রং পর্ব ৩৫

রং পর্ব ৩৫
তন্নী তনু

বয়স ম‍্যাচ করানোর জন‍্য কিছু জায়গা এডিট করা হবে। নতুন তো একটু একটু ভুল হয়। বয়স মিলাতে বারোটা বেজে গেছে। আগের পার্ট একটু কারেকশন করবো। সরি ফর দ‍্যাট….
চোখের সামনে পূর্ব সময়ে দেখা মানুষটাকে দেখে বুকের ভেতর ঝনঝন করে বেজে ওঠে।সিনথিয়া নিলয়ের চোখে চোখে রেখে বিস্ময়ে হা হয়ে থাকে কিছুক্ষণ। চেনা মানুষকে চোখের সামনে নিজের ভাইরূপে দেখে নিজেই থ হয়ে যায়। কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে তারপর বলে,
–তুমি!! তুমিইইই….!!!
দুজন আপন মানুষ, রক্তের সম্পর্কের মানুষের তেইশ বছর পর মুখোমুখি দেখা। নিলয় যদিও দূর থেকে দুই একবার দেখেছিলো। সিনথিয়াও দেখেছে অহরহ বার। কখনো স্টেডিয়াম এর পাতা চেয়ারের দূরে কোথাও বসে। কখনো টিভিতে ব‍্যাট হাতে। কখনো বল হাতে। কিন্তু দেখেছে তো! সিনথিয়া ঘোরের মধ‍্যে থাকে কিছুক্ষণ। তারপর থমথমে গলায় বলে,

— না মানে আপনিই!!
উঠে দাঁড়ায় নিলয়। সিনথিয়া উপরে চোখ তুলে তাকায়। আগাগোরা মিলে রাফসান বিশাল আকৃতির মানুষ।চুলগুলো বাড়তে বাড়তে ভ্রু ছুঁয়েছে। ভ্রু এর সাইডে সামান‍্য কাটা দাগ। অবহেলায় বেড়ে ওঠা চাপদাড়িতে ফর্সা গাল চাপা পড়ে গেছে। নিজের চেহারার সাথে কোনো ভাবেই মিল পায় না সিনথিয়া। নিঃসন্দেহে নিলয় আর পাঁচটা পুরুষের চেয়ে সুদর্শন। নিলয় দু”পা এগিয়ে আসে। বসে থেকে সিনথিয়া আকাশ পানে যেনো তাকিয়ে আছে। নিলয় বলে,
— আপনি হয়ে গেলাম??
— নাহ আসলে…. তুমি?? তুমি কি করে আমার ভাই হতে পারো?
–ডকুমেন্ট গুলো চেক দে…. সব প্রুফ আছে। আমি- ই তোর ভাই।পৃথিবীর সব মিথ‍্যা হতে পারে। তবে এটা সত‍্য তুই আমার বোন “ছোট পাখি”….
–কিন্তু তুমি দেখতে…

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

— মা ফরেনার ছিলো! বাবা-মা মিক্সড আমি। আর তুই শুধুই বাবা। ওয়েট পিক দেখাচ্ছি…..!
রাফির ফোনের স্ক্রিনে থাকা ছবিটির দিকে তাকায় সিনথিয়া। তার চোখের মতোই বড় বড় চোখ। তার ভ্রু-জুগলের কালারটা প্রায় সেম।পুরোটা মিল না থাকলেও কিছুটা মিল তো আছে…… তার বাবার চেহারার সাথে। প্রথম বারের মতো জন্মদাতা বাবার ছবি দেখে দু”চোখে পানি টলমল করে। চোখের সামনে তার ভাই। তার পুরো ইতিহাস আজ খোলা ডায়েরি। সিনথিয়ার বুকের ভেতর ভার হয়ে আসে। এই যদি হয় তার পরিবার তাহলে ভাগ‍্য তাকে এতোদূরে কেনো রাখলো। আপন জনের থেকে দূরে কেনো থাকতে হলো। নিলয় এগিয়ে আসে। সিনথিয়ার ঘন চুলে আলতো করে হাত রাখে। তারপর বলে,
— তেইশটা বছর পর!! অবশেষে!
সিনথিয়ার চোখদুটো ছলছল করে ওঠে। দুঃখ গুলো দলা পাকিয়ে চিহ্ন আঁকে থুতনির ভাজে। চোখ ছেপে আসে সিনথিয়ার। সিনথিয়া ভেজা গলায় বলে,
— তুমি পরিচয় কেনো হাইড রাখলে। তুমি তো নিলয় নও…
— এতোটুকু হাইড না রাখলে খেলা শুরু হওয়ার আগেই এসপি খেলার “দ‍্যা এ‍্যন্ড” টেনে দিতো। এই রাফসান কে সে বহুবার শেষ করেছে।

