মনে রেখ এ আমারে পর্ব ২
রায়েনা হায়াত
মাগরিবের আজান পরছে চারদিকে৷ অন্ধকার হয়ে আসছে। অন্তি দ্রুতহাতে ঔষধের প্যাকেট নিয়ে অস্থির পায়ে হাঁটা লাগায়। তাইমুর কি তাদের বাসায় এসেছে? আসলেও হঠাৎ কেনো? মাথার মধ্যে অনেকগুলো প্রশ্ন নিয়েই নিজেদের ফ্ল্যাটের সামনে এসে দাঁড়ায় অন্তি। বড় বড় শ্বাস নিয়ে নিজেকে স্বাভাবিক করে বেল বাজায়। দরজা তার মা-ই খুলে দেয়। অন্তি ঔষধের প্যাকেট মায়ের দিকে এগিয়ে দিয়ে বলে,
–‘সব আছে এখানে।’
রেহেনা বেগম ঔষধ নিতে নিতে বেশ খোশ মেজাজে বলেন,
–‘তাইমুর আর ওর মা এসেছে, অন্তি।’
রেহেনা বেগম না বললেও অন্তি জানতো। সামনেই সোফায় আনোয়ার সাহেব, তাইমুর আর তার পাশে একজন ভদ্র মহিলা বসে আছেন। তাইমুরের মা-কে কখনোই অন্তি দেখেননি তাই উনাকে সে চিনতেও পারেনি। অন্তি জিভ দিয়ে ঠোঁট ভিজিয়ে এগিয়ে গিয়ে সালাম দেয়। তাইমুরের মা একবার তার দিকে আর একবার নিজের ছেলের দিকে তাকান। যত্ন করে পাশে বসতেও বলেন। তবে অন্তি বসে না। আনোয়ার সাহেব বলেন,
–‘তুই তো কখনো ভাবীকে দেখিসনি। তাইমুর এসেছিলো তাও সেই কত বছর আগে! বস, মা!’
অন্তি তাইমুরের দিকে তাকায়। তার দৃষ্টি অন্যদিকে। সে এখনো অন্তির দিকে তাকায়ওনি। অন্তিরও অস্বস্তি হয়। তাই হাসার চেষ্টা করে বলে,
–‘আমি আম্মুকে সাহায্য করে আসতেছি।’
বলেই চলে যায়। রান্নাঘরে রেহেনা বেগম কাজ করছিলেন। অন্তি রান্নাঘর থেকেই একবার বাহিরে উঁকি দেয়। মা’কে শুধায়,
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
–‘উনারা হঠাৎ কেনো এসেছেন, আম্মু? তোমরা জানতে উনারা আসবে?’
–‘না। হঠাৎ করেই এসেছে। তুই যখন ছোট ছিলি তখন ভাবীরা আমাদের প্রতিবেশী ছিলেন। এরপর আমরাও এখানে চলে আসছি আর উনারাও সিলেটে চলে গেছিলেন। এতোদিন পর হঠাৎ চলে আসছে।’
অন্তি ছোট্ট করে শুধু ‘হু’ বলে। রান্নাঘর থেকেই সামান্য উঁকি দিয়ে দেখে তাইমুরের মুখ গম্ভীর। আনোয়ার সাহেব কথা বলছেন তাইমুরের মা তহুরা বেগমের সাথে। তহুরা বেগম আশেপাশে তাকিয়ে বলেন,
–‘অবনী কোথায়? ওকে তো দেখছি না!’
আনোয়ার সাহেব হেঁসে বলেন,
–‘ওর বিয়ে দিয়েছি ১৫ দিন হলো। আমি হায়দারকে অনেকবার কল করেছিলাম কিন্তু কল যায়নি। আর তাইমুরের সাথেও যোগাযোগ বন্ধ হয়ে গেছিলো সেই ৫ বছর আগেই। তাই আপনাদের জানাতে পারিনি।’
–‘আগের সিমটা হারিয়ে গেছে, ভাই সাহেব। আর তাইমুরও দেশে ছিলো না এতোদিন। ১ সপ্তাহ হলে এসেছে৷ এখানের একটা হসপিটালেই আছে ‘ও’। পাশের বিল্ডিং এই থাকবে। এখানে আসার পর ও-ই বললো আপনারা এখানে তাই ভাবলাম দেখা করে যাই।’
–‘ভালো কাজ করেছেন, ভাবী। হায়দারকেও আনতেন!’
