রং পর্ব ৩৮
তন্নী তনু
ভোরের আলো ফুটছে। সারারাত নিজ দায়িত্বে চারপাশের সবটা পর্যবেক্ষণ করেছে রাফসান। এক মূহুর্ত্তের জন্যে অন্যের উপর নির্ভর করেনি। সারারাত নজর রেখেছে সমুদ্র পথে।কেউ পিছু নিয়েছে কি না। কোনো রহস্যময় কিছু দেখা যায় কি না! তবে কেবিনের সাইডটা সে সময় দিতে পারেনি।রাফির সাথে লাস্ট কথা হয়েছিলো কেবিনে। এরপর থেকেই ছাদে ছিলো রাফসান। সারারাত নির্ঘুমে কেটেছে। এখন একটু রেস্ট দরকার। নিচে যাওয়ার জন্য পেছন ফেরে রাফসান।
রাফি এখনো শুয়ে আছে মেঝেতে। জানালা দিয়ে আসা ভোরের আলোয় চোখ মিটমিট করে রাফি। নিজেকে মেঝেতে দেখতে পায়। মাথা ব্যথায় টন টন করছে। সে এখানে কেনো??মেঝেতেই ঘুমিয়েছিলো কি সে? কিন্তু কেনো? পরক্ষণেই মনে পরে রাতের ঘটনা। ভেতরে ছোটখাটো একটা বোম ব্লাস্ট হয়। সিনথিয়া কি তাহলে পালিয়ে গেছে? সাথে সাথে উঠে বসে রাফি। এদিক ওদিক তাকায়। সিনথিয়া ঘরে নেই। ব্যথায় মাথা নাড়াতে কষ্ট হচ্ছে। তবে তার দায়িত্বে থাকা সিনথিয়া যদি সত্যিই পালিয়ে যায়। তাহলে তার জীবন আর থাকবে না। এক সেকেন্ডে ঝড়ের গতিতে যেনো উড়ে বাইরে আসে রাফি। দুপাশে কেবিন।মাঝে লম্বা রাস্তা।
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
মাঝামাঝি কেবিনের দরজা ঘেঁষে বসে আছে সিনথিয়া। হাফ ছাড়ে রাফি।সিনথিয়ার মাথাটা দরজায় ঠেকানো। অফহোয়াইট কালারের গাউনটা মেঝেতে ছড়িয়ে আছে। লম্বা চুলের বিনুনিটা কোলে জমা হয়ে আছে । বন্ধ চোখে যেনো পৃথিবীর সমস্ত মায়া ঢেলে দিয়েছে। এক মূহুর্ত্তের জন্য পুরো পৃথিবী থেমে যায় রাফির। মেয়েটা এতো মায়াবী, এতো স্নিগ্ধ। সুন্দর সবাই হতে পারে। তবে মায়াবী হয় খুব কম মেয়েই। হঠাৎ করেই একটা চিন্তা ঢুকে যায়। সিনথিয়া এখানে কেনো ঘুমাচ্ছে? এখানেই তো এসপি আর এসপির সহকর্মীকে রাখা হয়েছে। কি চলছে এসপির সাথে সিনথিয়ার? প্রেম কি হয়েই গেছে তাহলে? ঠিক ঐ সময়ে রাফসান নামে। প্রথম পা ফেলেই অবাক হয়ে যায় রাফসান।সিনথিয়া ফ্লোরে কেনো?” এই প্রশ্ন নিয়ে ধীর পায়ে এগিয়ে যায় রাফসান। চোখাচোখি হয় রাফির। রাফির চোখে ভয় আর রাফসানের চোখে দেখা যায় রাগ। চোয়াল শক্ত হয়ে আসে রাফসানের। ক্রুব্ধ গলায় বলে,
— ও এখানে কেনো?
চুপ করে থাকে রাফি। রাফসান কঠিন গলায় বলে,
— ও সারারাত মেঝেতে এখানে ছিলো?
রাফি মাথা নাড়ায়। রাফসান চেঁচিয়ে ওঠে,
— আর তুই কি করছিস সারারাত?
