মনে রেখ এ আমারে পর্ব ৮

মনে রেখ এ আমারে পর্ব ৮
রায়েনা হায়াত

কমিউনিটি সেন্টারের সামনে এসে গাড়ি দাঁড়িয়েছে। অন্তি একবার আশে পাশে তাকায়। তাইমুর নামতে বলে নিজেও নামে। অন্তি ভেতরে না গিয়ে বাহিরেই দাঁড়িয়ে বলে,
–‘বিনা দাওয়াতে এসে তো পরলাম। কিন্তু বিনা দাওয়াতের জন্য যদি আবার দৌড়ানি দেয় তখন?’
তাইমুর গাড়ি থেকে গিফটের বক্স বের করতে করতে বলে,
–‘আপনার অতো ভাবা লাগবে না। চলেন!’
অন্তি জানতো না তাইমুর গিফট এনেছে। বেশ অবাক হয়েই তাইমুরের পিছে যেতে যেতে বলে,
–‘গিফট কখন কিনলেন? আমাকে তো বলেনওনি!’
–‘আগেই কিনেছি।’
অন্তি মাথা নাড়ায়। দুজন একসাথেই ভেতরে এসেছে। স্টেজে তন্ময় আর তার বউ বসে আছে। ক্যামেরাম্যান ছবি তুলছে। সবাই গিফট দিচ্ছে। অন্তি একটু এগিয়ে তাইমুরের কাছাকাছি গিয়ে নিচু গলায় জিজ্ঞাসা করে,

–‘বিয়ে হয়ে গেছে নাকি?’
–‘হ্যাঁ। চোখের সামনে প্রেমিকের বিয়ে পড়ানো দেখতে পারতেন না তাই পরেই আনলাম। এখন চলেন নতুন বর-বউকে গিফট দিয়ে আসি। আর বরকে একটু সারপ্রাইজও দেওয়া হয়ে যাবে।’
অন্তি মাথা নাড়ায়। একবার চোখ তুলে তন্ময়ের হাসি মুখের দিকে তাকায়। তার কষ্টের চেয়ে বেশি তাচ্ছিল্য আসে। এই ছেলে তার পিছে আঠার মতো লেগে ছিলো একসময়! সে ভালোবাসা গ্রহণ করেনি বলে কত নাটক করেছে! অন্তির সেসব ভেবে হাসি পায়। যদি তন্ময় এতো খুশি থাকতে পারে তবে সেও আর নিজেকে কষ্ট দেবে না। সেও ভালো থাকবে৷ লম্বা একটা শ্বাস নিয়ে ঠোঁটের কোণে হাসি ঝুলিয়ে পা বাড়ায় তাইমুরের সাথে। দুজন একসাথেই স্টেজে ওঠে। তন্ময়ের চোখ বড় বড় হয়ে যায়। তাইমুর আর অন্তিকে একসাথে দেখবে সে হয়তো কখনোই ভাবেনি। অন্তি হেসে তন্ময়ের বউকে বলে,

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

–‘কংগ্রাচুলেশনস, ভাবী!’
তন্ময়ের বউ বেশ লজ্জা লজ্জা ভাবে বলে,
–‘থ্যাঙ্কস।’
তাইমুর বাঁকা হেসে তন্ময়কে জড়িয়ে ধরে শুভেচ্ছা জানায়। তন্ময় যেনো শকড হয়ে গেছে। সে শুধু অন্তির দিকে তাকিয়ে আছে। অন্তিকে এত বছরে সে অনেকবার শাড়ি পরা দেখেছে তবে আজ অন্যরকম লাগছে। হারিয়ে ফেলার পর সব জিনিসই হয়তো একটু বেশি সুন্দর মনে হয়! তন্ময় আর তার বউকে মাঝে রেখে দু পাশে তাইমুর আর অন্তি দাঁড়ায়। দুজনের সাথে ছবি তুলে তন্ময়ের বউকে জড়িয়ে ধরে অন্তি বলে,
–‘আপনি বেশ ভাগ্যবতী, ভাবী। তবে আমাদের ভাইয়ের কিন্তু পুরোনো জিনিসে বেশিদিন মন টিকে না। তাই সাবধানে থাইকেন।’

