অশ্রুজলে বোনা বিয়ে পর্ব ৩৬
ইয়াসমিন খন্দকার
আবরাজ নিঝুমের দিকে অবাক চোখে তাকিয়ে ছিল। তার সব হিসেব কেন গোলমেলে লাগছে। নির্ঝরের ভাষ্যমতে নিঝুম তার মা কিন্তু এটা কিভাবে সম্ভব? তাহলে নির্ঝরের বাবা কে? এই প্রশ্নই ঘুরছে তার মাথায়৷ এদিকে নিঝুম পরিস্থিতি বেগতিক দেখে কি করবে কিছু বুঝতে পারছিল না। যেই ভয়টা সে পাচ্ছিল অবশেষে সেটাই কি তবে সত্য হলো?! নিঝুম ভাবতে লাগল এখন কিভাবে সে পরিস্থিতি সামাল দিতে পারবে।
নিঝুমের ভাবনার মাঝেই আবরাজ বলে ওঠে,”নির্ঝর তোমার ছেলে নিঝুম? তাহলে ওর বাবা কে?”
নিঝুম নিশ্চুপ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকা। নির্ঝর পরিস্থিতির কিছুই আঁচ করতে পারে না। সে আবরাজের দিকে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে প্রশ্ন করে,”তুমি আমার আম্মুর নাম কিভাবে জানলে সুপারহিরো? তুমি কি আমার আম্মুকে চেনো?”
আবরাজ নির্ঝরের মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলে,”অনেক ভালো ভাবেই চিনি।”
নিঝুম বুঝতে পারছিল না এখন সে কি করবে। তবে এই পরিস্থিতিতে তার পক্ষে দাঁড়িয়ে থাকা সম্ভব ছিল না। তাই সে আবরাজলে এড়িয়ে পালিয়ে যেতে চাইল। নির্ঝরের হাত ধরে বলে উঠল,”চলো এখান থেকে।”
নিঝুম সামনের দিকে পা বাড়াতে যাবে এমন সময় আবরাজ নিঝুমের পথ আটকে ধরল। নিঝুম আর এগোতে পারল না। আবরাজের চোখে আজ বিস্ময় এবং ক্রোধ। এত দিন নিঝুম তার থেকে অনেক কিছু গোপন করেছে কিন্তু আজ সে সব প্রশ্নের উত্তর জানবেই। এটাই সংকল্প করে নিয়েছে আবরাজ। তাই সে নিঝুমের উদ্দ্যেশ্যে বলে,”আমার প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে তুমি আর এক পাও সামনে এগোতে পারবে না, নিঝুম। এতদিন তুমি অনেক কিছুই লুকিয়েছ আমার থেকে কিন্তু আর নয়।”
নিঝুম বলে,”আমার সামনে থেকে সরুন প্লিজ।”
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
“না, আজ আমি সরবো না। যতক্ষণ পর্যন্ত না তুমি আমার প্রশ্নের সঠিক জবাব দিচ্ছ ততক্ষণ আমি এখান থেকে একটুও সরবো না। বলো নির্ঝর তোমাকে আম্মু বলছে কেন? ও কি তোমার সন্তান?”
“হ্যাঁ, নির্ঝর আমার ছেলে। আমি ওর মা।”
কাপা কাপা কন্ঠে বলে নিঝুম। আবরাজ জিজ্ঞাংসু দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলে,”তাহলে ওর বাবা কে?”
নিঝুম এবার আর কিছু বলে না। আবরাজের ধৈর্যের সীমা অতিক্রম হয়ে যায়। সে চিৎকার করে বলে,”চুপ করে আছ কেন? বলো ওর বাবা কে? আমার জানামতে, যেহেতু আমার সাথে তোমার এখনো ডিভোর্স হয়নি তাই তুমি এখনো বিয়েও করো নি। তাহলে তোমার বাচ্চা এলো কোথা থেকে? নাকি এটা কোন অবৈধ…”
“মিস্টার আবরাজ!”
