প্রণয়ের বাঁধন পর্ব ৩৭
মুসতারিন মুসাররাত
রোদ ঝলমলে শ্রাবণের সকাল, নিস্তব্ধ ঘরে ধীরে ধীরে ঘুম ভাঙল নিতির। চোখের পাতায় তখনও ঘুমের আবেশ, যেন স্বপ্নের তাজা রেখা মুছে ফেলার আগেই প্রকৃতি তাকে স্বাগত জানাতে আসছে। কাঁচের জানালার ফাঁক গলিয়ে সোনালি রোদ্দুর রুমে প্রবাহিত হয়ে উষ্ণতা ছড়িয়ে দিচ্ছিল। একফালি রোদ চোখে পড়তেই নিথর ঘুমে আচ্ছন্ন নিতির চোখদ্বয় ধীরে ধীরে খোলার প্রস্তুতি নেয়। কিন্তু ঘুমের মাঝেই এক অদ্ভুত অনুভব, কোমড়ে শক্ত এক বাঁধন। নিতি চট করে চোখ মেলে তাকিয়ে দেখে, ঘুমে আচ্ছন্ন দিব্য তার কোমড় একহাতে শক্তভাবে আঁকড়ে ধরে, গায়ের সঙ্গে মিশে শুয়ে আছে। বিস্ময়ে নিতির চোখদুটো বড়বড় হয়ে যায়। নিতি হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে রয়। রোজকার দিনের মতো ভারত-পাকিস্তান সীমারেখা টানতে কাজে আসা কোলবালিশটি আজ হঠাৎ উধাও! আর কীকরে দিব্যর এতটা কাছে এসেছে? প্রশ্নগুলো মস্তিষ্ককে ঘুরপাক খাচ্ছে। কিন্তু উত্তর অজানা! কেবল আকাশছোঁয়া বিস্ময়। নিতি তড়িঘড়ি করে দিব্যর হাতটা কোমড় থেকে সরানোর চেষ্টা করে। কিন্তু দুই হাত দিয়ে চেষ্টা করেও কিছুতেই সফল হলো না। অতঃপর কণ্ঠে কঠোরতা টেনে বলল,
-” ছাড়ো! ছাড়ো বলছি।”
দিব্যর কপাল কুঁচকে যায়। যেন খুব বিরক্তি ভর করেছে ওর উপর। একটু নড়েচড়ে চায় দিব্য। চোখের ভারী পাতা টেনেটুনে তুলে ঘুমঘুম কণ্ঠে বলল,
-” কী হয়েছে?”
নিতি অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে। আচমকা মুখ থেকে বেরিয়ে আসে,
-” তুমি আমার এত কাছে কী করে?”
দিব্য যেন আকাশ থেকে পরে। এক ঝটকায় এদিক-ওদিক তাকিয়ে অবাক হওয়ার ভান ধরে বলল,
-” আমি! আমি নই তুই আমার কাছে। আমি তো নিজের বালিশেই আছি। বরং দ্যাখ তুই জায়গা ছেড়ে আমার জায়গায় চলে এসেছিস।”
দিব্যর হাতের বাঁধন ঢিল হতেই নিতি তড়িঘড়ি ওঠে বসে। কপালে গভীর ভাঁজ ফেলে বলে,
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
-” আমি কখন?”
-” ঘুমের মধ্যে।”
-” অ্যা!”
দিব্য উঠে বসতে বসতে বলল,
-” হ্যাঁ, ঘুমের ঘোরে শুধু জড়িয়েই ধরিসনি। আরো কত কী..।”
দিব্যর কথা শুনে নিতির মুখটা থমথমে হয়ে যায়। কাঁদো কাঁদো মুখ করে বলল,
-” আরো কত কী মানে? অসম্ভব! মিথ্যে বলছো।”
শেষের কথাগুলো বড়বড় চাউনীতে চেয়ে চেঁচিয়ে বলে ওঠে নিতি। দিব্য ডোন্ট কেয়ার ভঙ্গিতে শোয়া থেকে ওঠে বসে। একহাতে একটা বালিশ কোলের উপর বসিয়ে মুখটা ইন্নোসেন্ট বানিয়ে বলে,
-” তোর মনেহয় আমি এ ব্যাপারে মিথ্যে বলব? সবচেয়ে বড় কথা, আমি নিজ থেকে তোকে কাছে টানবো? এ-ও তোর কাছে বিশ্বাসযোগ্য!”