বলেই হাসতে শুরু করে। তন্ময়ের বউ বেশ ইতস্তত ভাবে তন্ময়ের দিকে তাকায়। তাইমুর তন্ময়ের সামনে ইচ্ছে করে অন্তির হাত চেপে ধরে। এরপর স্টেজ থেকে নামে। তন্ময়ের হুশ নেই সে কোথায় দাঁড়িয়ে আছে। সে শুধু অন্তির হাতের দিকে তাকিয়ে আছে। তার চোখ মুখ জ্বলছে। তাইমুর বেশ মজা নেয়। অন্তি নিজেও অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে তাইমুরের দিকে। স্টেজ থেকে নামার পর তাইমুর হাত ছেড়ে দেয়। অন্তি নিজের হাত আগলে নিয়ে অস্বস্তির সাথে আশে পাশে তাকায়। জিভ দিয়ে ঠোঁট ভিজিয়ে নিয়ে কিছু বলতে চেয়েও বলতে পারে না। তাইমুর নিজেও গম্ভীর ভাবে আশে পাশে দেখছে। দুজনেই চুপচাপ পাশে দাঁড়িয়ে আছে তবে কেউ কারো সাথে কথা বলে না। মিনিট পাঁচেক বাদেই তাইমুর বলে,

–‘এখানেই দাঁড়ান। আমি আসছি।’
অন্তি শুধু মাথা নাড়ায়। তাইমুর দ্রুত সরে যায়। অন্তি স্বস্তির শ্বাস ফেলে আরাম করে দাঁড়ায়। পাশ দিয়ে যাওয়া একটা ওয়েটারের হাত থেকে জুসের গ্লাস নিয়ে স্টেজে তাকায়। তন্ময়কে তার দিকে তাকাতে দেখে জুস দেখিয়ে হাসিমুখে খেতে শুরু করে। মিনিট খানেক পরেই তন্ময় তার কাছে আসে। অন্তি কিছু বলার আগেই সে বেশ উগ্র ভাবে বলে,
–‘তুমি এখানে কি করছো, অন্তি? তোমার সাথে তাইমুর ভাই কি করছে? উনার সাথে কি তোমার?’
অন্তি চোখ মুখ কুঁচকে বিরক্তি নিয়ে বলে,

–‘আমি আপনার গার্লফ্রেন্ড না, তন্ময় ভাই। আপনি হয়তো আমাদের সম্পর্কের শুরু আর শেষ দুটোই ভুলে গেছেন। মনে করিয়ে দেবো?’
তন্ময় আরও রেগে যায়। তবে নিজের রাগকে গিলে নিয়ে নিচু স্বরে বলে,
–‘তাইমুর ভাইয়ের সাথে কি চলছে তোমার?’
–‘তা আমি আপনাকে বলতে বাধ্য নাকি? আর ওয়েট! তাইমুর ভাইকে আপনি কিভাবে চেনেন?’
তন্ময় নিজের রাগকে নিয়ন্ত্রণ করছে। আশে পাশে তাকিয়ে আবারও নিচু স্বরে বলে,
–‘দেখো অন্তি!..’
–‘কিছু দেখাদেখির নাই। আপনি বিয়ে করেছেন আর স্টেজে আপনার বউ বসে আছে। উনি কার সাথে কি করতেছে ওইটা গিয়ে দেখেন। আমারটা দেখার দরকার নাই। তাইমুর ভাইকে কিভাবে চেনেন এটা বলেন!’
তন্ময় কিছু বলার আগেই তার ডাক পরে। সে প্রায় ছুটে যায়। তাইমুরও চলে আসে। এসেই আগে জিজ্ঞাসা করে,
–‘আপনার প্রেমিক আপনার কাছে আসছিলো কেনো আবার?’
অন্তি তার প্রশ্নের জবাব না দিয়ে উল্টো প্রশ্ন করে,

–‘আপনারা একে অপরকে চেনেন?’
প্রশ্নটাতে তাইমুর সামান্য চমকালেও নিজেকে সামলে নেয়। অন্তির হাত থেকে জুসের গ্লাস নিয়ে তাতে চুমুক দেয়। অন্তি সাথে সাথেই বলে ওঠে,
–‘আরে ওটা আমি খেয়েছি তো!’
তাইমুর একবার তার দিকে আরেকবার গ্লাসের দিকে তাকিয়ে ‘ঠিক আছে’ বলে অন্তির হাতে ধরিয়ে দেয় আবার। অন্তি হা করে তাকায়। তাইমুর ততক্ষণে উল্টো দিকে হাঁটা লাগায়। অন্তি গ্লাসটা পাশে রেখেই তাইমুরের পিছু পিছু ছুট লাগায়। পাশাপাশি এসে বলে,
–‘আমার প্রশ্নের জবাব দেননি কিন্তু!’
–‘দিবো না।’

