রং পর্ব ৩০

রং পর্ব ৩০
তন্নী তনু

কিছু কিছু অকাঙ্ক্ষিত ঘটনায়- সময়কে থামিয়ে দিয়ে যদি সবকিছু রোধ করা যেতো মানুষ হয়তো তাই করতো। তবে জীবনের যুদ্ধে দূর্ঘটনা এক স্বাভাবিক প্রক্রিয়া। সামান‍্যতম ভুল বড় দূর্ঘটনা ডেকে আনে। কি হতো যদি! সিনথিয়াকে বাসার গেইট অবধি দিয়ে আসতো ইরফাদ!অথবা সেইফ জোনে পা রাখা অবধি রাস্তায় অপেক্ষা করলে কতোটুকু সময় ব‍্যায় হতো? কিন্তু এগুলো কেবল অনুশোচনা। তবে ভুল তো হয়েই গেছে। এই মূহুর্তে অতীত ভেবে কোনোই লাভ নেই। শুধু সময় নষ্ট। হোটেল রুমের ধবধবে সাদা চারদেয়াল।সাদা চাদর জড়ানো বিছানার পাশে শূন‍্য দৃষ্টি মেলে দাঁড়িয়ে আছে ইরফাদ।

বাকিরা যা বোঝার অডিও ক্লিপ শুনেই বুঝে নিয়েছে। এই মূহুর্তে সকলেই ইরফাদের মুখপানে চেয়ে আছে। শূন‍্য থেকে চোখ ফিরিয়ে নেয় ইরফাদ।প্রতিদন্দীর বুদ্ধি যতো তীক্ষ-ই হোক- চোখের অগোচরে যে মেয়েটিকে গুটির চাল হিসেবে তারা ধরে নিয়ে গেলো তাদের সকলকে ঈগলের তীক্ষ্ম নখের আচড়ে ছিন্নভিন্ন করে দিয়ে আসাই এখন তার কাজ। কাজের বাইরে একটা চিন্তাও না।কিন্তু সময় যে বড্ড কম।মেয়েটা তার ভরসায় রাতের আধারে লুকিয়ে এসেছিলো। তার একটা ছোট্ট পরিবার আছে।এই রাতের মধ‍্যে তাদের আমানত উদ্ধার করে কি তাদের কাছে সম্মানমতো পৌঁছে দেয়া আদও সম্ভব?

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

ফিঙ্গারপ্রিন্টে আঙ্গুল ছোঁয়ায় ইরফাদ। পুরো স্ক্রিন জুরে বাচ্চা একটা মেয়ের হাস‍্যজ্জ্বল মুখ চাঁদের মতো আলো ছড়াচ্ছে। তার কপালের কাছ টায় চারটা সংখ‍্যা বলে দিচ্ছে তিনটা বাজতে এক মিনিট বাকি। সকাল হতে কয়েক প্রহর বাকি। এই স্বল্প সময়ে কি অসাধ‍্য সাধন সম্ভব? ভাবনার পেঁচানো জাল ছিড়ে বাস্তবে ফেরে ইরফাদ। লম্বা পা ফেলে বাইরে বেরিয়ে যায়। পিছু পিছু সমান তালে হাঁটে সহকর্মীরা।হোটেলের রিসিপশনে দেয়া তথ‍্যগুলো ফেইক। তাই একমাত্র উপায় চেকপোস্ট গুলোতে নজরদারী। যাতে ক্রিমিনাল দৃষ্টি সীমানার বাইরে যেতে না পারে। এটিই একমাত্র পথ। ইরফাদের গলা শক্ত,
— জাবির!
–জ্বি স‍্যার!
— আশেপাশের সকল চেকেং পয়েন্ট গুলোতে এলার্ট করুন। সিনথিয়ার বাসার আশে পাশে যতোগুলো রাস্তা আছে ঐখানের ফুটেজ কালেক্ট করতে বলেন। হারি আপ!
— ওকে স‍্যার।

