অশ্রুজলে বোনা বিয়ে সিজন ২ পর্ব ১৫
ইয়াসমিন খন্দকার
আরিশা এগিয়ে চলেছে অজানা গন্তব্যের দিকে। তার দুচোখ বেয়ে অঝোর ধারায় অশ্রু পড়ছে৷ নিজেকে নিয়ে বড্ড বিতৃষ্ণায় ভুগছে অসহায় মেয়েটি। মাত্র কিছুদিনের ব্যবধানে যে তার জীবন এতটা বদলে যাবে সেটা আরিশা কল্পনাও করতে পারে নি। আরিশা ভাবছিল সে আর নিজের এই জীবন রেখে কি লাভ পাবে? যাদেরকে সে এতদিন ধরে নিজের পরিবার ভেবে এসেছে তারা কেউ তার আপন নয়! তার পুরো জীবনটাই মিথ্যা। বিয়েও হলো এমন একজনের সাথে যে শুধু তার সাথে প্রতিশোধ নিতে চায়৷ আরিশা একটা রাস্তার পাশে একটা ল্যাম্পপোস্টের নিচে বসে পড়ল। অতঃপর নিজের ব্যর্থ জীবনের হিসাব মিলাতে লাগল।
এদিকে জাঈদ বাড়িতে ফিরে এসেই নিজের রুমে আরিশাকে না দেখে অস্থির হয়ে ওঠে। আরিশার নাম ধরে ডেকে সে সারা বাড়ি খুঁজতে থাকে। কিন্তু কোথাও আরিশার কোন খোঁজ পায় না৷ জামিলা শেখ এসব দেখে বিরক্ত হয়ে বললেন,”এত চেচাচ্ছিস কেন? আমি একটু ঘুমিয়েছিলাম তোর জন্য আমার কাচা ঘুম ভেঙে গেল।”
জাঈদ হাফাতে হাফাতে বলে,”আরিশা কোথায় আম্মু? ”
জামিলা শেখ নাটক করে বলেন,”ওই মেয়েটা কোথায় সেটা আমি কি ভাবে বলব? আমি কি সারাদিন ওর খোঁজ করতে বসে থাকি নাকি? কেন, ও ঘরে নেই?”
“না, আমি একটু বাইরে গেছিলাম বাড়িতে ফিরে দেখি ও রুমে নেই। তারপর পুরো বাড়ি তন্ন তন্ন করে খুঁজেছি। কিন্তু ওকে কোথাও খুঁজে পায়নি।”
“দেখ, নিজের বাপের বাড়িতে ফিরে গেছে হয়তো।”
“না, ও ওখানে যাবে না।”
“তাহলে আর কোথায় যাবে?”
জাঈদ কোন কথা না বলেই রুম থেকে বেরিয়ে যায়৷ এদিকে জামিলা শেখ জাঈদকে ডাক দিলেও সে সাড়া দেয় না। জামিলা শেখ বিরক্তির স্বরে বলে,”অনেক কষ্ট করে মেয়েটাকে তাড়াতে পেরেছি। আল্লাহ, তুমি দেখো, ঐ আপদটা যেন আর ফিরে না আসে!”
