রং পর্ব ৫০
তন্নী তনু
– আমার বাবা কোথায়?
— যদি বলি তোমার বাবাকে আমি মেরে ফেলেছি। তুমি আমাকে ছেড়ে যাবে?
এহেম কথায় চোখদুটো আপনাআপনি গোল গোল হয়ে যায়,কোমল কপালটুকুতে ভাজ পড়ে। ইরফাদ সোজা হয়ে বসে,অনেকটা ঝুকে আসে সিনথিয়ার দিকে। তারপর ধীর গলায় বলে,
— কি ছেড়ে যাবে?
সহসাই টোকা পড়ে দরজায়। পূর্বের ন্যায় বসে ইরফাদ। রিদুয়ানুর রহমান ডাকেন,
— ইরফাদ!
দাঁড়িয়ে যায় সিনথিয়া।ইরফাদ সাথে সাথে বলে,
–বাবা ভেতরে আসো।
সিনথিয়া কোমল গলায় বলে,
— বাবা! আসুন।
রিদুয়ানুর রহমান ভেতরে প্রবেশ করেন। সিনথিয়া চেয়ার এগিয়ে দেয়। তারপর নিঃশব্দে দরজার দিকে পা বাড়ায়। রিদুয়ানুর রহমান চোখ ফিরিয়ে বলেন,
— কোথায় যাচ্ছো মা! বাইরে যেতে হবে কেনো। বসো এখানেই।
সিনথিয়া দাঁড়ায়। আবার ধীর পায়ে পূর্বের জায়গায় দাঁড়িয়ে থাকে। রিদুয়ানুর রহমান বসেন ছেলের পাশে। ছেলের বলিষ্ঠ হাতের উপরে হাত বুলিয়ে দেন। আর কোমল গলায় বলেন,
— আব্বা! এখন কেমন লাগছে!
ইরফাদের চোখ মুখে শান্তির ছোঁয়া। ওষ্ঠাধর হালকা করে ছড়িয়ে বলে,
— সকাল থেকে হাজার বার জিজ্ঞেস করেছো বাবা। আমি তো বলেছি-আই ফিল বেটার।
— সন্তান অসুস্থ থাকলে বাবা-মায়ের হৃদয় শান্ত থাকে না,প্রতি সেকেন্ডের ভালো মন্দের খবর না শুনলে অন্তর ঠান্ডা হয় না আব্বা। তুমি বাবা হও তুমিও বুঝবে।
শেষের কথাটা শুনে একপলক তাকায় ইরফাদ, সিনথিয়ার চোখের দিকে। চোখে চোখ পড়তেই অজানা কারণেই শরীর হীম হয়ে আসে সিনথিয়ার। কেনো?কি কারণে তার কারণ জানা নেই। চোখ সরিয়ে দৃষ্টি নিচু করে সিনথিয়া। ইরফাদ চোখ ফিরিয়ে নেয়। রিদুয়ানুর রহমানের দিকে ফিরে বলে,
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
— বাবা, সাজিদ কেনো এসেছিলো? তুমি লোকেশন কেনো দিলে? আমি তো নিষেধ করেছিলাম বাবা।
— আমার মনে হয় সাজিদ ইভার সাথে কথা বলে। ইভা তোর ব্যাপারে না বললেও ছেলেটা বুঝতে পেরেছিলো বাসায় কিছু হয়েছে। বাসায় এসেছিলো। যেহেতু বাসায় কেউ নেই ঐজন্যে আমাকে কল দিয়েছিলো। ঐজন্যে বলা।
— নিষেধ করেছিলাম তো বাবা।
— আচ্ছা আব্বা সরি।
— ইভা কি চাচ্ছে এখন?
