রং পর্ব ৩৬
তন্নী তনু
রাত বাড়ছে…… সিনথিয়ার বাবা-মা, মুগ্ধ সাথে জিসান থানায় বসে আছে। রিজভি শিকদারকে ডেকে আনা হয়েছে কল করে। সিনথিয়াকে খুঁজে না পাওয়ায় একটা মিসিং ডায়েরি হয়েছে আগেই। তবে এইবার তার বাবা- মা এসেছেন আসল কথা বলতে। সে কথা পুলিশের কিছু অফিসার জানেন। তবে তারা কখনোই স্বীকার করবেন না। কথোপকথনের এক পর্যায়ে সিনথিয়ার বাবা মুগ্ধ”র সাথে সিনথিয়ার কনভারসেশন দেখান। সেখানে সিনথিয়া ইবনা এসপি”র কথা লিখে থাকলেও পুলিশ সে বিষয় মোটেও মাথায় নেন না। তাদের কাজ লজিক্যালি বিষয়টা ইগনোর করা। রিজভী শিকদার বলেন,
— এই কনভারসেশনে প্রুফ হয় না সেদিন মিস সিনথিয়া এসপি”র সাথেই ছিলেন।
সিনথিয়ার বাবা বলেন,
— মেয়েটা গত কয়েকদিন ধরে এসপি”কে হেল্প করছিলো। আর আপনারা কথাটা মাথায় নিচ্ছেন না।
— দেখুন! যদি এমন কিছু হতো স্যার আমাদের ইনফর্ম করতেন। বিষয়টি জানানো হয়েছিলো। তিনি মিস সিনথিয়া ইবনার সাথে ছিলেন না।
ঠিক তখন-ই জিসান পেনড্রাইভ এগিয়ে দেয়। তারপর বলে–” অনেক কষ্টে এই ফুটেজ গুলো কালেক্ট করতে পেরেছি। কষ্ট করে চেক দিবেন। গত কয়েকদিন রাতে এসপি ও সিনথিয়া ইবনা”কে একই সাথে দেখা গিয়েছে। আপনারা চাইলেই সত্য চাপা রাখতে পারেন না। এরপর প্রয়োজনে প্রেস মিডিয়া ডাকবো।”
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
রিজভী শিকদার পুরো বিষয়টা দেখে। প্রুফ এখন পুরোই বিপরীতে। ঘটনা এখন বেগতিক। রিজভী শিকদার পুরো বিষয় প্রভাতরঞ্জন সরকারকে ইনফর্ম করেন। ফুটেজ ও পাঠিয়ে দেন। তিনি সবটা দেখেন। আগের রাতের কিছু ফুটেজ সহ কিডন্যাপের রাতে জাবির, ইরফাদ, সিনথিয়া ইবনা ও তনয় এর একই সাথের ফুটেজ কালেক্ট করা হয়েছে। “এসব তথ্য এই ছেলে এতো দ্রুত কি করে কালেক্ট করলো প্রশ্ন থেকে যায়।” তবে এখন এসব ভাবার সময় না। তিনি উপরমহলে আলোচনা করেন। তারপর কল ব্যাক করে রিজভী শিকদারকে বলেন– সকাল পর্যন্ত সময় নিন। দ্যান আই”ল ম্যানেজ…
রাতের আধারে এসপি”র সাথে কুমারী মেয়ের চলাফেরা। আবার তার সাথে থাকাকালীন মেয়েটি নিখোঁজ। বিষয়টি জানাজানি হলে অবস্থা বেগতিক রূপ নিবে। এর চেয়ে আইজিপির নির্দেশ প্রেস মিডিয়া ডাকা হোক। এবং তাদের জানানো হোক –” কেসের সুবিধার্থে মেয়েটির হেল্প নেওয়ার সময়- মেয়েটিকে পুলিশের চোখ ফাঁকি দিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়। পুলিশ ফোর্স তাকে উদ্ধার কাজে সে রাত থেকেই নিয়োজিত। খুব তাড়াতাড়ি তাকে রেসকিউ করার আশ্বাস!” এতে মানুষ ঠান্ডা থাকবে। ঠান্ডা থাকবে সিনথিয়া ইবনার পরিবার।