শেষের কথাটা নিতির গায়ে লাগে। কিছুটা অপমানিত বোধ করে। তবে দিব্যর কথাও পুরোপুরি অবিশ্বাস্য ঠেকছে না। নিতি আর এ ব্যাপারে টু শব্দটি করতে চায় না। মুখ বেঁকিয়ে বেড ছেড়ে নামতে নেয়, তন্মধ্যে দিব্য ফিচেল হেসে বলল,
-” কিসব বাচ্চাদের মতো গেঞ্জি পরে ঘুমোস। আজকের পর থেকে এসব বাদ দিয়ে বড়সড় ড্রেস পরে ঘুমোবি, ক্যামন?”
নিতি ঘাড় ঘুরিয়ে দিব্যর দিকে তাকায়। দুইহাত নিজের গায়ের দিকে ধরে দাঁত চেপে বলল,
-” এটা গেঞ্জি নয়। এটা লেডিস টিশার্ট, ক্লিয়ার?”
-” যা ফিনফিনে, শরীরের অবয়ব স্পষ্ট বোঝা যায়। তবে তুই যদি আমাকে সিডিউস করতে এসব পড়িস। তাহলে বলবো, আচ্ছা ঠিক আছে।”
নিতির চোখদুটো বিস্ফোরিত হয়। তৎক্ষণাৎ দুইহাতে টেনেটুনে টিশার্ট ঠিক করতে ব্যস্ত হয়ে পরে, ত্রস্ত হাতে প্লাজু টেনে দেয় গোড়ালি অবধি। জিভ দিয়ে ঠোঁট ভিজিয়ে জড় গলায় বলে উঠল,
-” ই-ইউ রং। আমার বইয়ে গিয়েছে তোমাকে সিডিউস করতে। গরমের মধ্যে এটা পরে ঘুমুতে কমফোর্টেবল ফিল করি। তাই, হু।”
কথা শেষ করেই নিতি চপল পায়ে ওয়াশরুমে ঢোকে। দিব্য ধপ করে বিছানায় শরীর এলিয়ে দেয়। রোদের তীক্ষ্ণ আভা থেকে বাঁচতে আলতো করে চাদর টেনে নেয় মুখের ওপর।
ডাইনিং টেবিলে নাস্তার তোড়জোড় চলছে। ধোঁয়া ওঠা খিচুড়ি, বেগুন ভাজা, ইলিশ মাছ ভাজা, ডিমের ঝুরি, মুরগির কষা আরো গরম গরম ফুলকো রুটি আর পরোটা সাজানো টেবিলজুড়ে। নিতি তনুজার পাশে দাঁড়িয়ে সাহায্য করছে, প্লেটে খাবার গুছিয়ে রাখতে। তন্মধ্যে নৃত্য প্রাণবন্ত হাসি নিয়ে পাশে এসে দাঁড়িয়ে বলল,
-” গুড মর্নিং এভরিওয়ান!”
তনুজা ঠোঁটের কোণে এক চিলতে হাসি টেনে জবাব দেয়,
-” গুড মর্নিং ননদিনী।”
নৃত্য বিনিময় প্রশস্ত হাসলো। চেয়ার টেনে বসতে গিয়ে আচমকা নৃত্যের চোখ নিতির দিকে আটকালো। কপাল কুঁচকে সরু চোখে চেয়ে নিতিকে উদ্দেশ্য করে প্রশ্ন করল,
-” আপু! তোমার গলায় কীসের দাগ?”
নিতি বি’র’ক্ত মুখে তাকিয়ে বলল,
-” কই! কোথায়?”
নৃত্য আঙুল তুলে দেখিয়ে বলল,
-” এইযে এখানে? কেমন কালচে হয়ে আছে?”
