অশ্রুজলে বোনা বিয়ে পর্ব ৩৯
ইয়াসমিন খন্দকার
নিঝুম রাস্তার মধ্যেই নিজের বাচ্চার জন্য কান্নাকাটি করতে লাগল। নির্ঝরই যেন তার জীবনের সবটা জুড়ে ছিল৷ সেই নির্ঝরকে যদি তার থেকে আলাদা করা হয় তাহলে তার জীবনে তো আর কিছুই বেঁচে থাকবে না। এমন সময় ছবি বেগম এসে নিঝুমকে টেনে তোলেন। নিঝুমের মাথায় হাত বুলিয়ে বলেন,”চিন্তা করো না, তোমার ছেলেকে তুমি ফেরত পাবেই।”
নিঝুম বলে,”প্রয়োজনে আমি আইনের সহায়তা নেব তবুও নিজের সন্তানকে নিজের করে নেব। আবরাজকে কিছুতেই আমার ছেলেকে আমার কাছ থেকে আলাদা করে নিতে দেব না।”
মিজানুর রহমান এসে বলেন,”তোমরা শুরু থেকেই ভুল পথে ঘুরছ। এমন রাগারাগি, ঝগড়াঝাটি করে কোন কিছুরই সমাধান হয় না। ভালো ভাবে বসেও সব সমস্যার সমাধান করা যায়।”
নিঝুম বলে,”মিস্টার আবরাজ আমার থেকে আমার সন্তানকে আলাদা করে নিয়ে গেলেন আর আমি শান্তিমতো বসে কথা বলব!”
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
“নির্ঝর কিন্তু তোমার একার সন্তান নয় নিঝুম ও আবরাজেরও সন্তান। আর ইসলাম মতে সন্তানের উপর বাবার অধিকারই সবথেকে বেশি৷ তবে এটাও অস্বীকার করার উপায় নেই যে, বাচ্চার মায়ের পরিচর্যারও দরকার আছে। একটা বাচ্চার সুস্থ স্বাভাবিক জীবনের জন্য বাবা-মা দুজনেরই সান্নিধ্যের দরকার। তাই আমি তোমার সামনে হাতজোড় করে অনুরোধ করছি, নিজের ইগোকে একটু পাশ কাটানোর চেষ্টা করো। তোমাকে আমি মেয়ের মতোই দেখি। তাই বাবা হিসেবে অনুরোধ করব, আমার কথাটা রাখো।”
ছবি বেগম নিঝুমের উদ্দ্যেশ্যে বলেন,”হ্যাঁ, নিঝুম। উনি একদম ঠিক বলেছেন। এত দিন ধরে আমি তোমার কথা ভেবে তোমার পাশে থেকেছি। তুমি যা চেয়েছ তাতেই সম্মতি দিয়েছি কিন্তু এবার আমিও তোমাকে অনুরোধ করব সবকিছু ঠিক করার চেষ্টা করো। নিজেদের মধ্যকার রাগ, অভিমান এসব কিছু নিজেদের সন্তানের মাঝে টেনে এনো না। নির্ঝরকে একটা সুন্দর জীবন দাও। মা-বাবার মধ্যকার ঝামেলা একটা সন্তানের সুস্থ স্বাভাবিক মানসিক বিকাশের পথে অন্তরায়। আমি তাই আজ নির্ঝরের দাদি হিসেবে তোমার কাছে অনুরোধ রাখব, এই সম্পর্কটা ঠিক করে নাও।”
নিঝুম বলে,”কিভাবে? কিভাবে আমি সব ঠিক করব? মিস্টার আবরাজ তো কোন কথা না শুনেই আমার ছেলেকে আমার থেকে আলাদা করে নিয়ে গেলেন।”
মিজানুর রহমান বলেন,”ও যাই করেছে রাগের মাথায় করেছে। দীর্ঘ ৫ বছর ধরে ও নিজের সন্তানের থেকে আলাদা ছিল এই বিষয়টাই ওকে ভাবাচ্ছে। তবে তুমি চিন্তা করো না, আমি আবরাজকে বোঝাব। আবরাজ এখন রেগে থাকলেও শীঘ্রই বুঝবে বলে মনে করি।”
নিঝুম কান্নারত স্বরে বলে,”আমার শুধু আমার নির্ঝরকে ফেরত চাই। আর কিছু চাই না আমার।”
মিজানুর রহমান বলেন,”আমি তোমার পাশে আছি৷ তবে তোমাকেও আমাকে একটা কথা দিতে হবে।”
‘কি কথা?’