— কিন্তু ভাইয়া আমার জন্মের সময় ঐ মানুষটার কতোটুকুই বা বয়স ছিলো??
— গল্পটা দু”দিনের নয়।তোর জন্মের আগে থেকেই কেসের শুধু। ঐকারণেই মা ঐ সিচুয়েশনে আমাকে রেখে বাংলাদেশে যান। আমাকে সেইফ জোনে রাখার জন‍্যে আমাকে ফেলে রেখে যান।ঐ সময়ে আমার সমস্ত কাগজ পত্র চাচা চাচীর নামে হয়। স্কুল থেকে শুরু করে আমার সমস্ত আইডেন্টিই চাচা-চাচীর নাম দেয়া। হয়তো মা বুঝতে পেরেছিলো।তাই এসব করেছেন। বাবা ফেঁসে যান তারপর জেল।ঐ সময় মা ভারসাম্য হারান। বাবা জেলে মা মানষিক হাসপাতালে। তোর জন্মের পরেও বাবা জেলে ছিলেন। এর মধ‍্যে মা কোথায় কেউ জানতো না। আমিও দেশের বাহিরে চাচা চাচির কাছে।

তাদের পরিচয়েই বড় হয়েছি। এইদিকে কেস চলে প্রায় বারো বছর। এরপরে বাবা জামিনে বের হতে পারেন। তবুও এর জাল থেকে তো পুরোপুরি মুক্ত হন না। যখন পরিপূর্ণ ভাবে মুক্ত হয় তখন প্রায় তেরো বছর পার হয়ে গেছে। তোর তখন বয়স তেরো। এর পরে বাবাকে মিথ‍্যা কেসে ফাঁসানোর জন‍্য কর্ণেল রিদুয়ানুর রহমানের জব চলে যায়। এই সময়ে বাবা প্রায় পুরোপুরি মুক্ত। তখন সব গুছিয়ে নেওয়ার সময়। আমাকে নিয়ে চাচা-চাচী দেশে আসেন। তখন তোর প্রায় তেরো বছর বয়স। আমি তোর ছয় বছরের বড়। আমার বয়স তখন প্রায় উনিশ। এসপি আমাদের সিনিয়র তাহলে সে সময় এসপি অবশ‍্যেই ক্রাইম করার ক্ষমতা রাখে । হয়ে গেছে দশ বছর। এখন তুই তেইশ। এই দশটা এগারো বছরের অনেক কিছু হয়ে গেছে। বাবা নিখোঁজ, মা নিঁখোজ। কাউকে পাইনি।অনেক ঝড় ঝাপটা পেরিয়ে তোকে খুঁজে পেয়েছি।

সিনথিয়া বুক ক্রমেই ভারি হয়ে ওঠে…..। একটু ভুলে কতো গুলো জীবন নষ্ট। কতোগুলো মানুষের হাহাকার কতো যন্ত্রণা কতো দীর্ঘশ্বাস। সিনথিয়ার চোখ থেকে টুপটুপ করে পানি গড়িয়ে পড়ে। এতো কাল পরে নিজের ভাই তার সামনে দাঁড়িয়ে। দুচোখের পানি বাঁধা মানে না। বৃষ্টির ফোটার মতো টুপটুপ করে চোখ থেকে পানি ঝড়ে পড়ে। রাফসান নিজের বোনের মাথায় হাত বুলায়। তারপর ঘনচুলের মধ‍্যে ছোট্ট করে হামি দেয়। ভাইয়ের আদরে সিনথিয়ার কান্না আরো উথলে ওঠে। কান্নারত গলায় সিনথিয়া বলে,
— আমি বাবা-মাকে দেখতে চাই। স্পর্শ করতে চাই।
রাফসান এক বাহুডোরে সিনথিয়াকে আগলে নেয়। তারপর বলে,

— যদি বেঁচে থাকে দেখা হবে। এই জন‍্যেই তো এতো স্ট্রাগল। তুই শুধু হেল্প কর।
পুরো প্ল‍্যান ক‍্যামেরার ফ্ল‍্যাসের মতো মাথা চাড়া দিয়ে ওঠে। এতো কিছুর পরও ইরফাদকে সে বিপদে ফেলতে চায় না। সিনথিয়া রাফসানের বাহুডোর থেকে বেরিয়ে আসে। তারপর মিনমিনে গলায় বলে,
— পৃথিবীর কোনো কিছুর জন‍্য আমি এসপি”কে বিপদে ফেলতে পারবো না। আমি সরি।
রাফসান ফোস করে শ্বাস টেনে নেয়। তারপর ওষ্ঠধর গোল করে শ্বাস ফেলে। তারপর বলে,
— এতোক্ষণ ধরে বুঝিয়ে কি হলো?
–আমি সব বুঝেছি! কিন্তু ভাইয়া…. ইরফাদ স‍্যার কে আমি খুব কাছে থেকে দেখেছি। মানুষটা খুব ভালো….
— আমি কি খারাপ বলেছি! উদ্দেশ্য ইরফাদ। তাকে ধরলেই বাবার খোঁজ মিলবে। আমি এসপির কোনো ক্ষতি করবো না। তুই শুধু একটা কল দে…