উচ্চস্বর শুনেই ঘুম ছুটে যায় সিনথিয়ার। চোখ খুলেই দু”জন মানুষকে মুখোমুখি দেখে সিনথিয়া। নিজের অবস্থান দেখে চিন্তা করে রাতে কখন ঘুমিয়েছিলো সে? রাতের কথা মনে পড়ে। ইরফাদ অনেকবার বলেছিলো রুমে যেতে। সে যায়নি। তারপর কখন ঘুমিয়ে গেছে মনে নেই। ওপাশের মানুষটা কি তার সাড়া না পেয়ে পরবর্তীতে বিছানায় গিয়েছিলো?ঘুমিয়েছিলো? নাকি দরজার ওপাশেই বসে আছে। চাইলেও তো সে দেখতে পারছে না। রাফির উত্তরে ভাবনার ছেদ ঘটে। উপরের দিকে তাকায় সিনথিয়া।
— আপনার বোনকে জিজ্ঞেস করুন! আপনার বোন আমাকে মেরে এখানে চলে আসছে……
রাফসান সিনথিয়ার দিকে তাকায়। বড় বড় গোল গোল চোখে রাফসান চোখ রাখে। গম্ভীর গলায় বলে,
— সত্যি!!
সিনথিয়া চোখ সরায়। রাফসান বুঝে নেয় সব। রাফিকে কিছু বলে লাভ নেই। রাফসান জানে তার বোনের কথা। তবে বোন যে দুনিয়ার সব ভেঙেচুরে ইরফাদের কাছে ছুটে আসতে পারে। ইরফাদের জন্যে এতো লড়াই করতে পারে এটা তো জানা ছিলো না। এতো কিছু বলার পরও সিনথিয়ার মনে কোনো পরিবর্তন নেই। ইরফাদ এই কয়েকটা দিনে কি এমন জাদু করলো! এখন তার বোন তাকেই বিশ্বাস করলো না। আগে তো সব শুনতো বাচ্চাদের মতো। তাহলে কি দুজনের মধ্যেই কোনো কিছু আছে! যেটা সিনথিয়া বলতে চাচ্ছে না! রাফসান সিনথিয়ার সামনে বসে। ধীর গলায় বলে,
— সত্যি করে বল!এসপি তোকে ভালোবাসে?
সিনথিয়ার মুখটা গম্ভীর। চোখ দুটো নামানো। হাজার হোক বড় ভাই তো রাফসান। নির্লজ্জতার পরিচয় বার বার বড় ভাইয়ের কাছে দেয়া যায় না। সিনথিয়া কথা বলে না। রাফসান আবারো বলে,
— কি বলি?
সিনথিয়া নিরবে দুদিকে মাথা নাড়ায়। যার অর্থ “না”। রাফসান নরম দৃষ্টিতে একবার রাফির দিকে তাকায়। তারপর আবার সিনথিয়ার দিকে তাকিয়ে বলে,
–চল এখান থেকে।
সিনথিয়ার হেলদোল নেই কোনো। যেনো শুনতেই পাচ্ছে না। রাফসান আবারো বলে,
–এতো কিছু এসপি”র এইগনেস্টে সব শুনেও তোর একতরফা কিসের ভালোবাসা। হি ইজ আ মার্ডারার। ড্যামেড….
ও নামেই শুধু এসপি। তুই তোর ভাইয়াকে বিলিভ করিস না? ও আমাদের বাবার খু!নি! আমাদের সুন্দর একটা পরিবার ছিলো….আউয়ার ফ্যামিলি ওয়াজ দিটাচ ফর হিম। অনলি ফর হিম।
— তিনি খু/নি হলে তু/মিও খু/নি ভাইয়া। তিনি অনেক অপরাধীকে হয়তো শাস্তি দিয়েছেন। হয়তো মেরেছেন। এটা তার প্রফেশন। কিন্তু তুমি তো একজনের হৃদয়ে ছুরি চালিয়ে এসেছো!
— তুই কি বাবা কে অপরাধী বলছিস??
