে। মুখটা থমথমে। তিথি ধীর গলায় বলে,
— আমার কিচ্ছু মাথায় ঢুকছে না। কি থেকে কি হলো?
— ঐদিন তুই এসপির গল্প করছিলি না কুটুস এর কাছে। আমি তো শুনেছিলাম বাইরে থেকে। তারপর মা আসলো। তোকে কথা শোনালো। আমি শুধু তোর কুটুসের মাধ‍্যেমেই আগের নাম্বারটা চেঞ্জ করে দিয়েছিলাম। সরি…
–কিন্তু কেনো? এই নাটকের কোনো প্রয়োজন ছিলো? আমি তো সত‍্যিই ভেবেছিলাম অবশেষে মনের মতো কাউকে পেলাম।

— তো আমি কি এমনি-ই এসেছি!
— কি চাও তোমরা! তোমার মা প্রতি নিয়ত পুড়িয়ে মারে। তুমি সেখানে ঘি ঢালতে এসেছো?
–তোর কি মনে হয়?
— আমার মন বলতে কিছু নেই।নাটকটা না করে আমার হৃদয়টা না ভাঙ্গলেও পারতে।
–তিথি! ভুল বুঝিস না। আমি সত‍্যিই “ভালোবাসি”। আমি তোকেই বিয়ে করতে চাই।
— হাসালে তুমি। তোমার মা আমাকে জীবন্ত পুতে ফেলবে। আমি আসছি….
— তিথি! কথা তো শোন…
–হুম…
— আমি অনেক আগে থেকেই অনুভব করেছি। তুই রাজি হবি না বলেই এমন একটা পথ খুঁজে নিয়েছি। প্লিজ ভুল বুঝিস না।
— এই রঙ হীন জীবনে এন্ট্রি নিয়ে জীবনের রঙ নষ্ট করে তুমিই একদিন বলবে তোমার ডিসিশন রং ছিলো।
— আর যদি “রং” পথ ধরে তোকে নিয়ে হেঁটে কোনোদিন জীবনের রঙ খুঁজে এনে দিতে পারি?
— আমার সাথে জীবন জড়াতে এসো না প্লিজ….

সিনথিয়ার হৃদয় একটা ফোনের অপেক্ষায় তৃষ্ণার্ত হয়ে আছে। একটা ফোন করলে কি এমন ক্ষতি হতো! একটা মানুষ এতো নিষ্ঠুর কি করে হয়? ফোনের অপেক্ষায় থাকতে থাকতে সিনথিয়া অসহ‍্য হয়ে এসপির নম্বরে আরেকটা কল করে। ফোনে রিং হচ্ছে। সিনথিয়ার আত্মায় এক অদ্ভুত অনুভূতি হয়।ফোন বেজেই চলছে। রিং শেষ হওয়ার পূর্ব মূহুর্তে ফোনটা রিসিভ হয়। সিনথিয়ার ভিতরটা স্তব্ধ হয় কয়েক সেকেন্ডের জন‍্য। তারপর মেয়েলি গলা শুনে থতমত খেয়ে যায়। নিজেকে যথারীতি নিয়ন্ত্রণে এনে সালাম দেয়। তারপর বলে,
–ইরফাদ স‍্যার আছেন?
— হুমম। কিন্তু আপনি কে?
সিনথিয়া মনের সাথে বুঝে উঠতে পারে না।এই মূহুর্তে কি বলবে সে! চুপচাপ থাকলেও চলবে না। কোনো রকম গুছিয়ে বলে,

— আমার কেসটা স‍্যার ই দেখছেন। কেসের ব‍্যাপারে কথা বলার জন‍্যে আজ ফোন দিতে বলেছিলেন।
— ভাইয়া ঘুমিয়েছে।
— ” কেমন আছেন তিনি?” এই কথাটা ভেতর থেকে সব বাধা ভেঙ্গে বের হতে চাইলেও সিনথিয়া নিজেকে সংযত করে। সব জায়গায় পাগলামি মানায় না। ফোন যখন অন হয়েছে। বাকি তথ‍্য নেয়া যাবে। একটু কষ্ট করতে হবে এইতো। সিনথিয়া বলে,
— ইমারজেন্সি ছিলো তো!
–ওকে! আমি ভাইয়াকে বলবো।

কিছু সময়ের কথায় তিথি অনেকটাই দূর্বল হয়ে গেছিলো। তবে নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করার ক্ষমতা তার আছে। সে কখনোই এমন ভুল করবে না। একে তো মামীর যন্ত্রণায় জীবন অতিষ্ঠ। তার উপর তার ছেলের সাথে জীবন জড়িয়ে মৃত‍্যু ডেকে আনবে না। শিশির দেখতে সুদর্শন, নম্র-ভদ্র ভালো ছেলে। সে অনেক ভালো কিছু ডিজার্ভ করে। তাই যতোটুকু দূর্বলতা আছে সব নিজ হা*তে খু*ন করে হলেও এসব থেকে শিশির কে দূরে রাখবে। ভুল করা তার সাজে না। তিথি উঠে দাড়ায়। হ‍্যান্ড পার্স হাতে নিয়ে সামনে পা বাড়াতেই শিশির বলে ওঠে,
— তিথি! ভালোবাসি, ভালোবাসি, ভালোবাসি।
তিথির ভেতরটা দূর্বল হয়ে আসে। মনে হয় যদি পাশ ফিরে একবার তাকানো যেতো। কিন্তু সবসময় মনকে সাই দিতে নেই। সে দ্রুত পায়ে বেরিয়ে যায়।

