পূর্ণিমায় বিলীন চন্দ্র পর্ব ১০

পূর্ণিমায় বিলীন চন্দ্র পর্ব ১০
সাদিয়া আক্তার

রাত আটটা বাজে চন্দ্র তড়িঘড়ি করে বাসার মেইন গেট খুলতেই ড্রয়িং রুমে বাবা চাচাদের বসা দেখতে পায়।
কামরুল সাহেবরা কেউ আজ আর গ্রামে ফিরে যায় নি। পারভেজ সাহেব পুনম নিশাকে নিয়ে চলে গেছে রোজিনা বেগম বাসায় একা দেখে।
মিরাজ সাহেব কাল চলে যাবেন চট্টগ্রামের উদ্দেশ্যে তার কর্মস্থল সেখানেই।
ড্রয়িং রুমে গম্ভীর কামরুল সাহেবকে দেখে এগিয়ে যায় চন্দ্র। তার সামনে দাড়িয়ে জিজ্ঞাসা করে — কি হয়েছে বাবা??
চন্দ্রর কথা শেষ হতে দেরী কামরুল সাহেবের থাপ্পড় মারতে দেরী নেই। রক্ত চোক্ষু নিয়ে গালে হাত দিয়ে তাকিয়ে থাকে বাবার দিকে

— কি হয়েছে তুমি জানো না বাড়িতে থাকতে আমি তোমাকে প্রথম দিনেই সাবধান করেছিলাম তারপরও কেন নিশার হাতে তুমি এরকম করেছ??
— নিশা আমার গালে হাত দিয়েছিল তোমরা সবাই জানো আমি নিজের গায়ে কারো ছোঁয়া মেনে নিতে পারিনা।
— তাই বলে মেয়েটার হাতের এই অবস্থা করবে। আমি তোমাকে সাবধান করছি চন্দ্র তুমি যদি এরকমই বেপরোয়া থাকো আমি তোমার থেকে পুনমকে সরাতে বাধ‍্য হবো পারভেজকে দিয়ে পুনমকে অন‍্য জায়গাই সরাতে বাধ‍্য হবো।।।
কামরুল সাহেবের কথা শেষ হতেই গ্লাস ভাঙ্গার ঝনঝন আওয়াজে ড্রয়িং রুমে উপস্থিত সবাই কেপে ওঠে।

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

— এই বাবা তোমরা জানো না পুনম আমার জন‍্য কি?? হ‍্যা তুমি এই কথাটা কিভাবে বলতে পারলা বলো তো।। আমি আমি পুনম বিহীন নিশ্চিন্ন সেটা তোমরা জানো না,,
বলতে বলতে ড্রয়িং রুমের এদিক ওদিক পায়চারি করছে আর নিজের চুল খামচে ধরছে। চাদনী বেগম নিপা বেগম চন্দ্রের এই রূপ দেখে আচল মুখে গুজে কেদেঁ দেয়।
কামরুল সাহেব ইশারা করতে শিহাব রিশান এসে চন্দ্রের ঘাড়ে ইনজেকশন পুশ করতে চন্দ্র শিহাবের দিকে তাকিয়ে ঢলে পড়ে।

শিহাব রিশান মিলে চন্দ্রকে ধরে তার ঘরে শুয়িয়ে দেয়। কামরুল সাহেব ধপ করে বসে পড়ে সোফায়। মিরাজ সাহেব সেদিকে একবার তাকিয়ে বলল — আমি বলি কি ভাইজান পারভেজ ভাইকে একবার সব বলেই দেখেন চন্দ্রকে পারভেজ ভাই অনেক ভালোবাসে সব জেনে অমত করবে না। কত দিন তাদের থেকে লুকিয়ে রাখবেন।
— কি বলব মিরাজ এইটা বলব যে আমার ছেলের ওসিডি আছে আমার ছেলে মা বোন আর পুনম বিহীন কোনো নারী সহ‍্য করতে পারে না নাকি এটা বলব যে সে একসময় ড্রাগ অ‍্যাডিক্টেড ছিলো??
।। থেমে আবার বললেন — একটা মাত্র ছেলে আমার কি হাল হয়েছিল সেটা আমিই জানি এক মাত্র পুনমের উছিলায় ভালো আছে বর্তমানে। পারভেজ জানলে সেই ভালো থাকাটাও কেড়ে নিয়ে যাবে

