রং পর্ব ২৫

রং পর্ব ২৫
তন্নী তনু

রাতের আলো আধারের খেলার মাঝে সিনথিয়ার চোখটা ভেজা মাটির মতো ভিজে ওঠে। পৃথিবীর কি নির্মম পরিহাস।এই ছোট্ট একটা পৃথিবীতে মানুষের জীবন নিয়ে কতো রকমের গল্পের সৃষ্টি। প্রতিনিয়ত কতো মানুষের দীর্ঘশ্বাসের সাথে বের হয় হৃদয়ের অদৃশ‍্য কতো যন্ত্রণা, কতো হাহাকার।জীবনের গল্পে হিসাব না মেলা কতো অংক, কতো রাশি। জীবনের অংক সত‍্যিই বড় কঠিন। কেউ ভালোবাসা পাওয়ার জন‍্য হাহাকার করে পায় না, আর কেও পেয়েও অবহেলায় হারায়। ইরফাদের বলা কথা গুলো হৃদয়ের দোরগোড়ায় পৌছে মৃদ‍্যু জ্বালা ধরায় সিনথিয়ার। হাহাকার করে ওঠে মন। ইরফাদ কিছুক্ষণ পজ দিয়ে আবার বলা শুরু করে,

— সতেরোটা দিন একটা ঘোরের মধ‍্যে ছিলাম। সেই ঘোর কাটে নিধির দেয়া কলে। ঝড় তুফানে বিলীন করে নেয়া এই হৃদয় খানি তার গলার ছোঁয়া পেয়ে একটু একটু করে জোড়া লাগে। কিন্তু পরবর্তী একমিনিটের মধ‍্যে আবার ভেঙেচুড়ে শেষ হয়ে যাই আমি। যে গলার স্বর ছিলো আমার সস্তির কারণ সেই গলার স্বর সেদিন আমার হৃদয়কে আগুনে দগ্ধ করে।সে আমাকে কঠিন গলায় বলে,” সে ডিভোর্স চায়। চায় মানে এখন চায়।”
আমি শুধু প্রশ্ন করেছিলাম,” কেনো ডিভোর্স চাও নিধি? আমি কি ভালোবাসতে পারিনি?”

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

সে উত্তর দিয়েছিলো,” কোনো কারণ নেই।” আর কারণ না থাকাটাই আমাকে এতোগুলো বছর পুড়িয়েছে।
প্রিয় মানুষের চাওয়া কি অপূর্ণ রাখা যায় সিনথি?তার কোনো চাওয়াই আমি তো অপূর্ণ রাখিনি। দিয়ে দিলাম। কি বা চেয়েছে- একটা পেপার্স সাইন ই তো করতে হবে।করে দিলাম- দিয়ে দিলাম মুক্তি। কিন্তু প্রিয় মানুষকে কাগজে কলমে নিজের করে নেওয়া যতোটা আনন্দের সেই মানুষটাকে চিরতরে কাগজে কলমে বাদ করে দেওয়াটাও ঠিক ততোটাই যন্ত্রণার। “অধিকার ফলানোর চেয়ে অধিকার তুলে নেওয়া অনেক কঠিন।” একটা পেপারস সাইন করে মানুষ যখন প্রিয় মানুষটিকে নিজের করে পায় তখন তার রাজ‍্যজয়ী আনন্দ হয়। আবার সেই পেপার্স সাইন করে ঐ মানুষটাকে চিরতরে ছুটি দিতে যে দাবানল হৃদয়ে সৃষ্টি হয়-তা যদি কেউ বুঝতো তাহলে বিচ্ছেদের যন্ত্রণা কেউ কাউকে দিতো না। কে বলে ছেলেরা কাঁদে না? আমি তো কেঁদেছিলাম।সে কান্নার হলো না কোনো শব্দ, এলো না একফোটা চোখের জল। ভাগ‍্যের নির্মম পরিহাসের এক আকাশ যন্ত্রণা মাথায় নিয়ে আমি তাকে মুক্ত করলাম এই ভেবে, ভালোবাসার অপর নাম যদি ভালো রাখাই হয় তাহলে ভালোবাসা ভালো থাকুক।

