অশ্রুজলে বোনা বিয়ে পর্ব ২৯
ইয়াসমিন খন্দকার
নিঝুমের জীবনে একয়দিনে অনেক পরিবর্তন এসেছে৷ লন্ডন থেকে আসার পর আজ এক মাসের কাছাকাছি হতে চলল৷ এই এক মাসে আবরাজের সাথে তার যোগাযোগ হয়নি। সিলেট মেডিকেলে চান্স পাবার পর আপাতত নিঝুম পড়াশোনাতেই মনযোগ দিয়েছে যাতে নিজের একটা সুন্দর জীবন গড়তে পারে। তবে সব সময় আমাদের জীবন তো আমরা যেমন চাই সেভাবে এগোয় না। নিঝুমের ক্ষেত্রেও তাই হলো। সে যেভাবে ভেবেছিল সেভাবে জীবন আগাতে পারল না।
কিছুদিন থেকেই নিঝুম বেশ অসুস্থ বোধ করছে। মাথা ব্যাথা, বমি বমি ভাব এসব উপসর্গের কারণে ডাক্তারের শরণাপন্ন হতে হলো তাকে। ডাক্তার নয়না খান সব উপসর্গ শুনে জিজ্ঞেস করেন,”আপনার শেষ পিরিয়ড কবে হয়েছিল?”
নিঝুম কিছুটা বিব্রত বোধ করে বলে,”বেশ অনেক আগেই হয়েছিল।”
“একজন মেডিকেল স্টুডেন্ট হিসেবে তো আপনার সন্দেহ করার কথা ছিল বিষয়টা নিয়ে।”
নিঝুম বলে,”আমার ব্যাপারটা নিয়ে সন্দেহ হয়েছিল। কিন্তু আমার মনে একটা ভয় ছিল আর সেজন্যই আমি এই বিষয়টা নিতে ভাবতে চাইনি।”
“বিয়ের কয়দিন হলো?”
“জ্বি, ৫ মাসের মতো।”
“আপনার স্বামী জানে এই বিষয়ে?”
“আমার স্বামী লন্ডনে থাকে। আর ওনার সাথে আমার সম্পর্ক স্বাভাবিক না।”
“ওহ। বুঝতে পেরেছি। যাইহোক, সত্যটাকে তো আর অস্বীকার করা যাবে না। আমি প্রায় নিশ্চিত যে আপনি প্রেগন্যান্ট। বাকিটা তো রিপোর্ট আসলেই জানা যাবে।”
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
নিঝুম একটা দীর্ঘ শ্বাস ফেলে। এই ভয়টাই সে পাচ্ছিল। জীবনে এমন একটা মোড় আসবে সেটা সে চিন্তাও করতে পারে নি। আল্লাহর কাছে কত অনুরোধ করেছে এমনটা যাতে না হয়। কারণ যেখানে এই সম্পর্কেরই মূল্য নেই সেখানে একটা নতুন প্রাণের আগমনে তো পরিস্থিতি আরো জটিল আকার ধারণ করবে।
নিঝুম এসব ভেবেই দুশ্চিন্তাগ্রস্ত ছিল৷ এমন সময় একজন নার্স নিঝুমের রিপোর্টটা নিয়ে আসে। ডাক্তার নয়না খান রিপোর্টটা দেখে দীর্ঘ শ্বাস ফেলে বলেন,”যা ভেবেছিলাম তাই সত্য। আপনি প্রেগন্যান্ট।”
নিঝুম পুরোপুরি ভাষাহীন হয়ে পড়ে। বলার মতো কিছুই খুঁজে পায় না। ডাক্তার নয়না খান তার দিকে রিপোর্ট কার্ডটা বাড়িয়ে দিয়ে বলেন,”আমি বুঝতে পারছি আপনার অবস্থাটা জটিল তবে আপনাকে পরামর্শ দেব, নিজের খেয়াল রাখুন। স্বাস্থ্যকর খাবার খান,যেহেতু আপনি মেডিকেল স্টুডেন্ট তাই এই ব্যাপারে আশা করি আপনার জ্ঞান আছে।”
নিঝুম শুকনো মুখে উঠে দাঁড়ায়। অতঃপর ক্লিনিক থেকে বেরিয়ে আসে। তার চোখের কোণে জল জমে। এই মুহুর্তে তার মনে পড়ে যাচ্ছে আবরাজ কিভাবে জোরপূর্বক তার সাথে শারীরিক সম্পর্ক করেছিল৷ এই ঘটনাটা মনে করে সে বলে,”এর জন্য আমি আপনাকে কখনোই ক্ষমা করবো না মিস্টার আবরাজ।”
বাসায় ফিরে নিজের রুমে এসে চুপচাপ বসে আছে নিঝুম। শান্তি বেগম নিঝুমের পাশেই তার রিপোর্ট হাতে নিয়ে বসে আছেন। মা হিসেবে নিঝুমের কষ্টটা তিনি বুঝতে পারছেন। তাই তিনি বলেন,”এখন কি সিদ্ধান্ত নিবি তুই? এব্যাপারে কিছু ভেবেছিস?”
