অশ্রুজলে বোনা বিয়ে পর্ব ২৬
ইয়াসমিন খন্দকার
নিঝুম ও আবরাজ বর্তমানে লন্ডনে একটি বিশাল হোটেল The Ritz London এ অবস্থান করছে যা মূলত বিয়ের ভেন্যু হিসেবে ব্যবহৃত হয়৷ এখানেই এলা ও ম্যাক্সের বিয়ের আয়োজন করা হয়েছে।
এলাকে যখন সাজানো হচ্ছিল তখন নিঝুম তার পাশেই বসেছিল। নিঝুমকে পাশে পেয়ে এলা অনেক খু্শি ছিল। এলা নিঝুমের উদ্দ্যেশ্যে বলে,”তোমাকে অনেক ধন্যবাদ, আমার কথা রাখার জন্য।”
নিঝুম সামান্য হেসে বলে,”ধন্যবাদ দিতে হবে না। তোমার খুশিতে অবদান রাখতে পেরে আমিও খুশি।”
এলা বলে,”জানো, আমার না আপন বলতে কেউ নেই। আমার যখন ৫ বছর বয়স ছিল তখন আমার মা-বাবার ডিভোর্স হয়ে যায়৷ তারপর আমি আমার মার সাথেই বেড়ে উঠেছি। আমার মা আমার কাছে এক আদর্শ নারী। তিনি যেভাবে একা হাতে আমায় বড় করেছেন তার থেকে আমি অনুপ্রেরণা পেয়েছি। কিন্তু যখন আমার ১৮ বছর বয়স তখন আমার মা ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে মারা যায়। এরপর থেকে আমি এই দুনিয়ায় সম্পূর্ণ একা।”
এলার জীবনের কাহিনি শুনে নিঝুমের বেশ খারাপ লাগে। সে বলে,”তোমার বাবা আর তোমার খোঁজ নেয় নি?”
“ঐ জঘন্য লোকটার কথা বলো না তো। উনি তো একজন ব্যভিচারী লোক ছিলেন। আমার মায়ের সাথে ডিভোর্স হবার পর থেকে জীবনেও আমাদের খোঁজ নেন নি। মায়ের মৃত্যুর পরেও না। যদিও আমার এতে কিছু যায় আসে নি। আমার মা আমার জন্য কিছু জমানো টাকা রেখে দিয়েছিল তা দিয়েই আমার দিব্যি চলে গেছে। তারপর তো আমি এখন নিজেই নিজের পায়ে দাঁড়িয়েছি।”
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
“বাহ, তোমার বাবাও তো তাহলে আমার বাবার মতোই জঘন্য।”
“হুম, তবে ম্যাক্সের পরিবার কিন্তু ভীষণ সুন্দর। এই আধুনিক যুগে লন্ডনে এমন পরিবার তো আর দেখাই যায় না। ম্যাক্সের দুই ভাই তাদের বউ, ওর মা-বাবা সবাই কি সুন্দর মিলেমিশে থাকে। এমন একটা পরিবার পেয়ে আমি সত্যি ভীষণ লাকি।”
“হুম, ঠিক বলেছ তুমি। আচ্ছা, তোমাকে আর ম্যাক্সকে তো আমি সবসময় বন্ধুই ভাবতাম। তোমাদের মাঝে যে এমন কিছু চলছিল সেটা তো বুঝি নি!”