–‘যেহেতু জেনেই গেলাম আপনারা এখানে থাকছেন তাহলে অবশ্যই ক’দিনের মধ্যেই আসবো আপনার ভাইকে নিয়ে।’
আনোয়ার সাহেব তৃপ্তির হাসি হাসেন। অনেক দিন দুই বন্ধুর সামনাসামনি আলাপ নেই। সেই যে দুজন দু শহরে চলে গেছে সেখান থেকেই আর তাদের মাঝে দেখা সাক্ষাৎ নেই। শুধু মাঝখানে একবার তাইমুর এসেছিলো বাসায়। রেহেনা বেগম নাস্তা নিয়ে আসে। পেছন পেছন অন্তিও এসেছে। তহুরা বেগম তাকে পাশে ডাকেন। অন্তি বাধ্য মেয়ের মতো তার পাশে গিয়ে বসে। তহুরা বেগম আঁড়চোখে ছেলের দিকে তাকান। ছেলের কোনো ভাবান্তর তার নজরে আসে না। বরং সে আনোয়ার সাহেবের সাথে গল্প জুড়েছে। তহুরা বেগম অন্তির থুতনিতে হাত দিয়ে বলেন,
–‘তোমাকে শেষ দেখেছিলাম অনেকদিন আগে। তখন তুমি হয়তো ৭-৮ এ পড়ো। এতো বড় হয়ে গেছো যে চিনতেই পারিনি।’
অন্তি হাসার চেষ্টা করে। তহুরা বেগম রেহেনা বেগমের সাথে গল্প শুরু করেন। কিছু সময় পর বলেন,
–‘আচ্ছা ভাই! তাহলে আমি উঠি। ক’দিন পর আপনার ভাইকে নিয়েই আসবো ইন শাহ আল্লাহ।’
–‘যাবেন মানে কি, ভাবী? আজ থেকে কাল যাবেন।’
–‘না না, ভাবী। আপনার ভাই বাসায় একা। আমি বরং আবার আসবো।’
–‘অন্তত রাতের খাবারটা খেয়ে যান!’
তহুরা বেগম বারণ করেন। অন্তিও থাকতে বলে। তহুরা বেগম বুঝিয়ে বিদায় নেন। আনোয়ার সাহেব তাইমুরের হাত ধরে বলেন,
–‘ভাবী চলে গেলেও তোমাকে কিন্তু ছাড়ছি না, তাইমুর। আজ রাতের খাবার কিন্তু এখানেই খেতে হবে!’