নিতি ঢের বি’র’ক্তি নিয়ে অতীষ্ঠ চোখে চেয়ে বলল,
-” এইযে এখানে এখানে করছে..আমি মনেহয় দেখতে পাচ্ছি।”
নৃত্য ফোঁস করে নিঃশ্বাস ফেলে নিতির কাঁধ ধরে বেসিনের সামনে এনে দাঁড় করায়,
-” আমার কথা বিশ্বাস হচ্ছিল না তো। এবার আয়নায় নিজেই দ্যাখো।”
নিতির চোখ আয়নায় পড়তেই ফর্সা গলায় জমাট বাঁধা কালচে দাগ স্পষ্ট হয়ে ওঠে। মূহুর্তেই কপালে ভাঁজ পরে। কিছু বুঝে ওঠার চেষ্টা করে। কিছুপল পর নির্বোধের মতোন চেয়ে পরপর বলল,
-” কী জানি বুঝতে পারছি না। পিঁপড়ে-টিপড়ে কা’ম’ড়েছে হয়তো।”
নৃত্য অবাক হয়ে বলল,
-” পিঁপড়ে! পিঁপড়ে আসবে কোত্থেকে? আমি তো ভেবেছিলাম তোমার মে বি এলার্জি হয়েছে।”
ওদিকে তনুজা মিটমিট করে হাসছিল। তনুজার মুখের অভিব্যক্তি দেখে নিতির মস্তিষ্ক সজাগ হয়। কপালের ভাঁজ মিলিয়ে যায়। মনে মনে দিব্যকে প্রশ্নবিদ্ধ করে। এদিকে তনুজার হাসি দেখে নিতির লজ্জা অস্বস্তি হয়। নিতির সমস্ত রাগ-ক্ষোভ গিয়ে বর্তাল নৃত্যর উপর। দাঁত কিড়মিড় করে বলল,
-” আনারসের শরীরের মতো শখানেক চোখ নিয়ে ঘুরিস নাকি? কারো চোখে ধরা না পড়লেও তোর চোখের আড়াল হয় না কিছু।”
নৃত্য তাজ্জব বনে যায়। সে আবার কী করল? যার দরুণ নিতির এরুপ তিরস্কার! নৃত্য আঙুল দিয়ে চোখের চশমাটা ঠিক করে ঠোঁট উল্টে বলল,
-” আমার চোখের আবার কী দোষ? বুঝলাম না তো।”
তিরিক্ষি গলায় নিতি বলল,
-” বুঝতে হবে না তোর।”
এরমধ্যে তনুজা আলতো গলায় বলল,
-” নৃত্য তোমার স্কুলের টাইম হয়ে যাচ্ছে তো। তাড়াতাড়ি ব্রেকফাস্ট সেরে নাও। নইলে ফুপি এসে আবার ব’ক’বে।”
দুইবোনের কথা কা’টা’কা’টি মিমাংসা করতে তনুজা তাড়া দেখিয়ে বলে নৃত্যকে। তনুজার দিকে তাকিয়ে স্মিত হেসে বলে নৃত্য,
-” থ্যাংকিউ ভাবিমণি।”
তনুজা কিচেনে যায়। নিতির চুলগুলো মাথার উপর ঝুঁটি করে বাঁধা ছিলো। গলা ঘেঁষে কাঁধের উপর দিয়ে চুলগুলো সামনে রাখে, দাগটা আড়াল করতে। ডাইনিংয়ে এখনো বড়রা আসেনি। এরমধ্যে আজ সকাল সকাল দিব্যর আগমণ দেখে নিতির ভ্রু কুঁচকে যায়। হালকা ভেজা চুল। মনে হচ্ছে শাওয়ার নিয়ে সোজা চলে এসেছে। চুলের ভেজাভাব এখনো শুকায়নি। নীলচে ডেনিম জিন্স, পারফেক্ট ফিট, সাথে সাদা টিশার্ট। শরীরের সাথে একটু ঢিলেঢালা, কিন্তু এতেই যেন বেশি স্টাইলিশ লাগছে। দিব্য এক হাত চুলে আঙুল চালিয়ে সামনে এল। নিতির দৃষ্টি থমকে গেল। নিজেকে সামলে পরপর দৃষ্টি সরিয়ে নেয় নিতি। দিব্য কোনোদিকে না তাকিয়ে সোজা চেয়ার টেনে বসতে নেয়, সেই মূহূর্তে নিতি দিব্যর দৃষ্টি আকর্ষণ করতে হালকা কাশে,
-” এহেম এহেম।” শব্দ করে। দিব্যর হাত দু’টো চেয়ারের পিঠে থেমে যায়। ভ্রুকুটি করে নিতির দিকে চাইল। নিতি রাগি দৃষ্টি নিক্ষেপ করে দিব্যর দিকে। একহাত কানের পাশে নিয়ে চুলকানোর ভঙি করে। তারপর গলার কাছে আঙুল ছুঁইয়ে ফিসফিসিয়ে বলে,
-” এসবের মানে কী? ঘুমের মধ্যে আমি তোমার কাছাকাছি যায়নি, এটা স্পষ্ট প্রমাণ। বরং তুমিই আমার ঘুমের সুযোগ নিয়েছো।”
দিব্য নির্লিপ্ত, নির্বিকার। ভ্রুদ্বয়ের ভাঁজ মিলিয়ে শান্ত গলায় বলল,
-” আগে তোর একটু-আকটু মাথা খারাপ ছিলো। তবে ইদানিং দেখছি পুরোটাই খা’রাপ হয়েছে। তা পাবনায় পাঠানোর ব্যবস্থা করবো নাকি?”
স্বীকার তো করলোই না, উল্টো ঘুরিয়ে ফিরিয়ে পা/গ/ল বলে ছাড়ল। নিতির মেজাজ চ’টে যায়। কিছু বলার আগেই দিব্য নিম্নস্বরে বলল,
-” তোর ঘুমের সুযোগ নিবো! যেখানে শুরু থেকেই হাজারো সুযোগ তুই দিয়ে এসেছিস। কখনো সুযোগ লুফে নেওয়ার চেষ্টা করেছি? বল…তুই বল?”