তবে এখানেই শেষ নয়। ঠিক এগারো দিন পর নিধি আরেকটা কল দেয়। আমার সাথে মিট করতে চায়। আচ্ছা ঠিক আছে দেখা করলাম। তার কথাগুলো তুমি শোন সিনথি- তুমিই ফিল করো। মুখোমুখি বসে আমরা দুজন। সে বললো, ” ইরফাদ তুমি আমার কোনো চাওয়াই অপূর্ণ রাখোনি।আমি এই মূহুর্তে খুব নিরুপায়। বাসা থেকে নিউ এফেয়ার কোনো ভাবেই মানছে না। আই নিড ইউর হেল্প।”
আমি বললাম,” ওকে, যা চাও তাই হবে।”
মানুষের বুকের মধ‍্যেও অনেক সময় ঝড়ের তান্ডব হয়। সব তোলপাড় হয়ে যায়। তবে তা শব্দহীন। আমার বুক তখন দুরুদুরু করে কাঁপে। সে আমাকে বললো,” আমাকে দুদিন থাকার ব‍্যবস্থা করে দিতে পারবে?”
আমার মনের সাথে মনের প্রশ্ন।আমি আমার এক্স বউকে কি করে কাছে রাখবো? এটা কি সম্ভব। সে তখন নিজে থেকে বললো,” তোমার কাছে থাকবো না। মানে তোমার কোনো মেয়ে ফ্রেন্ডের কাছে রাখতে পারবে? তারপর অভ্রকে বিয়ে করে আমি চলে যাবো।”

আমি রাজি হলাম। ভালোবাসার মানুষ বলে কথা।শেষ ইচ্ছে কখনোই অপূর্ণ রাখবো না। দুদিন পর নিধি আমাকে ফোন দিল। বললো,” অভ্র তো সাহস পাচ্ছে না। তোমার কাছে একটা জিনিস চাইবো, ধরে নাও এটাই তোমার কাছে শেষ চাওয়া।”
আমি তাকে আশ্বস্ত করলাম, প্রথম হোক বা শেষ সব ইচ্ছেই আমি পূরণ করবো। নিধি আমাকে বলে,
— আমাকে অভ্রের সাথে বিয়ের ব‍্যবস্থা করে দাও।

কথাটি বলে ইরফাদ ম‍ৃদু হাসলো। সে হাসির কোনো শব্দ হলো না। তারপর আবার বলা শুরু করলো,
আমি ছেলেটার সাথে কথা বললাম। সে বললো,” আমি তো স্টুডেন্ট। বুঝতে পারছি না কি করবো। ভয় লাগছে।” আমি বললাম,” আপনি বিয়ে করতে চান কি না? সে বললো,” হুম।” তখন বললাম- বাকি দায়িত্ব আমার।
নিজ দায়িত্বে বিয়ের শপিং করলাম। চোখের সামনে নতুন বউ সাজলো নিধি। তবে আমার জন‍্যে না। অন‍্য পুরুষের জন‍্যে। নিজ দায়িত্বে, নিজে সাক্ষী হয়ে নিজের প্রাক্তন বউকে বিয়ে দিলাম। আমার ভালোবাসার মানুষ আমার সামনে “কবুল” বললো। বুকের পাজর ভাঙার যদি শব্দ হতো, হৃদয় ভাঙার যদি শব্দ হতো। তাহলে আমার হৃদয় ভাঙার শব্দ সেদিন আসমান অবধি পৌছাতো।মানুষ ভালোবাসতে ভয় পেতো। আমার ভেতরের হাহাকার যদি পরিমাপ করা যেতো। আমার শব্দহীন কান্না যদি প্রকাশিত হতো তা দিয়ে একটা সাগর হয়ে যেতো।
আমি ঐ ভাঙাচোরা হৃদয় নিয়েও নিজেকে রিকভার করেছি। কিন্তু রাস্তাটা কিন্তু মসৃণ ছিলো না। ডিভোর্সী শব্দটা ইরফাদের সাথে জড়িয়ে যে নতুন পৃথিবী আমি দেখেছি। সেখান থেকে নিজেকে দাঁড় করানো এতোটাও সহজ ছিলো না। গল্পটা দুমিনিটে বলা গেলেও। ইটস আ লং টার্ম,লং প্রসেস। নিজের অস্তিত্ব কে বললেই বিলীন করা যায় না। ইটস আ প্র‍্যাকটিস।