ধূসর রঙের উদাম উন্মুক্ত আকাশটা তার শূন্য সুবিশাল বুকের এক পাশে রূপালী চাঁদকে পেজা তুলোর মতো মেঘের কোমল নরম চাদরে ঢেকে ঘুম পারাচ্ছে। রূপালী চাঁদ দুষ্টু বাচ্চার মতো মেঘের চাদরের আড়াল থেকে উঁকি দিচ্ছে। ধূসর আকাশের একপাশে চাঁদের রূপালী আলোতে কালো মেঘের গাঁ থেকে শুভ্র রঙ ঝলমলিয়ে উঠছে। বইছে মৃদুমন্দ বাতাস।কখনো কখনো সেই কোমল বাতাস রূপ বদলে শা শা শব্দ তুলছে। রুপালি চাঁদের আলো পড়েছে উত্তাল সমুদ্রের ছোট বড় ঢেউ”এ। উত্তাল ঢেউ উপেক্ষা করে জাহাজ চলছে আপন গতিতে। জাহাজের একটি ছোট আকারের কেবিনে বন্দী সিনথিয়া। ছোট্ট বেডে সাদা বিছানা পাতা। পাশে একটি ছোট্ট সোফা। পাশের দেয়ালে ছোট একটি জানালা। তাতেও পর্দা টানা। সিনথিয়া বিছানায় নিস্তেজ শরীরে পড়ে আছে। দীর্ঘ সময় ধরে পেটে পানি ব্যতিত কিছুই পড়েনি। জোর করেও তাকে খাওয়ানো যায়নি।তার পায়ের মাপে একটা গোলাকার বেড়ি পড়ানো হয়েছে। রাফসান যে তাকে বিশ্বাস পাচ্ছে না এটিই তার প্রমাণ। তাই বন্ধ রুমেও তাকে বড় শিকলে বেঁধে রাখা হয়েছে।এবং শেকল সামনের রুমটিতে কিছুর সাথে লাগানো। যাতে সিনথিয়া নির্দিষ্ট জায়গা জুরে চলাফেরা করতে পারে। এবং প্রয়োজনে শেকল টেনে ভাইকে নক দিতে পারে।
রুমের বাইরে কি চলছে কিছুই জানা নেই। ইরফাদ কোথায়? কেমন আছে? কি করছে সবটা অজানা।
মনে আরেকটা প্রশ্ন দানা বাঁধছে। শুধু প্রতিশোধ আর বাবা”কে খুঁজে পাওয়াই কি রাফসানের উদ্দেশ্য। এতো ক্ষোভ এতো রাগ ইরফাদের উপরেই কেনো? রাফসান বলেছে ইরফাদের কোনো ক্ষতি করবে না। কিন্তু তাকে কি বিশ্বাস করা যায়? প্রতিশোধের নেশায় উম্মাদ রাফসান। যেনো সব কিছু তার কাছে তুচ্ছ। এমনকি নিজের জীবনের মূল্যেও নেই। নেই তার মূল্যও। যেনো পুরোটাই সাইকো।সিনথিয়া নিজেও রাফসানের ব্ল্যাকমেইলের শিকার।একদিকে আদরের ছোট ভাই মুগ্ধ, বাবা-মা কে রক্ষা করা যখন তার উপর। চাইলেও সে এই ফাঁদ থেকে বের হতে পারছে না সে।যদিও ইরফাদকে ধরার জন্য একচুল সাহায্যে সে করেনি। তার হাতে তো কোনো উপায় ছিলো না। এখান থেকে পালালে ঐদিকে মুগ্ধকে কিডন্যাপ করা হবে। প্রাণভোমড়া বন্দি রেখে রাফসান তাকে অদৃশ্য শেকলে আগেই বেঁধে ফেলেছে। তাই এই লোহার শেকলে বাঁধার কোনো মানেই হয় না। এই মূহুর্তে তাকে জাহাজ থেকে নামিয়ে দিলেও সে যাবে না। কারণ আরেকজন ভালোবাসার মানুষও এখানেই বন্দী।
জীবনটা গল্পের মতো হয়ে গেছে। আর প্রশ্ন গুলোও। জীবনের এই কঠিন মূহুর্তে অদৃশ্য কেউ যেনো তাকে প্রশ্ন করছে- ধরো তিনজন ভালোবাসার মানুষ উত্তাল সমুদ্রে হাবুডুবু খাচ্ছে। আর তোমার কাছে আছে একটা বোট। যেকোনো দুইজনকে তুমি বাঁচাতে পারবে।