-” আগের কথা আর এখনকার কথা এক নয়। ইদানিং আবহাওয়ার মতো থেকে থেকেই চেঞ্জ হচ্ছে তোমার মুড। যা আমি স্পষ্ট বুঝতে পারছি।”
-” ইউ টোটালি রং।”
নিতি বিড়বিড় করে বলে,’ যতদিন মুখ ফুটে স্বীকার না করছো, তুমি আমাকে ভালোবাসো। ততদিন তোমার প্রতি হওয়া আমার অনুভূতিগুলো প্রকাশ করবো না। আর তোমাকে একটু শা’স্তি দেওয়ার জন্য, নিজে থেকে ধরা না দেওয়া, এন্ড নিজেকে দূরেদূরে রাখা। কিন্তু তুমি তো তুমিই! এক আচ্ছা ধূর্ত! ধূরন্দর লোক! দূর্বলতা প্রকাশ করবে না, আরো উল্টো ঘোল খাইয়ে ছাড়বে। উফ্!’
এসব কথা মনে মনে ভেবে পিছু ঘুরতে নেয়, কাঁধের উপর দিয়ে সামনে থাকা চুলের গাছি ইচ্ছে করে পিছুনে বারি মা’রে, যা দিব্যর মুখের উপর গিয়ে পরে। ঘাড় ফিরিয়ে দিব্যর দিকে তাকিয়ে ভাব নিয়ে চেয়ার টেনে পরপর বসতে নেয় নিতি। ওদিকে দিব্য রাগল না, শান্ত থাকল। মুখে বাঁকা হাসি নিয়ে মনে মনে শয়তানির ফন্দি আঁটে । ঠিক যখন নিতি বসতে নিচ্ছে, তখনই দিব্য পিছুন থেকে নিঃশব্দে চেয়ারটা সরিয়ে নেয়।
-” ধপাস!”
শব্দ করে নিতি সোজা ফ্লোরে পরে। তৎক্ষণাৎ কোমড়ে হাত রেখে চোখমুখ ব্যাথায় কুঁচকে মৃদু আর্তনাদ করে ওঠে,
-” আহ্!”
ওদিকে দিব্য নির্বিকার ভঙ্গিতে নিজের চেয়ারে বসতে থাকে। মুখে এক চিলতে ফিচেল হাসি। ওপাশের চেয়ারে বসে খাবার খাচ্ছিল নৃত্য, এ দৃশ্য দেখে মিটমিট করে হাসতে থাকে। তন্মধ্যে শিরিন ডাইনিংয়ে আসতে গিয়ে নিতিকে দেখে চমকে ওঠে শুধালেন,
-” ওমা! সেকি নিতি পড়লি কী করে!”
নিতি দাঁতে দাঁত চেপে কটমট চোখে দিব্যর দিকে চেয়েছিলো। শিরিনের কথা কানে পৌঁছতেই উঠে বসতে নেয়। এরমধ্যে শিরিন তড়িঘড়ি করে কাছে আসে। উদ্বিগ্ন কণ্ঠে প্রশ্ন করলেন,
-” কোথাও লাগেনি তো? আর পড়লি কীভাবে?”
-” তোমার আদরের ধন গুনধর পুত্রকে সেটা জিজ্ঞেস করো?”
নিতির এটা বলতে ইচ্ছে করলেও মুখে এটা না বলে নিশ্চুপ থাকে। এরমধ্যে শিরিন দিব্যকে উদ্দেশ্য করে ধ’ম’কের সুরে বললেন,
-” মেয়েটা পরে গিয়েছে, কোথায় টেনে তুলবি। তা না আরাম করে বসে আছিস।”
দিব্য নির্বিকার ভঙ্গিতে বলল,
-” দেখেশুনে না চললে তো পড়বেই। মাম্মা তুমি আমাকে না বলে, যে পড়েছে তাকে বরং দেখেশুনে চলতে-ফিরতে বলো।”
বিস্ময়ে নিতির চক্ষু কোটর ছাড়ার জোগাড়। কী ডাহা মিথ্যা! আগে হলে নিতি শিরিনের কাছে নালিশ করতো। মামী তোমার ছেলে এহেন কর্ম করে কী সুন্দর অবলীলায় মিথ্যে বলছে! তবে আজ শুধু মামী নয় শ্বাশুড়িও। তাই বলতে গিয়েও বলল না। বরং পরে দিব্যকে দেখে নিবে বলে চুপচাপ রইল। হাত দু’টো ঝেরে চেয়ারে বসল।
এরমধ্যে তামান্না উপস্থিত হয়। তনুজা কিচেন থেকে এদিকেই আসছিলো হঠাৎ শিরিন ডাকল,
-” তনুজা?”