–অবশ্যেই না! তবে ঘটনা তো এখনো একপাক্ষিক। আমাকে আমার (পালিত) বাবা বলেছেন–ঐ সময়ে “ক্যাসিনো সম্রাট” শব্দটা শাহজাহান নামের আগে যুক্ত হয়েছিলো। এটার অবশ্যেই কোনো কারণ আছে। কিছু ঘটে থাকলেই তো কিছু রটে। একপাক্ষিক কথা শুনে আমি ম্যনুপুলেট হতে পারিনা।
দাঁড়িয়ে থাকা রাফি সাথে সাথে উত্তর দেয়।
— তাহলে একপাক্ষিক দেখা ঘটনায় আমাকে কেনো শাস্তি দিচ্ছো? কেনো আমাকে মানতে পারছো না….
— সাট আপ! তুমি লুকিয়ে বিয়ে করেছো..আমার মন ভেঙ্গেছো, বিশ্বাস ভেঙ্গেছো….। মন ভাঙার আবার একপাক্ষিক আর উভয়পাক্ষিক কিছু হয় নাকি?
— আমি বাধ্য হয়ে করেছি। বলেছিতো। না হলে বাবা পরের মাসে ইনস্টলমেন্ট দিতেননা।
— এতো বাহানা কোরো না রাফি। তুমি চাইলে আমাকে জানাতে পারতে…দু”জন মিলে সলুশন খোঁজা যেতো।
–এটা তো কল্পনা না। টাকার প্রবলেম…
–সরি টু সে…. মনে হয় কখনো আমার থেকে টাকা নিও নি। আমি তোমাকে কখনো হেল্প করিনি। আসলে কি জানো ভেতরের খবরটা আমাকে তুমি বলছো না। তুমি চেয়েছো সাপও মরে লাঠিও না ভাঙে। ঐদিকে সুন্দরী একটা বউও পেলাম… বাবার সম্পত্তি উদ্ধার হলো। আবার সেই নিউজটা হাইড রেখে গার্লফ্রেন্ড কেও পেলাম।
–তুমি তো এতো কঠিন ছিলে না!
— তাহলে ভাবো কি পরিমাণ আঘাত তুমি দিয়েছো…..। এখন আমি সব আবেগ নয় বিবেক দিয়ে ভাবা শিখেছি।
— তাহলে কি এখন তোমাকে বিয়ে করতে চাইতাম সিনথি?
— সিনথি বলবে না ঐ মুখে…..
মানুষের ভেতরে কি চলে তা যদি বুঝতে পারা যেতো তাহলে ভুল মানুষকে বিশ্বাস করে এতো হৃদয় ভাঙার গল্প, এতো দীর্ঘশ্বাসের গল্প তৈরী হতো না।
আমি এতো কিছু বুঝিনা। আমি শুধু এই রুলস মানি– যে একবার হৃদয় ভাঙতে পারে সে কখনোই ভালোবাসতে পারে না। জীবন খুব মূল্যবান। ভুল জায়গা থেকে মুভ অন করা, নিজেকে যতো দ্রুত সম্ভব রিকভার করে ভালো থাকার চেষ্টা করে যাওয়াটাই জীবন। তাই আমার জীবনে প্রতারক, চরিত্রহীন দের একবিন্দু জায়গা নেই।
— তাহলে তুমি কি করে ভাবছো এসপি চরিত্রবান। তাকে বিশ্বাস করার কারণ?
— আমি বিশ্বাস করি একজন হৃদয় ভাঙা মানুষ কখনো অন্যের হৃদয় ভাঙতে পারে না। কারণ সে জানে হৃদয় ভাঙার কতো যন্ত্রণা।
রাফি ক্ষেপে যায়। রাফসানের দিকে এগিয়ে আসে। সিনথিয়ার দিকে আঙুল তুলে বলে,
–দেখছেন বড় ভাই! তলে তলে এরা কতোদূর গেছে। আপনি কি মনে করেন ওদের সম্পর্ক খুবই নরমাল। কতোটা ক্লোজ হলে একে অপরের হৃদয়ের খবর রাখে?
রাফসান সিনথির দিকে তাকিয়ে বলে,
— তুই ডেসপারেট হয়ে যাচ্ছিস ছোট পাখি! আপন মানুষকে তুই বিশ্বাস করছিস না। আমার কথা শুনছিস না। আমি ভাই হয়ে কি তোর খারাপ চাইবো??