— কিছু বলেনি। কথা বলে দেখতে হবে। সাজিদ তো অনেকদিন হলো বলে। তুই ছিলি না তাই বিষয়টা পিছিয়ে আছে। আজ বাসায় ফিরে ইভার সাথে একবার কথা বলিস। সম্মতি থাকলে না হয় সাজিদের ফ্যামিলিকে ডেকে নিবো।
–আমি একটা বিষয় ক্লিয়ার করতে চাই বাবা। ইভার লাইফ ইভার ডিসিশন।আমার চোখে দেখা ছেলেদের মধ্যে সাজিদ অন্যতম।সো আমার কোনো কথা নেই। তবে টুম্পাকে আমি আমার কাছে রাখতে চাই।
— এইটুকু বাচ্চা মা ছাড়া থাকবে? আর ইভা!
— টুম্পার লাইফ রিস্ক বা অন্য কোনো প্রবলেম ফেস করুক, কোনো ট্রমার মধ্যে বড় হোক আমি চাইনা। আমার প্রথম সন্তান হিসেবে ও বড় হবে।
— আমি জানি তুই ওকে সবচেয়ে ভালো রাখবি। তবে বাচ্চার তো মা”কে প্রয়োজন। মায়ের ওম প্রয়োজন।
–মায়ের আদর ও পাবে। ওর যখন যেতে ইচ্ছে করবে যাবে। শুধু ওর দায়িত্বটুকু পালন করবো যাতে কারো উপর ভাড় না হয়। আমাদের কাছে থাকলে আমি জানি সিনথিয়া ওকে আগলে রাখবে। যতোটা নিজের সন্তানকে আগলে রাখে।
এতটুকু বলেই সিনথিয়ার দিকে তাকায় ইরফাদ। তারপর বলে,
–কি পারবে তো?
সিনথিয়া চুপচাপ নিঃশব্দে মাথা নাড়ায়। তবে অন্য একটা ব্যাথায় বুক ভার হয়ে আসে সিনথিয়ার। নিঃশব্দ, নিরবে দাঁড়িয়ে থাকে সিনথিয়া। সময়ের অপেক্ষা, এক মিনিট সময় পেলেও ইরফাদের সাথে এই ব্যপারে কথা বলবে সিনথিয়া।
বাসায় ফেরার পর………
সুসজ্জিত পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন সাদা ধবধবে ড্রয়িং রুম। আধুনিক ডিজাইনের সোফায় বালিস ফেলে শুয়ে আছে ইরফাদ। বসে আছেন রিদুয়ানুর রহমান। কড়া লিকারের চা আর স্ন্যাকস নিয়ে আসে ইভা। সিনথিয়াও আসে সাথে। ট্রে থেকে চিকেন স্যুপের বাটিটা ইশারায় দেখায় সিনথিয়াকে। তারপর বলে,
— ভাইয়াকে দাও। আর চা বাবাকে।
সিনথিয়া চুপচাপ কাজ করে। রিদুয়ানুর রহমান চায়ের কাপটা তুলে নেন। তারপর বলেন,
–ইভা! বসোতো আম্মা। তোমার সাথে কিছু কথা আছে।
এই মূহুর্তে কি নিয়ে আলোচনা হবে সিনথিয়া তা জানে। তাই চুপচাপ সোফা পেরিয়ে নিজের রুমে ফেরার জন্যে পা বাড়ায়। ঠিক ঐ মূহুর্তে রিদুয়ানুর রহমান ডাকেন,
— সিনথিয়া! এখানে আসো।
ইরফাদ উঠে বসে।বাটি থেকে ধোঁয়া ওঠা স্যুপ চামচ নাড়িয়ে তুলে নেয়। রিদুয়ানুর রহমান চায়ের কাপে গাঢ় চুমুক দিয়ে বলেন,
–তুমি এই বাড়ির মেম্বার। সকল আলোচনায় তুমি থাকবে। তোমার মতামত জানাবে। তুমি এই বাসার অংশ। এইখানে তোমার কর্তৃত্ব অনেক বেশী। তুমি এই বাড়ির বউ। আমার ইরফাদের অর্ধাঙ্গী। সুতরাং কোনো আলোচনা থেকে নিজেকে দূরে রাখবে না। বসো ইরফাদের পাশে।