তাইমুর খুবই শান্ত ভাবে বলে,
–‘জ্বি, আমি খেয়ে যাবো। আম্মুকে এগিয়ে দিয়ে আসছি, আঙ্কেল।’
তহুরা বেগমকে নিয়ে তাইমুর বেড়িয়ে যায়। একবারও পিছে ফিরে তাকায় না সে। এই পর্যন্ত একবারও সে অন্তির দিকে তাকায়নি। অন্তি তা নিয়ে ভাবেও না। তহুরা বেগম যাওয়ার আগে বেশ কয়েকবার অন্তির দিকে তাকিয়েছে। অন্তি খেয়াল করলেও কারণ বোঝেনি। তারা বেড়িয়ে যেতেই রেহেনা বেগম রান্নাঘরে চলে যান। অন্তি নিজের ঘরে গিয়ে ব্যালকনিতে দাঁড়ায়। তাইমুর আর তহুরা বেগম বিল্ডিং এর বাইরে গিয়ে তহুরা বেগমকে একটা গাড়িতে তুলে দেয়। কিছু কথাও বলে। অন্তি তখনও সেখানে দাঁড়িয়ে। ৫ বছর আগের তাইমুর আর এখনের তাইমুরের মাঝে আকাশ পাতাল তফাৎ। আগে তাইমুর ছিলো চঞ্চল, দুষ্টু, দূরন্ত আর হাসিখুশি একজন। কিন্তু আজকের তাইমুরের মাঝে তেমন কিছুই নেই। শুধু গাম্ভীর্য পুরো মুখ জুড়ে। আজকের তাইমুরকে দেখে অন্তির সত্যিই মনে হলো ‘তাইমুর আহসান’। অন্তির আগ্রহ হয়। কেনো তাইমুর হঠাৎ হারিয়ে গেছিলো এবং কেনোই বা হঠাৎ সামনে আসলো! অন্তির ভাবনার মাঝেই তাইমুর ফিরে তাকায়। দুর থেকেও দুজন দুজনের দিকে তাকানোই অন্তি অস্বস্তিতে চোখ সরিয়ে দু পা পিছিয়ে দাঁড়ায়। তাইমুরের চোখ মুখ শক্ত হয়ে যায়। অন্তি সেখান থেকেও দেখে তাইমুর চোখ সরিয়ে নিছে। তার চোয়াল দেখে বোঝা যায় সে রেগে আছে। কিন্তু কেনো?
রাত প্রায় ১১ টা বাজে। চারদিকে শুনশান নীরবতা। অবনীর শাশুড়ি আর ননদ দুজনেই যার যার ঘরে। হৃদান এখনো বাহিরেই আছে। বাসায় আসেনি। অবনী সারাদিন কাজের পর ক্লান্ত হয়ে আছে। ঘুমানোর জন্য চোখ দুটো রীতিমতো বার বার বন্ধ হয়ে আসছে। তবুও না খেয়ে জেগে বসে আছে হৃদানের জন্য। অবনী একবার ঘড়ির কাঁটার দিকে তাকিয়ে ঘরে যায় ফোন নিতে। এর মাঝেই বাইকের হর্ণের শব্দ পায়। ছুটে ব্যালকনিতে গিয়ে দেখে নিচে হৃদান। অবনী স্বস্তির শ্বাস ফেলে লিভিং রুমে যায়। মিনিট কয়েক বাদেই হৃদান নিজেই চাবি দিয়ে দরজা খোলে। তবে ঘরের আলো তখনও জ্বলছে দেখে অবাক হয়। সে ভেবেছিলো অবনী ঘুমিয়ে পরেছে হয়তো। ডাইনিং এর দিকে তাকিয়ে দেখে সেখানে অবনী দাঁড়িয়ে আছে। হৃদান দরজা লাগাতে লাগাতে বলে,
–‘জেগে আছেন কেনো এতো রাত অব্দি?’
অবনী প্লেট সাজাতে সাজাতে জবাব দেয়,
–‘আপনার জন্যই। খেয়ে এসেছেন কি?’
হৃদান তাকায় অবনীর মুখপানে। ক্লান্ত লাগছে। তবুও তার জন্য রাত জেগে বসে আছে ভেবে খারাপও লাগলো৷ আবার কোথাও একটা ভালো লাগা কাজ করলো। নিজ মনেই সামান্য হেঁসে বলে,
–‘আপনি খেয়েছেন?’
অবনী দুদিকে মাথা নাড়ায়। হৃদান রুমের দিকে যায়। যাওয়ার আগে বলে যায়,
–‘এক প্লেটের খাবার বাড়ুন শুধু। আমি আসছি।’
অবনী কোনো প্রশ্ন করার আগেই হৃদান চলে গেছে। অবনী বোকার মতো সেদিকে তাকিয়ে থাকে। এক প্লেটে কেনো খাবার বাড়বে? সে খাবে না? হৃদানের আসার অপেক্ষা করতে থাকে এবং কথামতো শুধু এক প্লেটেই খাবার পরিবেশন করে। বেশিক্ষণ লাগায়নি হৃদান। শুধু বাইরে পরে থাকা শার্ট পাল্টে টি-শার্ট আর ট্রাউজার পরে নিয়েছে। আর হয়তো হাত মুখ ধুয়ে এসেছে। অবনী প্রশ্নসূচক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে। হৃদান ভ্রু উঁচিয়ে শুধায়,
–‘কী?’