ইরফাদ, মুগ্ধ, আর রাফসান। তুমি কোন দুইজনকে বাঁচাবে। এখন সিনথিয়ার মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে-কাকে রেখে কাকে বাঁচাবে সে? মুগ্ধ, রাফসান নাকি ইরফাদ! এই কঠিন প্রশ্নের সম্মুখীন সিনথিয়া। ভালোবাসার মানুষ তো তিন জন-ই। তাই মুগ্ধ আর রাফসান কেই সে বোট”এ একসাথেই জায়গা দিয়েছে। আর উত্তাল সমুদ্রে নিজেই লাফিয়ে পড়েছে ইরফাদের সাথে। বাকিটা পথ ইরফাদের হাত ধরে সে সাতরে পার হতে চাচ্ছে। অজানা গন্তব্যে শুধুই ধোঁয়াশা। জানা নেই– এই পথ আদোও সাতরে পার হতে পারবে কি না।
আরেকটা কেবিনে বন্দি করে রাখা হয়েছে ইরফাদ আর জাবিরকে। বাকিরা বাইরে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। রাফি বসে আছে সিনথিয়ার কেবিনের সামনের কেবিনে। সিনথিয়ার প্রয়োজন অপ্রয়োজনের ডাকে সাড়া দিতে। সে সিনথিয়াকে জাহাজে তোলা অবধি রাফসানকে সহযোগিতা করে গেছে। রাফসান পায়চারী করছে এদিক থেকে ওদিকে। একদল লোক দূরবীনে চোখ রেখেই চলেছে। এসপিকে কোনো ভাবেই বিশ্বাস করা যায় না। সে ধূর্ত চালাক। কখন রাঘব বোয়ালের মতো জাল ছিড়ে বেরিয়ে যাবে টের পাওয়া মুশকিল। তাই গন্তব্য পৌঁছানো অবধি সবাইকে সতর্ক থাকতে হবেই।
জাবির আর ইরফাদ বসে আছে। দুটো বালিসে পিঠ ঠেকিয়ে পায়ের উপর পা তুলে বসে আছে ইরফাদ। জাবির বসে আছে সোফায়। পড়নের লুঙ্গি কোমেরে কাছে গিট পাকিয়ে তুলে রেখেছে। বাকি অংশ হাঁটু ছুঁয়েছে। হাত সোফার হাতলের উপর রেখে কপাল ঠেস দিয়ে আছে সে। কথোপকথনের এক পর্যায়ে বললো,
— স্যার! এতো রিস্ক নেয়া কি প্রয়োজন ছিলো। আপনি তো জানতেন আপনাকেই চায় রাফসান। ওদের প্ল্যান-ই তো ছিলো এইটা…..
— তো কি করতাম?
— স্যার ফিরে যাওয়া উচিৎ ছিলো। আমরা ডিপার্টমেন্টকে জানাতাম। বলতাম ট্রাই করেছি তবুও মেয়েটিকে রেসকিউ করতে পারিনি।
— দ্যান??
— দ্যান….. ডিপার্টমেন্ট যা ডিসিশন নিতো তাই হতো….
— আর মেয়েটি?
— স্যার মেয়েটিকে রেসকিউ করার জন্য সকল ডিপার্টমেন্টে আলোচনা হতো। কোনো না কোনো রাস্তা ঠিক বের হতো। এভাবে একা যাওয়া আপনার জন্য রিস্কি স্যার। আমরা তো জানি না–কেনো? আর কি কারণে ওরা আপনাকে চায়…..আর কোথায় নিয়ে যাচ্ছে তাও জানা নেই….
— রাফসান জাল শক্তপোক্ত ভাবেই বিছিয়েছে……. আমি ধরা না দিলে হিতে বিপরীত হতো। আ”ম সিউর সিনথিয়ার বাসার আশেপাশে কেউ রাফসানের সাথে আছে। সিনথিয়া ইবনা আমাদের হেল্প করতে গিয়ে কিডন্যাপ হয়েছে। আর পুলিশ এখনো বসে আছে নিশ্চিন্তে। এইটুকু প্রুফ করতে পারলেই পুরো ডিপার্টমেন্টের নাম খারাপ হবে। আঙ্গুল উঠবে এই আইন ব্যবস্থার উপর।
— স্যার! আপনার লাইফ তো রিস্কে।
— ডোন্ট প্যানিক!লাইফ ইজ নট আ বেড অফ রোজ। স্ট্রাগল করে টিকে থাকাটাই আসলে লাইফ। বাকি ডিসিশন উপরওয়ালার। তিনি চাইলে বেঁচে থাকবো না চাইলে কেউ বেঁধে রাখতে পারবে না…..