সিনথিয়া নৈঃশব্দে ধীর পায়ে বসে ইরফাদের পাশে। ইভা বসে সিঙ্গেল সোফায়। রিদুয়ানুর রহমান চায়ের কাপে চুমুকের ফাঁকে ফাঁকে কথা বলেন,
— আমি সব সময় তোমাদের বাক স্বাধীনতা দিয়েছি। যে কোনো প্রবলেম,যেকোনো ডিসিশন নেওয়ার আগে আমার সাথে ডিসকাস করে নেওয়ার সুযোগ দিয়েছি। আলোচনার বেলায় আমি তোমাদের বাবা নই বন্ধু। তবুও কোনো বিষয় আমাকে বলতে আনইজি লাগলে ভাইয়াকে বলবে না বলতে পারলে চিরকুট লিখবে। এরপর আমি আমার সিদ্ধান্ত জানাবো। বাবা হিসেবে অবশ্যেই সন্তানের ভালোটাই আমি চাইবো। এখন কাজের কথায় আসি। সাজিদ অনেক দিন ধরে আমাদের বাসায় আসা যাওয়া করে। তার পারসোনালিটি, তার বিহেভিয়ার সত্যিই মনমুগ্ধকর। না হলে তেমন সম্পর্ক না থেকেও এই বাসায় আসা যাওয়া করতে পারতো না। রিসেন্ট ছেলেটা কিছু বিষয় ক্লিয়ার করেছে। এখন আমি আর ইরফাদ এই বিষয়ে অবগত যতোটা সাজিদ বলেছে। কিন্তু তোমার মতামত জানা প্রয়োজন।
লজ্জাবতী গাছের নুইয়ে পড়া পাতার মতো মাথা নুইয়ে ফেলে।বাবা ভাই খুব বন্ধুসুলভ আচরণ করলেও কিছু বিষয়ে মুক্তভাবে কথা বলা যায় না। ইবার নিচু মাথা দেখে ইরফাদ বলে,
— সব ক্লিয়ারলি বল! না হলে বুঝবো কি করে?
ইভা মাথা নিচু করে বলে,
— তোমরা যা ভালো বোঝ!
ইরফাদ স্যুপের বাটিটা টি টেবিলের উপর রাখে। তারপর এক পা মেঝেতে নামায়। বালিসটা পিঠের পেছনে দিয়ে শরীর এলিয়ে দেয়। তারপর বলে,
— ডিসিশন তোমার, আমরা শুধু দেখবো ডিসিশন টা ঠিক কি না। সাজিদ ভালো ছেলে তোমার ইচ্ছে থাকলে আজকেই ডাকবো তাদের।
এহেম কথায় বুকের মধ্যে কেঁপে ওঠে সিনথিয়ার। সব টা এখানেই ছিন্ন হয়ে যাবে? এখানে ইতি টানা হবে। তার যে খুব অশান্ত লাগছে। রাফসানের সেই শেষ রূপ টা, সে তো নিজের ভুল বুঝতে পেরেছে। ভালো হতে চেয়েছে। ঐ যে রিসোর্টের দিনগুলো, তার ভাইয়ের চোখে টুম্পার জন্য দূর্বলতা দেখেছে, অনুতাপের উত্তাপে রাফসান ঝলসে যাচ্ছিলো তাকে কি একটা সুযোগ দেয়া উচিত নয়। হাতের শক্তিটা ক্রমশ শূন্য হয়ে আসছে। সোফার কর্ণারে বসে থাকা সিনথিয়া অজান্তেই মেলে রাখা ইরফাদের পায়ের তালুর উপর হাত রাখে। উষ্ণ পায়ে বরফ শীতল হাতের স্পর্শ পেয়ে জমে যাওয়া সিনথিয়ার পানে একপলক তাকায় ইরফাদ। তারপর ইভার উদ্দেশ্য বলে,
— আজ কি ডাকবো?
