রং পর্ব ৫১

রং পর্ব ৫১
তন্নী তনু

বৃষ্টিভেজা ঠান্ডা আমেজে ডুবে আছে সকালের দৃশ‍্যপট। নামাজ শেষ করে উঠেছে ইভা। ঝিরিঝিরি বৃষ্টি বইছে এখনো। কালো মেঘে অন্ধকার ছড়িয়ে ডুবে আছে আকাশ। চারপাশটা অন্ধকারাচ্ছন্ন।বেলকনির গাছগুলো তুমুল বৃষ্টিতে নুইয়ে পড়েছে, ঝড়ে গেছে কিছু ফুল। বেলকনির সাদা টাইলস বৃষ্টির পানিতে ভেসে যাচ্ছে।বেলকনি থেকে ফুল গুলো ছোট ঝুড়িতে তুলে নিচ্ছে ইভা। গাঢ় নীল রঙের মাঝে মোমবাতির মতো প্রজ্জলিত আগুনের শিখার মতো অপরাজিতা ফুল যেনো জ্বলছে। ফুল গুলো তুলে নেয় ইভা। ফুটন্ত গরম পানিতে অপরাজিতা মিশিয়ে চা তৈরী করে কাচের স্বচ্ছ কাপে ঢেলে নেয়। অতঃপর বিছানায় কাঁথা জড়িয়ে গুটিশুটি মেরে জানালায় অদূরে তাকিয়ে গরম ধোঁয়া ওঠা চায়ে প্রগাঢ় চুমুক দেয় ইভা। বালিসের উপর অবহেলায় পড়ে থাকা ফোনটা এই নিয়ে তিনবার কেঁপে কেঁপে উঠলো। হাত বাড়িয়ে ফোনটা কাছে টেনে নেয় । ফোনের স্ক্রিনে ভাসছে “সাজিদ ভাই” নামক নামটি। ইনবক্সে যায় ইভা।
— ‘বৃষ্টির জলে ভেসে যাক তোমাক সমস্ত বিষণ্নতা, বিষণ্ন বিকেল, একাকিত্বের রাত। জরাজীর্ণ হৃদয়ে শুভ্র সকালের মতো ফুল ফুটুক, ঝড়ে যাক সমস্ত যন্ত্রণা। আমার হৃদয়ের রাণী “শুভ সকাল”।’

— পরীর ছানা” ঘুমাচ্ছে? আমার মিষ্টি ছানাটাকে গুড মর্ণিং বলে দিও।
— বিশ্বাস করো! যতোটা ভালো আমি তোমাকে বাসি ঠিক ততোটা যত্ন আমি টুম্পাকে করবো। তুমি একবার ভরসা করো।
আরেএএএ অনলাইনে থেকেও মেসেজ সিন করো না কেনো?
পরপর এতোগুলো মেসেজ পড়ে ইভা চায়ের কাপে আরেকবার চুমুক দেয়। অন‍্যহাতে কি-বোর্ডে টাইপ করে,
— টুম্পা ঘুমাচ্ছে।
— তুমি কি কখনোই আমার সাথে স্বেচ্ছায় কথা বলবে না?
ইভা দীর্ঘশ্বাস টানে। তারপর দ্রুত আঙুল চালিয়ে টাইপ করে,
— মন ভাঙা মানুষগুলো মনে হয় এমন ই হয় সাজিদ ভাই। একবার বিশ্বাস নষ্ট হলে, সে মানুষটা মনে হয় আর স্বাভাবিক হতে পারে না।
— তুমি কি আমাকে কখনোই ভালোবাসতে পারবে না ইভা?? শুধু নামমাত্র আমাকে বিয়ে করে কি হবে যদি ভালোই না বাসতে পারো!!

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

ইভা নিজের মনের সাথে তলিয়ে ভাবে, ক্ষণে ক্ষণে ছাড়ে দীর্ঘশ্বাস। ফোনটা নিজের চোখের সামনে থেকে সরিয়ে রাখে। হৃদয়ের ব‍্যাথা এখনো তাজা। এতো সহজ?? এতোই সহজ সব নতুন করে শুরু করা।সঠিক মানুষের ভালোবাসা নাকি অতীত মুছে দিতে পারে, কতোটুকু সত‍্য কথাটুকু? গুড়িগুড়ি বৃষ্টির পানে দৃষ্টি ফেলে তাকিয়ে থাকে ইভা!! কি করা উচিত? মেয়ের জন‍্য একজন মানুষকে কি মেনে নেওয়া উচিৎ। কিন্তু হৃদয়ে যে ব‍্যাথা বইয়ে বেড়ায় তা কি কখনো মুছবে? একটা মানুষ ফুলের মতো রঙিন জীবনটাকে আধারে ডুবিয়ে গেছে সেখান থেকে কি আলো দেখা সম্ভব? জীবনকে এতো সহজে দ্বিতীয় সুযোগ দেয়া যায়? সবাই পারে?

