তোমাতেই আসক্ত পর্ব ৩৫
তানিশা সুলতানা
মা হয় মমতাময়ী। পৃথিবীর সকল মা তার বাচ্চার জন্য জীবন উৎসর্গ করতে প্রস্তুত। বাচ্চার ভালোর জন্য তারা বিনা বাক্যে বিষ পান করে নিতে পারবে।
খুব কম সংখ্যক মা রয়েছে যাদের বাচ্চার প্রতি টান কম। বাচ্চার ভালো খারাপে কিছু এসে যায় না।
আতিয়া বেগম কি ঠিক সেই কোয়ালিটির মা?
ছেলে মেয়ের ভালো খারাপে তার কি হৃদয় কাঁপে না?
কলিজা ছটফট করে না?
হয়ত তাই। নয়ত টিকিট ক্যান্সেল করে দেওয়ার পরেও ফের নতুন টিকিট কেনো কিনবে?
কেনো চলে যাওয়ার এতো তাড়া?
আবরার আকুল স্বরে নিজের ভালোবাসার বার্তা জানান দেওয়ার পরেও কেনো এতো ছলনা করছে মা?
মাঝ রাস্তায় গাড়ি থামিয়ে দেয় আবরার। আজকে বেশ শীত পড়েছে। সেই সাথে কুয়াশা নেমেছে গোটা শহর জুড়ে। দূরের বস্তুর দেখা মেলা ভার। বিশাল আকৃতির গাছ গুলো কুয়াশার চাদরে মুরে রয়েছে। যেনো মা তার সন্তানকে সূর্যের আলো হতে রক্ষা করার প্রস্তুতি নিয়েছে। রাস্তার দুই পাশে দুটো বাড়ি রয়েছে। একটা অহনার এবং অপর পাশেরটা জানা নেই।
অহনা বেলকনিতে পায়চারি করছে বাচ্চা নিয়ে। হয়ত কান্না থামানোর চেষ্টা করছে বা ঘুম পাড়ানোর চেষ্টা চালাচ্ছে।
আহাদ, ইভান, আমান, সিয়াম সকলেই গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন। একজনের ওপর আরেকজন হাত পা ছড়িয়ে ছিটিয়ে ঘুমচ্ছে। সিয়ামের মাথা আবরারের কাঁধে।
বিরক্ত হয় না আবরার। বরং তার অভ্যাস রয়েছে৷
সিঙ্গাপুরের প্রজেক্ট একাই হ্যান্ডেল করতে চেয়েছিলো সে। কাঠ কাঠ স্বরে বলেছিলো “আই উইল ম্যানেজ। তোদের যেতে হবে না”
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
তখুনি বদের হাড্ডি চারটাই আবরারের পা জড়িয়ে ধরে। যাবে মানে যাবেই জেদ ধরে বসে।
অগত্যা তাদের নিয়েই পাড়ি জমাতে হচ্ছে সিঙ্গাপুর।
অহনাদের বাড়ির বন্ধ গেইটের পানে বেশ কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকে আবরার। মন বলছে গাড়ি থেকে নেমে অহনার কাছে যেতে। অনুন্নয়ের স্বরে বলতে
“বোনু প্লিজজজ আম্মুকে বল আদ্রিকে নিয়ে যেনো চলে না যায়৷ আমি ওকে ছাড়া থাকতে পারবো না। এখানে ফিরে যেনো আদ্রিকে দেখতে পাই।”