ইভা মাথা নুইয়ে রেখেই জবাব দেয়,
— ভাইয়া! পারসোনালি আমার কোনো ইচ্ছে নেই নেক্সট কোনো সম্পর্কে জড়ানো। তবে টুম্পা”র কথা ভেবে আমি ভেবেছিলাম বিষয়টা। সাজিদ ভাই টুম্পাকে খুব ভালোবাসে, ঐ জন্য ভেবেছিলাম আরকি। পাস্টের কিছু ঘটনায় এই কয়েকটা বছরে যা যা ফেস করেছি টুম্পার উপর কোনো ইফেক্ট না পরুক।
— আমার একটা বিষয় ক্লিয়ার করার আছে। আমি তো সিঙ্গেল ছিলাম তাই তখন টুম্পার সমস্ত ভার আমি বহন করতে পারিনি এখন সিনথি আছে।টুম্পা আমার কাছেই থাকবে।
— ওকে ছাড়া তো আমি বাঁচবো না ভাইয়া। ওর জন্যেই সাজিদকে একসেপ্ট করতে চেয়েছি। তুমি ওকে নিয়ে নিলে আমি কেনো নতুন লাইফে যাবো। আমি এখানেই থাকবো।
–ওকে পুরোপুরি নিতে চাইনি। ও আমার কাছে পার্মানেন্ট থাকবে, তোমার কাছেও যাবে। যখন যেমন খুশি। শুধু ওর জীবনের সমস্ত কিছুর দায়িত্ব আমি পালন করবো।
— তাহলে বিয়ের বিষয়টা থাক…
— জীবনে ভুল থাকবেই, রং চয়েজ, রং ডিসিশন নিয়ে জীবন নষ্টের পর যদি জীবনকে নতুন করে সাজানোর সুযোগ থাকে তাহলে কেনো তুমি জীবনকে সুযোগ দিবে না। আমি দেই নি?
— টুম্পার জন্যেই এমন ডিসিশন নিয়েছি আমি।
— আমি ওকে বন্দি করে রাখতে চাইনি।ওকে আমার কাছে রাখতে চাই যাতে ওর লাইফ রিস্ক না থাকে। কারো জীবনের বোঝা না হয় বাচ্চাটা। ও একটা স্বাধীন লাইফ লিড করবে। যেখানে এই সকল বিচ্ছেদের বিষণ্নতা টুম্পাকে না স্পর্শ করে। সর্বোপরি ওর একটা ভরসার জায়গা থাকবে, ওর মাথার উপর একটা ছাদ থাকবে। জীবনের কোনো একটা সময়ে ও যেনো ইনসিকিউর ফিল না করে।
— তাহলে তো হয়েই গেলো ভাইয়া। আমার আর বিয়ে করার কি দরকার।
— জীবন খুব সংক্ষিপ্ত। আর সংক্ষিপ্ত জীবনে ভালো থাকার অধিকার সবার আছে। তুমি কি সারাজীবন অতীত ভেবে কাঁদবে?
ইভা নিরব,নিস্তব্ধ চোখে তাকিয়ে আছে। ঠিক সে মূহুর্তে সিনথিয়া বলে,
–আপু যখন চাচ্ছে না….
ইরফাদ চোখ তুলে তাকায়। চোখের দৃষ্টির গরম উত্তাপে চুপ হয়ে যায় সিনথিয়া। অতঃপর ইরফাদ বলে,
–ইভা, যে মানুষটা তোমাকে ভালোবেসে গ্রহণ করতে চাচ্ছে তুমি তাকে কেবল বাচ্চার জন্যে এক্সেপ্ট করতে চাচ্ছো। এই বিষয়টা চোখে লাগছে আমার। যাকে অনুভব করোনা তাকে কেনো বিয়ে করবে? তার লাইফ তো একটাই, তার জীবনের সকল অপূর্ণতা, বিষণ্নতা,একাকিত্বতা যদি পার্টনারের স্পর্শে দূর না হয়। তাহলে তাকে এমন জীবন কেনো দিবে যাকে তুমি ভালোবাসতে পারবে না, অনুভব করতে পারবে না। তার সাথেই জীবন জড়ানো উচিত যাকে তুমি অনুভব করো, যাকে তুমি ভালো রাখতে পারবে।
— ওনার সাথে কয়েকদিন কথা হয়েছে আমার। মানুষটা ভালো। তবে টুম্পার প্রতি ওনার ভালোবাসা থাকায় আমার মনে একটু সফট কর্ণার তৈরী হয়েছে।
— তাহলে রাতে সাজিদের ফ্যামিলিকে ডাকি!
