অশ্রুজলে বোনা বিয়ে পর্ব ৪০

অশ্রুজলে বোনা বিয়ে পর্ব ৪০
ইয়াসমিন খন্দকার

নিঝুম ও নির্ঝরকে নিয়ে লন্ডনের মাটিতে পা রাখল আবরাজ। নিজের শহরে নিজের পরিবারকে নিয়ে আসার পর তার ভীষণ ভালো লাগছে। প্লেন থেকে নামার পরই তারা গাড়িতে উঠে পড়েছে। লন্ডনের ব্যস্ত রাস্তা দিয়ে ছুটে চলেছে আবরাজের গাড়ি৷ নির্ঝর অবাক চোখে জানালা দিয়ে লন্ডন শহরটাকে দেখছে। এ যেন সম্পূর্ণ এক নতুন অভিজ্ঞতা তার কাছে। সিলেটের গ্রামীন পরিবেশে বড় হবার পর এখন লন্ডনের মতো এক জাকজমকপূর্ণ শহর তার কাছে বড্ড অচেনা। জানালা দিয়ে দেখছে আর নিঝুমকে একের পর এক প্রশ্ন করে চলছে। নিঝুমও বিরক্ত না হয়ে শান্ত থেকেই সব প্রশ্নের উত্তর দিচ্ছে। মা-ছেলের এই সব কাণ্ড আবরাজেরও চোখে পড়ছে। গাড়ি চালাতে চালাতে আড়চোখে সে সমস্তটাই দেখছে এবং এক চিলতে স্মিত হাসি দেখা যাচ্ছে তার ঠোঁটের মাঝে। আবার একটু আফসোসও হচ্ছে। আজ যদি ছোট থেকেই নির্ঝর তার সাথে থাকত তাহলে তার সাথেও হয়তো নির্ঝরের এমনই সুন্দর একটা বন্ধন তৈরি হতো।

অবশেষে কয়েক ঘন্টার যাত্রার পর গাড়ি এসে থামে ইস্ট লন্ডনের টাওয়ার হ্যামলেটস এ অবস্থিত আবরাজের বিলাবহুল এপার্টমেন্টের সামনে। নিঝুম নির্ঝরকে নিয়ে গাড়ি থেকে নামে। নির্ঝর গাড়ি থেকে নেমেই অবাক চোখে চারিদিকে তাকায়৷ অতঃপর নিঝুমের উদ্দ্যেশ্যে বলে,”এখন থেকে কি আমরা এখানেই থাকব আম্মু?”
নিঝুম বলে,”হ্যাঁ, সোনা। এখন থেকে আমরা এখানেই থাকব।”
আবরাজ গাড়ির জানালা থেকেই নিঝুমের দিকে এপার্টমেন্টের চাবি বাড়িয়ে দিয়ে বলে,”তুমি নির্ঝরকে নিয়ে ভেতরে যাও। আমি গাড়িটা গ্যারেজে রেখে আসছি।”
“আচ্ছা।”

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

নিঝুম এরপর আবরাজের কথা মতো নির্ঝরকে সাথে নিয়ে ভেতরের দিকে যায়। চাবি খুলে এপার্টমেন্টে প্রবেশ কর‍তেই পুরাতন সব কথা মনে পড়ে যায়। সেই প্রথম বার যখন সে লন্ডন শহরে পা রেখেছিল, অতঃপর আবরাজের সাথে কাটানো কিছু স্মৃতি। এসব ভেবেই নিঝুম দীর্ঘ শ্বাস ফেলে।
এরইমাঝে আবরাজ ফোনে কারো সাথে কথা বলতে বলতে এপার্টমেন্টে প্রবেশ করে। সে বলছিল,
“হ্যাঁ, মামা। আমরা সবাই সাবধানে লন্ডনে পৌঁছে গেছি৷ তুমি কি এখন নিউ ইয়র্কে?”
বিপরীত দিক থেকে মিজানুর রহমান বলেন,”হ্যাঁ, আমি তো অনেক আগেই পৌঁছে গেছি। আচ্ছা, তোরা তাহলে সাবধানে থাক। আর ঝগড়াঝাটি করিস না বাপু। আমি বারবার তোদের মাঝে মিল করানোর জন্য এই বুড়ো বয়সে ছোটাছুটি করতে পারব না।”
আবরাজ নিঝুমের দিকে তাকিয়ে বলে,”তুমি চিন্তা করো না, মামা। আমাদের মাঝে আর কোন ঝামেলা হবে না।”
নিঝুম আবরাজের কথা শুনে তার দিকে তাকাতেই দুজনের আবারো চোখাচোখি হয়। আবরাজ তার মামাকে বিদায় জানিয়ে ফোনটা রেখে দেয়। নিঝুম তার হাতে থাকা ব্যাগগুলোর দিকে ইশারা করে বলে ওঠে,”এগুলো কোথায় রাখব?”