বলেই তিনি হতাশার শ্বাস ফেলেন।
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
জাঈদ নিজের বাইক বের করে রাস্তার মধ্যে উন্মাদের মতো বাইকটা চালাতে থাকে। তার কেন জানি হঠাৎ অনেক বেশিই চিন্তা হচ্ছে আরিশার জন্য? কালকের রাতের ঘটনার পর মেয়েটা কি ভুল কোন সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলল নাকি? জাঈদ আর ভাবতে পারে না। বাইকের স্পিড আরো বাড়াতে থাকে। সে নিশ্চিত আরিশা নিজের বাড়িতে ফিরে যায় নি? তাহলে কোথায় গেছে? মাথায় কিছু একটা খেলে যেতেই জাঈদ বাইকটা ঘুরিয়ে বাস স্ট্যান্ডের দিকে যেতে থাকে
আরিশা ঠিক বাস স্ট্যান্ডেই বসে ছিল। অনেক রাত হয়ে গেছে। চারিপাশটা বেশ নিস্তব্ধ। সর্বশেষ বাস একটু পরেই ছাড়বে। আরিশা সেই বাসের টিকিট হাতে নিয়ে বসে আছে৷ কিন্তু বাসে ওঠার সাহস পাচ্ছে না। কারণ সে একটু আগেই দেখে এলো, বাসে শুধু ৪/৫ জন পুরুষ আছে। এই বাসটা সিলেট থেকে ঢাকার উদ্দ্যেশ্যে রওনা দেবে। এত রাতে এমন একটা বাসে এত জন পুরুষের সাথে উঠে যাওয়ার ভরসা সে পাচ্ছিল না। এদিকে বাসটা ছাড়ার সময় হয়ে এলো। বাসের হেলপার আরিশার উদ্দ্যেশ্যে বলল”কি ব্যাপার? আপনে উঠবেন না? না উঠলে কইয়া দেন, বাস ছাইড়া দিব এখন।”
আরিশা মনে মনে আল্লাহকে স্মরণ বলে ওঠে,”দাঁড়ান আমি উঠব।”
বলেই সে বাসে উঠে বসে। কোনরকমে গুটিশুটি মেরে এককোনায় একটা সিটে বসে পড়ে। একটু পরই বাসটা স্টার্ট দেয়। আরিশা বুঝতে পারে কিছু শয়তানের লোলুপ দৃষ্টি ছিল তার দিকে। তাই সে ভয় পেয়ে হেলপারের উদ্দ্যেশ্যে বলে,”ভাইয়া..বাসটা থামান প্লিজ..আমি নামব..”
হেলপার একটা বিশ্রী হাসি দিয়ে বলে,”তা বললে তো হবে না মামনী..বাসে উঠে যখন পড়েছ আজকের রাতের জন্য আমাদের মনোরঞ্জনটা করে দিয়ে যাও!”
হেলপারের কথা শুনে আরিশার অন্তরাত্মা কেপে ওঠে। সে আকুতি মিনতি করতে শুরু করে দেয়।
এদিকে জাঈদ বাস স্ট্যান্ডে পৌঁছেই দেখতে পায় একটা পাস কিছু সময় আগেই ছাড়ল৷ তার মনে সন্দেহ জাগায় সে সবার শেষ বাসটিকে ফলো করতে লাগল।
বাসের মধ্যে আরিশার দিকে এগিয়ে আসতে লাগল ভেতরে বসে থাকা চার-পাঁচজন নরপিশাচ৷ তাদের মধ্যে একজন তো আরিশার ওড়না ধরে টান দিল। আরিশা হাত দিয়ে নিজের লজ্জা ঢাকার ব্যর্থ চেষ্টা করলো। ততক্ষণে কিছু নোংরা হাতের স্পর্শে তার পুরো শরীর বিষিয়ে উঠছিল। আরিশা আর্তনাদ করতে থাকে। এরইমধ্যে একজন পুরষ তার ওড়না দিয়ে তার মুখটা বেধে বলে,”যত খুশি চিৎকার করার করে নাও কিন্তু কোন লাভ হবে না।”
বলেই তারা আরিশার উপর ঝাপিয়ে পড়তে লাগল। এমন সময় হঠাৎ করে বাসটা থেমে গেল। বাসটা থেমে যেতেই একজন বলে উঠল,”থামল কেন?
এরমধ্যেই জাঈদ বাইক থেকে নেমে দৌড়ে বাসের মধ্যে ওঠে। উঠেই সে একটু খুঁজতেই আরিশাকে করুণ অবস্থায় দেখতে পায়। সাথে সাথেই তার মাথা গরম হয়ে যায়। জাঈদ এগিয়ে এসে সকলের সাথে মারামারি করতে করতে বলে,”তোদের সাহস কি করে হয় ওকে স্পর্শ করার?”