— এভাবে আর কতো দিন??
— যতদিন পারি।।
আর কেউ কোনো কথা বলল না মুক্তি ঘরে বসে ভাইয়ের জন‍্য কাদছে। তার পাশে ঝিনুক ও রিমিও কাদছে। শিহাব রিশান চন্দ্রের পাশে বসে আছে। ঘুমের ঘরেও উঠে কোথাও চলে যেতে পারে এই ছেলে।
— চন্দ্র ভাই,,,,,
রাইয়‍্যান দৌড়ে চন্দ্রের ঘরে যেতে নিলে তাকে থামায় নিপা বেগম।
— বাবা চন্দ্র ভাই এখন ঘুমাচ্ছে সে অসুস্থ তো তাই তাকে ডিসটার্ব করা যাবে না।
রাইয়‍্যান মাথা নাড়িয়ে আবার তার আপ্পির কাছে চলে যায়।

পারভেজ সাহেবকে একা আসতে দেখে রোজিনা বেগম থমকে যায়।
— রুপশা আর জামাই আসেনি??
রোজিনা বেগমের প্রশ্নে পারভেজ সাহেব তাচ্ছিল্য হেসে বলল — বড়লোক ঘরে বিয়ে দিয়েছ তারা কি এই গরীবের বাড়িতে পা দিবে। পরোক্ষনেই আবার গম্ভীর স্বরে বলল — জামাই আসতে পারবে না,, সে কাল কক্সবাজার যাবে রুপশাকে নিয়ে।
রোজিনা বেগমের চোখে মুখে আধার নামে নিশা দৌড়ে এসে কত কথা বলে বড় আপার শশুর বাড়ির সেগুলো কানে যায় না রোজিনা বেগমের। যেতো কক্সবাজার তারা না করত নাকি তবে একটা দিন মেয়েটাকে এখানে নিয়ে আসতো পরে যেতো।
পরেই মাথায় চিন্তা আসে সে কি ভুল করল নাকি মেয়ে এখানে বিয়ে দিয়ে,,,??
মাথায় নানান চিন্তা আসলেও তা ঝেড়ে ফেলে রোজিনা রাতের খাবারের আয়োজন করে হালকা পাতলা।
পুনম এসেই সবার আগে ঘরে ঢুকেছে। ড্রেস চেঞ্জ করে বাইরে বের হয় রান্নাঘরে উকি দিয়ে দেখে রোজিনা বেগম উদাসীন ভঙ্গিতে কিছু ভাবছে আর রান্না করছে,,,;

— আম্মু আমি সাহায্য করি তোমার তো হাতে ব‍্যাথা,,,
পুনমের কথায় ধ‍্যান ভাঙ্গে রোজিনা বেগমের সে বিরক্ত হলেও কিছু বলল না। পুনম নিরবতা সম্মতি ভেবে পাশে বসে এটা সেটা এগিয়ে দেয়। মনোযোগ দিয়ে রান্না দেখে।
— আম্মু আম্মু রুপশা আপুর মোবাইলটা কোই???
নিশার চিল্লাচিল্লিতে আরো বিরক্ত হয় রোজিনা। নিশার দিকে তাকিয়ে গম্ভীর স্বরে বলল — কেনো ওর মোবাইল দিয়ে তুমি কি করবা??
— রুপশা আপু ওর মোবাইলটা আমারে নিতে বলছে ওরে দুলাভাই নতুন মোবাইল কিনে দিব।।
— ঐটা এখন তোমারে দেয়া যাবে না আপাতত আমার কাছেই থাক পুনম এসএসসি পরীক্ষা দিলে ওরে দিব,,
মায়ের গম্ভীর স্বরে নিশা কিছু বলল না তবে পুনমের দিকে রাগী চোখে তাকিয়ে চলে যায়। পুনম নিশার ঔদ্ধত‍্য দেখে ভরকে যায়। এই মেয়েটা বয়সের আগে পেকে গেছে একে এখন সামলানোর দরকার ।