— টুম্পাকে ছাড়া আমি এমন চিন্তা করতেই পারবো না।
— টুম্পা ভালো থাকবে…… তোর কাছেও আমাদের কাছেও। ওর দুটো পরিবার। ওর যেখানে খুশি থাকবে। একান্তই কখনো প্রবলেম ফেস করলে টুম্পার দায়িত্ব আমার।তুই শুধু সম্মতি দে…
— খুব ভয় লাগছে ভাইয়া।
— যদি বলতে কিছু নেই। রাইট পারসন হলে লাইফকে সেকেন্ড চান্স দেয়া উচিত। তুই সম্মতি দিলে আমি আজ রাতেই কল দিবো।
রিদুয়ানুর রহমান বলেন,
— আমার একটা ইচ্ছে আছে। যেহেতু সিনথিয়া কেস সলভ না হওয়া অবধি বাসায় যেতে পারবে না। দুটো সন্তান আমার। আমি চাই দুটো প্রোগ্রাম একদিনেই হোক। আমার দুটো বাচ্চা আমার সামনে নতুন জীবনে পদার্পণ করুক।উপরওয়ালা শান্তি দিক পৃথিবীর সমস্ত সন্তানের বুকে, সাথে আমার বাচ্চা দু’টোর হৃদয় বরফশীতল হোক।
সাজিদের বাসায় কল দেয়া হলে তারা জানায় কাল আসবে তাই আজকের রাতে কোনো আয়োজন নেই। রাতের খাবার শেষে নিজস্ব কক্ষে সবাই। সিনথিয়ার মন পাথরের মতো ভার, গম্ভীর। যা হচ্ছে সব মিলিয়ে অশান্ত হৃদয়ে উত্তাল ঢেউ থামছে না। ইরফাদের কোলের উপর ল্যাপটপ। মন ডুবিয়ে কাজ করছে সে। অশান্ত সিনথিয়া হাঁসফাস করছে–অনুতপ্ত মানুষকে কি একবার সুযোগ দেয়া উচিত নয়। এই বাসার একটা মানুষ এই বিষয়টা ভেবে দেখলো না। আনমনে আবছা আলোয় পায়চারী করছে সিনথিয়া। ইরফাদ কাজের ফাঁকে চোখ উঁচিয়ে দেখে।তারপর দৃষ্টি দেয় ল্যাপটপের স্ক্রিনে।
— ফ্রেশ হয়ে এসে শুয়ে পড়।
সিনথিয়া থেমে যায়। মনে মনে ভাবে আজ কোথায় ঘুমাবে সে, দোলনায় নাকি ইরফাদের পাশে? সিনথিয়া বলে,
–ফ্রেশ তো হয়েছি! এখন কোথায় ঘুমাবো?
ইরফাদ সিনথিয়ার দিকে তাকায়। আপাদমস্তক চোখ বুলিয়ে বলে,
–ড্রেস চেঞ্জ করো। কটন সফট ড্রেস পড়ে আসো। অথবা স্কার্ট,টি-শার্ট ও পড়তে পারো।
— এগুলো তে কি প্রবলেম।
— ঘুমাতে প্রবলেম হয়।
–এগুলোও তো কটনেরই।
— হুম তবে সফট না, আর জামার সাথে হালকা জড়ি ওয়ার্ক, স্টোন আছে।
–এগুলো তো আমার শরীরে আছে। আপনার কি সমস্যা!