এলা সামান্য হেসে বলে,”আমরা নিজেও এতগুলো দিন আমাদের সম্পর্কটা বুঝতে পারিনি। তবে কিছুদিন আগে হঠাৎ করেই ম্যাক্স আমাকে জানায় ওর নাকি আমার প্রতি অদ্ভুত অনুভূতি আছে। যদিও ও এটা বলার সময় ড্রাংক ছিল তাই আমি ওর এই কথাকে খুব একটা পাত্তা দেই না। কিন্তু পরদিন আবার ও আমাকে একই কথা বলে। আমি তো তখন ম্যাক্সকে বলেছিলাম ওকে বন্ধুর থেকে বেশি কিছু ভাবি না। কিন্তু ম্যাক্স তো ছেড়ে দেয়ার পাত্র না। ও তো আমার পেছনেই পড়ে যায়। আর আমার মনও আগে থেকে ম্যাক্সের জন্য কিছুটা হলেও দূর্বল ছিল কিন্তু ওকে শুধু নিজের বন্ধুর নজরে দেখার জন্য আমি ব্যাপার টা বুঝতে পারি নি৷ কিন্তু যখন ও আমায় বলল, ভালোবাসার কথা আর বার বার এভাবে আমাকে মানানোর চেষ্টা করল তখন আমি আমার এই অনুভূতি আর বেশিদিন চেপে রাখতে পারি না। ওকে বলে দেই যে ওকে আমি ভালোবাসি। এরপর ও হঠাৎ বিয়ে করার কথা বলে৷ আমি তো এত তাড়াতাড়ি বিয়ে করতেই চাই নি। কিন্তু শেষ অব্দি ওর জেদের কাছে হার মেনেই নিলাম। আসলে..ম্যাক্স আসলে অনেক ভালো মনের ছেলে। ওকে স্বামী হিসেবে পাওয়া সত্যিই ভাগ্যের ব্যাপার।”
এলার কথায় নিঝুম হেসে বলে,”তোমাদের ভবিষ্যৎ জীবন সুখের হোক। এই কামনাই করি।”
এলা এবার নিঝুমের কানের কাছে এসে বলল,”তোমায় কিছু বলব..যদি কিছু মনে না করো।”
“হুম, বলো।”
“আবরাজকে তুমি চাইলে একটা সুযোগ দিয়ে দেখতে পারো। ও কিন্তু সত্যি সত্যি তোমায় ভালোবেসে ফেলেছে। আমি, ম্যাক্স ও আবরাজ স্কুলজীবন থেকে একে অপরের অনেক ভালো বন্ধু। আমরা একে অপরের পালস বুঝতে পারি। বিশ্বাস করো, আবরাজের চোখে এর আগে অন্য কারো জন্য এমন অনুভূতি আমরা দেখি নি যেমনটা তোমার জন্য দেখেছি। লন্ডনে বেড়ে উঠলেও আবরাজ ছিল সবার থেকে আলাদা। ও কখনো কোন মেয়ের সাথে কোন রিলেশনে যায়নি। ও সব সময় চেয়েছে, বিয়ের পরই তোমাদের ধর্ম মতে হালাল ভাবে কাউকে ভালোবাসবে। এজন্য ওর চারিত্রিক বিশুদ্ধতার গ্যারান্টি আমি তোমাকে দিতে পারি।”
আবরাজের সম্পর্কে এসব কথা শুনে নিঝুমের অন্যরকম অনুভূতি হচ্ছিল যদিওবা তবুও সে বলে,”আমি এই ব্যাপারে কথা বলতে বা শুনতে চাই না এলা। আমি এ ব্যাপারে যা সিদ্ধান্ত নেবার নিয়ে ফেলেছি। মিস্টার আবরাজ এর সাথে সংসার করা আমার পক্ষে সম্ভব নয়।”
“একটু ভেবে দেখতে যদি..”