রাত এগারোটা ড্রেসিং টেবিলের সামনে বসে হাত মুখে ময়শ্চরাইজার লাগাচ্ছিল রূপশা তখন ঘরে ঢোকে লিমন।
রূপশা সেদিকে একপল তাকিয়ে আবার নিজের কাজ করতে থাকে। লিমন সেদিকে দেখে চলে যায় ওয়াশরুমে। খানিকক্ষণ পর বের হয়ে রুপশার পিছন বরাবর দেয়ালে হ‍্যালান দিয়ে বলল — এগুলো মেখে লাভ কি সেই একটু পরতো উঠেই যাবে,,,,
লিমনের কথার মানে বুঝতে পেরে রূপশা আড়চোখে সেদিকে তাকায়। রুপশাকে আড়চোখে তাকাতে দেখে হাসে লিমন। হেসেই বলে — আমার বউটা কি রাগ করেছে?? বাপের বাড়ী যেতে দেইনি বলে।
লিমনের কথা শুনে রুপশা ফুপিয়ে ওঠে। এই লিমনকে তার অচেনা ফোনে মিষ্টি মিষ্টি কথা বলা লিমন না ইনি। রাপশার কেনো জানি মনে হচ্ছে যে এতোদিন যার আদুরে কথায় গা ভাসিয়েছে লিমন সে না। এই লিমন গম্ভীর কেমন জানি কথার ধাত।
লিমনের আদুরে ছোঁয়ায় ঘোর ভাঙ্গে রুপশার।

— আজ বাবার বাসায় গিয়ে কাল চলে আসতাম তাহলেই হতো,,,;
— উহু আমার হতো না
রুপশাতে মত্ত্ব থেকেই বলল লিমন। রুপশা আবার কিছু বলতে যাবে লিমন নিজস্ব ভঙ্গিতে চুপ করিয়ে দেয়। মিনিট খানিকক্ষণ পর ছেড়ে গম্ভীর স্বরে বলে — আমার কথার বিপরীতে যাওয়ার চেষ্টা করবে না। তাহলে ফলাফল ভালো হবে না।
রুপশা ভয় পায়। ভীতু চোখে তাকাতেই লিমন চোখের পাতায় চুমু খায়। আলগোছে নিজের আধিপত্য বিস্তার করে রুপশার তনুতে।
অন্ধকারের রুপশার চোখে এক ফোটা জল পড়ে এ কোথায় পড়ল সে।
এরকম বন্দী জীবন রূপশার কোনোকালে পছন্দ ছিলো না। বাবার বাড়িতে স্বাধীন ভাবেই চলাফেরা করেছে । আর রুপশা এখানে একেকটা কদম মনে হয় লিমনের অনুমতি নিয়ে দিতে হয় রুপশার। এই দুইদিনেই রূপশার অসহ‍্য হয়ে গেছে বাকী জীবন সে কিভাবে কাটাবে ভেবে পায় না।।

অন্ধকার রাত পেরিয়ে স্নিগ্ধ সকালের আনাগোনা। আজ বুঝি একটু বেশীই শীত পড়েছে। সকাল সকাল বাবার ফোন থেকে পুনম চাচা চাচীদের ফোন দিয়েছে।
চন্দ্রদের বাড়িতে রাতে কেউ ঘুমাতে পারেননি। সবাই চিন্তিত ছিলো। তাদের বংশের বড় ছেলে চন্দ্র। ছেলের সংখ‍্যা মাত্র দুইজন। রাইয়‍্যান,, চন্দ্র।
এদের তিন ভাই অনেক ভালোবাসে,,। তবে তিন ভাইয়ের কাছে মেয়েরাও সমান ভালোবাসার ভাগিদার। বাবাদের কাছে চন্দ্র রাইয়‍্যান একটু বেশী শাষন পেয়েছে ।। মেয়েদের মধ‍্যে সবচাইতে বেশী আদর পায় পুনম সেই পুনমের কল সকাল সকাল পেয়ে সবার মন পুলকিত হলো।
— আসসালামু আলাইকুম বড় চাচা কেমন আছেন। চাচী কই ছোট চাচা কই ছোট চাচী কই আপু কই ঝিনুক রিমি কই??? সবাই কেমন আছে??