চোখ সরিয়ে নেয় ইভা। অতঃপর নিজের ভাইয়ের কথাগুলো স্বরণ করে। ইরফাদ নিজেও ঠকে যাওয়ার তালিকার একজন, তার হৃদয়ে যে ঝড় বয়ে গেছে তা কি তার জীবনের চেয়ে কম?বরং তার চেয়েও বেশী। সঠিক মানুষের ভালোবাসায় তার জীবনে রঙ ফিরেছে। একজনের জীবন থেকে অন‍্য জন কি অনুপ্রাণিত হয়? সবার জীবনে কি দ্বিতীয়বার সঠিক মানুষ আসে? দ্বিতীয়বার কি সবাই ভালোবাসতে পারে? মানব জীবন বড়ই অদ্ভুত। কেউ ভালোবাসা পেয়েও মর্যাদা দেয় না,কেউ চেয়েও পায় না। কিছু মানুষ ভুল করে, সেখান থেকে মুভ অন করে সহজেই। আবার কেউ কেউ থেমে যায় ভাঙা জায়গাতেই, আবার কারো কারো মুভ অন করার সুযোগ ই নেই। একজনের জীবন অপর জনের সাথে কখনোই মিলবে না। কতোটুকু ভুল করেছেন তার উপর ডিপেন্ড করে মুভ অন করাটা। আপনি ভুলের পথ ধরে যতো বেশী আগাবেন আপনার জন‍্যে ফিরে আসার পথ ততোই জটিল হবে। হয়েছেও তাই। ভুলটা এতোই বেশী যে জীবন মরণের সন্ধিক্ষণে সিদ্ধান্তহীনতায় ঝুলছে সে। না পারছে ফিরে আসতে না পারছে এগিয়ে যেতে। ভাবতে ভাবতে ভাবনার জগতে তলিয়ে যাওয়া ইভার তাল ফেরে ফোনের মৃদু কম্পনে। ফোনটা অনিচ্ছাকৃত ভাবে আরেকবার হাতে তোলে ইভা। অতঃপর,

–ইভা। ভালোবাসা নাকি ভালোরাখার ই অন‍্যরুপ। ভালোরাখার শক্তি আমার আছে। পৃথিবীর সবাইকে খারাপ মনে করোনা। সব পুরুষ যদি খারাপ ই হতো পৃথিবীতে এতো এতো নারী পুরুষদের ছায়াতলে থাকতো না। “আমার স্পর্শে, আমার উপস্থিতিতে তোমার চোখে ভয়, অসস্তি, চোখে জল দেখতে হয়, এই জীবনে এর চেয়ে ভারী কিছু হবে না। তবে এতোটুকু বলতে পারি, ওতোটুকুই আগলে রাখবো যতোটা আগলে রাখলে তুমি একঘুমে সকাল পাবে
ঠান্ডা হাওয়ায় উড়ে ওঠে ইভার চুল গুলো, ভেসে আসা দুঃখের ভেলায় করে ভাসতে থাকে ইভা! সুন্দর একটা সহজ জীবন হতো, ভালোবাসায় ভরপুর, ডাল-ভাত খেয়ে বেঁচে থাকা যেতো,ছোট্ট সংসার হতো, অপরপ্রান্তের মানুষটা ভালোবাসতো, আগলে রাখতো। এতো কঠিন জীবনে যে সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগতে ভুগতে পাজর ভেঙ্গে যায়। একাকী, নিরালায়, নিভৃতে ভাবতে গেলে যে ঝড় বয়ে যায়, সে ঝড়ের তান্ডবে হৃদয় ভেঙে ভেঙে একাকার হয়ে যায়। ভালোবাসা দেখতেও ভালোলাগে, অনুভব করতেও ভালোলাগে। কিন্তু ভাঙা মন নিয়ে ভালোবাসতে যে ভয় লাগে, আত্মবিশ্বাসের অভাববোধ হয়।