হুংকার দিয়ে বলে ওঠে নিঝুম। নির্ঝরের হাত শক্ত করে ধরে বলে,”নিঝুম আমার সন্তান ও পবিত্র ওকে নিয়ে এমন কথা আমি বরদাস্ত করব না। আপনি নিজের সীমা অতিক্রম করবেন না।”
আবরাজ ক্রোধে ফেটে পড়ে নিঝুমকে শক্ত করে ধরে বলে,”আমি সীমা অতিক্রম করছি? নাকি তুমি করছ? একেই তোমার বাবা আমাকে ঠকিয়ে তোমার সাথে আমার বিয়ে দিয়েছিল যার কারণে প্রথম প্রথম আমি তোমায় মেনে নিতে পারি নি আর তারপর যখন তোমায় মেনে নেয়ার চেষ্টা করলাম তখন তুমি নিজের জেদ দেখিয়ে আমাকে ফিরিয়ে দিলে। নিজের বন্ধু ইমরানের সাথে…..আমি তো আরো ভেবেছিলাম সবটা আমারই ভুল ছিল৷ এই ভেবে ৫ বছরে কত কষ্ট পেলাম অথচ এই ৫ বছর পর তো মনে হচ্ছে আমার ভাবনাই ঠিক ছিল। শুধু শুধুই তোমার মতো একটা চরিত্রহীন মেয়ের জন্য আমি নিজের জীবনের ৫ টা বছর নষ্ট করলাম। এই বাচ্চাটা নিশ্চয়ই তোমার আর ইমরানের নষ্টামির ফসল তাই না?”
নিঝুম আর নিজেকে সামলাতে পারে না। ঠাস করে থা*প্পড় বসিয়ে দেয় আবরাজের গালে। ক্রোধান্বিত স্বরে বলে,”ব্যস, অনেক বলে নিয়েছেন আপনি। আর না। এবার আপনার মুখটা বন্ধ করুন। নির্ঝর আমার ছেলে আর এটাই ওর একমাত্র পরিচয়। বুঝলেন? ওকে নিয়ে আর একটা খারাপ কথাও বলবেন না।”
এদিকে এতক্ষণ ধরে চিৎকার চেচামেচিতে চারপাশে অনেক লোক জমে গেছে। তাদের সবার ভীড় ঠেলে ছবি বেগম এগিয়ে এসে বলেন,”তোমরা এখানে আর কোন ঝামেলা করো না। এটা আমার অনুরোধ। এটা আমাদের নতুন কুটুম বাড়ি৷ এখানে এসব ভালো দেখাচ্ছে না। আবরাজ, নিঝুম তোমরা বাড়িতে ফিরি চলো। ওখানে বসে ঠান্ডা মাথায় কথা বলা যাবে।”
আবরাজ এবার ছবি বেগমকেও রাগ দেখিয়ে বলে,”আপনি চুপ করুন! আপনিও আমাকে কম ঠকান নি। কি যেন বলেছিলেন? নির্ঝর আপনার কোন আত্মীয়র ছেলে। এই নিঝুমের পাশাপাশি আপনিও আমার সাথেও ৫ বছরই ধরে প্রতারণা করছেন। সমস্ত সত্যটা জেনেও আমার থেকে লুকিয়ে রেখেছেন। আপনার আর কোন কথা আমি শুনতে চাই না। আপনারা সবাই ঠকবাজ। আমি আর এক মুহুর্ত এখানে থাকব না। তবে যাওয়ার আগে আমি এই চরিত্রহীন মেয়েটার সাথে নিজের সমস্ত সম্পর্ক ছিন্ন করে দিয়ে যাব।”
বলেই আবরাজ নিঝুমের হাতটা শক্ত করে ধরে। অতঃপর সবার সামনে থেকে টানতে টানতে তাকে নিয়ে যেতে থাকে। নিঝুম বলে ওঠে,”কোথায় নিয়ে যাচ্ছেন আমাকে?”