— শরীরটা তো আর আলাদা থাকে না,আমার বুকের ওম খুঁজতে আসে। ড্রেস সফট না থাকলে জড়িয়ে ধরে ফিল পাওয়া যায় না। সো অলওয়েজ সফট ড্রেস পড়বে।
সিথনিয়ার মাথায় একটা চক্কর দেয়। কি চিন্তাভাবনা রে বাবা। এমন টা তো সে কখনো ভেবেও দেখেনি ।
সাদা রঙের কোমল নরম ঢিলেঢালা টি-শার্ট, কটনের স্কার্ট টা লাল রঙের। টি-শার্টের পেছনের অংশের নেক ভি আকৃতির। আয়নায় দেখা যাচ্ছে পিঠের কালো তিলটা। হাতা দুটো বড় শূন্য আকৃতির,ছোট ছোট ফিতা দিয়ে বাঁধা। চুলগুলো বিনুনি পাকায় সিনথিয়া। তারপরে ধীর পায়ে কক্ষে প্রবেশ করে পাথরের মূর্তির মতো দাঁড়িয়ে থাকে। ইরফাদ ফিরে তাকায়।
— মাশাল্লাহ্! আজকে খুব বেশী সুন্দর লাগছে। আসুন আসুন।
সিনথিয়া ধীর গলায় বলে,
— দোলনাটা নামিয়ে দিন। আমি আজ ঐখানেই ঘুমাই।
— দূরত্ব বাড়াচ্ছেন ম্যাডাম?
— আপনার যে ঘুম হয় না।
— অসুস্থ স্বামীকে ফেলে দোলনায় ঘুমাবেন! আপনি তো নির্জন রাস্তায় আকাশ-বাতাস কাঁপিয়ে কথা দিয়েছিলেন ভালোবাসবেন, ভালোরাখবেন। তাহলে এতো পালাই পালাই কিসের আপনার।
— না মানে!
— আসুন!! বুকটা ফাঁকা আছে…… আপনার ঘুমটা দীর্ঘ, শান্তির,সস্তির হওয়ার জন্যে আমি অলওয়েজ রেডি।
— আমার কোনো কাজে আপনি অসন্তুষ্ঠ? আমি কি ভালোবাসতে পারছি না, ভালোরাখতে পারছি না?
— আপনি হসপিটালের গত সময়ে আমার কেবিনের বেড থেকে নামেননি। এতোগুলো নার্স এর কথা আপনি অমান্য করেছেন। এই প্রথমবার আপনার জন্য আমি ক্ষমতার অপব্যবহার করেছি ম্যাডাম। আপনাকে কাছে রাখার জন্য হসপিটালের রুলস ভেঙেছি। তবে সব বুঝলাম। রাতে চুপিচুপি পায়ের তালুতে কি করছিলেন?
সিনথিয়া লজ্জায় চোখ বন্ধ করে ফেলে। এই লোক তাকে জ্বালিয়ে মারবে এখন। সব বুঝেও কেনো মুখে বলছে এসব। ইরফাদ সিনথিয়ার বালিসটা ঠিকঠাক দিতে দিতে বলে,
— পায়ের তালুতে অজস্র চুমু। এই পুরো আমিটা কি করলাম।আমার মুখটা কি খুব বাজে দেখতে। উঠে আসুন ম্যাডাম। আপনার শীতল ওষ্ঠে আমাকে ছুঁয়ে ধন্য করুন।
সিনথিয়া পিটপিট করে তাকায়। এ কি অবস্থা। এমন কঠিন পরীক্ষার সম্মুখীন হতে হবে জানলে তো রুমেই আসতো না সে। সিনথিয়া চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকে। নিরব, নিস্তব্ধ সিনথিয়াকে দেখে ইরফাদ বলে,
–তুমি আসবে নাকি আমি উঠবো?
সিনথিয়া দোটানায় পড়ে যায়। বুকের মধ্যে নতুন অনুভূতি ধিকি ধিকি জ্বলছে। প্রথম দিনের মতো অজানা অনুভূতিতে কাঁপছে হৃদয়। তবুও ধীর পায়ে উঠে যায় বিছানায়। গুটিশুটি মেরে শুয়ে পড়ে ইরফাদের পাশে। ইভার হাতে তোলা পাতলা হালকা সুতার কাজের নকশি কাঁথাটা টেনে নেয় ইরফাদ। অতঃপর,
— ভালোবাসো!
