অশ্রুজলে বোনা বিয়ে সিজন ২ পর্ব ১৮
ইয়াসমিন খন্দকার
আরিশা নিজের জন্য বরাদ্দ সার্ভেন্ট কোয়ার্টারে এসে চুপচাপ বসে আছে। আজ বেশ অসুস্থ অনুভব হচ্ছে তার। কেন জানি মাথাটা ভীষণ ব্যথা করছে। আরিশা সবেমাত্র শুতে যাবে এমন সময় জামিলা শেখ সেখানে এসে বললেন,”এই মেয়ে, নিজেকে কি নবাবজাদী ভেবেছ? এখানে শুয়েবসে থাকার জন্য এসেছ নাকি? আমার বোনঝি আজ কতগুলো বছর পর লন্ডন থেকে এসেছে৷ যাও ওর জন্য ভালোমন্দ কিছু খাবার বানাও।”
আরিশার মেজাজটা গরম হয়ে যায়। সে বলে,”আপনার বোনঝিকে খাওয়ানোর এত শখ থাকলে গিয়ে খাওয়ান না! আমায় কেন বলছেন? আমি কিছু করতে পারবো না। আপনাদের কেনা দাসীবাঁদী নই আমি।”
জামিলা শেখ আরিশার এমন সাহস দেখে অবাক হয়ে যান। তিনি রেগে আরোও কিছু বলতে যাবেন তার আগেই আরিশা বলে ওঠে,”আপনি যাবেন এখান থেকে নাকি আমি মিস সন্ধ্যাকে গিয়ে বলে দেব যে, আমার সাথে আপনার ছেলে জাঈদের..”
“তোমার সাহস তো মন্দ নয়! তুমি আমাকে হুমকি দিচ্ছ?”
“যেই রোগের যেই ওষুধ। যে যেই ভাষায় বোঝে, তাকে তো সেই ভাষাতেই বোঝাতে হয় মিসেস জামিলা শেখ।”
“নিজেকে বেশি চালাক ভেবো না। একবার শুধু সন্ধ্যার সাথে জাঈদের বিয়েটা হতে দাও। তারপর দেখো, কিভাবে টানতে টানতে তোমায় এই বাড়ি থেকে বের দেই।”
“আপনাকে আমায় টানতে টানতে বের করতে হবে না। সময় হলে আমি নিজেই চলে যাব। কিন্তু তার আগে আমার আমার আপ্পির নিশ্চয়তা নিশ্চিত করতে হবে।”
শেষের কথাটা মনে মনে বলে আরিশা। এদিকে জামিলা শেখ রাগে গজগজ করতে করতে চলে যান। তিনি চলে যেতেই আরিশা দীর্ঘ শ্বাস ফেলে বলে,”এখন একটু ঘুমিয়ে নেই। এই মহিলা এসে শুধু শুধু এত বিরক্ত করল ধুর।”
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
সন্ধ্যার সামনে হরেক রকম খাবার পরিবেশন করলেন জামিলা শেখ। এত সব খাবার দেখে সন্ধ্যা বললো,”বাহ, খালা। এত কিছু তুমি আমার জন্য বানিয়েছ?”
“হ্যাঁ, দেখো সব তোমার পছন্দের খাবার।”
“তোমাকে অনেক অনেক ধন্যবাদ।”
সন্ধ্যা খেতে যাবে এমন সময় জাঈদও এসে খাবার টেবিলে বসে পড়ল। সন্ধ্যা ভেবেছিল জাঈদ হয়তো তার পাশে বসবে কিন্তু জাঈদ তার থেকে কিছুটা দূরত্ব বজায় রেখে বসেছে। এই জিনিসটা তাকে কিছুটা অপ্রস্তুত করে দেয়। এরইমধ্যে আরিশা সেখানে চলে আসে। একটু আগেই ঘুম থেকে উঠল সে। হঠাৎ ভীষণ পানি পিপাসা পেয়েছিল তার। কিন্তু তার রুমে পানি ছিল না। তাই মূলত পানি খেতেই তার এখানে আসা। আরিশাকে দেখেই জামিলা শেখ বিরক্তিতে ভ্রু কুচকে নেন। এদিকে সন্ধ্যা আরিশাকে দেখেই হাসি মুখে বলে,”আরে আরিশা, তুমি! তোমাকে এমন লাগছে কেন?”
আরিশা বলে,”সবেমাত্র ঘুম থেকে উঠলাম তো তাই আরকি..”