নিঝুম বলে,”ভাবার কি আছে? এই বাচ্চাটা আমার৷ আমি সেটা অস্বীকার করতে পারবো না। এই বাচ্চাটা আমি রাখবো এবং নিজের পরিচয়েই এই বাচ্চাটাকে বড় করব।”
“কি বলছিস ভেবে বলছিস তো তুই নিঝুম? এই সমাজে একটা বাচ্চাকে বাবার পরিচয় ছাড়া বড় করবি তুই?”
“তাছাড়া আমি কি করবো বলো আম্মু?”
“আমার মনে হয়, তোর আবরাজের সাথে এই বিষয় নিয়ে কথা বলা উচিত। যতো যাইহোক এই বাচ্চাটা তো আবরাজেরই। ওরও তো একটা দায়িত্ব আছে।”
“তোমার মনে হয়, উনি এই বাচ্চার দায়িত্ব নেবেন? উনি তো আমাকেই মেনে নিতে চান নি।”
“হ্যাঁ, কিন্তু বাচ্চাটাকে তো মানতে পারে।”
নিঝুমের মনে পড়ে যায় আবরাজের বলা শেষ কথাগুলো। সেসব ভেবে সে মনে মনে বলে,”ওনাকে যদি আমি এই বাচ্চার ব্যাপারে জানাই, তাহলে নিশ্চয়ই উনি এটাই সন্দেহ করবেন যেই এই বাচ্চাটা ওনার নয়। এই বাচ্চাটা ইমরানের। উনি তো আমাকে দুশ্চরিত্রা বলেই দিয়েছেন। এখন আর যাইহোক, এই বিষয় নিয়ে ঘাটাঘাটি করে আমি নিজের বাচ্চার দিকে কোন আঙুল উঠতে দেব না। আমি কিছুতেই এটা মেনে নেবো না, যে আমার বাচ্চাকে জারজ বলা হবে।”
তাই নিঝুম তার মায়ের উদ্দ্যেশ্যে বলে,”আমি আমার সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছি। এই বাচ্চাটাকে আমি একাই মানুষ করব।”
বলেই সে রুম থেকে বেরিয়ে যায়। শান্তি বেগম নিঝুমের যাওয়ার দিকে তাকিয়ে বলেন,”তুই যতো যাই বলিস না, কেন। এসব তোর আবেগের কথা। আমি বাস্তবতাটা বুঝি রে। তাই তোকে কোন ভুল পথে পা বাড়াতে দেব না। তোর মা হিসেবে তোর ভালোর চিন্তা আমাকেই করতে হবে।”
এমন ভাবনা থেকেই শান্তি বেগম ছবি বেগমের সাথে কথা বলতে যান। ছবি বেগম তখন বসে টিভি দেখছিলেন। শান্তি বেগমকে দেখেই তিনি টিভি বন্ধ করে বলেন,”শান্তি তুমি! আচ্ছা, নিঝুমের কি খবর গো? ও না ডাক্তার দেখাতে গেল। ডাক্তার কি বলল?”
“অনেক বড় খুশির খবর আছে আপা। আপনি দাদি হতে চলেছেন।”
ছবি বেগম অবাক হয়ে বলেন,”বাহ, এটা তো অনেক খুশির খবর। আমি আগেই জানতাম, একসাথে থাকলে ওদের মধ্যকার সবকিছু ঠিক হয়ে যাবে। আল্লাহ যা করেন ভালোর জন্যই করেন। আমার মনে হয়, ওদের মধ্যে সব ঠিক হয়েছিল তারপর আবার কোন ভুল বোঝাবুঝি হয়েছিল। নিঝুম তো আমাদের কিছু খুলে বলে নি। আমি একটা কাজ করি, আবরাজকে খুশির সংবাদ টা দিয়ে দেই।”
“জ্বি, আপা। আপনি আবরাজকে একটা ফোন দিন। আমি ওর সাথে কথা বলব। এরা দুজনেই অনেক জেদি। আমাদেরকেই এদের বোঝাতে হবে।”
“হুম।”
ছবি বেগম আবরাজকে কল দেন। আবরাজ তখন সবেমাত্র বার থেকে ফিরেছে। সে তখনো মদ্যপ ছিল। নেশার ঘোরে তার মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছিল, নিঝুম ও ইমরানের একত্র অবস্থায় দেখে ফেলার ঘটনাটা। এমন সময় তার ফোন বেজে উঠতেই সে বিরক্ত স্বরে বলে,”এত রাতে কে ফোন করল! ধুর!”