সিনথিয়া চোখ উল্টে বন্ধ করে নেয় চোখ। ইরফাদ আরেকটু দূরত্ব কমায়। ঘন উষ্ণ শ্বাস পড়ছে সিনথিয়ার কপালজুরে। সিনথিয়া নৈঃশব্দে তলিয়ে যায়। তবে তার হৃদযন্ত্রটা দাপিয়ে চলতে শুরু করে দূনির্বার। ইরফাদ শীতল গলায় বলে,
— বলো
— কি?
–ভালোবাসো?
সিনথিয়া মাথা ঝাকিয়ে বলে,
— হুম!
— কি হুম?
— ভালোবাসি।
— এতো লজ্জা কোথা থেকে এসে ভর করলো সিনথি?
–বিরক্ত লাগে আপনার?
— একটুও নাহ!
–আমি একটা কথা বলতে চাই। প্লিজ একটু ভেবে দেখেন। আমি না সস্তি পাচ্ছি না। ইভা আপুকে প্লিজ বিয়ে দিবেন না। ভাইয়ার রায় আসা আবধি।
— ছেলেমানুষী কোরো না সিনথি। ইম্যাচুউরিটি, পাগলামি, ছেলেমানুষী আমি উপভোগ করি। তবে কিছু ক্ষেত্রে ইম্যাচুউরিটি বেমানান। নিজেদের সম্পর্কের মধ্যে থার্ড পারসন টেনে সম্পর্ক নষ্ট কোরো না। তোমার ধারণা আছে রাফসান কি কি করেছে?
— যাই করুক। ভাইয়া অনুতপ্ত। অনুতপ্ত মানুষকে তো একবার সুযোগ দেয়া উচিত।
— তুমি ভুলে গেছো কি? রাফসান ইভার সাথে কি কি করেছে? ওকে ঐ বিধ্বস্ত অবস্থায় কোথায় রেখে এসেছিলো?
— আমি ভাইয়াকে বলেছিলাম। ভাইয়া আমার মাথায় হাত রেখে বলেছে এমন কিছু সে করেনি।
— তুমি কি ভুলে যাচ্ছো রাফসানের অপরাধ?
— এই অপরাধের মাস্টারমাইন্ড আমার ভাইয়া নয়। ভাইয়াকে কেউ ম্যানুপুলেট করতো। তার ব্রেইন ওয়াশ করা হতো। তবুও সে অপরাধী আমি জানি। তবে ফাঁ/সি/র আসামী তো নয়। যদি একদিনের জন্য ছাড়া পায় তবুও তাকে একটা সুযোগ দিন।
— তুমি পারতে? পারবে? আমার জীবনেও এক্সিডেন্ট আছে। তাকে আমি মুক্ত করে দিয়েছি তার প্রতি আমার কোনো অভিযোগ নেই। তবে আছে ঘৃণা। এই ঘৃণা কোনো কিছু দিয়ে রিমুভ করা যাবে? তাকে আরেকবার সুযোগ তো দূর তার মুখোমুখি হওয়ার ইচ্ছে আমার নেই। তুমি পারবে রাফিকে ক্ষমা করতে? নিজের জায়গায় না অন্যের জায়গায় দাঁড়িয়ে অন্যের বিষয়গুলো বিচার করো।
— সবার জীবনে কি সব দূর্ঘটনা সেইম এসপি সাহেব?
— দূর্ঘটনা সেইম না হলেও কিছু কিছু ঘটনার তিক্ততা এতো বেশী যে, প্রিয় মানুষটাও মন থেকে উঠে যায়। আর একবার মন থেকে উঠে গেলে সে জায়গায় সেকেন্ড টাইম তাকে বসানো যায় না।
— আপুদের বিষয়টা ভিন্ন।ওদের একটা বাচ্চাও আছে। ঐ বাচ্চার দিকে তাকিয়েও যদি…
— ইভা অনেক আগেই ডিভোর্স পেপারস সাইন করেছে সিনথি।
— ঐটা তো আর ইসলামিক দৃষ্টিতে ডিভোর্স হয় না। আপনি আপুর সাথে একবার আলোচনা করুন। আমার খুব অশান্তি লাগছে।
— সিনথি আমাকে ফোর্স কোরোনা।
–আপনি একবার তো জানান….