— আমাকে ক্ষমা করো।আমি পারবো না। কোনো কিছুর বিনিয়য়েই আমি তাকে ফোন দিতে পারবো না। আমি ফোন দিলে সে ভরসা করবে, বিশ্বাস করবে। বিশ্বাস করে আমাকে খুঁজতে এসে ফেঁসে যাবে। জীবনে অনেকবার ঠকেছি। এর যন্ত্রণা ভিষণ। আমি কাউকেই এমন যন্ত্রণা দিতে পারবো না।
–তুই কি ভাবছিস পুরো দুনিয়া তোর মতো ইমোশনাল??
— পৃথিবীতে কেউ ইমোশনাল না ধরে নিলাম। কিন্তু আমি তো ইমোশনাল। আমি তো জানি বিশ্বাস ভাঙলে কতো কষ্ট হয়। আর যে যন্ত্রণা আমি জানি সে যন্ত্রণা অন‍্যকাউকে দিতে পারবো না।
–পাখি!! বোঝ…
— আমি কিচ্ছু বুঝতে চাইনা। তুমি আমাকে ধরে রেখে মেরে ফেলো!যা খুশি করো। যা খুশি….. কিন্তু আমি ফোন দিতে পারবো না….
— সিনহা তোকে ভালোবাসে??
— নাহহ!!
— তাহলে তোকে কিসের ভরসা করবে? কিসের বিশ্বাস? এসপি কি তোর মতো বাচ্চামি করবে নাকি ছেলেমানুষী।
— ঐ ভাঙা হৃদয়ের মানুষটাকে আমি ফুলের টোকাও দিতে পারবো না। আমাকে মেরে ফেললেও না….
— কিসের ভাঙা হৃদয়।
— সে তুমি বুঝবে না….

দরজা বন্ধ ঘরে পায়চারী করছে রাফসান। রাগে বিষাক্ত সাপের মতো ফোঁস ফোঁস করছে। এতো ঝড় ঝাপটা পেড়িয়ে গন্তব্যস্থল পাওয়ার সময় সিনথিয়া কথা শুনছে না। তবে টোপ হিসেবে তো সিনথিয়া আছেই। প্ল‍্যান চেঞ্জ করা প্রয়োজন।

ইরফাদ, জাবির আর তনয় একই গাড়িতে আছে। কোন দিকে যাবে। ক্লু ছাড়া অন্ধদের মতো কোথায় খুঁজবে সিনথিয়াকে। এদিকে ফেনির রাস্তা। আশেপাশের যে কোনো জায়গাতে তো ক্রিমিনাল যেতে পারে। লোকেশন না জেনে কোন দিকে খুঁজবে তারা। কোন উদ্দেশ্যে সিনথিয়াকে কিডন‍্যাপ করেছে। কোন দিকের ডিরেকশন দিচ্ছে কিডন‍্যাপার। আর তারা কোন ডিরেকশন অনুযায়ী যাবে। তনয় কোলের উপর ল‍্যাপটপে চোখ বসিয়ে রাখছে। এইটুকু অঞ্চলের মধ‍্যে সকল ফোন কল ট্র‍্যাক করা হচ্ছে পিবিআই সেক্টরে। কোন একটা ক্লু পেলেই এট‍্যাক করা যাবে। কিন্তু পুরো বিষয়টা সময় সাপেক্ষ। লক্ষ লক্ষ ফোন কলের ভীরে ক্রিমিন‍্যাল খুঁজে বের করা, কোনো একটা কথার ভিত্তিতে আঁচ করা খুবই কঠিন সময় যাচ্ছে। ইরফাদ গাড়ি থামিয়ে শূন‍্য তাকিয়ে আছে। ঠিক ঐ সময় তনয় বলে,
— স‍্যার! ক্লু পাওয়া গেছে। এই তো এই দুটো নম্বরের কথোপকথন শুনুন।
তনয় রেকর্ডিং স্লো মশানে দেয়। ইরফাদ ঈগলের মতো তীক্ষ্ম দৃষ্টিতে এগিয়ে আসে। হেডফোন কানে লাগায়। সেখানে দুজনের কথপকোথনে শোনা যায়,