সিনথিয়া হাসে। তারপর বলে,
— ভালোবাসা, আদর-স্নেহ মানে কি জানো?ভালো চাওয়ার মানে কি জানো ভাইয়া? আমার হৃদয় ভাঙার গল্প তোমাকে বলেছিলাম। তুমি সেই গল্পকে টেনে ভয়ংকর রূপ দিয়েছো। আমি সেদিন একটা বিশ্বস্ত শেলটার খুঁজছিলাম। আর ছোট বোন হিসেবে তোমার কাছে দুঃখ গুলো বলেছিলাম। সেই তুমি কি করলে? আমাকে আরও দুঃখ দিলে। এখন বলছো খারাপ চাওনা? কোন ভালোটা চাও আমার বলোতো?
— আমি একটা ন্যায় বিচার পাওয়ার জন্যে এমন করেছি। আর কিচ্ছু না…. হারানো পরিবার ফিরে পেতে করেছি। বাবা বেঁচে আছে নাকি আমাদের রেখে চলে গেছে এসব প্রশ্ন আমাকে শান্তি দেয় না। ঘুমাতে পারি না। তাই করেছি। তুই ছাড়া আমাকে কে নিঃস্বার্থ ভাবে হেল্প করবে বল!
— আসলে কি জানো। যতোই তোমাদের নিয়ে রিসার্চ করি হিসেব মেলেনা। পরিবার বিচ্ছিন্ন হওয়ার কষ্ট যদি পেয়েই থাকো সেই দায় কি ইভা নামের মেয়েটির ছিলো ভাইয়া?
অজানা নাম টা সিনথিয়ার মুখে শুনে অবাক হয়ে যায় রাফসান। ভ্রু-জুগলের মাঝে ভাজ পড়ে কয়েকটা। কপাল কুচকে আসে।
–ইভাকে তুই চিনিস?
— আমি সব জানি ভাইয়া।
— এসপি এসবও বলেছে?স্ট্রেঞ্জ!
সিনথিয়া দেখে বাঁকা হাসে। তারপর বলে,
— ফ্যামিলি বিচ্ছিন্ন হওয়ার কষ্ট যদি তোমার হৃদয়ে থেকেই থাকে। তোমার শত্রুতা সিনহার সাথে, তার বাবার সাথে। ঐ মেয়েটার সাথে কি? মেনে নিলাম প্রতিশোধের নেশায় ঐ মেয়েটাকে তুমি যা খুশি করেছো। কিন্তু তোমার বাচ্চা! বাচ্চাটাকে কেনো এমন জীবন দিলে? ফ্যামিলি বিচ্ছিন্ন হওয়ায় যদি তোমার ভেতরে এতো কষ্টই থাকে। তুমি নিজের হাতে তোমার পরিবার কেনো ভাঙলে? “ঐ বাচ্চাটার কি দোষ?তুমি বেঁচে থাকতে বাচ্চাটা বাবাহীন! ঐ বাচ্চা যখন বলে- সবার বাবা আছে আমার বাবা নেই কেনো?”তার মা তাকে প্রতিনিয়ত কি বলে সামলায়।কি উত্তর দেয়? যে একটা বাচ্চার সাথে এমন অবিচার করতে পারে সে কি আসলেই নরমাল অবস্থায় আছে? যে নিজের বাচ্চা কে এমন সিচুয়েশন ফেলে সে আদও মানুষ নাকি অমানুষ।
ভাই বলে কা/পুরুষ শব্দটা টানলাম না…তবে বেশী বাড়াবাড়ি করলে এটাও বলবো।
সিনথিয়ার মুখের শেষের কথা শুনে রাফসান রুষ্ট হয়ে যায়। রাগে দাঁতে দাঁত চাপে। চোখ বন্ধ করে রাখে। তারপর ক্রুদ্ধ গলায় বলে,
— লিমিট ক্রস করিস না!
— আমি আমার লিমিটের মধ্যেই আছি। স্বজ্ঞানে আছি, সুস্থ স্বাভাবিক আছি। তোমরা ঠিক নেই। তুমি প্রতিশোধের নেশায় আরেকজনের বুকে ছুড়ি চালিয়ে এসেছো। ইরফাদ স্যার যে তোমাকে এখনো শ্যু/ট করেনি এই অনেক।
রাফসান চেঁচিয়ে ওঠে,
— সিনথি!