“আমাদের রুমে গিয়ে রাখো।”
“আমাদের রুমে?”
“হুম,আমাদের রুম।”
নিঝুম বুঝতে পারে আবরাজ তার রুমের কথাই বলছে। নিঝুমও আর কথা না বাড়িয়ে সমস্ত জিনিসপত্র নিয়ে আবরাজের রুমেই রেখে দেয়। নির্ঝর এত দীর্ঘ যাত্রার পর অনেক ক্লান্ত হয়ে পড়েছিল। তাই সে নির্ঝরকেও ঘুম পাড়িয়ে দেয়। অতঃপর ঘুমন্ত নির্ঝরের মাথায় হাত বোলাতে থাকে।
একটু পর আবরাজ রুমে এসে বলে,”নির্ঝর ঘুমিয়ে পড়েছে?”
“হুম।”
এরপর তাদের মাঝে কিছু সময়ের নীরবতা কাজ করে। আবরাজ টাওয়াল নিয়ে ওয়াশরুমে যায়। অতঃপর ফ্রেশ হয়ে বেরিয়ে আসে। টাওয়াল দিয়ে মুখ মুছতে মুছতে সে নিঝুমের উদ্দ্যেশ্যে বলে,”তুমিও যাও ফ্রেশ হয়ে এসে ঘুমিয়ে পড়ো।”

নিঝুম বলে,”আপনার সাথে কিছু জরুরি কথা ছিল।”
“হুম, বলো।”
“আপনার মামা তো বলল, এখানকার কোন এক হাসপাতালে আমার জবের ব্যবস্থা করেছেন। তার কি হলো?”
“এ ব্যাপারে চিন্তা করো না। মামা আমায় সব বলে দিয়েছেন। কিছু ফর্মালিটিস পূরণ করা বাকি আছে। আশা করি, এক সপ্তাহের মধ্যেই ব্যবস্থা হয়ে যাবে।”
“আর একটা কথা।”
“বলতে থাক।”
“সিলেটে তো নির্ঝরকে দেখে রাখার জন্য চাচি ছিল। তাই আমি নিশ্চিন্তে ওকে বাসায় রেখে হাসপাতালে চলে যেতাম। কিন্তু এখানে তো আপনিও অফিসে যাবেন আর আমাকেও হসপিটালে যেতে হবে। তাই আমার ভীষণ চিন্তা হচ্ছে যে নির্ঝরের খেয়াল কে রাখবে।”

“এটা নিয়েও তোমায় ভাবতে হবে না। আমি ভেবেছি, নির্ঝরকে এখানেই একটা স্কুলে ভর্তি করিয়ে দেব। এখানকার স্কুল গুলোয় ডে-কেয়ার সিস্টেম চালু আছে। সারাদিন বাচ্চারা স্যার-ম্যাডামদের তত্ত্বাবধানেই থাকে।”
“কিন্তু নির্ঝর কি এই অচেনা পরিবেশে মানিয়ে নিতে পারবে?”
“সন্তানের ভালো ভবিষ্যতের জন্য তো আর এর বিকল্প নেই। তবে নির্ঝরের যাতে কোন অসুবিধা না হয় সেই ব্যবস্থা আমি করব। ওর একটা বন্ধুর দরকার। তোমার ম্যাক্স আর এলিনার কথা মনে আছে নিঝুম?”
“হ্যাঁ, মনে থাকবে না কেন? ওরা তো আপনার কত ভালো বন্ধু। ওদের বিয়েতেও তো আমি ছিলাম।”
আবরাজ দীর্ঘ শ্বাস ফেলে বলে,”ম্যাক্স আজ আর পৃথিবীতে নেই।”
নিঝুম ভীষণ অবাক হয় কথাটা শুনে। আবরাজ বলতে থাকে,”কয়েক বছর আগে একটা এক্সিডেন্টে ম্যাক্সের মৃত্যু হয়েছে। এলিনা এখন ওর ছেলে এলেক্সকে নিয়েই জীবন কাটাচ্ছে। এলেক্সও আমাদের নির্ঝরের বয়সী। ও এখানকার একটা স্কুলে পড়ে। আমরা আমাদের নির্ঝরকেও ঐ স্কুলে ভর্তি করাতে পারি।”
“তাহলে তো ভালোই হয়।”
“হুম৷ তুমি ফ্রেশ হয়ে একটু ঘুমাও। আমি রাতের খাবারের ব্যবস্থা করছি।”
“আমি নাহয় রান্নাটা করে নেই।”
“নাহ, এমনিতেই অনেক জার্নি করেছ এখন আর কষ্ট করে রান্না করতে হবে না। আমি বাইরে থেকে খাবার অর্ডার করছি।”
আবরাজের এই কেয়ারিং ব্যাপারটা ভীষণ ভালো লেগে যায় নিঝুমের। সেও আর না করে না।