-” হ্যা মামনি।”
-” ইভানকে দেখছি না। এখনো নিচে নামেনি যে।”
-” একেবারে রেডি হয়ে আসছে হয়তো। চলে আসবে এক্ষুনি।”
-” সবাই বসেছে, ছেলেটা এখনো নামল না।”
তনুজা আলতো হেসে বলল,
-” আমি দেখছি মামণি।”
শিরিন ইতস্তত গলায় বলল,
-” আবার কষ্ট করে উপরে উঠবে। বুয়া ডেকে..”
কথার মাঝেই তনুজা নম্র স্বরে বলল,
-” সমস্যা নেই মামণি। আমি এমনিতেই এখন উপরেই যাচ্ছিলাম ফ্রেশ হতে।”
শিরিন অমায়িক হেসে বলল,
-” ওহ্ ঠিক আছে।”
তনুজা রুমে যাবে বলে পা বাড়াতে গিয়ে থেমে যায়। পরপর বুয়াকে ডেকে বলল,
-” দিদুনের খাবার গুছিয়ে রেখেছি। রুমে দিয়ে এসো।”
বুয়া -“আইচ্ছা ভাবীমণি” বলে খাবার নিয়ে পা বাড়ায়। তনুজা উপরে যেতে থাকে। নুরজাহানের কোমড়ের ব্যাথা বেড়েছে বিধায় বেড রেস্টে আছেন। বাড়ির সকলের প্রতি তনুজার দায়িত্ব পালন দেখে শিরিন ক্ষণেক্ষণেই মুগ্ধ হোন মেয়েটির উপর। মেয়েটার সব দিকে কত সুন্দর নজর! লক্ষীমন্ত একটা মেয়ে। মনেমনে বলে আলতো হেসে হাতের কাজে মনোযোগ দেয় শিরিন সুলতানা। ফ্রুটস জেলির কৌটা আর ব্রেড দিব্যর দিকে এগিয়ে দিতেই দিব্য বলল,
-” এটা রাখো। খিচুড়ি দাও। ওটাই খাব।”
দিব্যর সকালের নাস্তায় আজ হঠাৎ পরিবর্তন দেখে শিরিন খানিকটা বিস্মিত হলেন। দিব্যর প্লেটে ইলিশ মাছ ভাজি আর বেগুনের চাক ভাজি তুলে দিতে দিতে জিজ্ঞেস করলেন,
-” দিব্য আজ এত তাড়াতাড়ি ব্রেকফাস্ট টেবিলে। কোনো কাজ আছে?”
দিব্য ছোট করে বলে,
-” হুম।”
নিতি ভেংচি কে’টে মনেমনে বলে,’ এর আবার কাজ। ঐতো গিয়ে বন্ধুদের সাথে আড্ডা দিবে। সাথে এটা-ওটা ঝামেলা পাকাবে। এছাড়া আর কী? হুঁ!”
এসব ভেবে মাথা ঝাড়া দিয়ে খাবার মুখে তুলে নেয় নিতি। খাবার চিবুতে চিবুতে আড়চোখে দিব্যর দিকে তাকায়। সবার অগোচরে দিব্যর দিকে ঝুঁকে ফিসফিসিয়ে বলল,
-” কী যেনো এক কথায় প্রকাশ ছিলো, ও হ্যা মনে পড়েছে। আমিষের অভাব; যাকে এককথায় বলে নিরামিষ। তা নিরামিষ থেকে নিজেকে কনভার্ট করে আমিষে রুপান্তরিত হচ্ছো নাকি? সেইজন্য আজকে ব্রেকফাস্টে বেডের জায়গায় আমিষ খাচ্ছো।”
দিব্য একহাতে পানির গ্লাস তুলে নিয়ে ঢকঢক করে পুরো গ্লাস সাবাড় করে গ্লাসটা টেবিলে নামায়। নিতি কোনো উত্তর না পেয়ে খাওয়ায় মনোনিবেশ করে। এরমধ্যে হঠাৎ পায়ে স্পর্শ পেতেই নিতির সারা শরীর কেঁপে উঠল। পুরো শরীর জুড়ে বিদ্যুতের ঝলকানির মতো শকড খায়। দিব্য পা দিয়ে নিতির পায়ে স্লাইড করে। দিব্যর চোখে চঞ্চল ভঙ্গি। ঠোঁটে রহস্যময় হাসি। নিতির পায়ের উপর পা দিয়ে স্লাইড করতে করতে নিতির দিকে ঝুঁকে ফিসফিসিয়ে বলল,
-” তোর কথা ভেবে ভেজিটেরিয়ান থেকে নন-ভেজেটেরিয়ান হতে পারছি না। একবার নন-ভেজ হলে তোকে আর খুঁজে পাওয়া যাবে না। আমাকে সামলাতে হিমশিম খাবি। আমার স্পর্শে সেন্সলেস হয়ে না পড়িস সেই ভয়ে, আজীবন ভেজই না থাকতে হয়।”