— ইভা!আজ বাসা থেকে আমার পরিবার তোমার বাসায় যাবে। সমাজটা তো জানো। তবুও আমি অনেক কষ্ট করে সব বুঝিয়ে মানিয়ে নিয়েছি। এমন কাজ কোরো না আমি আমার পরিবারের সামনে মাথা তুলে দাঁড়াতে না পারি।
গুড়ো বালির মতো বৃষ্টি যেনো এক ঝটকায় রূপ বদলে ঝড়ে পরিণত হয়। শেষ কথাটা চোখে পড়তেই ইভার বুকে তান্ডব শুরু হয় অবলিলায়। ধোয়াসার ধুম্রজাল ভেদ করে মনের কথাটা প্রস্ফুটিত হয় না, কখনো কখনো মুভ অন করাটা মৃত‍্যুর চেয়েও কঠিন হয়ে দাঁড়ায়। সবাই সহজেই মুভ অন করতে পারে না। দিধা দন্দের দেয়াল ভেঙে গুড়িয়ে দিয়ে বেড়িয়ে আসতে পারে না ইভা, ধোয়াসার ধুম্রজালে আটকা পড়ে তার হৃদয়। নতুন করে ভালোবাসা এতো সহজ নয়!! সবাই পারে না। ইভা আঙুল চালিয়ে লেখে,
— আমার দম বন্ধ হয়ে আসছে! আই নিড টাইম!

— ইভা!! কি বলছো? এই শেষ সময়ে এসে এভাবে গুটিয়ে নিওনা। তোমাকে নিয়ে অনেক স্বপ্ন। টুম্পা আমার কলিজার টুকরা। ওকে আমার কাছে থেকে কেড়ে নিও না। ও জন্মের পর থেকেই আমি ওর খুব কাছে থেকেছি। জন্ম দিলেই তো বাবা হওয়া যায় না। ও কাছে এলে মনে হয় ও আমার বাচ্চা। আমিই ওর বাবা। পৃথিবীতে এমন ঘটনা কি সত‍্যিই নেই? কোনো পুরুষ কি অন‍্যের বাচ্চাকে মেনে নেয় নি? ভালোবাসেনি? যদি নাও বেসে থাকে আমি পৃথিবীর বুকে লিখে যেতে চাই– জন্ম না দিয়েও বাবা হওয়া যায়।
ইভার বুকের পাজর ভার হয়ে আসে ক্রমেই। ফোনের কি-বোর্ডে টাইপ করে ইরফাদের নাম্বারে,
— ভাইয়া! তোমার সাথে একটা বিষয় ডিসকাস করার ছিলো।
জানালা দরজা বন্ধ, অন্ধকারাচ্ছন্ন চার দেয়াল। ইরফাদের বাহুডোরে ঘুমন্ত এলোকেশী মেয়ে বুকের উষ্ণ ওমে বেঘোরে ঘুমাচ্ছে। সাইড টেবিলে মৃদু আওয়াজে চোখ খুলে তাকায় ইরফাদ। অন্ধকার, ঠান্ডা আমেজে নকশি কাঁথা জড়ানো উষ্ণ ভালোবাসাটুকু বুকে জড়িয়ে এলোকেশী মায়ায় প্রগাঢ় চুমু বসিয়ে অতঃপর বুকের উষ্ণ আঁচ থেকে মুক্ত করে এলোকেশী মাথাটা। অতঃপর ইভার মেসেজে চোখ বুলিয়ে নেয়। তারপর আঙুলের দাপটে দ্রুত টাইপিং করে,

— আমার রুমে আয়। একমিনিটের মধ‍্যে।
বিছানার ওম ছেড়ে উঠে বসে ইরফাদ। ফোনে মেসেজ আসে,
— বউ উঠেছে?
–ঘুমায়!!
— তাহলে পরে যাবো!
— আবার পরে কিসের? ও সব জানে!! মানুষের সুখ, দুঃখ বোঝার মতোই মেয়ে “ও”, ইমোশোনাল।
–ঘুমের ডিসটার্ব হবে যে।
–আরে আয় তো!!
একমিনিট হওয়ার কয়েক সেকেন্ড পূর্বেই দরজায় কড়া নাড়ে। ইরফাদ ফোনের স্ক্রিন থেকে চোখ সরিয়ে নেয়।
– দরজা খোলা আছে।