— আরে ব‍্যাটা! যা বলছি শোন। ঝাল কাঁকড়া আনবি। সিনথিয়া খুব পছন্দ করে….
দুজনের নরমাল কনভারসেশন হয়তো তাই দুটো সচল সীমকার্ড ইউজ হয়েছে। ইরফাদ তড়িঘড়ি করে গমগমে গলায় বলে,
— ট্র‍্যাকিং দিজ নম্বর।
— স‍্যার! লোকেশন চট্টগ্রাম। জাবির এর গেজ শতভাগ মিলেছে।
— দ‍্যাটস গুড। নাউ মুভ…
বলেই গাড়ির স্পিড বাড়িয়ে দেয় ইরফাদ। যেনো পুরো পৃথিবীর সমস্ত নিয়ম ভেঙ্গে এক মিনিটে সেদিকে পৌঁছানো যায়। গাড়ির স্পিড দেখে জাবির বলে,
— স‍্যার! আই হোপ ক্রিমিন‍্যাল সেদিকে বড় সড় ট্র‍্যাপ রেডি ই রেখেছে। এই গাড়ি সরাসরি নিয়ে যাওয়া রিস্ক হবে।
— কাছাকাছি থানায় কল দিন। অন‍্য গাড়ি রেডি করতে বলুন। সাথে আমাদের জন‍্য লুঙ্গি।
— লুঙ্গি????
— আকাশ থেকে পড়লেন নাকি?? মনে হচ্ছে লুঙ্গি শব্দ কোনোদিন শোনেন নি?
— আরে তা হবে কেনো। বাঙালি বলে কথা লুঙ্গি কেনো চিনবো না।
–শুধু চিনলে তো হবে না। পড়তে জানতেও হবে।
জাবির ঢোক গেলে। লুঙ্গি!! এটা সামলানোর মতো কষ্ট সাধ‍্য পোশাক তার কাছে আর দ্বিতীয়টা নেই। কি যে হবে আজ। তনয় ল‍্যাপটপ থেকে মাথা তুলে বলে,

— স‍্যার আমাকেও পড়তে হবে নাকি??
— একচুয়ালি! এই কিডন‍্যাপিং এর মেইন উদ্দেশ্য আমি। আমাদের চট্টগ্রামে এই লুক নিয়ে এন্ট্রি নেয়াই যাবে না। তাহলে রেসকিউ এর পরিবর্তে উল্টো শিকার হতে হবে। সো…
–ওকে ওকে স‍্যার!
কথোপকথনের মাঝখানে তুমুল শব্দে ফোন কেঁপে ওঠে ইরফাদের। তনয়ের ট‍্যাবের সাথে কানেক্ট করে নেয় ইরফাদ। ফোন ধরে ইরফাদ। প্রথমেই হাহা করে শব্দ করে কেউ হাসে। তারপর বলে,
— কেমন দিলাম! এসপি সাহেব??
–হু আর ইউ…?
— ইওর বারথ এনিমি।আরে এতো তীক্ষ্ম বুদ্ধি সম্পন্ন এসপি তুই নিজের শত্রু চিনিস না!!
— হাউ ব্রেভারি শো ইওর সেল্ফ!!
— ওয়েট…ভয়েজ চেঞ্জার টা অফ করি।

ইরফাদ অপেক্ষা করে। তনয়ের দিকে তাকায়। এক ভ্রু উঁচিয়ে তনয়কে ইশারা করে। “ট্র‍্যাক করতে পেরেছেন?”
তনয় মাথা ঝাকায়। এদিকে ফোনের অপর পৃষ্ঠের মানুষটা ডেভিলের মতো হাসে। তারপর বলে,
–ঢাকা থেকে চট্টগ্রাম আসতে কতো সময় লাগবে রে?? তুই হেলিকপ্টার নিয়ে আয়!! প্রাইভেট জেড থাকলেও আনতে পারিস। তোকে কখন খাঁচায় তুলবো….. তখন না শান্তি! এতো গুলো বছর আমি এই দিনের অপেক্ষা করে গেছি!!