আবরাজ বলে,”এসেছিলাম তোমাকে মুক্তি দিতে তবে এবার আমি নিজে তোমাকে ডিভোর্স দিয়ে এই সম্পর্ক থেকে মুক্তি পাবো। তোমার মতো একটা ঠকবাজ, দুশ্চরিত্র মেয়ের ছায়াও নিজের উপর আর পড়তে দেব না।”
নিঝুমের দুই চোখ বেয়ে জল পড়তে থাকে। আবরাজ নিঝুমকে নিয়ে জোরপূর্বক গাড়িতে ওঠায়। অতঃপর গাড়ি নিয়ে যেতে থাকে কোর্টের দিকে। এদিকে নির্ঝর হতবাক হয়ে দাঁড়িয়ে ছিল। সমস্ত ঘটনায় সে বেশ ঘাবড়ে গেছে। তাই তো ছবি বেগমকে জড়িয়ে ধরে বলে,”সুপারহিরো আম্মুকে কোথায় নিয়ে গেল গ্রানি? আমার তো ভীষণ ভয় করছে।”
ছবি বেগম বলেন,”চিন্তা করো না। সব ঠিক হয়ে যাবে।”
আলমগীর খান এগিয়ে এসে ছবি বেগমকে বলেন,”এজন্যই আমি চেয়েছিলাম আবরাজকে সমস্ত সত্যটা জানাতে। এখন পরিস্থিতি কেমন হয়ে গেছে দেখলে? আমাত কথা তো তখন শুনলে।”
বরবেশে থাকা আবিরের মধ্যেও চিন্তার ছাপ। আনিকা নিজের সদ্য বিবাহিত স্বামীর চিন্তাটা বুঝতে পারছে। আবির হুইল চেয়ারে করে এগিয়ে এসে ছবি বেগমকে জিজ্ঞেস করে,”এখন কি হবে আম্মু? আবরাজ ভাইয়া কি এবার সত্যি নিঝুম আপিকে ডিভোর্স দিবে? ওদের কি আর এক হওয়া হবে না?”
ছবি বেগম বলেন,”ওদের ডিভোর্স কিছুতেই হবে না। ওরা এবার এক হবেই।”
আলমগীর খান হতাশ স্বরে বলেন,”এত কিছুর পরেও তুমি কোন মুখে এই কথা বলছ?”
“বলছি তার কারণ আছে।”
এরইমধ্যে তার ফোন বেজে ওঠে। ছবি বেগম ফোন রিসিভ করেই হাসিমুখে বলেন,”আপনারা এসে গেছেন? আসলে একটা সমস্যা হয়ে গেছে আপনারা আসার আগেই আবরাজের সামনে সমস্ত সত্যটা চলে এসেছে। তাই আবরাজ রেগে গিয়ে নিঝুমকে নিয়ে আদালতের দিকে গেছে। আপনি এখন সংকরপুর আদালতের দিকে যান। ওখানে গেলেই ওদের দেখা পাবেন।”
বলেই তিনি ফোন রেখে দেন। আলমগীর খান প্রশ্ন করেন,”কার সাথে কথা বললে তুমি? কে এসেছে?”
ছবি বেগম তৃপ্তির হাসি দিয়ে বলেন,”এমন কেউ যে তাদের মধ্যকার সবকিছু ঠিক করতে পারবে।”
নিঝুমকে টানতে টানতে কোর্টের ভেতরে নিয়ে আসে আবরাজ। অতঃপর গলা খাকারি দিয়ে তার উকিল মোহাম্মদ আবদুল হাকিমের উদ্দ্যেশ্যে বলে,”আপনাকে যেই ডিভোর্স পেপারস রেডি করতে রাখতে বলেছিলাম তা এক্ষুনি এদিকে দিন।”
আবদুল হাকিম এমন ধমক শুনে দ্রুত ডিভোর্স পেপারস বাড়িয়ে দেয় তাদের দিকে। আবরাজ নিঝুমের দিকে ডিভোর্স পেপার এগিয়ে দিয়ে বলে,”জলদি এখানে সই করে আমায় মুক্তি দাও এই সম্পর্ক থেকে।”
নিঝুমের চোখ তখন অশ্রুজলে পূর্ণ। যেমনটা ছিল বিয়ের দিন। কাপা কাপা হাতে সে ডিভোর্স পেপারসে সই করতে যাবে এমন সময় হঠাৎ করে এক গম্ভীর কন্ঠে কেউ বলে ওঠেন,”দাঁড়াও।”
অশ্রুজলে বোনা বিয়ে পর্ব ৩৫
আবরাজ গলার স্বর অনুসরণ করে সেদিকে তাকিয়ে বলে,”মামা তুমি!”
মিজানুর রহমান এগিয়ে আসতে আসতে বলেন,”হ্যাঁ, আমি। তবে আমি একা আসিনি। সঙ্গে একজনকে নিয়েও এসেছি।”
বলেই তিনি পেছনে ফিরে বলেন,”ভেতরে এসো।”
সেই ব্যক্তিটি ভেতরে প্রবেশ করতেই আবরাজ ও নিঝুম দুজনেই হতবাক হয়ে যায়। নিঝুম হতবাক স্বরে বলে,”ইমরান!”