ধীর পায়ে ঘুমন্ত বাচ্চাটাকে কাঁধে আগলে নিয়ে কক্ষে প্রবেশ করে ইভা। সাইড টেবিলের উপরে মৃদু আলোর লাইটটা অন করে দেয় ইরফাদ। নিজের সাইডে জায়গা করে দেয় ইরফাদ। ঘুমন্ত বাচ্চাটাকে কোলে তুলে কোমল আলিঙ্গনে বুকে নেয়, কাঁথা টেনে ঢেকে নেয় ইরফাদ। অতঃপর ধীর গলায় জিজ্ঞেস করে,
— কি হয়েছে!!
— তুমি কি সাজিদ ভাইয়ের সাথে কথা বলছো ভাইয়া?
–হুম!
— আমার মনে হয় আমার সময় দরকার ভাইয়া। খুব আপসেট লাগছে আমার।
— তুই সাজিদ এর সাথে কথা বলিস না? আমি যতটুকু জানি তোদের মধ‍্যে কথা হয়। কাল তো তোর কাছে মতামত নিয়েই কল দিলাম।

— ভাঙা হৃদয় কখনো জোড়া লাগে ভাইয়া? দ্বিতীয়বার কাউকে ভালোবাসা যায়?
— জীবন যদি ভুল পথে এগিয়ে ধ্বংসের মুখে পড়ে, ভুল মানুষকে ভালোবেসে বিষণ্নতার আধারে ডুবে যায়, যেখানে নিজের কোনো ভুল নেই, বিনা দোষে যদি কেউ ছেড়ে চলে যায় তাহলে প্রত‍্যেক মানুষের উচিত সঠিক মানুষের জন‍্য জীবনকে দ্বিতীয়বার সুযোগ দেয়া। যে মানুষটা তোকে মাঝ পথে ভেঙ্গেচুড়ে ফেলে দিয়ে গেলো, সে মানুষটা তো জানে তুই তাকে ছাড়া শূন‍্য,মাঝ পথে হাত ছেড়ে দিলে তোর জীবনে কেমন ঝড় উঠবে, কেমন তান্ডব চলবে সব জানে। সব জেনে বুঝে যে চলে গেলো। বিন্দু পরিমাণ অনুতপ্ত হলো না তার জন‍্য সারাজীবন কষ্ট বয়ে নেওয়ার শুধু শুধু মানেই হয় না।

— আর যদি কখনো অনুতপ্ত হয় ভাইয়া? জীবনের কোনো এক ক্ষণে যদি সে তার ভুল বুঝতে পারে?
— তুই কি রাফসানের অপেক্ষা করিস ইভা?
মায়াবী টানা টানা আখি পল্লবে ভীর করে অশ্রুকণারা, ইভা চোখ নামিয়ে ফেলে। গরম উষ্ণ জল টুপ করে পড়ে। ইভা কান্না জড়ানো গলায় বলে,
— খুব কঠিন একটা প্রশ্ন করি??
তুমি কি তোমার পাস্ট ভুলে গেছো? তার অপেক্ষা করেছো কখনো?

— No one’s life will match another’s.আমার প্রবলেম আর তোর প্রবলেম আলাদা। প্রত‍্যেকটা জীবনের প্রবলেম, গল্প, দূর্ঘটনা ভিন্ন। তাই ডিসিশন ও ভিন্ন হবে।আমার পাস্ট নিয়ে আক্ষেপ নেই, তার প্রতি অভিযোগ নেই। তার যে অপরাধ তাকে আমি ক্ষমা করে দিয়েছি। তবে তার ফেরার রাস্তা বন্ধ। পৃথিবীর সব তোলপাড় করেও যদি সে ব‍্যাক করতে চায় তার জন‍্য বিন্দু পরিমাণ জায়গা আমার কাছে নেই।
— তাহলে আমার কি করা উচিত ভাইয়া?
— যেখানে তুমি ভালো থাকবে,জীবনকে উপভোগ করবে, প্রাণোচ্ছল থাকবে তুমি সেদিকেই যাবে।
— ভালো মনে করেই তো একজন কে একসেপ্ট করলাম। সে তো জীবন শেষ করে চলে গেলো।
— তখন ছোট ছিলে, এতোটাও বোঝার বয়স ছিলো না। এখন তুমি ম‍্যাচিউর। ভালো মন্দ তুমি বোঝ। কোনটাতে তোমার লাইফ রিস্ক, কোনটা তোমার জন‍্য ভালো তুমি এখন বোঝ।
— আমি তো বুঝতে পারছি না ভাইয়া। পৃথিবীর সকল মানুষের সাথে আমার প্রবলেম তো মিলবে না। আজ সাজিদ”কে গ্রহণ করলে যদি রাফসান কখনো ফিরে আসে। আমার বাচ্চার দাবী করে। আমার জীবন তো পূণরায় যতটুকু বাদ আছে ততোটুকুও ভেঙ্গে যাবে।