–‘আপনি খাবেন না?’
–খাবো না কেনো? খাবো তো। অনেক ক্ষুধাও লাগছে।’
–‘তাহলে আমি খাবো না?’
অবনীর বোকা প্রশ্নে হৃদান তার দিকে তাকায়। ফিক করে হেঁসে ওঠে। অবনী তখনও তার দিকে বোকার মতো তাকিয়ে আছে। হাসার মতো কি বললো সে বুঝতে পারেনি। হৃদান নিজেই এক হাতে তাকে টেনে পাশের টেবিলে বসিয়ে দেয়। খাবার মাখিয়ে অবনীর মুখের সামনে ধরে বলে,
–‘আমি মোটেও এতো অ’ত্যা’চা’রি নই যে বউকে না খাইয়ে কষ্ট দেবো! বরং আমি তো রোমান্টিক। বউকে নিজ হাতেই খাইয়ে দেবো। সমস্যা আছে, মাই মিসেস?’
অবনী একবার হৃদানের দিকে তাকিয়ে আরেকবার খাবারের দিকে তাকায়। মুখের কাছে থাকা খাবারটুকু সে উপেক্ষা করতে পারে না। চুপচাপ মুখে নিয়ে নেয়। হৃদান একবার অবনীর মুখে তুলে দেয় আর একবার নিজে খায়। অবনী শুধু নিশ্চুপ হয়ে হৃদানের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে। সবকিছু তার কল্পনা মনে হয়। তার কপালে সত্যিই এতো সুখ? এটা কতদিনের? খাওয়া শেষ হলে অবনী প্লেট সরাতে গেলে হৃদান বাঁধা দেয়। নিজেই প্লেট উঠিয়ে বলে,
–‘পানি খেয়ে চুপচাপ রুমে যান। সারাদিন অনেক কাজ করেছেন। আপনার চোখ মুখেই ক্লান্তি বোঝা যাচ্ছে। এটুকু আমি করে নিবো।’
অবনী ব্যস্ত গলায় বলে,
–‘না না। আম্মা দেখলে আবার কি না কি ভাববে! আপনিও তো সারাদিন অফিস করেই ফেরেন। এটুকু করে নিতে সমস্যা হবে না। আপনি যান।’
হৃদান শুনলো না, মানলোও না। অবনীকে চুপ করিয়ে বসিয়ে দিয়ে নিজেই বেসিনে যায়। খাবারগুলো ফ্রিজে রেখে সব গুছিয়ে অবনীর কাছে আসে। অবনী শুধায়,
–‘এগুলোর দরকার ছিলো?’
–‘ছিলো। চলুন!’
অবনী বোঝে হৃদানের সাথে সে পেরে উঠবে না। রুমে এসে দুজনেই শুয়ে পরে। একই ছাঁদের নিচে থাকার পরও দুজনের মনের দূরত্ব অনেক। আর এই দূরত্ব হৃদান নিজেই ধীরে ধীরে দুর করে দিচ্ছে। অবনী নিজেও মনে প্রাণে চাচ্ছে এই দূরত্বটুকু ঘুচে যাক। তার জীবনটা ভরে উঠুক ভালোবাসায়। হৃদান লাইট অফ করে কম্বল টেনে নেয় দুজনের গায়েই। এরপর অবনীকে কাছে টেনে বুকে জড়িয়ে নেয়। অবনীর অস্বস্তি হয় না বরং সে জানে এই প্রশস্ত বক্ষটাই তার সবচেয়ে নিরাপদ জায়গা। তার স্বস্তির জায়গা। চুপচাপ নিজেও মুখ গুজে পরে থাকে। হৃদান হুট করেই বলে ওঠে,
–‘অবনী! ঘুমিয়েছেন?’