নিতির গাল লজ্জায় পাকা টমেটোর মতো লাল হয়ে উঠল। তবে কণ্ঠে লজ্জার লেশমাত্র নেই। নিজেকে সামলে গভীর চোখে তাকিয়ে, দৃঢ় স্বরে বলল,
-” তুমি যদি ভেবে থাকো আমি দূর্বল। তবে ভুল ভাবছো। তুমি ঝড় হলে, আমি পাহাড়। তোমার দাপট সামলানোর শক্তি আছে আমার।”
কথাটা বলতে বলতে নিতি নিরাপদ দূরত্বে পা সরিয়ে নেয়। দিব্য নিতির চোখে গভীর দৃষ্টি রাখল। ঠোঁটের কোণে চিরচেনা বাঁকা হাসি। কণ্ঠে রহস্য মিশিয়ে ফিসফিস করে বলল,
-” ইউ থিংক ইউ আর আ মাউন্টেন? উই’ল সী। টুনাইট, ইউ উইল হ্যাভ টু প্রুভ জাস্ট হাও স্ট্রং ইউ রিয়েলি আর অ্যাগেইনস্ট মাই স্টর্ম।”
এক চিলতে দুষ্টুমি হাসি ছুঁড়ে মুখ ফিরিয়ে নেয় দিব্য। যেন কথাগুলো বাতাসে মিশে রইল। রাতের প্রতিক্ষায়। এদিকে নিতি শুকনো ঢোক গিলল। ওতো মজার ছলেই অমন করে বলেছিলো। কিন্তু দিব্য যে সিরিয়াসলি নিবে তা ঘূর্ণাক্ষরেও টের পায়নি নিতি।
ঘড়ির কাঁ’টা রাত বারোটার ঘর পেরিয়ে, এক পা এক পা করে চলে যাচ্ছে গভীর রাত্রির দিকে। বাইরে রাতের আকাশে মেঘের ঘনঘটা, দমকা হাওয়া যেকোনো মুহূর্তে ঘূর্ণির মতো ছুটে আসবে। ঝিরিঝিরি বৃষ্টির শব্দ এক অন্যরকম আবহ তৈরি করেছে, যেন এক মনোরম সুরে প্যাঁচানো। বিছানার হেডের সাথে হেলান দিয়ে শুয়ে দিব্য। পরনে ব্লু টিশার্ট আর এ্যশ কালারের ট্রাউজার। এক পায়ের সাথে অন্য পা মেলে শুয়ে ফোন স্ক্রল করছে। আর মাঝে মাঝে ধোঁয়া ওঠা কফির মগে চুমুক দিচ্ছে।
রুমের একপাশে থাকা কুশনে বসে নিতি। গায়ে হালকা রঙের সুতির কুর্তি। কোমল সিল্কি চুল পিঠজুড়ে ছড়িয়ে। নিতি ফোনে কথা বলছিলো বান্ধবীর সাথে। ফোনে বান্ধবীর সাথে গল্প করতে করতে, হাসি ঠাট্টার মাঝে এক অদ্ভুত আনন্দে ডুবে যাচ্ছিল নিতি। সকালবেলায় নাস্তার টেবিলে বসে দিব্যর বলা কথা বেমালুম ভুলে বসেছে। দিনভর ব্যস্ততার মাঝে সকালের কথা এখন অবধি মাথায় আসেনি। নিতি ভেবে নিয়েছে দিব্যও তার মতোই ফাজলামি করেই বলেছে। ভিডিও কলে কথা বলছে আর কফি খাচ্ছে নিতি। অনেকক্ষণ গল্প শেষে ফোনের ওপাশ থেকে রিয়া বড় করে হামি দিয়ে বলল,
-” ঘুম পাচ্ছে রে। অনেক রাত হয়েছে। রাখি।”
নিতি বলল,
-” আচ্ছা।”
ফোন কাটতে গিয়ে রিয়া হঠাৎ টিপ্পনি কে’টে বলল,
-” এই যাহ্! এত সুন্দর বৃষ্টির রাতে এত সময় ফোনালাপ করে তোদের রোমান্টিক মূহুর্তটা ন’ষ্ট করে ফেললাম না তো! তুই মুখে বলতে পারছিলি না, তবে মনেমনে নিশ্চয় বেজায় চটেছিস আমার উপর। স্যরি রে দোস্ত! বিষয়টা আমার মাথায়ই ছিলো না।”
নিতি প্রত্যুত্তরে বলল,
-” আরেহ না না! তুই যেমন ভাবছিস ওমন মোটেই নয়।”
-” আচ্ছা দোস্ত ভালো থাক। গুড নাইট।”
-” গুড নাইট।”