— তুমি রাফসানকে এখনো ভালোবাসো?
— আমি কিছু বুঝতে পারিনা ভাইয়া। আমার শুধু শ্বাস ফুরিয়ে আসে।
— সে সৎ পথে ফিরলে তুমি তার সমস্ত অন‍্যায় ক্ষমা করে দেবে? সব ভুলে যাবে?
— ক্ষমা করার মালিক উপরওয়ালা। তবে তার দেয়া কষ্ট আমার শিরায় শিরায় ঢুকে আছে।
–তাহলে?
— আমি দোটানায় ভুগছি। ঐজন‍্যেই তো তোমার কাছে এলাম। তুমি বলো আমার কি করা উচিত।
— আমি সাজিদ, রাফসান কাউকে ইন্ডিকেড করে কোনো কথা বলবো না। লাইফ আমার ডিসিশন আমার। আমার জীবনে প্রতারকের সেকেন্ড চাঞ্চ নেই। আমার বোনের জীবনেও আমি অবশ‍্যেই এসব এলাও করবো না।
দুজনের মধ‍্যে পিনপতন নিরবতা ভেঙ্গে উঠে বসে সিনথিয়া,দুজনের মুখ পানে চেয়ে চুপচাপ বসে থাকে কিছুক্ষণ। অতঃপর নিরবতা ভেঙ্গে সিনথিয়া বলে,

— আপু কেঁদোনা। ভালো থাকার জন‍্য তোমার মন যা বলে তুমি তাই করো।
ইভা চোখের পানি মুছে ধীর গলায় বলে,
— তার প্রতি আমার ঘৃণা ছাড়া কিছুই নেই। তবুও ভালোবেসেছিলাম তো। আফসোস রয়ে গেছে। একবার কষ্ট দিয়েছি বাবাকে, ভাইয়া তোমাকে। আর এমন ভুল আমি করতে চাইনা।
ইরফাদ টুম্পার মাথায় হাত বুলানোর ফাঁকে ফাঁকে কথা বলে,
— কাল তোকে জিজ্ঞেস করেছি, তোর সম্মতিতেই সাজিদকে কল করা হয়েছে।এই মূহুর্তে এসে তুমি এসব বলছো? তার ফ‍্যামিলি আছে। যাকে ভালোবাসতে পারবে না, তার সাথে ভেবে চিন্তে কথা বলা উচিত। এই কাজটা কোনো ভাবেই একসেপ্টেড না ইভা।
পুরো বিষয়টা তলিয়ে ভাবে। কখনো কখনো সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগে ঠিক ভুল বিচার করা কঠিন হয়ে যায়। এখন কি হবে?জোরপূর্বক বিয়ে করলে সে পাগল হয়ে যাবে। চিন্তারা মাথায় ভীর করে। রক্তচক্ষু তে টুপ টুপ করে পড়ে কান্নার উষ্ণ জল। ভাঙা গলায় হু হু করে কেঁদে ওঠে ইভা,

— এখন কি করবো আমি!!
সব খুব কঠিন লাগছে ভাইয়া।
পরিস্থিতি বুঝে ইরফাদ উঁচু গলাটা নামিয়ে ধীর গলায় বলে,
–কুল কুল!
ইভার আখিপল্লবে অশ্রুর বন‍্যা, উপচে পড়া কান্না দেখে সিনথিয়ার ঘন আঁখিযুগলে অশ্রুকণারা ভীর জমায়। আপনজনের কষ্ট দেখলে নিজের হৃদয়েও সেই কষ্ট কড়া নাড়ে। ইভার কষ্ট দেখে হৃদয় যে হু হু করে উঠছে। ইরফাদ এর কঠিন হৃদয় কখনো কখনো নরম হয়ে যায়। আপন জনের কান্নায় কখনো কখনো সে ইস্পাত কঠিন তবে ভুল মানুষের জন‍্যে অশ্রুবিসর্জন সে কখনোই সাপোর্ট করে না। তবে যখন মানুষ সিদ্ধান্তহীনতায় ভোগে তখন কঠিন হয়ে পরিস্থিতি সামাল দিতে হয় না, তখন বন্ধুসুলভ আচরণ করতে হয়। এই মূহুর্তে ইভা যদি ভুল মানুষের স্মৃতিচারণ করে কাঁদতো তাহলে ইরফাদের আচরণ হতো ইস্পাত কঠিন। তবে বোন যে বিষণ্নতায় ভুগছে। তাই এই মূহুর্তে তার আচরণ বন্ধুসুলভ। ইরফাদ নরম গলায় বলে,