অনেক অনেক অনেক কথা বললাম সিনথি। এর একটা কারণ হলো- তোমার বলা রাফির বিয়ের ড্রেসক্রিপশন অনেকটা হৃদয় থেকে অনুভব করেছিলাম। এই ব‍্যাথা আমি বুঝি। আমি চাইনি তুমি ভেঙে পড়।আমি চেয়েছি তুমি স্ট্রং থাকো। একারণেই আমি তোমার সাথে বরাবর ফ্রেন্ডলি ছিলাম। কিন্তু এই ফ্রেন্ডলি হওয়া টা ডেঞ্জার সাইন দিবে ভাবিনি। আমি অনেক কিছু পার করে এসেছি। চোখ দেখলেই মাইন্ড রিড করতে পারি। তোমাকেও রিড করে ফেলেছি। তুমি তোমার ছোট্ট মনে আমার জন‍্যে সফট কর্ণার বয়ে বেড়াচ্ছো। এটা আর না বাড়ুক। ইটস আ রং ইমাজিনেশন।

সিথনিয়া আপাদমস্তক কেঁপে ওঠে। বুকের ভেতরের কোনো একটা জায়গায় তীব্র শব্দ হয়। হৃদয়ের মধ‍্যেকার লুকিয়ে রাখা ডায়েরির পাতার লেখাগুলো আজ ইরফাদের চোখ পড়ে নিয়েছে । কি হবে এখন? ইরফাদ পেছন ঘোরে। পলকহীন দৃষ্টিতে সিনথিয়ার চোখে চোখ রাখে ইরফাদ। ধরা পড়া চোরের মতো চোখ সরিয়ে নেয় সিনথিয়া। এই সূচালো চোখ দিয়েই কি ইরফাদ সব পড়ে নিলো। ইরফাদের ধীর শান্ত গলা,
— প্রয়োজনে মরে যাও তবুও ভালোবাসার বিষ পান কোরো না। পাওয়া যতোটা সুখ ধরে রাখা এর চেয়ে বেশী কঠিন। আর পেয়ে হারানো আরোও বেশী তীব্র যন্ত্রণার। আমি চাইনা তোমার ভেতরে আমার জন‍্য কোনো অনুভূতি থাকুক।
সিনথিয়া মনের সাথে কথা বলে। এই মূহুর্তে তার কি কোনো উত্তর দেয়া উচিত? এতো সিনিয়র একজন মানুষের সাথে মুখে মুখে কথা বলা কি উচিত। কিন্তু ভালোতো সে বেসেই ফেলেছে।ভালোবাসা যদি ফিরিয়েই নেয়া যেতো। তাহলে পৃথিবীতে এতো যন্ত্রণা কেউ বয়ে বেড়াতো না। আর বুকের মধ‍্যে লুকায়িত কথা যখন বেড়িয়ে গেছেই এই মূহুর্তে তার পিছু হটে লাভ নেই। জয় পরাজয়ের যুদ্ধ এখন সামনা-সামনি। সিনথিয়া কাঁপা কাঁপা গলায় বলে,