— আস্তে আম্মা আস্তে,,, সবাই এখানে আছে ভালো আছে। তোমার চাচীরা রান্নাঘরে আর সবাই ঘুমায়।
— ওও আমি মনে হয় ডিসটার্ব করলাম??
পুনমের কথা শুনে মিরাজ সাহেব ফোন নিয়ে বলেন — আমার আম্মার ফোনে আমরা কখনও ডিসটার্ব ফিল করি না,,
মিরাজ সাহেবের কথা শুনে পুনম খিলখিল করে হাসে। পিছন থেকে রোজিনা ঝাড়ি দিতেই মুখ গোমড়া করে চুপ বনে যায়। মিরাজ সাহেব মোবাইলের স্ক্রিনে রোজিনা বেগমের দিকে বিরক্তি নিয়ে তাকিয়ে বলল — আমাদের আম্মার ঠোঁটে এরকম হাসি মানায়। নিজের মতো হাসবে কে কি বলল শুনবে না।
পুনম মুচকি হাসে। পারভেজ সাহেব স্ত্রীর দিকে চোখ রাঙিয়ে তাকায়। পুনম একে একে সবার সাথে কথা বলে
মুক্তি কথা বলতে বলতে রান্নাঘরের ফোন মায়ের কাছে নিয়ে যায়।
— আসসালামু আলাইকুম বড় চাচী,, ছোট চাচী।
চাদনী বেগম নিপা বেগম একসাথে উত্তর নেয়। বেশ কিছুক্ষণ কথা বলে ফোন রাখে ততক্ষণে চন্দ্র ঝিমাতে ঝিমাতে ড্রয়িং রুমে পৌছায়। সবাই চন্দ্রের দিকে তাকায়।
চন্দ্র চোখ বন্ধ রেখেই বলল — পুনম কল দিয়েছিল??

— হ‍্যা
— আমি কথা বলব আবার কল দাও,,,,
কামরুল সাহেব গম্ভীর স্বরে বললেন — যতদিন না তোমার পড়াশোনা শেষ না করে কিছু করছ পুনমের সাথে কোনো কথা বলবে না তুমি এবং কোনো যোগাযোগ রাখবে না।
বাবার কথা শুনে চন্দ্র তড়াক করে চোখ খুলে।। উত্তেজিত হয়ে বলে — এটা কেমন কথা বাবা?? আমি তোমাদের কথা মানতে রাজী না।।
— ঠিকাছে তাহলে আমি পারভেজকে বলে দেই তোমার সত‍্যতা।
চন্দ্রের চেহারা চুপসে যায়। পরোক্ষনেই ঠোট বাকিয়ে হেসে বলল — তোমরা আটকাতে পারবে আমাকে??
চন্দ্রের কথায় আবারও বাপ ছেলের তর্কাতর্কি লাগবে লাগবে ভাব তখনই আবারও কল আসে পারভেজ সাহেবের। এবার হোয়াটস অ‍্যাপে তখনই কামরুল সাহেব চুপ হয়ে কল রিসিভ করে।

— উফফ বড় চাচা আমি জিজ্ঞাসা করতেই ভুলে গেছি
একটা টিশার্ট দেখিয়ে বলল — দেখোতো এটা চন্দ্র ভাইয়ের কি না,,,
কামরুল সাহেব আড়চোখে চন্দ্রের দিকে তাকিয়ে ফোন ফিরায়। স্ক্রিনে চন্দ্রকে দেখে ভরকে যায় পুনম সালাম দেয়।
— ওয়ালাইকুম আসসালাম কি বলছিলি বল,,,
টিশার্ট দেখিয়ে বলল — এটা কি আপনার??
— হ‍্যা ধুয়ে যত্ন করে রাখবি যদি একটুও নষ্ট হয় তাহলে তোর খবর আছে বলে দিলাম।
— আচ্ছা

পূর্ণিমায় বিলীন চন্দ্র পর্ব ৯

বলেই পুনম দ্রুত কল কাটে। চন্দ্র বাবার দিকে তাকিয়ে বলল — আমি তোমাদের সব কথা মানলাম। এবং ঐ পাগলের ডাক্তারের কাছেও যাব তবে আমার শর্ত আছে।
চন্দ্রের কথা শুনে সবার মুখে হাসি ফুটল। আবার চন্দ্র বলল — তবে আমার চাকুরী পাওয়ার একদিনের মধ‍্যেই পুনমকে আমি ঘরে তুলতে চাই তখন কেউ কোনো বাহানা করতে পারবে না।
চন্দ্রের কথা সবাই মানে কামরুল সাহেব চিন্তা করে ততোদিনে চন্দ্র ট্রিটমেন্টে অনেকখানি সুস্থ হয়ে যাবে।
চন্দ্র নিজের ঘরে যেতে যেতে বিড়বিড় করে বলল
— তোকে ছাড় দিলাম এই চার বছর তার পরের প্রত‍্যেকটা বছর তুই আমার সাথে থাকবি এই চন্দ্র বিলীন হবে তার পূর্নিমায়।।

পূর্ণিমায় বিলীন চন্দ্র পর্ব ১১