কিন্তু এতজনের সাথে সে একা পেরে ওঠে না। অনেক মার খেতে থাকে। এমন সময় জাঈদের বন্ধুরাও সবাই বাইক নিয়ে উপস্থিত হয়। জাঈদ নিজে তাদের ফোন করে ডেকেছে। জাঈদের বন্ধুরা মিলে জাঈদকে সাহায্য করে। খুব দ্রুতই ঐ শয়তান গুলোকে পর্যুদস্ত করে তোলে। জাঈদ তো যেই লোকটা আরিশার মুখ বেঁধেছিল তার মুখে ঘুষি মারতে মারতে তাকে আধমরা করে ফেলে। তার বন্ধুরা মিলে অনেক কষ্টে তাকে সরিয়ে আনে।
সবকিছুর পর জাঈদের নজর যায় ভীত আরিশার দিকে। সে এগিয়ে এসে উদ্বিগ্ন স্বরে জানতে চায়,”ঠিক আছ তো তুমি?”
আরিশার গায়ে আঁচড়ের দাগ, সালোয়ারের কিছু অংশ ছিড়ে ফেলেছে হায়না গুলো। তাই তার ভীষণ অস্বস্তি হচ্ছিল৷ আরিশার এই অস্বস্তি বুঝ পেরে জাঈদ নিজের জ্যাকেট খুলে আরিশাকে আবৃত করে আলতো করে তাকে জড়িয়ে ধরে বলে,”চিন্তা করো না৷ তুমি একদম ঠিক আছ।”
আরিশার হঠাৎ কি হয় সে বুঝতে পারে না। সে জাঈদকে জোরে একটা ধাক্কা দিতে নিজের থেকে সরিয়ে বলে,”দূরে সরে যান আপনি৷ কেন এসেছেন এখানে? আজ আপনার জন্য আমাকে এই দিন দেখতে হলো। আপনি আমার জীবনটা নষ্ট করে দিলেন।”
“কিচ্ছু হয়নি তোমার! ওরা তোমার কোন ক্ষতি করতে পারে নি।”
“ওরা পারে নি তো কি? আপনি তো কাল রাতে আমার যা ক্ষতি করার করেই দিয়েছেন। এখন আর আমার বাকি আছে কি? শুধু তো এই জীবনটাই বাকি আছে এটা নিয়ে নিন। তাহলেই তো আপনি শান্তি পাবেন, তাইনা? আপনার প্রতিশোধ তো তাহলেই পূর্ণতা পাবে। তো নিন,মারুন আমায়। এভাবে তিলে তিলে মারার থেকে একবারে শেষ করে দিন। শেষ করে দিন আমায়…”
বলেই আরিশা কাঁদতে থাকে। জাঈদের কি হয় সে বুঝতে পারে না। এই প্রথম বার তার নিজের কাজের জন্য খারাপ অনুভূতি হচ্ছিল৷ ইচ্ছা করছিল নিজেকে কঠিন শাস্তি দিতে। জাঈদ কাপা কাপা হাতে আরিশার কাধে হাত রেখে বলে,”ফিরে চলো আমার সাথে।”
“কোথথাও যাব না আমি আপনার সাথে। আমাকে আমার মতো ছেড়ে দিন। আমার জীবনটাকে যথেষ্ট নরক বানিয়েছেন আর না..আমি আর পারবো না। প্লিজ আমায় যেতে দিন..”
জাঈদ আরিশাকে উদ্দ্যেশ্য করে বলে,”তুমি যাই বলো আর তাই বলো, আমার হাত থেকে তোমার কোন মুক্তি নেই। তোমার ভাগ্য যেভাবেই হোক আমার সাথে জড়িয়ে গেছে। আর এই ভাগ্য এভাবে জড়িয়েই থাকে। তোমাকে আমি নিজের থেকে দূরে যেতে দেব না।”
আরিশা রাগে বলে ওঠে,”মগের মুল্লুক নাকি?”
অশ্রুজলে বোনা বিয়ে সিজন ২ পর্ব ১৪
“ধরে নাও তাই।”
“তাহলে আপনিও একটা কথা শুনে রাখুন। আপনি আমাকে এভাবে বেশিদিন আটকে রাখতে পারবে না। একদিন আমি আপনার থেকে এতোটা দূরে চলে যাব যে, আপনি চাইলেও আর আমাকে ফেরাতে পারবেন না!”
“আরিশা!”