ফোন কা’ট’তে কা’ট’তে মুখ ফস্কে বলে ফেলে নিতি,
-” সবাই কী ভাবে! অথচ তারা তো আর জানে না, আমার তিনি হলেন এক তৃণভোজী..।”
বিছানার দিকে যেতে যেতে কথাটা বলে নিতি। সামনে তাকাতেই দিব্যর চোখে চোখ পরে। দিব্য এদিকেই চেয়েছিলো। দিব্যর দৃষ্টি দেখে নিতির মুখটা হা হয়ে যায়। মনেমনেই কপাল চাপড়ায় নিতি। সাথে নিজেকে হাজারটা গা/লি দেয়। কথাটা আগে এত বলতো যে নিতির মুদ্রাদোষ হয়েছে। সময় অসময়ে মুখ ফস্কে বেরিয়ে পরে। বেডের পাশে বেড-টেবিলের উপর নিতি ফোনটা নামিয়ে রাখে। দিব্য তড়াক পা দু’টো ঝুলিয়ে বসল। কণ্ঠে মেকি আক্ষেপ জড়িয়ে বলল,
-” ওপসসস! আমি তো ভুলেই গিয়েছিলাম।”
নিতির কণ্ঠ কেঁপে ওঠে, ফাঁকা ঢোক গিলে অস্ফুটে বলে,
-” ক-কী?”
দিব্য ধীরসুস্থে উঠে দাঁড়ায়। কফির মগে শেষ চুমুক বসিয়ে নিতির দিকে ঝুঁকে সুর তোলে,
-” উফ্ কিয়া রাত আয়া হ্যায় মোহাব্বাত রাঙ লাইয়ে হ্যায়। হাম জাশনা মানায়েঙ্গে, সাগার ঝালকায়েঙ্গে, না হোশ মে আয়েঙ্গি।”
এতটুকু বলে আচমকা ভান করে নিতির গায়ের দিকে ঢলে পরে। দিব্যর উষ্ণ গাল ছুঁয়ে যায় নিতির নরম-কোমল ত্বক । মূহুর্তেই বিদ্যুৎ শিহরণ বয়ে যায় নিতির শরীর জুড়ে। বুকের ভেতর দম বন্ধ অনুভূতি। নিতি ধাক্কা দিয়ে দিব্যকে সরিয়ে দিয়ে পাশ কাটিয়ে যেতে নেয়। দিব্য চট করে নিতির হাত চেপে ধরে। নিজের কাছে টেনে আনে। নিতির বুকটা দুরুদুরু কাঁপছে। দিব্য একহাতে নিতির মুখের উপর থাকা একগাছি চুল সযত্নে কানের পিঠে গুঁজে দেয়। নিতি ঠোঁট নেড়ে কিছু বলবে, তার আগেই দিব্য বলল,
-” অ্যাম আই হারবিভোরাস অর কার্নিভোরাস? কাম, লেট সো ইউ প্র্যাকটিক্যালি।”
দিব্যর দৃষ্টি নিতির মুখের দিকে নিবদ্ধ। নিতির ঠোঁট তিরতির করে কাঁপছে। কণ্ঠনালী শুকিয়ে চৌচির। জিভ দিয়ে ঠোঁট ভিজিয়ে কোনো রকমে বলল,
-” আমি তো মজার ছলে বলেছিলাম। তুমি…।”
নিতির ভীতু মুখশ্রী। তারপর কাঁপা কাঁপা চোখের পল্লব। কম্পিত ওষ্ঠ। দিব্যর দৃষ্টিকে সম্মোহিত করে। দিব্যর চাহনি অন্যরকম। মা’দকতা ছড়িয়ে আছে আজ ও চোখেতে। এক আঙুল নিতির ঠোঁটের উপর রাখে দিব্য। বলে,
-” আ’ম সিরিয়াস। আ’ম নট জোকিং এ্যট অল।”
দিব্যর আঙুল সরিয়ে দেয় নিতি। অতঃপর নিতি দু’পা পিছাতেই বেডে গিয়ে ঠেকে। একটু থমকিয়ে পিছুন ফিরে তাকায়। তারপর ধপ করে বসে পরে। চোখেমুখে গাম্ভীর্য ভাব টেনে মিছেমিছে রাগ দেখিয়ে বলল,
-” মাথা ঠিক আছে তোমার! আমি তো সকালে মজার ছলেই বলেছিলাম।”
দিব্য পাশে বসে নির্ভার ভঙিতে সটান শুয়ে পরল। পা দুটো বেড ছাড়িয়ে বাইরে দুলছে। হাত দু’টো ভাঁজ করে মাথার নিচে রেখে শুণ্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল,
-” রোজ রোজ সিডিউস করে, মাথা যদি কেউ খা’রা’প করে, তাহলে এতে আমার দোষ কোথায় বলতো?”