–চিৎকার কোরোনা ভাইয়া। চিৎকার করেই সত্য মিথ্যা হয়ে যায় না। তোমরা কি ভেবেছো ভাই বলে আমি তোমাদের পক্ষে চলে এসেছি? প্রতিশোধের নেশা তোমাকে সাইকো করে দিয়েছে। বোন তো আমি। ভালোবাসতে আমি জানি– তাই দুই ভাইকে রক্ষা করতে এসপি স্যারের সাথে আমিও যুদ্ধে নেমেছি।
রাফসান চোখ রাঙায়। ক্রুদ্ধ গলায় বলে,
— সিনথি…
রাফি রাফসানের তালে তাল মিলায়। তারপর আরেকটু আগুনে ঘি ঢেলে রাফসানকে জ্বালায়,
— দেখেছেন অবস্থা?এসপি তো পুরাই ব্রেইন ওয়াশ করে দিয়েছে। ও কারো কথা শুনছে না।
রাফসান উঠে দাঁড়ায়। সিনথিয়ার দিকে তাকিয়ে বলে,
— অনেক হয়েছে চল রুমে, চল!
সিনথিয়া হাঁটুর ভাজে হাত শক্ত করে জড়িয়ে বসে। রাফসান তাড়া দেয়।
–ওঠ!
সিনথিয়া ওঠে না। দেয়ালের ওপারের মানুষটা কি কিছুই শুনছে না। উত্তাল সমুদ্র। বাইরে শা শা বাতাসের শব্দ। তেড়ে আসা ঢেউ এর গর্জন। গমগমে অবস্থা। তাই বলে কি কোনো কথাই রুমের ভেতরে যাচ্ছে না। সিনথিয়ার মন খারাপ হয়। সে এখান থেকে যেতে চায় না।রাফসান হাত ধরে। সিনথিয়া টান দিয়ে নিজের হাত ছুটিয়ে নেয়। রাফসান রেগে যাচ্ছে। তবুও সিনথিয়া কথা শোনে না। ঠিক তখন-ই রাফি বলে,
— ভাই আমার একটা কথা আছে। আপনার কথায় উঠবস করেছি। দীর্ঘ এই যাত্রায় যখন যে প্রয়োজন পড়েছে সব করেছি। সিনথিয়ার অবস্থা দেখুন। ও পুরাই অপজিটে। এভাবে থাকলে ও যেকোনো মূহুর্তে যেকোনো কিছু করে বসবে। এসপি সেই ভাবে আগেই ব্রেইন ওয়াশ করে রেখেছে। আমার শর্ত ছিলো- সিনথিয়াকে বিয়ে করতে চাই। আপনি আজ রাতেই বিয়ের ব্যবস্থা করুন।
রাফির বলা কথা শুনে মেঝেতে নিবদ্ধ থাকা চোখ সাথে সাথে উপরে উঠে যায়। একবার রাফসানের দিকে একবার রাফির দিকে তাকায় সিনথিয়া। রাফসানের মতামত বোঝার চেষ্টা করে। মন টা ভেতর থেকে কু ডাক দেয়। দুই ভাইকে রক্ষা করতে গিয়ে তাকে না “বলি” হতে হয় এখন।ইরফাদকে সে পাক বা না পাক। তাতে তার দুঃখ নেই। তবে রাফিকে সে কিছুতেই মানতে পারবে না। রাফসানের মুখ দেখে কিচ্ছু বোঝা যাচ্ছেনা। স্বার্থ সিদ্ধির জন্য তাকে কি রাফির হাতে তুলে দিবে এখন? একজন সাইকো- যে বউ বাচ্চার কথা ভাবেনি। যার হৃদয় নেই। সে কি বোনের চিন্তা করবে? চিন্তায় গলা শুকিয়ে আসে। এই এমন একটা জায়গায় সে বন্দি।