কিছু দিন পর,
নির্ঝরকে সাথে নিয়ে আজ ইস্ট লন্ডনের স্বনামধন্য একটা স্কুলে এসেছে নিঝুম ও আবরাজ। উদ্দ্যেশ্য তাকে এখানে ভর্তি করানো। এই ক’দিনে নিঝুম ও আবরাজ নির্ঝরের স্বার্থেই একে অপরের সাথে আপোষ করে নিয়েছে। তবে এখনো তাদের সম্পর্ক টা খুব একটা স্বাভাবিক স্বামী-স্ত্রীর মতো হয় নি। বরং তাদের সম্পর্ক অনেকটা নির্ঝরের মা-বাবা পর্যন্তই সীমিত। যেন তারা বিবাহিত দম্পত্তি হিসেবে না কেবলই সন্তানের পিতা-মাতা হিসেবে জীবনযাপন করছে।
নির্ঝরকে নিয়ে স্কুলে আসলে স্কুলের প্রিন্সিপাল মিসেস টেরেসা তাদের সাথে সাক্ষাৎ করেন। আবরাজ মিসেস টেরেসাকে বলে,”হ্যালো, মিসেস টেরেসা, আমি আবরাজ চৌধুরী, এলিনা নিশ্চয়ই আপনাকে আমার কথা বলেছে?”
বছর ৫০ এর বিচক্ষণ নারী মিসেস টেরেসা বলেন,”ওহ, হ্যাঁ। আপনি তো আপনার ছেলেকে এই স্কুলে ভর্তি করাতে চান, তাই না?”

“জ্বি।”
“তা কোথায় আপনার ছেলে? ওকে একটু সামনে নিয়ে আসুন। আমি ওর সাথে কথা বলে দেখি।”
নিঝুম নির্ঝরকে বলে,”নির্ঝর, ইনি তোমার ম্যাম। ওনাকে সালাম দাও।”
নির্ঝর বলে,”আসসালামু ওয়ালাইকুম, ম্যাম।”
মিসেস টেরেসাকে কিছুটা বিরক্ত লাগে। তিনি বলেন,”আমাদের লন্ডনে এসব গ্রাটিংস চলে না। ওকে হ্যালো বলতে শেখাবেন।”
নিঝুম বলে,”আমরা লন্ডনে এসেছি সেটা ঠিক আছে। তার মানে এই নয় যে,আমরা আমাদের সংস্কৃতি, আমাদের ধর্মীয় আচারকে ভুলে যাব।”

মিসেস টেরেসা বিরক্ত হন। তিনি ইংলিশে নির্ঝরকে কিছু প্রশ্ন করেন৷ কিন্তু নির্ঝর ইংলিশ তেমন একটা ভালো না বোঝায় ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে। মিসেস টেরেসা বলেন,”ও কি ইংরেজি পারে না নাকি?”
আবরাজ বলে ওঠে,”আসলে ও ছোটবেলা থেকে আমাদের দেশেমানুষ হয়েছে তো তাই আরকি..”
মিসেস টেরেসা এবার নিঝুমের দিকে তাকিয়ে বলেন,”নিজের ছেলেকে ইংরেজিও শেখাতে পারেন নি? ওকে এই স্কুলে ভর্তি করিয়ে কি করব? শুধু এই স্কুল কেন লন্ডনের কোন স্কুলেই তো ওকে নেবে না। ও তো আমাদের পড়া কিছুই বুঝবে না। জানি না, কেমন মা এনারা। নিজেরাও ইংরেজি জানে না, নিজেদের বাচ্চাদেরও শেখায় না। আর দুনিয়ার থার্ড ক্লাস কান্ট্রি থেকে UK তে এসে নিজেদের সন্তানকে ভালো স্কুলে পড়াতে চায়।”

অশ্রুজলে বোনা বিয়ে পর্ব ৩৯

নিঝুম ভীষণ অপমানিত বোধ করে। সে কিছু বলতে যাবেই তার আগে আবরাজ বলে ওঠে,”মাইন্ড ইওর ল্যাঙ্গুয়েজ, মিসেস টেরেসা। আমার ওয়াইফ একজন ডক্টর। ওর যোগ্যতার ব্যাপারে আপনি কিছু জানেন না। ওর ব্যাপারে আর একটা খারাপ কথা আমি বরদাস্ত করব না।”

অশ্রুজলে বোনা বিয়ে পর্ব ৪১