— রাফসান!!!
— চিনে ফেললি??? বাহহ….
তাতে কি?? শোন!!সিনথিয়াকে নিতে তুই একা আসবি!! একা….!!
— হোয়াট ডু ইউ থিং?? আই”ম স্টুপিড!!আই নোউ তুই তোর বোনের ক্ষতি করবিনা।
— আরেএএএ এসপি!!তোরে কষ্ট দিতে নিজের বউকে ছাড় দেইনি!! প্রতিশোধের নেশায় আমি মাতাল। তোকে ধরতে বোনকে না হয় একটু কষ্ট দিলাম। প্রয়োজনে ওকেও মারবো নিজেও মরবো।আমার কাছে পৃথিবীর কিচ্ছুর দাম নাই। চূর্ণবিচূর্ণ করেছিস আমার জীবন। আমি তোর জীবন নিতে সব পারবো সব।সিনথিয়ার কিছু হলে পুরো দেশকে কি জবাব দিবি?? তোর ডিপার্টমেন্ট তোকে কি করে বাঁচায় দেখবো….
— নাউ দ‍্যা ওয়ার ইজ ফেস টু ফেস।কিন্তু নিজের বোনকে টোপ হিসেবে ইউজ করার কি আছে? স্কাউনড্রেল…ওকে ছেড়ে দে। লোকেশন দে আমি আসবো…ইরফাদ কথার খেলাপ করে না।
— আরে!!! ঐ তো সোনার ডিম পাড়া হাঁস। ঐখানেই তো তুই দূর্বল। এই মেয়ে তোর কাছে থেকে নিখোঁজ। কি জবাব দিবি তুই। তুই ধরা না দিলে আমি আমার বোনকে নিয়ে দেশের বাইরে চলে যাবো। পুরো দেশকে তুই কি গোজামিল দেস দেখে নিবো।

তুই তোর বোনকে টোপ হিসেবে ব‍্যবহার করে আমার ক‍্যারিয়ার শেষ করেছিস। নিজের বোনের সম্মানের দিকে তাকাসনি।আমি তো আমার বোনের সম্মান নিয়ে খেলছিনা। শুধু তুই ধরা দে…. আমি সসম্মানে ওকে বাসায় পৌঁছে দিবো। শুধু না ধরা দিলে পুরো দুনিয়া জানবে এসপি নিজের কেস সলভের জন‍্যে একটা মেয়েকে গুম করে ফেলেছে। কি করবি ভেবে দেখ…..
— সাইকো….
— আমি সাইকো নই। সাইকো তুই….! সাহস থাকলে আমার দেয়া লোকেশনে আয়।
সাথে সাথে টুটটুট করে কেটে যায় ফোন। ইরফাদ দাঁতে দাঁত চেপে বলে,
— স্কাউন্ড্রেল!!

ইরফাদ গাড়ি থামায়। নিকটবর্তী কোনো একটা জায়গা থেকে তিনটা লুঙ্গি কিনে নেয়। প্রয়োজনীয় জিনিস পত্র কিনে পোশাক পাল্টে নেয়। থ্রি-কোয়ার্টার প‍্যান্টের উপর লুঙ্গি পড়ে নেয় ইরফাদ। উপরে পড়ে ঢিলেঢালা টি-শার্ট। সবার উদ্দেশ্য বলে,
— থানা থেকে ফোর্স রেডি রাখতে বলুন। আই হোপ!রাফসান শক্ত হাতেই মাঠে নামবে। আমাদের ঐ জন‍্য গেট আপ চেঞ্জ করা। যাতে প্রথম দেখাতেই বুঝতে না পারে আমরা আইনের লোক।
জাবির ঠোঁট টিপে হাসে তারপর বলে,
— কিন্তু স‍্যার! আপনাকে তো এই লুকে আরো‍ও সুদর্শন লাগছে।
–এসপি তো লাগছে না! এতেই হবে….আমাদের অনেক নিউজ লাগবে। সরাসরি ঐ লোকেশনের আশেপাশে যাওয়া যাবে না।
— আপনার পিকচার দেয়া থাকে যদি?
ইরফাদ নকল একটা গোফ লাগিয়ে নেয়। গোফের সাইড আঙুলে মুরিয়ে মুরিয়ে বলে,
— এখন কি চিনবে??
–এখন তো আপনাকে সেই রাজা-বাদশা আমলের বাদশা মনে হচ্ছে।
–নিজেরাও লুক চেঞ্জ করে নিন। হাতে সময় কম! হারি আপ…..

রাফসান চেয়ারে পায়ের উপর পা তুলে বসে আছে। ভাড়া করা ডেভিল গুলো বসে আছে মেঝেতে। মন দিয়ে শুনছে রাফসানের কথাগুলো।
— লোকেশন জানিয়ে দেয়া হয়েছে। এসপি ধূর্ত,চতুর। একা বললেই সে একা আসবে না। এই লোকেশনে ঢোকা মাত্র এসপিকে যে করেই হোক ধরতে হবে। তোদের প্রথম কাজ থাকবে এসপিকে কোনো ভাবে সেন্সলেস করা। এরপর রাতের অপেক্ষা……ওকে??
সবাই সম্মতি দেয়।