ফোনটা কোনরকমে রিসিভ করতেই বিপরীত দিক থেকে ছবি বেগম বলেন,”আবরাজ কেমন আছ তুমি?”
“ভালো, আপনি?”
“আমিও আলহামদুলিল্লাহ ভালো।”
শান্তি বেগম বলেন,”আপা আমায় ফোনটা দিন। আমি একটু আবরাজের সাথে কথা বলি।”
“আচ্ছা, ঠিক আছে। আবরাজ এই নে। তোর শাশুড়ী তোর সাথে কথা বলবে।”
শান্তি বেগম ফোনটা হাতে নিয়েই বলেন,”আবরাজ শুনতে পাচ্ছ আমার কথা?”
“হুম, পাচ্ছি।”
“আমি নিঝুমের মা বলছি। দেখো বাবা,আমি জানি তোমাদের বিয়েটা সে অবস্থায় হয়েছে সেটা স্বাভাবিক ছিল না। এ নিয়ে তোমাদের মধ্যে ঝামেলা হওয়াও স্বাভাবিক। কিন্তু বিয়ে তো একটা পবিত্র সম্পর্ক। এটাকে তো আর অস্বীকার করা যায় না। তাই তোমরা যদি তোমাদের মধ্যে সব সম্পর্ক ঠিক করে নিতে..আর তোমাদের ভবিষ্যত..”
আবরাজের নেশা তখন বাড়ছিল তার উপর নিঝুমের নাম শুনে মাথায় রাগও চড়ে বসে। সে বলে ওঠে,”আপনার ঐ দুশ্চরিত্রা মেয়ের সাথে আমি সংসার করবো এটা কিভাবে ভাবলেন?”
“কিসব বলছ তুমি বাবা? আমার মেয়ে এমন নয়।”
“আপনার মেয়ে কেমন সেটা আমি নিজের চোখে দেখছি। অন্য একটা ছেলের সাথে ওকে আমি একটা বদ্ধ রুমে ঘনিষ্ঠ অবস্থায় দেখেছি। আর আপনি এসেছেন আপনার সেই মেয়ের হয়ে দালালি করতে!”
শান্তি বেগমের বুকের বা পাশে হঠাৎ প্রচণ্ড ব্যাথা অনুভূত হয়। তিনি বলেন,”না, আমার মেয়ে এমন নয়।”
“আপনার মেয়ে এমনই। ও একটা চরিত্রহীন, একটা ব্যাভিচারী মেয়ে।”
ছবি বেগম শান্তি বেগমের দিকে খেয়াল করে বলেন,”কি হয়েছে তোমার শান্তি? হঠাত এমন করছ কেন?”
অশ্রুজলে বোনা বিয়ে পর্ব ২৮
এদিকে শান্ত বেগম প্রচণ্ড ঘামতে থাকেন। তার বুকের ব্যাথা বাড়তে থাকে। তার মেয়েকে নিয়েই তো তার আশা ছিল৷ সব হারিয়ে এই মেয়েকে নিয়েই বাঁচার স্বপ্ন দেখেছিলেন। তার চরিত্র সম্পর্কে এমন কথা তার সহ্য হয়না। শান্তি বেগম বুকে হাত দিয়ে পড়ে যান মাটিতে। নিঝুম এদিক দিয়েই যাচ্ছিল। নিজের মাকে এভাবে পড়ে যেতে দেখে সে দ্রুত ছুটে এসে হলে,”আম্মু কি হয়েছে তোমার?”
শান্তি বেগম নিঝুমের দিকে তাকিয়ে কিছু বলার চেষ্টা করেন কিন্তু পারেন না। তার আগেই তার দুচোখ চিরজীবনের মতো বন্ধ হয়ে যায়।