–‘উহু।’
হৃদান অন্ধকারেই হাসে। নিজের নাক মুখ গুঁজে দেয় অবনীর চুলের মাঝে। মেয়েটা তার প্রশান্তির জায়গা। এই মেয়েটার মায়াভরা মুখ দেখলেও তার হৃদয়ে প্রশান্তি অনুভব হয়। কখনো এই মেয়ে তাকে ছেড়ে চলে গেলে কি হবে তার? ভাবলেও অজানা আতঙ্কে বুক ভার হয়। পুরুষ মানুষ কিছুতে ভয় পাক বা না পাক! যে নারীতে তারা সুখ খুঁজে পায়, প্রশান্তি পায়! যে নারী আসলেই তাদের শখের হয়! সেই একটা নারীকে হারাতে পুরুষ মানুষ বড্ড ভয় পায়। হৃদান আরেকটু শক্ত করে ধরে অবনীকে। যেভাবে ছিলো সেভাবেই বলে,
–‘কখনো হারিয়ে যাওয়ার আগে, আমাকে নিঃস্ব করে দেওয়ার আগে আপনি আমার প্রাণটুকু সাথে নিয়ে যাবেন। নয়তো আজীবন আমার হয়ে, এভাবেই থাকবেন।’
নিস্তব্ধতায় অবনী শুনলো সবটুকু। সে কোথায় যাবে? কার কাছে যাবে? গেলেও কি কেউ কখনো হৃদান হবে? কেউ কখনো এই হৃদানের মতো করে তাকে ভালোবাসবে? আগলে রাখবে? মায়ায় বাঁধবে? যখন বিয়ে হয়েছিলো তখন এটা কেবলই তার কাছে একটা সংসার ছিলো। কিন্তু ধীরে ধীরে তা ভালোবাসা, মায়া হয়ে উঠছে।
গভীর রাত। তাইমুর আবার এসেছিলো। খেয়ে কিছুক্ষণ আনোয়ার সাহেবের সাথে কথা বলে চলে গেছে। অন্তি খাবার নিয়ে তার রুমে চলে এসেছিলো। সবার সামনে সে খেতে পারে না। এজন্যই রেহেনা বেগম আর আনোয়ার সাহেবও কিছু মনে করেননি। বিছানায় অনেকক্ষণ এদিক ওদিক করেও ঘুম আসে অন্তির। রাত হলেই মানুষকে বিরহগুলো আঁকড়ে ধরে। গুমরে গুমরে বাঁচায়। রাতগুলো বড্ড পীড়াদায়ক হয় কিছু মানুষের কাছে। বর্তমানে অন্তিও এই মানুষগুলোর অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। তন্ময় অন্য কাউকে বিয়ে করবে ভাবলেই তার অদ্ভুত একটা কষ্ট হচ্ছে। নিজেকে সামলানোর চেষ্টা করেও সে পারছে না। বিচ্ছেদ এতো যন্ত্রণার কেনো হয়? অন্তি ঘুমাতে না পেরে বিছানা ছেড়ে উঠে যায়। রুমে ডিম লাইট জ্বলছে। এভাবে রেখেই সে ব্যালকনিতে গিয়ে দাঁড়ায়।
ব্যালকনির মেঝেতে বসে দুর আকাশে তাকিয়ে থাকে। আকাশে অনেক তাঁরা উঠেছে আর তার মাঝে গোল হয়ে বসে আছে চাঁদ। চাঁদের আলোয় সবকিছু আলোকিত মনে হয়। অতীতের সুন্দর দিনগুলোর কথা ভেবে অন্তির চোখ ভিজে আসে। হাউমাউ করে কাঁদতে ইচ্ছে হলেও সে পারে না। ফোন থেকে নিজেদের ছবিগুলো দেখে হাত দিয়ে ছুঁয়ে দিতে থাকে। বুকের বা পাশটায় তিক্ত এক যন্ত্রণা জেঁকে বসেছে। অন্তি মুখে হাত চেপে ডুকরে ওঠে। ১ বছর মানে ৩৬৫ দিন। আর এই ৩৬৫ দিনকে তার ভুলে যেতে হবে। নিজের মানুষ বলে যাকে জানতো তাকে অন্যের হতে দেখতে হবে। অন্তির কান্নার মাঝেই ফোনে ম্যাসেজের টোন হয়। অন্তি ভাবে তন্ময় বোধহয় টেক্সট করেছে তাকে। চোখ দুটো দু’হাতে কোনোমতে মুছে নিয়ে হাসিমুখে ফোন হাতে নিতেই দেখে অপরিচিত নাম্বার থেকে ম্যাসেজ এসেছে। অন্তি তাচ্ছিল্য হেঁসে তা অন করতেই স্ক্রিনে ভেসে দু লাইন,
–‘প্রেমিকের বিরহে এতো রাতে ব্যালকনিতে বসে কাঁদছেন, অন্তিকা মাহজাবিন?’