কথা শেষ করেই আচমকা নিতির হাত ধরে হেঁচকা টান দেয় দিব্য। ভারসাম্য হারিয়ে নিতি দিব্যর গা ঘেঁষে কাছাকাছি পরে। দিব্য নিতির দিকে ঝুঁকে এলে, নিতি শোয়া থেকে ওঠে বসতে চায়। কিন্তু তার আগেই দিব্য নিতির হাত দু’টো বিছানার সাথে শক্ত করে ধরে আঁটকে ফেলে।
রাত যতই গভীর হতে থাকে, আকাশ ভেঙে ততোই বর্ষণ নামতে থাকে। আকাশও যেন তার সমস্ত আবেগ ঢেলে দিচ্ছে ধরণীর বুকে। জানালার কাঁচ বেঁয়ে জলের ধারা গড়িয়ে পরছে। রুমের ভেতরও যেন তার প্রতিধ্বনি বাজছে। নিতির বুকের ধড়ফড় ক্রমশ বাড়ছে। হৃদস্পন্দন দ্রুত, নিঃশ্বাস গাঢ়। দিব্যর চোখে এক ধরণের মা’দ’ক’তা, ও চোখেতে গভীর ভালোবাসা মিশ্রিত আকুলতা। বর্ষার শীতল বাতাস জানালার পর্দা গলে রুমে প্রবাহিত হয়। মূহুর্তেই রুমে দিব্যর গরম নিঃশ্বাসের বর্ষণের সাথে মিলেমিশে একাকার হয়। দিব্য ধীরে ধীরে নিতির দিকে ঝুঁকে আসে। নিতির ঠোঁটে আঙুল ছোঁয়ায়। বাইরের বিদ্যুৎ চমকানোর সাথে সাথে স্পর্শের বিদ্যুৎতে কেঁপে ওঠে নিতির পুরো কায়া। নিতি কাঁপা কাঁপা গলায় বলল,
-” সরো।”
দিব্য নির্লিপ্ত। নিতি ফের বলল,
-” আ’ম ফিলিং ভেরি স্লিপি।”
নিতির গালে গাল ছুঁইয়ে দিব্য হাস্কি স্বরে বলল,
-” আ’ম ফিলিং রোমান্টিক।”
থেমে নিতির ঠোঁটে বৃদ্ধা আঙুল রেখে বলল,
-” ইউর লিপস আর ড্রাইভিং মি ক্রেজি। আই রিয়েলি ওয়ান্ট টু টেস্ট দেম।”
কথা শেষ হতেই আচমকা দিব্য নিতির ঠোঁটে ঠোঁট ডুবায়। প্রথমে ছটফট করলেও পরক্ষণেই নিতি থেমে যায়। আবেশে চোখ বুজে নেয়। কোমল একটা হাত দিব্যর চুলের ভাঁজে চলে যায়। মুঠো করে ধরে দিব্যর মাথার পিছনের চুল। কয়েক মিনিট পর ছাড়া পেতেই নিতি বড়বড় শ্বাস টানে। লজ্জায় আড়ষ্ট হয়ে চোখ বুজে থাকে নিতি। দিব্য নিতির কানের পাশে মুখ নিয়ে বলে,
প্রণয়ের বাঁধন পর্ব ৩৬
-” লেট’স মেক টুনাইট আনফরগেট্যাবল। মে আই?”
নিতির নীরব থাকাকেই মৌন সম্মতি ধরে নেয় দিব্য। নিতির কপালে প্রগাঢ় চুম্বুন এঁকে মোলায়েম স্বরে বলল,
-” আই ওয়ান্ট দিস নাইট, দিস মোমেন্ট , দিস ওয়ার্ম টাচ টু নেভার ইন্ড।”
কথাটা শেষ করেই নিতির গলায় মুখ গুঁজে দিব্য। নিতি আলতো করে জড়িয়ে ধরে দিব্যকে। ঘরময় ভালোবাসার উষ্ণতা সময়ের সাথে বাড়তে থাকে। ভালোবাসার আবেগময় অনুভূতি সম্পন্ন মূহুর্তে একে অপরের কাছে গভীর হয়। যেখানে ভাষার থেকেও বেশি কথা বলে স্পর্শ আর অনুভূতি।