ইরফাদ লুঙ্গির কোণা ধরে দাপিয়ে হাঁটে।আসে পাশের দোকানে বসে। এর ওর সাথে কথা বলে। অল্প অল্প করে পুরো এলাকা সম্পর্কে জেনে নেয়। রাফসানের দেয়া লোকেশনে ঢোকা মানে এখন সিংহের খাঁচায় ঢোকা।বেলা গড়িয়ে যায়। সন্ধ‍্যার আধার দেখা যায়। আশেপাশে ভালোভাবে খোঁজ নেয় ইরফাদ। আশে পাশে সমস্ত কিছুর ডিটেলস রেডি করে। বিচের আশে পাশে একটা দোতলা বাসা। এই বাড়িটিই কল ট্র‍্যাক করার পর সবচেয়ে কাছে ছিলো। তার মানে এই বাসা সন্দেহজনক। সব প্ল‍্যানমাফিক গুছিয়ে নেয় ইরফাদ। প্রথমে ছদ্মবেশে জাবির ভেতরে ঢুকবে। পুলিশ ফোর্স রেডি। প্রয়োজনে সময় মতো সব প্রয়োগ করা হবে। রাতে থমথমে আবছা আলোর বাড়িতে ঢোকে জাবির সাথে একজন সহকারী। তারপর বলে,

— কেউ আছেন??
কয়েকবার ডাকার পর কেউ একজন বেরিয়ে আসে। দেখতে ডাকাতদের মতো। গরুর মতো বিশাল বিশাল চোখ। লম্বা গোফ। পরনে প‍্যান্ট, গেঞ্জি। আর গলায় ঝোলানো রুপার মালা। হাতে মোটা শেকলের ব্রেসলেট। জাবির বলে,
— ভাই আসছিলাম তো বীচে। গোসল করার জন‍্য পানিতে নামছি। একজনের কাছে ফোন আর কাপড়চোপড় রাখছিলাম। গোসল শেষে দেখি মানুষটাই নাই। একজন দুটো লুঙ্গি দিছে পড়ছি দুজন। আমরা ফেরার রাস্তা পাচ্ছি না। ফোন ও নেই। লোকেশন ও দেখতে পারছি না।
কথার ফাঁকে চারপাশে চোখ বুলিয়ে নেয় জাবির। সাথে আরেকজন পুলিশ। লোকটা আপাদমস্তক চোখ বুলিয়ে দেখে জাবিরকে। তারপর বলে,

–খাঁড়ান! কথা কইয়া লই।
জাবির পেছন ঘোরে। কানে লাগানো ব্লুটুথ কানেক্টড করে নেয়। তারপর ইংলিশে বলে,
— স‍্যার! ভেতরে দোতলা বাসা। আশে পাশে ছোট ছোট কুড়ে ঘরের মতোও আছে। লোকজন আছে ভেতরে।
— ভেতরে যাওয়ার চেষ্টা করেন। দেখুন সন্দেহজনক কিছু আছে কি না।
জাবির ধীর পায়ে ভেতরের দিকে যায়। ভেড়ানো দরজা ঠেলে দেখে ড্রয়িং রুমে অনেক মানুষ। পাশের কুড়েঘর গুলোতে আলো জানানো,হৈচৈ। মনে হচ্ছে কয়েকজন মিলে তাস খেলছে। জাবির বলে,
–সাসপেছিয়াস!অ্যারাউন্ড মেনি অফ পিপল!
–ওকে ওকে ব‍্যাক!
–ওকে স‍্যার।

তাদের মধ‍্যে থেকে কেউ একজন খেয়াল করে জাবিরের কথা। রাফসানকে কল দিয়ে বলে,
— বস! পোলায় তো ইংরেজিতে কুটুর কুটুর করতাছে।
— কেমন দেখতে?
–লুঙ্গি পড়া। সাদা সিধাই তো লাগতাছে। কইলো তো রাস্তা ভুইলা গেছে।
— এট‍্যাক দে… মনে রাখিস জীবিত চাই ওদের।
জাবির পেছন ঘুরে। পেছন থেকে লোকটা ডাকে আবার,
— চইলা যান কই??? রাস্তা দেখাই দেই চলেন..
জাবির পেছন ঘোরে। ঘুরেই হতভম্ব।সাত আটজন হকিস্টিক নিয়ে দাঁড়িয়ে। ধরা পড়েও শক্ত হয়ে দাঁড়ায় জাবির। সাথে সহকারী পুলিশ। জাবির ব্লুটুথে হাত দিয়ে বলে,
— স‍্যার! ওরা বুঝে ফেলছে। চলে আসুন। হারি আপ!