— ভালোবাসা কি অন‍্যায়??
— ভালোবাসা শুদ্ধ, পবিত্র অনুভূতি। ভালোবাসা কখনোই অন‍্যায় নয়। না পাওয়ার যন্ত্রণার পরিধি বিশাল। যে আগুনে আমি পুড়েছি সে আগুনে কেউ না পুরুক।
— আপনি চাইলেই আমি পুড়বো না। তবে পোড়ালে তো পুড়তেই হবে।
–প্রথমত তুমি বাচ্চা একটা মেয়ে। কঠিন পরিস্থিতিতে রিকভার করার “ওয়ে” আমি দেখিয়েছি। দ‍্যাটস মিন এই নয় সব বলার রাইটস আমি দিবো।
— আমি কোনো রাইটস চাইনি। আপনার উপর কথা বলার সাহস আমার নেই। আমি আপনাকে সম্মান করি। আর বুঝেই যখন ফেলেছেন। ভালোবাসা প্রকাশ করতে আমার সংকোচ নেই। ভালোবাসার অপর নাম যদি ভালোরাখা হয়। আমি একবার ভালোবেসে দেখাতে চাই– আমি ভালো রাখতে জানি। আমি ভালোবাসতে জানি।

— ‘ভালোরেখে’ ভালোবাসার মানুষকে কখনো ধরে রাখা যায় না।
— সেইটা ভুল মানুষের ক্ষেত্রে। আমি একটা সুযোগ চাই। আমি আপনাকে ভালোরাখতে চাই স‍্যার।
ইরফাদের গলা ঝাঝালো। চোখে রাগ স্পষ্ট,
— ডোন্ট ক্রস ইউর লিমিট। বাচ্চা ভেবে তোমাকে শুধু রেড জোন চেনাতে এসেছি। সফট ভেবে কঠোরতাকে তুমি ভুলে যেয়োনা।
— আমি কিচ্ছু ভুলিনি। ঐ কঠিন হৃদয়কে আমি স্পর্শ করতে চাই। হৃদয়ের সমস্ত ভালোবাসা নিংড়ে দিয়ে আমি সকল কষ্ট ভোলাতে চাই।
–আমার হৃদয় পাথর। এ হৃদয়ে না আছে দুঃখ না আছে কষ্ট। সো এসবের কোনো প্রয়োজন পড়বে না। তোমাকে এলার্ট করা আমার রেসপন্সসিবিলিটির মধ‍্যে পড়ে। এলার্ট করেছি। আমার কাজ শেষ।
সিনথিয়া এক পা সাহস নিয়ে এগিয়ে যায়। আকাশের দিকে মুখ করে তাকায়। দুহাত মুক্ত পাখির মতো ছড়িয়ে দেয়। ভেতরে দিরিমদিরিম বাজতে থাকে অনুভূতিরা।বুকের মধ‍্যে সকল দূর্বলতা,ভয় কে বন্দি করে বলে,
এই আকাশ-বাতাস, চাঁদ-জ‍্যোস্না, এই মধ‍্যেরাত্রি এই পুরো পৃথিবীকে সাক্ষী রেখে বলছি,
— “ভালোবাসি।” ঐ লৌহকঠিন হৃদয়কে ভালোবাসি। ঐ কঠিন মানুষটাকে ভালোবাসি….
ইরফাদের গলায় ধমকের সুর,

রং পর্ব ২৪

— স্টপ ইট।
চেপে রাখা ভয় গুলো ছিটকে বেড়িয়ে আসে। দু”পা পিছিয়ে দাঁড়ায় সিনথিয়া। কাঁপা কাঁপা গলায় বলে,
—-বাক স্বাধীনতায় আপনি যেমন স্বাধীন সে রকম আমিও স্বাধীন। ভালোবাসি বলাটা আমার বাক স্বাধীনতার মধ‍্যে পড়ে।আপনি চাইলে ইগনোর করতেই পারেন।
— আর একবারও এসব টলারেট করবো না। এই কঠিন হৃদয়, পাথরের মন কোনো কিছু দিয়েই তুমি স্পর্শ করতে পারবে না। শুধু শুধু বৃথা চেষ্টা করে নিজেকে কষ্ট দিও না।
— ভুল মানুষের আঘাতে যে হৃদয় পাথরে পরিণত হয়েছে আমার হৃদয়ের শুদ্ধতম ছোঁয়া দিয়ে সে পাথরে আমি ফুল ফুটাবোই। ইটস মাই চ‍্যালেঞ্জ।

রং পর্ব ২৬