সন্ধ‍্যা নেমে গেছে। হঠাৎ সিনথিয়ার ফোনটা উচ্চ শব্দে বেজে ওঠে। সিনথিয়া লাফিয়ে উঠে বসে। গলা শুকিয়ে আসে। সত‍্যিই ফোন এসেছে। ফোন ধরেই সালাম দেয়। উত্তরের অপেক্ষা না করেই কেনো যেনো মুখ ফসকে বেড়িয়ে আসে,” আপনি ঠিক আছেন।”
ওপর পাশের সেই বরফ শিক্ত গলা,” হুম।”
সিনথিয়া দম নেয়। যেনো এই শ্বাস টুকু এতোক্ষণ আটকে ছিলো। বুকটা হালকা হয়ে আসে। সকল প্রশান্তি যেনো “হুম” শব্দতেই আটকে ছিলো।সিনথিয়া আবেগে উচ্ছাসে বলে ফেলে,

— রাতে কি হয়েছিলো?
— কিছু না।
–তাহলে……!
— সব কি তোমাকে বলবো?
সিনথিয়া জমে যায় একদম।তাইতো সব কি তাকে বলবে? সে কে? এই ছোট্ট সত‍্য কথাও কেনো যেনো আজকাল মানতে ইচ্ছে করে না। অজান্তেই অধিকার ফলিয়ে ফেলে। সিনথিয়া ধীর গলায় বলে,
— সরি।
ওপাশের গলাটা রুক্ষ। যেনো অন‍্য মানুষ।
— তোমার জামিন নিতে অনেক শর্তের মধ‍্যে দিয়ে যেতে হয়েছে। আমার উপর অনেক প্রেশার। আমাদের যতোদ্রুত সম্ভব রাফিকে খুঁজে বের করতে হবে। ঐ চিঠিটা অনেকটাই জট পাকিয়ে আছে। আমার প্রয়োজন তোমার ভাইকে। তার মুখোমুখি হলেই সব জট খুলে যাবে।

–বুঝতে পারছি না।
— সব বোঝার দরকার নেই। যা বলছি তাই করো। তুমি ফোনের অপেক্ষা করো। তোমার ভাই ফোন করলেই আমাকে জানাবে। আমার দেয়া সীমকার্ড থেকে আমার সাথে যোগাযোগ করবে।
–হুম!
— ওকে রাখছি
— কিন্তু ভাইয়া কি এতো সহজে ধরা দিবে। এখন পর্যন্ত আমার সামনেই আসেনি। কখনো দেখিনি আমি।
— তিনি না আসলে আমি যাবো…।
— কিভাবে?
— যেভাবে তিনি আমাকে ধরার জাল ফেলেছেন।
— না না! ভাইয়া হয়তো শক্ত ফাদ ই পেতেছে। আমার ভয় করে।
— তোমার কিসের ভয়? তোমার ভাইয়া তো আর তোমার ক্ষতি করবে না।
মনের অব‍্যক্ত কথাখানা সিনথিয়া বলতে পারে না। তাকে নিয়েই তো মনের ভেতরে ভয়। সিনথিয়া দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে,
— প্রথমে বিষয়টা নরমাল মনে হলেও এখন খুব কমপ্লিকেটেড লাগছে। ভাইয়া কোনো কিছু খুলে বলেনি! তখন আবেগের বসে আমি সম্মতি দিয়েছিলাম। তবে জেলখানায় চিঠি আসাতে আমার ধারণা পাল্টে গেছে। আমি আর চাই না এসবের মধ‍্যে গিয়ে আপনি নিজের ক্ষতি করুন।

— আমার সাইড ভাবতে হবে না। তুমি শুধু হেল্প করে যাও….
–কিন্তু!
— কোনো কিন্তু না। রাখছি….

রং পর্ব ২০

প্রায় মধ‍্যে রাত।ভ‍্যাপসা গরমে শরীর পুড়ছে। সিনথিয়া বিছানার সাইডের জানালার থাই গ্লাস আধখোলা করে রেখেছে। কিছুক্ষণ পর পর দমকা হাওয়ায় প্রাণ জুড়িয়ে যাচ্ছে। দুটো চোখ ঘুমের ভারে আঠার মতো লেগে আছে। হঠাৎ জানালার গ্রীলে ঠক ঠক আওয়াজ হয়। সিনথিয়া ঘুমের ঘোড়ে আছে। আবারও শব্দ হয়। সিনথিয়ার ঘুম ছুটে যায়।

রং পর্ব ২২