জাবির লুঙ্গির নিচু অংশ মুড়ে নেয়। কেসের প্রয়োজনে কতো কিছুই না করতে হয়। সে জানতো না এভাবে ধরা পড়তে পারে। লুঙ্গির মোরানো অংশ দ্রুত পেছনে গুজে নেয়। তারপর নেমে পড়ে যুদ্ধের মাঠে। ইরফাদ নিজে দৌঁড়ে আসে। মাঝরাস্তায় পড়নের লুঙ্গি খুলে ফেলে। নিচে থ্রি কোয়ারর্টার প‍্যান্ট। হাতে রাইফেল। কোমরে রিভলবার। ফুল লোড করা রাইফেল হাতে দ্রুত প্রবেশ করে ইরফাদ। চোখে আগুন যেনো ফুলকি মেরে ওঠে। ঐদিকে সবার সাথে একাই লড়ছে জাবির। হকিস্টিক ঠেঁকিয়ে কোনো রকমে টিকে আছে। বাকিরাও পাহাড় ধসের মতো নেমে আসছে। ইরফাদ এগিয়ে যায়। কোনো কিছু ভাবে না। শুধু হাতে আর পায়ের দিকে তাক করে ট্রিগার চাপে। যাতে পুরোপুরি না মরে। আবার আঘাত ও করতে না পারে। ঝড়ের গতিতে নিচতলার সকল মানুষকে আহত করে ফেলে ইরফাদ। উপরে ছাদ থেকে পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে খেয়াল করে রাফসানের কিছু লোক। রাফসানকে ফোন দিয়ে বলে,
— বস! সবাইকে মেরে বিছিয়ে রেখেছে। আর একটু পরেই উপরে চলে আসবে। আমরা তো গান ইউজ করতে পারবো না। খুনাখুনি হয়ে যাবে….
— সেকেন্ড টিম বের হ…. হাত পায়ে গুলি মার। আহত কর। স্প্রে মার।
— ওকে বস!

রাফসানের দলের দ্বিতীয় টিম রিভলবার তাক করে নিচে নামে। এলোপাথাড়ি বুলেট ছোড়ে প্রথম ছয়জন। পেছনের ছয়জন রিভলবার নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে।সামনের লোকদের বুলেট শেষ হলে পেছনের ছয়জন এগিয়ে আসে। ইরফাদ, জাবির সহ সবাই পিছিয়ে যায়। সহকারীর থেকে বুলেটপ্রুফ জ‍্যাকেট এগিয়ে দেয় ইরফাদ। জাবিরের বাঙালিয়ানা দেখে ঠোঁট টিপে হাসে ইরফাদ।
— বাহ! সুন্দর সামলাচ্ছেন তো লুঙ্গি! খুলে নিতেন….
— অনেক তো ফরমাল পড়ে ফাইট করলাম। একবার বাঙালিয়ানার ভাইবস নেই….
— ফাইটিং এর সময় খুলে গেলে??
–শর্টস আছে স‍্যার!!
–ওকে রেডি?? আমি এইদিক সামলাবো বাকিরা উপরে উঠে যাবেন। সিনথিয়া কোথায় খুঁজে দেখবেন।
–ওকে স‍্যার।
বুলেটপ্রুভ জ‍্যাকেট পড়ে সামনে এগিয়ে যায় ইরফাদ। ছয়টা বুলেট পর পর মেরে সবাইকে বসিয়ে দেয়। বাকিরা পিছিয়ে যায়। জাবির উপরে যায়।সকল রুম তন্ন তন্ন করে খোঁজে। তারপর উপর থেকে চেঁচিয়ে বলে,

— স‍্যার এইখানে কোথাও সিনথিয়া ইবনা নেই।
— ছাদে??
কথাটা বলে কোমরে গোজা রিভলবার বিপক্ষ লোকের মুখের মধ‍্যে চেপে ধরে। ঝাকুনি দিয়ে বলে,
— সিনথিয়া ইবনা কোথায়???
কোকাতে থাকে লোকটি। কোনো উত্তর দেয় না। ইরফাদ আরেকটু ঝাকুনি দেয়। তারপর রক্তচক্ষু নিয়ে বলে,
— আই”ল শ‍্যুট ইউ!!
লোকটি কোকিয়ে বলে,
— সত‍্যি বলছি জানিনা। বস্ পেছনের রাস্তা দিয়ে বেরিয়ে গেছে। ইরফাদ রিভলবার সরায়। পুলিশ ফোর্স বেঁধে ফেলে সবাইকে। জাবির নিচে নেমে আসে। ইরফাদ ধীর গলায় বলে,
— মাই ফল্ট! এতো সহজে রাফসান ধরা দিবে না। অনেক বড় ভুল হয়ে গেছে।