অন্তি অবাক হয়। কান্না ভুলে ফোন রেখে আশে পাশে তাকায়। পাশের ব্যালকনিতেই তাইমুর দাঁড়িয়ে। এতো ঠান্ডার মাঝেও সে শুধু গায়ে একটা পাতলা শার্ট জড়িয়ে আছে। হাতে সিগারেট। সমানে ফুঁকে যাচ্ছে। যেনো রাগ কমাচ্ছে! অন্তি হা হয়ে তাকিয়ে থাকে। ব্যালকনির গ্রিল ধরে হাঁটু মুড়িয়ে তাইমুরের দিকে তাকিয়ে থাকে। তাইমুরের দৃষ্টিও তার দিকে। অন্তি ফেন হাতে তুলে নিয়ে দ্রুত সেই নাম্বারে কল দেয়। ওপাশ থেকে তাইমুরের ফোন বেজে ওঠে। তাইমুর ফোনের স্ক্রিন অন্তির দিকে করে দেখায়। অন্তি শিউর হয় এটা তাইমুরের নাম্বার। কিন্তু তাইমুর তার নাম্বার কোথায় পেলো? আর প্রেমিক? বিরহ? সে-সবই বা সে কিভাবে জানলো? দুটো বিল্ডিং পাশাপাশি অবস্থানে থাকায় অন্তি আর তাইমুরের মাঝের দূরত্ব কেবলই ২-৩ হাত কিংবা এর চেয়ে একটু বেশি। অথচ তাদের মনের দূরত্ব এক আকাশ সমান। অন্তি নিজের দুঃখ ভুলে গ্রিলের দিকে এগিয়ে গিয়ে সামান্য জোড়ে বলে,
–‘আপনি আমার নাম্বার কোথায় পেলেন, তাইমুর ভাই? আর প্রেমিক, বিরহ! এসব? এসব কিভাবে জানলেন?’
তাইমুর হাতের সিগারেট ফেলে তাচ্ছিল্য করে হাসে। পা দিয়ে সিগারেট পিষে দিয়ে বলে,
–‘আপনাকে জানানোর প্রয়োজনবোধ করছি না, মিস অন্তিকা মাহজাবিন।’
মনে রেখ এ আমারে পর্ব ১
এরপর এক সেকেন্ডও সে সেখানে দাঁড়ালো না। রুমের ভেতর ঢুকে গিয়ে এতো জোড়ে দরজা লাগিয়ে দিলো যে অন্তি নিজেও এপাশ থেকে কেঁপে উঠেছে। অন্তি কিছুই বুঝতে পারে না। হঠাৎ তাইমুর এতো ক্ষিপ্ত কেনো হয়ে উঠেছে সে সত্যিই বুঝলো না। সে শুধু তাইমুরের বাহিরের রাগটুকুই দেখলো এবং এতোদিন পর এসে হঠাৎ সে রাগের কারণও সে বের করতে পারলো না। তন্ময়ের জন্য কাঁদবে নাকি তাইমুরের বিষয়ে ভাবুক হবে এ নিয়ে ভাবতে ভাবতেই তার সে রাত কাটলো।