— টাইম নাও। নিজের সাথে বোঝ! তোমার মনের উপর কোনো প্রেশার দিবে না।
–আমার বাচ্চা”টার কি দোষ বলো। আমার বাচ্চাটা কেনো বাবাকে পেলো না ভাইয়া।
দুঃখের ভেলায় ভাসতে থাকা ইভার কোমল হৃদয় হু হু করে থাকে। অসহনীয় যন্ত্রণায় ছটফট করতে থাকা ইভা তরপাতে থাকে। ইরফাদ আবারো ধীর গলায় বলে,
— পৃথিবীতে সবাই সব পায় না। পৃথিবীতে কিছু প্রশ্নের উত্তর তুমি কখনো পাবেনা। তাই উত্তরহীন প্রশ্ন গুলো তুমি ভুলে যাও।

— কি করে ভুলবো!বিনা অপরাধে আমার বাচ্চা”টা কষ্ট পায় ভাইয়া। প্রতিটা দিন, প্রতিটা মুহূর্তে, প্রতিটা সেকেন্ডে কেনো শাস্তি পেতে হয় আমাকে। একাডেমির বাচ্চা”রা আমার টুম্পার সাথে খেলেনা। টুম্পার বাবা আমাকে ছেড়ে চলে গেছে বলে,ওরা আমার বাচ্চাটাকে ছাড় দেয় না, আমার এই ছোট বাচ্চাটাকেও না। দুরন্ত টুম্পা আজকাল মনমরা থাকে, কথা বলেনা ভাইয়া।
ঠান্ডা মাথাটা ক্রমেই গরম হয়ে উঠছে ইরফাদের। কান থেকে ধোয়া উঠছে। অসুস্থ সমাজ ব‍্যবস্থায় অসুস্থ মস্তিষ্কের কাজ দেখতে দেখতে সে নিজেও ক্লান্ত। ইরফাদ দাঁতে দাঁত চেপে বলে,

— আগে বলোনি কেনো?
— কয়জন কে তুমি বোঝাবে ভাইয়া? কয়জনকে থামাবে!! আমার ভেতরটা যে জ্বলে যায়। আমার ছোট্ট বাচ্চাকে ওরা ছাড় দেয় না। বাচ্চাদের মা, বাবা চায় না তাদের বাচ্চা আমার টুম্পার সাথে মিশুক। এই বাচ্চাটার কি দোষ!! এই সমাজ কেনো বোঝে না আমার কোনো অপরাধ ছিলো না, আমার টুম্পার কোনো দোষ নেই।
চিরকাল নিরবে চোখের জল ফেলা মেয়েটা খোলস ছেড়ে আজ বৃষ্টির ধারার মতো অবিরাম কাঁদছে। চোখের সামনে সবচেয়ে আদরের বোনকে এভাবে ভাঙতে দেখা একজন ভাইয়ের হৃদয়ের জন‍্য খুব কঠিন বিষয়। ইভা ঢুকরে বলে ওঠে,

— আমার হৃদয় ছাড়খাড়! এইটুকু দুঃখ প্রকাশ করার জায়গা নেই আমার। আমার দুঃখ কেবল আমার হৃদয়ে রক্তক্ষরণ বাকি সকলের কাছে শুধুই গল্প। এই গল্প বয়ে বেড়াতে আমি আর পারছি না। ফ্রেন্ড সারকেল কেউ যোগাযোগ করে না, আমার সাথে কোথাও যাওয়া যায় না, আমাকে আনন্দ উল্লাসে নেয়া যায় না, আমাকে কোথাও নেয়া যায় না, আমার এই পৃথিবীতে কোথাও একটুকরো জায়গা নেই, কোথাও না। আমি ছাদে যেতে পারি না, কারো সাথে কথা বলতে যেতে পারিনা। এই পৃথিবীতে ডিভোর্সীদের কেউ নেই, কোথাও কেউ নেই। আমার জীবন নিয়ে আমার কোনো আফসোস নেই ভাইয়া। কিন্তু আমার টুম্পা! ওর কোনো দোষ নেই। এই পৃথিবীকে আমি কি করে বোঝাই, আমার বাচ্চাটা নির্দোষ, বাচ্চাদের পাপ থাকে না। বাচ্চাদের কোনো ভুল থাকে না। ঐদিন একাডেমিতে গিয়ে আমার ভেতর পুড়ে ছাই হয়ে গেছে, ওরা আমাকে জ্বলন্ত আগুনে পুড়িয়েছে। এই দগ্ধ হৃদয়ের ঘাঁ আমার শুকায় না।এই পৃথিবীতে কেউ বোঝে না! বিনা অপরাধের শাস্তি পেতে পেতে আমি খুব ক্লান্ত হয়ে গেছি।