দুই ঘন্টা পেরিয়ে গেছে এখনো চেকিং পয়েন্টগুলোতে কিচ্ছু জানা যায়নি। সিনথিয়ার বাসার সামনে লাগানো সিসি ক‍্যামেরা রাত দুইটার পরের কোনো ফুটেজ নেই। সব কিছুই খুব দক্ষ হাতে সুক্ষ সুনিপুণ ভাবেই করা হয়েছে। ইরফাদ সিনথিয়াকে রিস্কে ফেলবেনা ভেবেই রাতের অন্ধকারে মেয়েটির সাথে দেখা করতো। কিন্তু আশঙ্কা আজ সত‍্যিতে পরিণত হলো একটু ভুলের কারণে। প্রথমত মেয়েটির নিরাপত্তা, দ্বিতীয়ত সকালের সিনথিয়ার পরিবারের পরিস্থিতি মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে। যেহেতু চেকিং পোস্ট গুলোতে এরকম কোনো কিছু ধরা পড়েনি। তাহলে ক্রিমিনাল হয়তো খুব একটা দূরে যায়নি। ইরফাদ জাবিরকে নিয়ে বের হয়। বাকিদের ভিন্ন ভিন্ন কাজ বুঝিয়ে দিয়ে গাড়ি স্টারট দেয় ইরফাদ। ইরফাদের চোখ দুটো শুধু সামনেই পড়ে আছে। জাবির বলে,

— স‍্যার! আমাদের উচিৎ সকালের অপেক্ষা করা।
— আই নোউ! কিন্তু মেয়েটির পরিবার সকাল হওয়া মাত্র তার রুম চেক করবে। সর্বোচ্চ দশটা এগারোটা পর্যন্ত তাদের মেয়ে ঘুমাচ্ছে বলে মেনে নিবে। দ‍্যান??
–জানি স‍্যার।তবে আমাদের হাতেও তো কিছু নেই। এটা কোনো কিডন‍্যাপিং কেস না। উদ্দেশ‍্য অন‍্য কিছু। আমার মনে হয় মেয়েটার কোনো ক্ষতি করবে না।
— সে কথা আমি তার পরিবারকে কি করে বুঝাবো? তারা মানবে?
— স‍্যার না বললে হয় না? আই মিন!আজ রাতের ঘটনা তাদের না বললে হয় না?
–পরপর এতোগুলো ধাক্কা তারা কি করে সহ‍্য করবে?
— এডপ্টেড মেয়ে স‍্যার!
–তো?? তারা যতেষ্ট ভালোবাসে তাদের মেয়েকে। এবং চিন্তাও করে। মিস সিনথিয়া জেলে থাকাকালীন তার মা হসপিটালাইজড ছিলেন।

–তো কি করবেন স‍্যার!
–খুঁজবো….
— কোথায়…!
— পুরো শহর!
–ক্লু ছাড়া কি মানুষ খুঁজে পাওয়া যাবে স‍্যার!
— তাই বলে চেষ্টা দমিয়ে রাখা যাবে? আপনার বাসা এসে গেছে জাবির। নামুন!
— কিন্তু কেনো স‍্যার! আমি যাই আপনার সাথে।
— নো…. বাসায় যান। রেস্ট করুন। কাল অনেক কাজ। আল্লাহ্ হাফেজ।
জাবিরকে নামিয়ে একটানে হাইওয়েতে উঠে যায় ইরফাদ। আশে পাশের সমস্ত হোটেল চেক করে। পুরো এড়িয়া তোলপাড় করে ফেলে। কিন্তু সিনথিয়া কে কোথাও পাওয়া যায় না।