অন্তি কটমট করে ওঠে। দাঁতে দাঁত চেপে তাকায় তার দিকে। ইচ্ছে করে একটা বা’রি দিয়ে মাথাটা ফা’টিয়ে দিতে। কিন্তু পারবে না বলে নাক ফোলায়। সামনে থেকে একজন এসে হঠাৎ তাইমুরকে জড়িয়ে ধরে। এই ঘটনায় অন্তি আকস্মিক দু পা পিছোয়। তাইমুর শক্ত করে তার হাত ধরে। তাইমুর ঘাড় বাকিয়ে তাকিয়ে হাত আবার ছেড়ে দেয়। জড়িয়ে ধরা ছেলেটা সায়মন। তাদের কথা শুনেই বোঝে অন্তি। সায়মন ব্যস্ত গলায় বলে,
–‘লেট করলি কেনো? কখন থেকে অপেক্ষা করছিলাম তোর!’
–‘হসপিটালে ছিলাম। তুই তো জানিস-ই!’
সায়মন মাথা নাড়ায়। পাশে অন্তিকে দেখে হাসিমুখে জিজ্ঞাসা করে,
–‘অন্তি?’
অন্তি উপর-নীচ মাথা নাড়ায়। তারপর বলে,
–‘আপনি এখানে কেনো?’
সায়মন অবাক হয়ে বলে,
–‘আমার চাচাতো ভাইয়ের বিয়ে। আমি থাকবো না?’

অন্তি অবাকের চরম পর্যায়ে। এতোদিনের সম্পর্কেও সে কখনো জানেইনি সায়মন তন্ময়ের কাজিন। সায়মন বিয়ে করেছে ৬ মাস আগে। ওর লাভ ম্যারেজ ছিলো। তাইমুরও একটু অবাক হয়েছে। সায়মন এতোদিন রাজশাহীতে ছিলো না। সে আর তার বাবা-মা পুরোপুরি ঢাকাতে শিফট হয়ে গেছে। তবে মাঝে মাঝে আসা হতো। সায়মন তার বউ নাদিয়ার সাথে পরিচয় করিয়ে দেয়। নাদিয়া তাইমুরকে দেখে অনুমান করে নেয় অন্তি তার বউ। যদিও সায়মন তাকে কিছুই বলেনি। না বুঝেই আগ্রহ নিয়ে জিজ্ঞাসা করে,
–‘তাইমুর ভাইয়ের বউ?’
তাইমুর আর অন্তি দুজনেই বিব্রত হয়। সায়মন নাদিয়ার হাত চেপে ধরে বলে,
–‘না। ও অন্তিকা।’
নাদিয়া অন্তিকা বুঝলেও তাইমুরের সাথে সম্পর্কটা বুঝলো না। সায়মন তাদেরকে থাকতে বলে নাদিয়াকে নিয়ে দুরে যায়। তারা যেতেই তাইমুর জিজ্ঞাসা করে,
–‘সায়মন যে তন্ময়ের ভাই হয় এটা আপনি জানতেন না?’
অন্তি দু দিকে মাথা নাড়ায়। তাইমুর তার মুখ দেখেই বোঝে আসলেই সে জানতো না। তাইমুর স্টেজের দিকে তাকালে দেখে তন্ময় তাদের দিকে তাকিয়ে আছে।

কিছুক্ষণ থেকে সেখান থেকে বের হয় তাইমুর আর অন্তি। ওখানে খাবারের কথা বললেও তাইমুর কিংবা অন্তি কেউই খায়নি। দুজনেই বের হয়ে চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে। তাইমুর নিজেই বলে,
–‘হাঁটি?’
অন্তি মাথা নাড়ায়। হাঁটতে গিয়েও থেমে বলে,
–‘আপনার গাড়ি?’
–‘সমস্যা নাই৷ সায়মন দেখে নিবে।’
অন্তি মাথা নাড়িয়ে তাইমুরের পাশাপাশি হাঁটতে শুরু করে। শীতের রাত। জিদ করে আসতে গিয়ে শাল বা শীতের জ্যাকেট কিছুই আনেনি। তার মা পিছু ডেকেছে সে তাও মানেনি। এখন বাহিরে তার ভালোই ঠান্ডা লাগছে। কাঁপতে শুরু করলে তাইমুর তা খেয়াল করে। নিজের জ্যাকেটের দিকে তাকিয়ে আরেকবার তাকায় অন্তির দিকে। খোঁচা দিয়ে বলে,