কথাগুলো শুনতে শুনতে সিনথিয়ার চোখ দুটো পানিতে ভিজে ওঠে, দুহাতে ঢেকে ফেলে তার মুখ। ইভার কান্না তার ভেতরটা এফোঁড়ওফোঁড় করে দিচ্ছে। দুজনের কান্নার মাঝামাঝিতে বসে আছে ইরফাদ। ইস্পাতকঠিন চোখ দুটি শুধু রক্তলাল আভা ছড়াচ্ছে। ইরফাদ ডান হাতে ইভার মাথায় হাত বুলায়। আর ধীর গলায় বলে,
— নিজের যন্ত্রণা নিজেকেই বয়ে বেড়াতে হয়, এর কোনো প্রকাশ নেই, নেই ভাগ করার উপায়। যদি ভাগ নেওয়াই যেতো তাহলে আমার বোন প্রতিদিন জানালায় দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কাঁদে,এটা জেনেও চুপ থাকতাম না। তোর সমস্ত যন্ত্রণা আমি নিয়ে নিতাম।
কঠিন মানুষটার হৃদয় যে কতো নমনীয়,কতো কোমল তা ইভা জানে। ভাইয়ের মুখে এহেম কথায় কান্নার তোড় বাড়ে। কান্না জড়ানো গলায় বলে,
–আমি কি করবো ভাইয়া! প্রতিটা নির্ঘুম রাত, আর পারিপাশ্বিক প্রেশারে আমি খুব হাঁপিয়ে গেছি। একঘুমে আমার আর সকাল হয় না, আমার জীবন অন্ধকারে তলিয়ে গেছে। আলো ঝলমলে দিন গুলো আমার জীবনে আধার নিয়ে আসে। জীবনে এইটুকু সস্তি পাইনি। আমাকে কি শুধু কাঁদতেই হবে সারাজীবন!আমি কি কখনো হাসতে পারবো না ভাইয়া?

বোনের এহেম কথায় বুকের পাজর ভেঙ্গে যেতে চায়। ইস্পাতকঠিন হৃদয় দুলে ওঠে। একবাহুডোরে বোনকে আগলে নেয় ইরফাদ। ভাই নামক শান্তির ছায়াতলে ইভা ছোট্ট বাচ্চার মতো মাথা ঠেকায়। হাত বুলিয়ে দেয় ইরফাদ। ছেড়ে রাখা চুলভর্তী মাথায় ছোট্ট করে হামি দেয় ইরফাদ। অতঃপর ধীর গলায় বলে,
— জীবনকে আরেকটা সুযোগ দাও! জীবনে অনেক স্ট্রাগল করেছো তুমি। অনেক টা কঠিন পথ তুমি পেরিয়ে এসেছো। এখন তোমার মুক্তির সময়, স্বাধীন হওয়ার সময়। এতো সহজে ভেঙ্গে পড়ার মেয়ে তুমি নও।
–জীবন কখনো কখনো এমন জায়গায় দাঁড় করায়, পেছনেও ফেরা যায় না,সামনে আগানো যায় না, আবার মাঝামাঝি তেও থাকা যায় না। জীবনের হিসেব কখনো কখনো এতই ভয়ংকর রূপ নেয়, জীবনের প্রতিটা সেকেন্ড বুঝিয়ে দেয় একটা ভুল ডিসিশন জীবন ধ্বংসের জন‍্যে যতেষ্ঠ। একটা মারাত্মক ভুল ডিসিশনের পর চোখের জল শুকিয়ে গেলেও জীবনের অংক আর মেলে না। কিছু কিছু ভুলের সংশোধন নেই, ফেরার রাস্তা নেই, শোধরানোর উপায় নেই,। কিছু কিছু ভুল শুধু জ্বালিয়ে, পুড়িয়ে সব ছারখার করে দেয়।