এসপি নিজেও বন্দি। রাফসান যদি রাজি থাকে। তাহলে নিজেকে কি করে রক্ষা করবে সে। আচ্ছা সিনেমার মতো যদি তাকে ফোর্স করে! এসপিকে সে ভালোবাসে রাফসান,রাফি দুজনেই জানে। এসপি তো তার হৃদয়ের দূর্বলতা। রাফসান মুগ্ধ”র ক্ষতি করতে চেয়ে তার সকল শক্তি কেড়ে নিয়েছে। এখন যদি ইরফাদকে মারতে চেয়ে রাফিকে বিয়ে করতে বলে! বুকের মধ্যে ভয় গুলো কুয়াশার মতো ধোঁয়া ছাড়ে। হাত পায়ের তালুতে শক্তি ফুরিয়ে আসার আভাস দেয়। এতো দূর্বল কেনো লাগছে। সিনথিয়া দরজায় মাথা ঠেকায়।
রুমে বিছানায় বসে আছে জাবির। মেঝেতে দরজায় মাথা ঠেকিয়ে বসে আছে ইরফাদ। একহাটুর ভাজের উপর হাত ঠেকিয়ে আছে ইরফাদ। সব কথাই শুনতে পাচ্ছে। জাবির ইশারা করছে বারবার।” স্যার এখন কিছু বলুন।” ইরফাদ হাঁটুর ভাঁজ থেকে হাত উঠিয়ে আঙুল ছোঁয়ায় ওষ্ঠের মাঝখানে। যার অর্থ “এখন না।”
সিনথিয়ার প্রতিবাদী মনটা ক্রমশ দূর্বল হয়ে যায়। কি হবে এর পর? সত্যিই সে এমন বিপদের কথা জানতো না। ভাবেও নি। সে তো নিজের ভাই আছে বলে আরও সাহস পাচ্ছিলো। কিন্তু রাফসান কি আদও ভাইয়ের দায়িত্ব পালন করবে। রাফসান আরেকবার বলে,
— সিনথি উঠে আয় বলছি!
সিনথিয়া ভয় পেয়ে যায়। কেনো যেনো উঠতে ইচ্ছে করছে না। রুমে বন্দি রেখে যদি রাফির সাথে বিয়ে দিতে চায় ? যদি ব্ল্যাকমেইল করে। যদি বলে– বিয়ে না করলে এসপিকে মেরে ফেলবে? তখন কি করবে সে? সিনথিয়া ওঠে না। রাফি বলে,
–ভাই! ওর যে অবস্থা– আমি আর রিস্ক নিতে চাই না। আমাকে আপনার দরকার কি না? আপনার এই কাজ যতোদিন আছে আমি আপনার গোলাম হয়ে থাকবো। শুধু আজ বিয়েটা দিন।
রাফসান কোনো কথা বলে না। নিরবে সিনথিয়ার হাত ধরে আবার। সিনথিয়া ছাড়ানোর চেষ্টা করে। অশ্বনীসংকেত যেনো ঘন্টা বাজিয়ে যায়। সিনথিয়ার ভয় লাগে। সামনের দু”টো মানুষকেই অসহনীয় লাগছে। সিনথিয়া কাঁপা গলায় বলে,
— ভাইয়া একটা প্রতারকের হাতে তুমি আমাকে তুলে দিবে?