তবে নিজের গম্ভীর ব্যক্তিত্ব ধরে রাখতে গাড়ি হতে নামে না। ছুঁটে যায় না অহনার নিকট। বরং দক্ষ হাতে স্টারিং ঘুরিয়ে চলে যায় এয়ারপোর্টের উদ্দেশ্যে।
বিরবির করে আওড়ায়
“আদ্রিতা প্লিজজজ চলে যেয়ো না। আই নিড ইউ ব্যাডলি।
প্লিজজ জান।
লাগেজে নিজের প্রয়োজনীয় সকল জামাকাপড় ঢুকিয়ে সেই লাগেজের ওপরেই বসে আছে আদ্রিতা। মনটা বেশ খারাপ। একটু আগেই মা এসে জানালো সন্ধ্যা ছয়টার ফ্লাইটে বাংলাদেশে যাচ্ছে তারা। জামাকাপড় যেনো গুছিয়ে রাখে।
কৌতুহলী আদ্রিতা মাকে জিজ্ঞেস করেছিলো “কেনো মা? আবরার তাসনিন তো থেকে যেতে বললো”
তখনই আতিয়া গম্ভীর স্বরে জবাব দেয়
“দুর্বল হয়ে পড়েছো আদ্রিতা? অথচ তুমি ভুলে গিয়েছো আবরার তাসনিন তোমাকে অস্বীকার করে ফেলে রেখে এসেছিলো”
আদ্রিতা ভুলে গিয়েছে সত্যিই। তার মনে নেই কিছু। মনে করার চেষ্টাও করে নি। শুধু এই টুকু বুঝতে পারছে “এখান থেকে যাওয়া ঠিক হবে না। তার বেহায়া মনটা বারংবার বলছে
” আদ্রি তুই যাসস না। থেকে যা নির্দয় পাষাণ পুরুষটির নিকটে”
তখনই টুংটাং করে বেজে ওঠে আদ্রিতার ফোন খানা। উহু কল আসে নি। এসেছে মেসেজ।
আদ্রিতা চটজলদি লাগেজের ওপর থেকে নেমে পড়ে। টি টেবিলের ওপরে থাকা ফোন খানা হাতে তুলে হোয়াটসঅ্যাপ এ ঢুকে।
আননন নাম্বার থেকে একটা ৮ মিনিটের ভিডিও এসেছে।
কাঁপা-কাঁপি হাতে ভিডিও খানা প্লে করে আদ্রিতা। আর দেখতে পায় তার আর আবরারের ঘনিষ্ঠ মুহুর্ত।
এই তো এই বিছানায় আবরারের সঙ্গে লেপ্টে রয়েছে সে। অধরে অধর মিলিত দুজনার। আবরারের হাত খানার পানে নজর পড়তেই চোখ দুটো বন্ধ করে ফেলে আদ্রিতা।
এটা তো গতকাল রাতের দৃশ্য।
গলা শুকিয়ে আসে। হাত পায়ের কাঁপন একটু বেড়েছে নিশ্চয়।
তল পেট মোচর দিয়ে উঠছে। এটা খুধার জন্য নয়। বরং গত কাল রাতের সেই ঘটনা অনুভব করছে বলে।
আবরার তাসনিন বড়ই বেহায়া এবং উম্মাদ।
হবে না?
সর্বক্ষণ উম্মাদনায় ভরপুর ডার্ক রোমান্টিক মুভি দেখে কি না।
সেইসব হিরোদের মতোই তো হচ্ছে।
আদ্রিতার ভাবনার মাঝেই এক খানা মেসেজ আসে একই নাম্বার থেকে
“এটা দেখে একদিন কাটিয়ে দিবো। কালকে ড্রেস ছাড়া হট পিক দিও সেটা দেখে কালকের দিন কাটিয়ে দিবো। এন্ড পৌরসু তোমার জামার মধ্যে মুখ ঢুকিয়ে ঘুমাবো।
ওকেহহহ জান?