–জানি আমি।
–ভাইয়া!
–বল
— একটা মানুষকে নিজের চেয়েও বিশ্বাস করলাম,ভালোবাসলাম,ভরসা করলাম। সে এতোটাই আশ্বাস দিলো, শেলটার দিলো,ভালোবাসা দিলো সব দিলো। বন্ধু বান্ধব জানলো– আমরা “মেইড ফর ইচ আদার।” তার পারসোনালিটি চোখে পড়ার মতো, কোটিতে একজন, জাতীর ক্রাশ।তার হাত ধরে ঘর ছাড়লাম, বাড়ি ছাড়লাম, পরিবার ছাড়লাম, সব ছাড়লাম। অতঃপর সবচেয়ে বিশ্বস্ত মানুষটির হাতে হাত রেখে পৃথিবীর সব উপেক্ষা করে চলে গেলাম।তারপর দেখলাম পুরো নতুন দুনিয়া। সবচেয়ে প‍্যাম্পার করা মানুষটি আর প‍্যাম্পার করলো না, ভালোবাসলোনা, আগলে রাখলোনা।

হঠাৎ একদিন ঘুম থেকে উঠে দেখলাম সে নেই, দিন শেষে আর ফিরলো না। আমার কাছে টাকা নেই, ঘরে খাবার নেই, বাসায় থাকার মতো ভাড়া নেই। বাড়ি ফিরবো? কাছে ফোনটাও নেই। বাসায় ফেরার রাস্তাও চেনা নেই, জব করবো? লবিং নেই। এই বিশাল পৃথিবীতে ঐদিন বুঝেছি আমার জন‍্যে এইটুকু জায়গা কোথাও নেই কোথাও না। একটা রাত কাটানোর মতো মাথার উপর একটু খানি ছাদও নেই। ঐদিন বুঝেছি ভুল ডিসিশন কি জিনিস। কখনো কখনো টিকে থাকাটাও খুব কঠিন হয়ে যায়। জীবন মরনের সন্ধিক্ষণে ঝুলতে থাকা জীবনটা বুঝিয়ে দেয়– একটা ভুল ডিসিশন,ভুল চয়েজ, ভুল লাইফ পার্টনার জীবনের সমস্ত রং বিলীন করার জন‍্য যতেষ্ঠ। হাতে কিচ্ছু থাকে না। অতঃপর আমার রঙিন, প্রাণোচ্ছল, শুভ্র জীবনটা ডুবে গেলো প্রগাঢ় অন্ধকারে…….. সেখানে শুধুই চোখের জল, শুধুই চোখের জল…..

— বি স্ট্রং। ভেঙ্গে পড়লে চলবে না। হেরে গেলেও চলবে না।
— আমার যে খুব ভয় করছে ভাইয়া। তাকেও তো ভালো ভেবেছিলাম। পুরো দেশ জানতো সে অনেস্ট, পোলাইট। তাহলে কেনো জীবনটা এমন হলো। যদি আরেকবার এমন হয় আমি আর উঠে দাঁড়াতে পারবো না।
— আল্লাহ্ সুবাহানা তায়ালা”র উপর ভরসা রাখো। আমাদের প্ল‍্যানের বাইরে তাঁর একটা প্ল‍্যান আছে। তিনি একসময় তোমাকে এতোটাই খুশি করবেন যা তুমি কখনো কল্পনাও করোনি। তিনি কখনো নিরাশ করেন না।

রং পর্ব ৫০

তুমি চোখ বন্ধ করে, ঠান্ডা মাথায় সিদ্ধান্ত নাও। আমি আছিতো! জীবনে জটিল পথ যদি আরেকবার আসে, ভাইয়া আছি না! আমি সমস্ত কঠিন পথে, সমস্ত অমসৃণ, অসমতল, আঁকাবাঁকা পথে আমি সবসময় তোমার পাশে থাকবো। যে কঠিন পথ রক্তাক্ত হৃদয় নিয়ে তুমি পার হয়ে এখনো সারভাইব করে আছো,তুমি বাকিটা পথ চলতে পারবে। আর ভাইয়া তো আছেই। আই অলওয়েজ দেয়ার ফর ইউ সোনা। আই অলওয়েজ দেয়ার ফর ইউ…..

রং পর্ব ৫১ (২)