–‘প্রেমিককে দেখতে এতো উতলা হয়ে গেছিলেন যে শীতের কাপড় আনেননি!’
–‘তো হিরোদের মতো নিজের জ্যাকেটটা দিয়ে দিলেই তো হয়!’
–‘আমরা হিরো হিরোইন না। তাই দিবোও না। আপনাকে দিয়ে নিজে ঠান্ডায় ম’রার ইচ্ছা নাই।’
অন্তি মুখ বাঁকায়। তাইমুর খেয়াল করে আসলেই অন্তির বেশ ঠান্ডা লাগছে। আশে পাশে একবার তাকিয়ে নিজের গায়ের জ্যাকেটটা খুলেই অন্তির দিকে এগিয়ে দেয়। অন্তি না নিয়ে বলে,
–‘এখন দিচ্ছেন কেনো?’
–‘অসহায় মানুষদের সাহায্য করলে সওয়াব পাবো। তাই দিচ্ছি।’
অন্তি ফোঁস করে শ্বাস ছেড়ে জ্যাকেটটা নিয়ে নেয়। পরতে পরতে বলে,
–‘আপনার ঠান্ডা লাগবে না?’
–‘না। আমি তো রোবট। ঠান্ডা কেনো লাগবে!’
এবারও ত্যাড়া জবাব দেওয়ায় অন্তির বেশ রাগ লাগে। থেমে গিয়ে বলে,
–‘এইরকম ত্যাড়া কথা বললে আপনি আমার সামনেই আসবেন না। রাগে কবে মাথা ফা’টিয়ে দিবো তা আমিও জানি না।’

তাইমুর কিছু বলে না। ল্যাম্পপোস্টের আলোতে রাস্তা স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে। জুতো পরে হাঁটতে কষ্ট হচ্ছে দেখে অন্তি জুতো খুলে হাতে নেয়। তা দেখে তাইমুর ব্যস্ত গলায় বলে,
–‘ঠান্ডা লাগবে তো।’
–‘লাগুক!’
তাইমুর আর কিছু বলে না। অন্তি বেশ সাচ্ছন্দ্যের সাথে হাঁটছে দেখে সেও চুপচাপ হাঁটতে থাকে। সামনে আসতেই নজরে আসে একটা ছোট্ট রেস্টুরেন্ট। তাইমুর টাইম দেখে নিয়ে বলে,
–‘এখান থেকে খেয়ে যাবো। চলেন!’
–‘কেনো?’
–‘বিয়ে বাড়ি গেছিলাম অথচ খেয়ে আসিনি! আঙ্কেল-আন্টি জিজ্ঞাসা করলে কি বলবেন? এক্সের বিয়ে ছিলো বলে খাইনি?’
অন্তি হতাশ চোখে তাকায়। তাইমুর আগে আগে হেঁটে রেস্টুরেন্টে ঢুকে যায়। অন্তি রেস্টুরেন্টে ঢোকার আগেই জুতোটা পরে নেয়। তারপর তাইমুরের সামনের চেয়ারে বসে। তাইমুর খাবার অর্ডার দেয়। দুজন দু পাশে নিজেদের মতো বসে আছে। রেস্টুরেন্টে তেমন কেউ নেই। তাদের মতোই অপরপাশে শুধু একটা কাপল বসে আছে। যদিও তারা কাপল নয়। অন্তি গালে হাত দিয়ে চারপাশ দেখছে। তাইমুর জিজ্ঞাসা করে,
–‘খারাপ লাগছে?’
–‘তন্ময়ের বিয়ের জন্য?’
–‘হুম।’

–‘সত্যি বলতে একটু খারাপ লাগছে তবে তার চেয়েও বেশি আফসোস হচ্ছে।’
তাইমুর প্রশ্নসূচক দৃষ্টিতে তাকালে অন্তি হেসে বলে,
–‘নিজের জীবনে ওকে জড়ানোর আফসোস হচ্ছে।’
তাইমুর স্বাভাবিক ভাবে বসে। তাইমুর নিজের ফোন স্ক্রল করছে। অন্তি হঠাৎ-ই জিজ্ঞাসা করে,
–‘আপনি এখনো বিয়ে করেননি কেনো? সায়মন ভাইয়াও বিয়ে করে ফেলেছে। তাহলে আপনি এখনও সিঙ্গেল কেনো?’
তাইমুর ফোনে দৃষ্টি রেখেই বলে,

মনে রেখ এ আমারে পর্ব ৭

–‘পছন্দের কাউকে পাইনি তাই বিয়ে করিনি। পেলে করে নিবো।’
মিনিট দুয়েক দুজনেই চুপ থাকে। কি মনে করে অন্তি ফের ফট করে জিজ্ঞাসা করে বসে,
–‘আপনি আমাকে পছন্দ করতেন, তাইমুর ভাই?’
তাইমুরের হাত থেমে যায়। চোখ তুলে তাকায় অন্তির দিকে। তার তাকানোতে অন্তি অস্বস্তিবোধ করে। এমন একটা প্রশ্ন করার জন্য নিজেকে বোকা মনে হয়৷ তাইমুর কয়েক সেকেন্ড সময় নিয়ে সোজা বলে,
–‘না।’

মনে রেখ এ আমারে পর্ব ৯