আর আর আর
যদি পৌরসু বাড়ি ফিরে তোমায় না দেখতে পাই।
পা কে/টে হাতে ধরিয়ে দিবো। মাইন্ড ইট।
আদ্রিতা চার পাঁচ বার মেসেজ খানা পড়ে এবং বিরবির করে বলে
“আবরার তাসনিন কবে জানি আপনার বেপরোয়া রোমাঞ্চের কবলে পড়ে জানটাই উড়ে যাবে আমার।
তারপর শেষের লেখা টুকু মনে পড়তেই কলিজা কেঁপে ওঠে। তখনই আতিয়া বেগম চলে আসে কক্ষে। ব্যস্ত পায়ে পায়চারি করতে করতে বলে
“আদ্রিতা দ্রুত করো।
বেরবো আমরা।
চমকায় আদ্রিতা। হাতে থাকা ফোনের সাইড বাটড চেপে বন্ধ করে ফেলে। এবং বলে
” আ…..আমি রেডি। চলো
আতিয়া ছোট ছোট নয়নে তাকায় আদ্রিতার পানে। চমকানো আদল খানা ভালো করে পর্যবেক্ষণ করে বলে
“আবরারের সাথে কন্ট্রাক্ট করিও না। সে যেনো নতুন হোয়াটসঅ্যাপ এর খবর না জানতে পারে।
আদ্রিতা ঠোঁট উল্টায়৷ মনে মনে বলে
” অলরেডি জেনে গেছে মা।
আরিফ নিজে এসেছে আদ্রিতা এবং আতিয়াকে নিতে। এয়ারপোর্টে এসে সেটা দেখতে পেলো আদ্রিতা। ওই তো কালো রংয়ের শুট বুট পড়ে দাঁড়িয়ে আছে পার্কিং এরিয়ায়। বয়স বেড়েছে তবে বোঝার উপায় নেই। এখনো আগের মতোই হ্যান্ডসাম। শেষবার যখন দেখেছিলো তখনও ঠিক এমনই ছিলো দেখতে।
আতিয়া মুচকি হাসে। নিজের লাগেজ এর হাতল টেনে বড় বড় পা ফেলে এগিয়ে যায় আরিফ এর নিকট। আরিফ ভীষণ যত্ন সহকারে আতিয়ার ডান হাত খানা মুঠোয় পুরে নেয়।
“এতো লেট হলো যে?
” আদ্রিতা লেট করিয়ে দিলো।
তারপর বলো ফ্লাইট কখন আমাদের?
আরিফ হাত ঘড়িতে নজর বুলিয়ে বলে
“এই আর আধ ঘন্টা।
তুমি আমার কথা শুনে চলে আসবে ভাবতে পারি নি আমি।
আতিয়ার হাসি মুখ খানা কালো হয়ে যায়। মাথা নত করে বলে
” আমার ছেলেটা থাকতে বলেছিলো। চলে এসে বোধহয় ভুল করলাম।
“কোনো ভুল করো নি তুমি। তোমার ছেলে থাকলে কখনোই আসতে পারতে না।
তাই তো আমিই প্ল্যানিং করে তাকে সিঙ্গাপুর নিয়ে গিয়েছি।
বলেই উচ্চস্বরে হাসে আরিফ। তবে আতিয়ার হাসি পায় না। বরং ছোট ছোট নয়নে আরিফ এর পানে তাকিয়ে থাকে।।
আজকে আবরার বাসা থেকে বের হয়ে যাওয়ার পরে আরিফ কল করে আতিয়াকে।
কেঁদে কেঁটে বলে
” আমি আর এভাবে বাঁচতে পারছি না আতিয়া। একটু রিলাক্স চাই।
শান্তি চাই।
তাই ভেবেছি আদ্রিতাকে নিয়ে বাংলাদেশে থাকবো। আমার পুরোনো বাড়িতে মেয়েকে নিয়ে শান্তিতে বসবাস করবো। তুমি প্লিজজ আদ্রিতাকে ফিরিয়ে দাও।
আতিয়া তখন চিন্তায় পড়ে গিয়েছিলো। কখনোই আরিফকে দুর্বল হতে দেখে নি সে। আজকে তবে এতো দুর্বল কেনো হলো?
এক কোণায় দাঁড়িয়ে আদ্রিতা দেখছিলো নিজের বাবাকে। অপেক্ষা করছিলো কখন তার পানে তাকাবে আর দুই হাত মেলে দিয়ে ডাকবে। বলবে “মামনি বাবার কাছে এসো”
কিন্তু বাবার আর সময় কোথায় আদ্রিতার পানে তাকানোর?
হঠাৎ একটা গাড়ি এসে থামে আদ্রিতার সামনে এবং সঙ্গে সঙ্গে দরজা খুলে যায়। একটা শক্তপোক্ত হাত আদ্রিতার কোমর জড়িয়ে ধরে। শূন্যে তুলে গাড়িতে বসিয়ে দেয়।
তোমাতেই আসক্ত পর্ব ৩৪
চিৎকার করারও সময় পায় না আদ্রিতা। কিছু বুঝে উঠতেও পারে না। শুধু শুনতে পায়
“আবরার তাসনিন এর কলিজায় আগুন জ্বালিয়ে পালিয়ে যাওয়া হচ্ছে?
বলেছিলাম না কলিজা ঠান্ডা না হওয়া ওবদি তোর মুক্তি নেই?