নীলচে আলো কেটে যাচ্ছে তীর্যক সূর্যের আলোর কিরণে। সোজা পিচঢালা রাস্তা। গাড়ি চলতে শুরু করেছে গুটিকয়েক। একহাতে এখনো গাড়ি চালিয়ে যাচ্ছে ইরফাদ। এদিক থেকে সেদিক। এই হোটেল থেকে ঐ হোটেল। এই রুম থেকে ঐ রুম। এভাবেই সকাল। ফোনে জমেছে বাবার শ-খানেক কল। কেনো ভোর হওয়ার পরও বাসায় ফিরছি না এই তার প্রশ্ন।বাবা তো সন্তানের অনেক কিছুই আঁচ করতে পারে। তাকে বোঝানোর সাধ‍্য একজন এসপি”র তো নেই। আর সন্তান হিসেবে তো আরও নেই। এই মূহুর্তে নিজের বাড়ি ফেরার চেয়ে এক পরিবারেকে করুণ অবস্থায় না ফেলাটাই তার প্রথম কাজ।

হেডকোয়ার্টারস-এ সকাল সকাল মিটিং। খুব প্রাইভেসি মেইনটেইন করে আলোচনায় বসে ইরফাদ। সকল কিছু ভালোভাবে শুনে প্রভাতরঞ্জন সরকার বলেন,
— রাতের বিষয়টি টোটালি হিডেন রাখা উচিত। যেহেতু উদ্দেশ্য তুমি। আমার মনেহয় মেয়েটির কোনো ক্ষতি হবে না।
— মেয়েটিকে না পেলে তার পরিবার হাইপার হয়ে যাবে।
–হলে কিছু করার নেই। তোমার এতো বছরের এক্সপিরিয়েনসে তুমি তো জানো কেসের জন‍্যে অনেক সময় অনেক কিছু হাইড করতে হয়।
— কিন্তু এই ক্ষেত্র ভিন্ন স‍্যার!
— তুমি কি চাচ্ছো। সব বলে তুমি সিচুয়েশন হ‍্যান্ডেল করতে পারবে?
–জানি। তবে এই মূহুর্তে তারা যখন জানবে তাদের মেয়ে বাসায় নেই বিষয়টা খুব ক্রিটিক‍্যাল হবে।
— কিচ্ছু হবে না। তারা থানায় আসবে। ডায়েরি লিখবে। আমরা চেষ্টা করবো। এতে সাপও মরলো লাঠিও ভাঙলো না। এর চেয়ে ভালোমানুষি করতে গেলেই ঝামেলা বাড়বে। আই হোপ তুমি বুঝতে পারছো।
ইরফাদ এর পরেও বলে,
— কিন্তু স‍্যার!
— কোনো কিন্তু না। ইটস মাই ফাইনাল ডিসিশন। তারা মেয়েকে খুঁজবে এই সুযোগে কেস সলভের টাইম ও পাবে। তুমি খুব স্ট্রং মেনটালিটির মানুষ আই নোউ। ইমোশন দিয়ে নয় বুদ্ধি দিয়েই এই রাস্তা পার হতে হবে…

বেলা দশটা প্রায় বেজে গেলো। সিনথিয়ার দরজা ভোর থেকে একবারো খোলা পায়নি সানজিদা বেগম। তিনি মেয়েটিকে কোনো কাজেই প্রেশার দেন না। থাকুক না নিজের মতো। যখন খুশি উঠুক। উঠে খেয়ে নিবে এই চিন্তায় ডাকেনি একবারো। তবে বেলা তো গড়িয়ে যাচ্ছে। মেয়েটির শরীর খারাপ হলো কি না? এই চিন্তায় এগিয়ে যায় সিনথিয়ার মা। দরজার নব ঘুড়াতেই দরজা খুলে যায়। আধখোলা জানালা, ঘর জুরে পর্দা টানা। বিছানার উপর এলোমেলো জড় হয়ে থাকা কাঁথা। কিন্তু মেয়ে কই? ওয়াশরুমে উঁকি দেয়। না ঘর শূন‍্য সব শূন‍্য মেয়ে কই। তড়িঘড়ি করে বাইরে বের হয়। পরপর কয়েকটা কল দেন তিনি। কিন্তু নাম্বার বন্ধ। মেয়ের উপর ঝড় ঝাপ্টার কোনো অন্ত নেই। কোনদিক থেকে আবার পাহাড় ধসে না পড়ে। পেটে না ধরলেও এক সময় এই মেয়ে ছিলো মন ভালো থাকার ঔষধ। ভালোথাকার কারণ। কখনো অন‍্যচোখে দেখেনি। তার কাছে মুগ্ধ যা সিনথিয়া তার চেয়ে বেশী। মেয়ের শোকে সে পাগল প্রায় ছিলো। ঠিক সে সময় ডোরবেল বেজে ওঠে। দৌড়ে গিয়ে খুলে দেন দরজা। দরজার ওপারে মুগ্ধ। সানজিদা বেগমর চোখ খুঁজে বেড়ায় সিনথিয়াকে। তারপর বলে,