“তুমি আর আবরাজের থেকে নির্ঝরকে আলাদা করতে চাইবে না। তোমাদের মধ্যে যতই মতপার্থক্য থাকুক না কেন, নিজের সন্তানের কথা হলেও নিজেদের মধ্যকার সব ভুল বোঝাবুঝি মিটিয়ে নেবে।”
নিঝুম ভাবনার জগতে হারিয়ে যায়। ছবি বেগম বলেন,”রাজি হয়ে যাও নিঝুম। এতেই সবার জন্য মঙ্গল হবে।”
নিঝুম চোখের জল মুছে বলে,”বেশ, আমি রাজি।”
আবরাজ নির্ঝরকে নিয়ে একটি ফ্ল্যাটে এসেছে। কিন্তু নির্ঝর এখনো পর্যন্ত কেঁদে চলেছে এবং বলছে সে তার মায়ের কাছে যেতে চায়। আবরাজ নির্ঝরকে বোঝানোর জন্য তার গালে হাত রেখে বলে,”এমন করো না বাবু। বাবা যে তোমার সাথে একটু সময় কাটাতে চায়।”
“আম্মু…আম্মুকেও এনে দাও না, বাবা। আম্মুকে ছাড়া আমি থাকতে পারব না এখানে।”
আবরাজ দীর্ঘ শ্বাস ফেলে। এমন সময় কলিং বেল বেজে ওঠায় সে উঠে গিয়ে দরজাটা খুলে দেয়। সাথে সাথেই তার মামা মিজানুর রহমান ফ্ল্যাটে প্রবেশ করে। আবরাজ তাকে দেখে বলে,”মামা, তুমি?”
“হুম। কিছু জরুরি কথা বলতে এলাম।”
“জ্বি, বলো।”
“তোমার ছেলে কই? কেমন আছে এখন ও?”
আবরাজ হতাশ স্বরে বলে,”ও বিছানায় বসে আছে। সমানে কেঁদে চলছে আর বলছে ওর মায়ের সাথে দেখা করতে চায়।”
মিজানুর রহমান স্মিত হেসে বলেন,”এমনটা তো হবারই ছিল। ছোটবেলা থেকেই তো ওর মায়ের কাছেই বড় হয়েছে। তাই স্বাভাবিক ভাবেই মায়ের প্রতি ওর বেশি এটাচমেন্ট থাকবে।”
আবরাজ ব্যথিত স্বরে বলে,”কিন্তু ও তো আমারও সন্তান, আমার রক্ত বইছে ওর শরীরে। ওর উপর কি আমার কোন অধিকার নেই?”
“থাকবে না কেন? অবশ্যই আছে। তবে তোমাকে এটাও বুঝতে হবে ওর জন্য ওর মায়ের প্রয়োজনীয়তা কতটা বেশি। মানছি, নিঝুম তোমার থেকে এত গুলো বছর তোমার সন্তানের কথা লুকিয়ে অনেক বড় অন্যায় করেছে কিন্তু এখন যদি তুমিও সেই একই ভুল করো তাহলে সেটা আরো বড় অন্যায় করা হবে। আমি তাই তোমাদের একটা ভালো প্রস্তাব দিচ্ছি। তোমরা নিজেদের মধ্যকার ভুল বোঝাবুঝির জন্য নিজেদের সন্তানের জীবন নিয়ে ছিনিমিনি খেলো না। ওর কথা ভেবে হলেও সব কিছু ঠিক করার চেষ্টা করো।”
আবরাজ বলে,”আমি তো সবকিছু ঠিকই করতে চাই। কিন্তু নিঝুম..ওই তো ঝামেলা করছে। ও তো চায় আমার ছেলের থেকে আমাকে বিছিন্ন রাখতে।”
“আমার নিঝুমের সাথে কথা হয়েছে। নিঝুম আমায় কথা দিয়েছে, ও নিজের সন্তানের স্বার্থে সবকিছু ঠিক করতে রাজি আছে।”
” ও সত্যিই এই কথা বলেছে?”