রাফসান নিরব। চোখ মুখ শক্ত। শক্ত চোয়াল গালে ফুটে উঠছে। সিনথিয়া ওঠে না। ভিষণ ভয় লাগছে। যেনো উঠলেই সব শেষ। মনটা চাচ্ছে দরজায় কড়া নাড়তে। আর গলা ফাঁটিয়ে বলতে-” স্যার আপনি কি আমাকে সেইভ করবেননা! আপনি কি শুনতে পাচ্ছেন না? একটা নিরাপদ জায়গা আমার ভিষণ দরকার ভিষণ….. আমি ভয় পাচ্ছি..খুউউব। আপনাকে হারানোর ভয় পাচ্ছি। নিজেকে হারানোর ভয় পাচ্ছি। শুনতে পাচ্ছেন?” ঠিক তখন ই দরজায় মৃদু ধাক্কা লাগে। যেনো তার পিঠ ঘেষে একটা পিঠ ভরসা হয়ে ঠেকলো। কেও যেনো পিঠে পিঠ আর মাথায় মাথা ঠেকিয়ে বলছে– “ভয় পাচ্ছো কেনো পাগলি! আমি আছি তো।”মনের গহীনে চিৎকার দিয়ে বলা কথাগুলো কি সত্যিই ইরফাদের মন পর্যন্ত পৌছালো। তাই যদি না হয় কেনো মনে হচ্ছে — ওপাশে কেউ তাকে ঘেঁষে বসলো। তাকে ভরসা দিলো। সত্যিই কি ইরফাদ তাকে শেলটার দিচ্ছে? সিনথিয়া মন ব্যকুল হয়ে যায়। খুব করে জানতে ইচ্ছে করে একবার বলতে– আপনি কি সত্যিই ভরসা দিচ্ছেন স্যার। ঠিক তখন-ই দরজায় আরেকটু জোরে পিঠে লাগে। পরপর আরও একবার লাগে। সিনথিয়া এইবার নিশ্চিত হয়ে যায়। তারমানে ইরফাদ আছে। মেঘের মতো কালো হয়ে আসা মুখটা হঠাৎ করেই আলো ঝলমল করে ওঠে। চোখ বন্ধ করে সিনথিয়া। সস্তির একটা শ্বাস টানে। সেই শ্বাসে যেনো মিশে যায় ঝড়া বকুলের গন্ধ আর শীতল বাতাস। আহ! ভালোবাসা সত্যিই সুন্দর।
কিছু দিন পর……..
রাফসান দাঁড়িয়ে আছে কেবিনে। কানে ফোন। অজ্ঞাত ব্যক্তির সাথে চলছে কথোপকথন,
— জ্বি স্যার! কোনো প্রবলেম হয়নি স্যার। এসপি এখনো নিরব!
— ঐটাই তো ভয়! নিরবতা ঝড়ের লক্ষণ!
— টেনশন করবেন না স্যার! এদিকে সব ঠিক আছে। বাংলাদেশ ক্রিকেট টিম সেমি ফাইনালেও উইন । ফাইনাল খেলা শেষ না অবধি এসপির মাইন্ড শুধু রাফসানের দিকেই থাকবে। সে আঁচও করতে পারবে না কি হচ্ছে। ঐদিকে সব ব্যবস্থা করা আছে। আপনি শুধু বাকিটা দেখবেন….
— এখানে সব নরমাল। এসপির মাইন্ড ডায়ভার্ট কেসের দিকে। পুলিশ ডিপার্টমেন্টের মাইন্ড ডায়ভার্ট এসপিকে ফাইন্ডআউট করার দিকে। দেশের মানুষ, প্রেস মিডিয়াও ঠান্ডা এসপি মিশনে গেছে এই জেনে। এমন নিরব পরিবেশ ই তো প্রয়োজন ছিলো। অনেক দিন পর শান্তি লাগছে।এই জন্যেই তো এতো ড্রামা। সকল কনসার্টে এ্যপস এর প্রমোশন হয়ে গেছে। গত কয়েকদিন হলো অনলাইন প্রমোশন প্রায় শেষ। ক্রিকেটারদের বউ বাচ্চা জিম্মি। সব হাতের মুঠোয়। খেলা তো হবে এখন আমাদের রুলসে। একবার জিততে পারলেই দেশের ক্রিকেটের সুনাম নষ্ট আর আমাদের হবে টাকা…
–টাকাই তো জীবনের সব স্যার।
— হোয়াটএভার রাফসান….. আমরা সাকসেস হলেও তো দেশে ক্রাইম বাড়বে। টাকা পয়সা হারালে কি আর মাথা ঠিক থাকে! এসপিকে ছাড়লে আমাকে ঠিকই খুঁজে বের করবে….
— এত সহজে কি আর এসপিকে ছাড়বো! বাংলাদেশের খেলা শেষ হলেও ওর সাথে আমার খেলা তো বাকি। অনেক হিসেব বাকি…..