রাত বারোটা নাগাদ ইরফাদের ফোনে ফোন আসে। ফোন ধরে ইরফাদ। ঐদিকে ব‍্যাঙ্গাত্বকভাবে হাহা করে হেসে ওঠে,
— পারলি না তো!!! “তুই বাঘা তেতুল হলে আমি বুনো ওল।”
আয় চরপাড়া ঘাটে। আমি সিনথিয়াকে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছি।
বলেই ফোন কেটে দেয় রাফসান। ইরফাদ জাবিরকে সাথে নিয়ে চড়পাড়া ঘাটে যায়। বিশাল আকারের মালবাহী জাহাজ। জাহাজের ছাদে কোণা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে আছে রাফসান। লম্বা মানুষটার হাতের তলায় দাঁড়িয়ে আছে সিনথিয়া। মাথায় রিভলবার ঠেকানো। রাফসানের ফিসফাসানো গলায় সিনথিয়াকে বলে,

— আমি তোকে মারতে পারবো না ছোট পাখি। তবে নিজে মরে যাবো। আমি জানি তুই পালাতে পারবি। তুই হাতে নিচ থেকে সরলে আমি নিজের মাথায় শ‍্যুট করে দিবো। এই যুদ্ধ আমার অনেক দিনের অনেক দিনের। গন্তব্যস্থলেল দোড়গোড়ায় পৌছে আমি কিছুতেই হার মানবো না।আমি ইরফাদের ক্ষতি করবো না। কাজ শেষ হলে এসপি মুক্ত।
সিনথিয়া মনের দিক থেকে দূর্বল। কাকে বাঁচাবে সে। দুদিকেই দুটো মানুষের জীবন তার কাছে দামী। মনে হচ্ছে রাফসানের হাতের রিভলবারের ট্রিগার চেপে নিজের শেষ হয়ে যেতে। ছলছল চোখে সামনে তাকিয়ে আছে সিনথিয়া। ইরফাদ দৌঁড়ে এসে থামে চরপাড়ার ঘাটে। রাফসান চেচিয়ে বলে,
–আমার কাছে প্রতিশোধের চেয়ে এই মূহুর্তে বড় কিছু নাই। চালাকি করবি তো ওকেও মারবো নিজেও মরবো। সোজা জাহাজে উঠবি। ওঠ…..

ইরফাদের হাতে আর কিছুই নেই। রাফসান সাইকো হয়ে গেছে। এই মূহুর্তে যা কিছু হতে পারে। ইরফাদ দ্রুত পায়ে জাহাজের দিকে যায়। ইরফাদের আগানো দেখে বুকের মধ‍্য শূন‍্য হয়ে আসে সিনথিয়ার। সিনথিয়ার চোখ থেকে টুপ করে পানি পড়ে। মনে মনে বলে,
” আপনি আমার দুর্দিনে আমাকে যত্নে আগলে রেখেছিলেন। প্রতিদানে আমি আপনাকে মৃত‍্যুর দিকে ঠেলে দিলাম। আমাকে ক্ষমা করবেন।”
জাবির পেছন থেকে পা বাড়াতেই কোথা থেকে যেনো চিলের মতো ছুটে আসে শয়তানের দল। পুলিশ ফোর্স অনেকটা দূরে। রাফসান উপর থেকে চেঁচিয়ে বলে,
— শুধু ইরফাদ। আর কেউ না। কেউ আসবে না।
জাহাজ ধীর গতিতে ছাড়ে। ইরফাদ জাবিরকে বলে,
— আপনি চলে যান। খুব শিঘ্রই ফিরবো ইনশাআল্লাহ।

সকলে ঝাপটে ধরে জাবিরকে। জাবির এলোপাথাড়ি মারতে থাকে। হাত পা ছোটাছুটি করে। তার মধ‍্যে চেঁচিয়ে বলে,
— স‍্যার! আমি কিছুতেই আপনাকে একা ছাড়বো না।
বলেই এলোপাথাড়ি মারে সবাইকে। পরনের লুঙ্গি টানাটানিতে খুলে যায়। নিচে টু কোয়ার্টার শর্টস হিসেবে পড়া। সেদিকে খেয়াল নেই তার। সবাইকে মেরে বিছিয়ে ফেলে। তারপর চেঁচিয়ে বলে,
— স‍্যার আমার লুঙ্গি খুলে গেছে!

রং পর্ব ৩৪

ইরফাদ মৃদু হাসে। তারপর বলে,
— ওকে চলে যান! আবার দেখা হবে।
জাবির লুঙ্গি কোমরে পেঁচিয়ে নেয় আগের মতো করে। তারপর লাফিয়ে উঠে যায় জাহাজে। জাহাজ চলতে শুরু করে।চোখে শূন‍্যতা নিয়ে অজানা দেশ, অজানা রহস‍্যের দিকে এগিয়ে যায় জাবির,ইরফাদ, সিনথিয়া….

রং পর্ব ৩৬