— কথা বারিওনা সিনথি, ঘুমাও।
— রাগ করছেন কেনো? আমি কি খুব খারাপ কিছু বলেছি? আমার ভাইয়া অনেক বড় অপরাধী। ক্ষমার অযোগ্য।তার একটা বাচ্চা আছে সে জানতোই না। জানার পর সে দূর্বল হয়ে পড়েছে। এটা কি আপুকে জানানো উচিত নয়। সে পাস্ট লাইফের মানুষের কাছে ফিরে যাক না যাক ঐটা তার পারসোনাল ম্যাটার। কিন্তু বাচ্চাটা আমার ভাইয়ের। সে মুক্তি পেয়ে যদি বাচ্চার দাবি করে? আপুর জীবনে আরেকবার ঝড় উঠবে। আমি তো মানতে পারছি না।
— ডোন্ট ওয়ারি। যখন আমি সিউর হবো বাচ্চা তোমার ভাইয়ের কাছে নিরাপদ। আমি নিজে দেখা করাতে নিয়ে যাবো।
— আমার আরেকটা প্রশ্ন আছে!
— বলে ফেলো….
— বাবা ফোন করে একটা কথা বললেন– আমার শ্বশুর বাবা কি জানেন আমি সম্রাট শাহজাহানের মেয়ে?
— নাহ।
— এই বিষয়টা তো ধোঁয়াসায় রয়ে গেছে এসপি সাহেব। শ্বশুর বাবা জানলে তো আমাকে মেনেই নিবে না।
–কেনো নিবে না?
— আমার বাবা বলেছেন সম্রাট শাহজাহানের সাথে আপনার বাবার একটা বড়সড় ঝামেলা ছিলো।এই বিষয়ে আমি কিছু জানতে চাই না। তবে রাফসান আমার ভাই, সম্রাট শাহজাহান আমার বাবা এটা জানার পর তাঁরা আমাকে আর ভালোবাসবে না। ইভাপু আমাকে আর আদর করবে না। সবাই দূরে ঠেলে দিবে!!
— দন্দ তোমার বাবার সাথে, ভাইয়ের সাথে। তোমার সাথে কি?
— আমি তাদের রক্ত। ওঁনারা কি বিশ্বাস করবে আমি অমন অপরাধী নই? সবাই দূরে ঠেলে দিবে আমাকে। আমি আপনাকে হারিয়ে ফেলবো! আমি বিশ্বাস করি আপনি অন্যায়ের সাথে নেই। তাহলে অপরাধ করেই আমার বাবা ভাই শাস্তি পেয়েছে এই বিষয়টা লজিক্যাল। সেই জায়গা থেকে আমি ভরসা পেয়েছি আপনাকে আকড়ে ধরেছি। আপনি কি আমাকে ভরসা করবেন, সবাই দূরে ঠেলে দিলেও আমাকে আকড়ে ধরবেন?
রং পর্ব ৪৯
— ইরফাদ যখন একবার তোমাকে বলেছে ভালোবাসে তাহলে হৃদয় উজার করেই ভালোবাসে। আর ভালো যখন বাসেই সকল প্রতিকূলতাকে উপেক্ষা করে যুদ্ধক্ষেত্রে টিকে থাকার ক্ষমতা সে রাখে। সো ডোন্ট প্যানিক।
ইরফাদের শীতল গলার হৃদয়স্পর্শী কথা হৃদয় ছুঁয়ে যায়। অন্ধকারাচ্ছন্ন কক্ষে ডুবে আদুরে বেড়ালের মতো ওম নিতে আসে বলিষ্ঠ বুকে। হৃদযন্ত্রের দূর্বার কম্পনে কান পেতে থাকে সে। ইরফাদর গলার স্বর আরও শীতল,
— তোমাকে আগলে রাখতে পুরো পৃথিবীর সাথে লড়বো আমি, তুমি শুধু ভালোবাসাটুকু দিও।