— সিনথিয়া কই।
মুগ্ধ মায়ের চোখে চোখ রেখে নিজেও পেছন ফেরে। তারপর বলে,
— কই আপু?
— আরে সিনথু ঘরে নেই।
কালকের রাতের কথা মনে পড়ে জিভের পানিটুকু গিলে নেয় মুগ্ধ। সিনথিয়া বাইরে যাওয়ার সময় সেই তো দরজা লাগিয়ে দিয়েছিলো। ভোর হওয়ার আগে ফেরার কথাও ছিলো। আর কোনো কারণে না ফিরতে পারলে বাকিটা ম‍্যানেজ করতে বলেছিলো। বিনিময়ে প্রথম দিনে পাঁচ আর আজ রাতে পেয়েছে দুই হাজার টাকা। কিন্তু এতো দেরী তো করার কথা ছিলো না। মুগ্ধ নিচের ওষ্ঠ জিভ দিয়ে ভিজিয়ে নিলো। তারপর বললো,

–ও ভোরে আপু বাইরে গেছে বান্ধবীদের সাথে হাঁটতে। তুমি তো নামাজ পড়ে ঘুমিয়েছিলে তাই বলে নি। মাত্র মনে পড়লো।
–কিন্তু ওর ফোন বন্ধ বলছে।
–অনেক সময় নেটওয়ার্কের প্রবলেম হয় আম্মু। ট্রাই করতে থাকো। আর আপু বলছিলো ফিরতে দেরি হতে পারে।
বলেই পাশ কেটে কোনো রকম চলে যায় মুগ্ধ আপুর একটা সিক্রেট নাম্বার তার কাছে আছে। সেই নাম্বার পর পর দশটা কল দেয়। নাম্বার বন্ধ। এমন তো হওয়ার কথা ছিলো না। কোনো বিপদ হলো না তো? সেদিন রাতে তো বোনকে সে বলেছিলো,” এতো রাতে বাইরে গেলে বিপদে পড়তে পারে।” সিনথিয়া তার হাতে পাঁচ হাজার টাকা গুঁজে দিয়ে বলেছিলো,” এই শহরের এসপি সাথে থাকলে ভয় কিসের।” তাহলে এখনও বাসায় কেনো আসছে না। চৌদ্দ বয়সী কিশোর মনটাতে বোনের বিপদ সংকেত যেনো ঘন্টা বেজে ওঠে। আর কতোক্ষণ এভাবে ম‍্যানেজ করা যায়। কতোক্ষণ চাপিয়ে রাখবে সে! এমন সময় মেঝেতে পায়ের শব্দ শোনা যায়।সানজিদা বেগম চিন্তিত গলায় বলে,

রং পর্ব ২৯

— তিথি, রিমা দুজনকেই ফোন দিলাম সিনথু ওদের সাথে যায়নি।
— ঐ দু”জন বাদ দিয়ে কি আর কেউ নাই??
শুধু শুধু চিন্তা করছো…. অপেক্ষা করো আসবে..
উপরে উপরে মা”কে যাই বলুক। ভেতর থেকে মুগ্ধ ভয় পাচ্ছে। এখন ই সব বলে ফেললে ঝামেলা বারবে। কিছুক্ষণ চুপচাপ দেখাযাক কি হয়।

রং পর্ব ৩১