রাত বাড়ছে। মধ্যরাতে জাতীয় দলের ক্রিকেট খেলা। স্বাভাবিক ভাবেই ছোট বেলা থেকে ক্রিকেট খেলতে পছন্দ করে শিশির। দেশের ক্রিকেট খেলার প্রতি দূর্বলতা দেশের প্রত্যেক মানুষের-ই। নিজের দেশের খেলা একটা আবেগ।একটা অন্যরকম ভালোবাসার নাম ক্রিকেট। বন্ধুরা সবাই মিলে খেলা দেখবে বলে এখনো বন্ধ করেনি দোকান। দোকানের এক শাটার বন্ধ করে দোকানে বসে আছে তারা বন্ধুরা মিলে। আর দু”মিনিট পরেই খেলা।
অডিটোরিয়ামে মানুষের ঢল। যেনো একটা চেয়ারও খালি নেই। এইবারের বাংলাদেশ ক্রিকেট টিম শক্তিশালী। খুব ভালো অবস্থা। আশা করা যায় বিশ্বকাপ জেতার।প্রথমেই ব্যাটিং এর জন্য নামে নিশান। শিশিরের বন্ধু রিফাত বলে,
–এক ওভারে কি বারো রান হবে??
শিশির বলে,
— প্রথম ওভার তো! বলা যায় না… তবে খেলে তো ভালো।
— আরে শা/লা শিউরলি বল!
— ফাস্ট ওভারে তেমন রান হয় না। হয়তো হবে না।
— শিউর??
— নট শিউর বাট লজিক্যালি বললাম।
–ওকে….. তোর কথাই রাখলাম।
— কেনো রে….
— নতুন এ্যাপ্স লঞ্জ হইছে। সবচেয়ে সহজ পদ্ধতিতে বা*জি জেতা যাবে….
–মানে কি??
— আরে ব্যা/টা। অল ওভার বাংলাদেশে এই মাসে তিনটা চারটা কনসার্ট হইছে। ওখানেই লাইভ প্রমোশন হইছে এপস গুলো। বড় বড় কনটেন্ট ক্রিয়েটর, ক্রিকেটার আর অনেক শিল্পীরাও প্রমোট করছে। অনেক বিশ্বস্ত এপস। আমিতো গত দুই সপ্তায় এতো জিতেছি যে আর ওয়ান ফাইভ কিনছি।
–আরে লাইভ কনসার্টে বা/জির প্রমোশন হইলো আর পুলিশ কিছু করলো না??
— আরে পৃথিবী টাকার পাগল। বড় বড় নেতা, এমপি মন্ত্রী সাথে থাকলে কে কি করবে!
ফোনের স্ক্রিনে খেলা চলছে। রিফাত খেলার এক ওভারে বা*জি রেখেছে পঁচিশ হাজার টাকা। আজকের খেলায় কয়েকবার বাজি জিতলেই আইফোন কালকেই চলে আসবে। শিশিরের কথা মতো বা*জি ধরে। এক ওভারে দশ রান হয়। জিতে যায় রিফাত। মুখে রাজ্যজয়ী হাসি। আর একটু। আইফোন হাতের নাগালে। রিফাত উচ্ছাস নিয়ে বলে,
— আরে শা*লা আমি তো দেখছি বড়লোক হয়ে যাবো। যা বলছিস তাই হয়েছে। তুই এতো ভালো বুঝিস। এপস টা নে। দুইদিনে বড়লোক হয়ে যাবি…
রং পর্ব ৩৫
–আরে নাহ….এতো লোভ ভালো না।
— আরে যেই ভালো ক্রিকেট বুঝিস। একবার ট্রাই কর। কিছু টাকা হলে পরে আর করিস না। সমস্যা কি??
— না রে….. এমনিই ভালো আছি।
— আরে চালাস তো পুরানা আমলের বাইক। একটা আরওয়ান ফাইভ/ রয়েল এনফিয়েল্ড এর টাকা হলেই আর খে/ল/বি না। প্রবলেম কি??