“নো। প্লিজ..এ নিয়ে আর কিছু বলো না।”
বেশ রাগী কন্ঠে বলে নিঝুম। এলা একটা দীর্ঘ শ্বাস ফেলে বলে,”বেশ, তুমি যদি অস্বস্তি বোধ করো তাহলে আমি আর এই নিয়ে কথা তুলব না।”
নিঝুম এলাকে নিয়ে এবার বাইরে আসে। এলার সাজ কমপ্লিট। বাইরে বিয়ের প্রস্তুতি করা হয়েছে। এলা একটি লম্বা গাউন পড়েছে নিজের বিয়ে উপলক্ষে, অন্যদিকে ম্যাক্সও সাদা ফর্মাল সার্টের উপর কালো কোর্ট ও টাই পড়েছে যেমনটা লন্ডনে বিয়ের সময় পরা হয়। তবে তাদের বিয়ের একটি বিশেষ রীতি মেয়ের বাবা মেয়েকে লাল কার্পেটের উপর দিয়ে হাটিয়ে ছেলের কাছে নিয়ে যায়। যেহেতু এলার বাবা নেই তাই সে নিঝুমকে বলে,”আজ নাহয় নিয়মের একটু ব্যত্যয় ঘটুক। তুমি নাহয় আমাকে ম্যাক্সের কাছে নিয়ে চলো।”
নিঝুম আপত্তি করে না। এলার হাত ধরে তাকে ম্যাক্সের কাছে নিয়ে যায়। অতঃপর ম্যাক্স ও এলা বিয়ের শপথ বাক্য পাঠ করে সবশেষে রেজিস্ট্রি পেপারে সাইন করার মাধ্যমে তাদের বিয়ে সম্পন্ন করে। এরপর সবাই আনন্দে মেতে ওঠে। আবরাজ ম্যাক্সকে আলিঙ্গন করে বলে,”শুভ কামনা, বন্ধু। তোমার ভবিষ্যৎ জীবন সুখের হোক।”
“তোমারও।”
এটা শুনেই আবরাজ মলিন হাসে। ম্যাক্স বলে,”আমি তো আমার ভালোবাসার মানুষটার মন জয় করে তাকে নিজের করে নিলাম। এবার তোর পালা। তুই এবার গিয়ে তোর বউয়ের মান ভাঙা। তাকে নিজের করে রাখার চেষ্টা কর।”
“তাই করবো।”
“বেস্ট অফ লাক।”
বলেই ম্যাক্স এলার কাছে চলে যায়। দুজনে মিলে কিছু সুন্দর মুহুর্ত কাটায়। এদিকে নিঝুম এককোণে দাঁড়িয়ে ছিল। আবরাজ তার কাছে আসে। আবরাজকে দেখে নিঝুম কিছুটা অবাক হয়। আবরাজ বলে,”তাহলে এখন যাওয়া যাক।”
“জ্বি, চলুন।”
দুজনে বাইরে এসে গাড়িতে বসে পড়ে। আবরাজ গাড়ি ড্রাইভ করতে করতে নিঝুমকে বলে,”তুমি কি আমাকে আর একটা সুযোগ দেবে না?”
“কালকে আমার সিলেটে ফেরার জন্য ফ্লাইট বুক করে দিন।”
“নিঝুম!”
“আমি নিজের সিদ্ধান্ত বদলাবো না। এই নিয়ে আমায় জোর করে লাভ নেই।”
আবরাজ একটা দীর্ঘ শ্বাস ফেলে৷ বলে,”আমায় ক্ষমা করলে কি খুব ক্ষতি হয়ে যাবে?”
“সব কিছুর ক্ষমা হয় না মিস্টার আবরাজ। আমি চাইলেও আপনাকে ক্ষমা করতে পারব না।”
“কিন্তু..”
অশ্রুজলে বোনা বিয়ে পর্ব ২৫
“প্লিজ..আমি নিজের সিদ্ধান্ত জানিয়ে ফেলছি। আমাকে আর কিছু বলবেন না। আমি বিব্রত বোধ করছি।”
“বেশ, তোমার জেদই যদি তোমার কাছে বেশি হয় তবে তাই হোক। তুমি ফিরে যাও সিলেট। আমি আর তোমাকে বাঁধা দেব না। তুমি যেভাবে চাও সেভাবেই তোমার জীবন কাটাও। আর তিন মাস পর তো আমাদের বিয়ের ৬ মাস পূর্ণ হবে। তারপর আমি তোমায় ডিভোর্স পেপারও পাঠিয়ে দেব।”
“ধন্যবাদ!”