রাফির বন্ধ চোখে সিনথিয়ার মুখটা বারবার ভেসে ওঠে। এইখানে এসপি স্বয়ং উপস্থিত। সিনথিয়াও বিগড়ে গেছে। যেকোনো সময় হাতছাড়া হতে পারে। তার আগেই কোনো একটা ব্যবস্থা করতেই হবে। হারানোর পর আর কোনো ভাবেই নিজের করে পাওয়া যাবে না। তাই যে করেই হোক! আজকের মধ্যেই বিয়ের ব্যবস্থা করতে হবে আর আজকে মানে আজ কেই। ভেবেই রাফসানের কেবিনে যায় রাফি। তারপর বলে,
— আমি আজকেই বিয়ে করতে চাই।
রাফসান পিছু ফেরে। রাফির দিকে তাকায়। তারপর বলে,
— না করলো কে? কর….
— বিয়ের ব্যবস্থা করুন।এই অজানা দেশে আপনি ব্যবস্থা না করে দিলে কিভাবে করবো?
— যাহ মেয়ে খুঁজে বের কর। যারে চাস আমি সুপারিশ করবো…
— যাকে চাই মানে?? আমি সিনথিয়াকে বিয়ে করবো। এইটাই তো শর্ত!
— ও বাদ দিয়ে যাকে খুশি বিয়ে কর…যত টাকা লাগে দিবো যাহ..
— ভাই! আপনি কিন্তু এখন মত পাল্টাচ্ছেন। সিনথিয়ার জন্যেই আমি আপনার সব কাজ করেছি। সব….
— তো?
— সিনথিয়াকে বিয়ে করতে চাই..
— বোন আমার ওতো সস্তা! যার তার সাথে বোন বিয়ে দিবো??
— কথা তো এমন ছিলো না–
— আমি কি কথা দিয়েছিলাম? তোর সাথে বোন বিয়ে দিবো! আর যদি দিয়েও থাকি সেই কথার দাম আছে? বোনকে একটু কাজে লাগিয়েছি। কষ্ট দিয়েছি- দ্যাটস মিন এই নয় বোন যার তার হাতে তুলে দিবো। ও আমার কাছে থাকবে।
রেগে যায় রাফি। ক্রুদ্ধ গলায় বলে,
— কথা তো এমন ছিলো না। আপনি যা বলেছেন শুনছি। এই এপস গুলো ইজি করে আমি আপনাকে তৈরী করে দিয়েছি। এমনকি এজেন্ট নেওয়ার ব্যবস্থাও করেছি। এখন আপনি আমার থেকে মুখ ফিরিয়ে নিতে পারেন না।
— ওয়েট ওয়েট! তুই কি মনে করিস আমি বোকা? তোকে স্টাডি না করে তোকে প্যাচে ফেলেছি। আরে সিনথিয়া যেদিন বলেছে তোর কথা– দুইদিনের মধ্যে তোর অল ডিটেলস নিয়েছি। তুই তো আগেও গেমিং এ্যপস সেল করেছিস।এই জন্যে তোকে তোর জব থেকে বাদ দিয়েছিলো। তারপর কিসে কিসে ধরা খেয়ে মোটা অংকের ঋণ হয়েছিস। আমি ঋণ থেকে মুক্তির জন্যে টাকা দিবো। এ্যপস ক্রিয়েট করার জন্যেও মোটা অংকের টাকা দিবো। আগেও সেল করেছিস এখনো করবি। হিসেব বরাবর। বোন দিবো একবারো বলেছি?
রাফি বাঁকা হাসে। তারপর বলে,
রং পর্ব ৩৭
— এ্যপস যখন বানাতে পেরেছি। ধ্বংসও করতে পারবো। এই এ্যাপস অল বাংলাদেশ ছড়িয়ে গেছে। এই মূহুর্তে আপনি ভাবুন কি করবেন! বোন দিবেন…. নাকি…???
রাফসান তেড়ে আসে। কলার চেপে ধরে রাফির। তারপর চেঁচিয়ে বলে,
— স্ক্রাউনড্রেল।
–আমি নই আপনি। সারাদিন টাইম দিলাম। বোনকে সুন্দর করে সাজাবেন। যেনো চোখ না ফেরানো যায়। বিয়ে আজই করবো…আসছি…..