“হুম।৷ তাই আমিও তোমাকে অনুরোধ করব, নিঝুমের ভুলের পুনরাবৃত্তি আর তুমি করো না৷ যদি নির্ঝরের ভালো চাও তাহলে নিজেদের মধ্যকার বিভেদ দূরে ঠেলে নিজেদের সন্তানের স্বার্থে এক হয়ে যাও।”
আবরাজ ক্রন্দনরত নির্ঝরের দিকে তাকিয়ে বলে,”বেশ, নিজের ছেলের ভালোর জন্য যা করা লাগবে আমি তাই করবো।”
দীর্ঘ বহু বছর পর শান্তিপূর্ণ ভাবে একে অপরের পাশাপাশি বসে আছে নিঝুম ও আবরাজ। তাদের মাঝখানেই হাসিমুখে বসে বসে চকলেট খাচ্ছে নির্ঝর। মিজানুর রহমান তাদের দুজনের এই মিলনের অনুঘটক হিসেবে কাজ করেছেন। বর্তমানে খান ভিলায় বসে আছে তারা সবাই। ছবি বেগম সবার জন্য চা নিয়ে আসেন। মিজানুর রহমান চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে বলেন,”বেশ সুন্দর খেতে হয়েছে।”
ছবি বেগম মৃদু হাসেন। মিজানুর রহমান আরেক টা চুমুক দিয়ে বলেন,”এবার আসল কথায় আসি। আবরাজ ও নিঝুমের দুজনেরই পূর্ণ অধিকার আছে নির্ঝরের উপর। তবে কর্মসূত্রে আবরাজকে আবারো লন্ডনে ফিরতে হবে অন্যদিকে নিঝুমও এখানে হাসপাতালে ডাক্তার হিসেবে আছে। তাই তাদের মধ্যকার এই দূরত্বের প্রভাব তাদের সন্তানের উপর যেন না পড়ে সেটা আমাদের ভাবতে হবে। এজন্য আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছি এবার নির্ঝর ও নিঝুমও আবরাজের সাথে লন্ডনে যাবে!”
নিঝুম বলে,”কিন্তু আমার পেশা..”
“এ নিয়ে চিন্তা করতে হবে না। আমি ইতিমধ্যেই লন্ডনের একটি হসপিটালে কথা বলে রেখেছি। আমার রেকোমেন্ডোশনে ওখানে তোমার জব হয়ে যাবে। তাছাড়া নিজের ছেলের কথাও ভাবো। লন্ডন হলো বিশ্বের অন্যতম সেরা শহর ওখানে গেলে ও অনেক ভালো সুযোগ পাবে জীবনে, সিলেটে যেটা সম্ভব নয়।”
ছবি বেগম বলেন,”আমার মনে হয় উনি ঠিকই বলছে। তুমি আর চিন্তা না করে রাজি হয়ে যাও।”
নিঝুম নির্ঝরের দিকে তাকিয়ে বলে,”বেশ, এতে যদি আমার ছেলের ভালো হয় তাহলে আমি রাজি আছি।”
মিজানুর রহমান বলেন,”বেশ, তাহলে আমি দ্রুতই তোমাদের লন্ডনে যাওয়ার ব্যবস্থা করে দিচ্ছি। আবরাজ, তুমি কবে ফিরবে?”
অশ্রুজলে বোনা বিয়ে পর্ব ৩৮
আবরাজ বলে,”এবার আমি সপরিবারে লন্ডনে ফিরতে চাই।”
আবরাজের কথায় নিঝুম তার দিকে তাকায়। আবরাজও তাকিয়ে ছিল নিঝুমের দিকে। দুজনের চোখাচোখি হয়। দুজনের চোখে আর আগের মতো রাগ, আক্রোশ নেই। বরং নিজের সন্তানের কথা ভেবে সমঝোতার বার্তাই শোভা পাচ্ছে দুজনের চোখে। এখন যেই লন্ডনে তাদের জীবনের ঝামেলা কেন্দ্রীভূত হয়েছিল সেই লন্ডনই কি আবার তাদের জীবন সুন্দর করে সাজিয়ে দিতে চলেছে? সেটাই এখন দেখার।