“ওহ আচ্ছা। তো এসো আমাদের সাথে খেতে বসো।”
আরিশা জামিলা শেখ ও জাঈদের দিকে তাকায় একবার করে। জামিলা শেখের চোখ থেকে যেন অগ্নিবৃষ্টি হচ্ছে কিন্তু জাঈদ ভাবলেশহীন। আরিশা কিছু বলবে তার আগেই জামিলা শেখ বলেন,”ও এখন পরে নিজের রুমে বসে খেয়ে নেবে। তোমরা এখন নেয়ে নাও।”
সন্ধ্যা নিজের টেবিল থেকে উঠে আরিশাকে টেনে একদম নিজের পাশের সিটে বসিয়ে বলে,”পরে কেন খাবে? ও আমাদের সাথেই খাক।”
জামিলা শেখ এবার আর কিছু বলতে পারেন না। অগত্যা মুখ ফুলিয়ে থাকেন। এদিকে সন্ধ্যা আরিশার দিকে খাবার এগিয়ে দিয়ে বলে,”নাও, খাও।”
আরিশাও আর কথা না বাড়িয়ে খেতে শুরু করে। কিছু সময়ের মধ্যেই জাঈদ নিজের খাওয়া শেষ করে উঠে দাঁড়ায়। অতঃপর কোথাও যেন একটা বেরিয়ে যায়। সন্ধ্যাও নিজের খাওয়া শেষ করে নিয়ে জামিলা শেখকে জানায়,”খালা, আমি এখন একটু আসছি। আমার এক ফ্রেন্ড আছে তো সিলেটে ওর সাথে দেখা করতে যাব।”
“আচ্ছা, যাও।”
সন্ধ্যা বেরিয়ে যেতেই জামিলা শেখ আরিশার সামনে থেকে খাবার প্লেট নিয়ে ফ্লোরে ছুড়ে ফেলে আরিশাকে চেয়ারে বসা থেকে টেনে তুলে বলেন,”কোন সাহসে তুমি আমাদের বাড়ির ডাইনিং টেবিলে বসে ভাত খেলে?”
“কেন? আমি এখানে ভাত খাওয়ায় কি আপনাদের জাত চলে গেছে?”
“হ্যাঁ, গেছে। তোমার মতো অনাথ, বাপ-মায়ের পরিচয়হীন একটা মেয়ে আমাদেরও ডাইনিং টেবিলে বসার অযোগ্য।”
আরিশা জেদ দেখিয়ে আবারো ডাইনিং টেবিলে বসে বলে,”এই যে আবার বসে নিলাম আমি। কি করবেন করুন তো।”
“তোমাকে তো আমি..”
বলে যেই না তিনি আরিশার গালে হাত তুলতে যাবেন এমন সময় আরিশা জামিলা শেখের হাত শক্ত করে ধরে বলে,”খবরদার! এই ভুল আর দ্বিতীয় বার করতে যাবেন না। নাহলে আপনার হাতে ঐ দেয়ালের সাথে ঝুলে থাকবে।”
“তোমার এত বড় সাহস…”
“আমার সাহসের এক আনাও এখনো দেখেন নি আপনি। আপনাদের মা-ছেলে দুজনের পাপের ঘড়া পূর্ণ হয়ে গেছে। এবার নিজেদের পাপের ফল ভোগ করার জন্য প্রস্তুত হন।”
বলেই আরিশা ডোন্ট কেয়ার ভাব নিয়ে নিজের রুমের দিকে পা বাড়ায়। আর জামিলা শেখ সেখানে দাঁড়িয়ে ফুঁসতে থাকেন।
দীর্ঘ দিন পর নিজের বান্ধবী নিঝুমের সাথে মিলিত হয়েই তাকে আলিঙ্গন করে সন্ধ্যা। নিঝুম বলে ওঠে,”ইশ! আজ দীর্ঘ এক মাস পর আমাদের দেখা হলে৷ তোকে খুব মিস করেছি রে এতদিন। আমার তো অনেক আগেই লন্ডনে ফেরার কথা ছিল। কিন্তু আটকে গেলাম!”
সন্ধ্যা বলে,”হুম, সেটাই। তা তুই এখানে থাকছিস কিভাবে? তোর নাকি বাংলাদেশি একটুও পছন্দ নয়।”
“তা তো নয়ই। নেহাতই মম-ড্যাড থাকতে বলেছে তাই বাধ্য হয়ে থাকছি।”
“যা-ইহোক, শুনলাম তোর ভাইয়ের নাকি বিয়ে হয়ে গেছে!”
সন্ধ্যার গলার স্বরে কিছুটা আক্ষেপ ছিল। নিঝুম হাপিত্যেশ করে বলে,”কি আর বলবো দুঃখের কথা। আমি তো বুঝতেই পারলাম না, ব্রো বাংলাদেশে এসে এমন একটা টিপিক্যাল মেয়েকে কেন বিয়ে করল। আমার কত ইচ্ছা ছিল তোকে নিজের ব্রোয়ের বউ হিসেবে দেখব। ”
“বাদ দে এসব কথা নিঝুম। আমি আজ থেকে ৬ মাস আগে যখন তোর ভাইকে প্রপোজ করেছিলাম তখনই সে আমায় প্রত্যাখ্যান করে দিয়েছিল এটা বলে যে সে অন্য কাউকে পছন্দ করে। আমি ব্যাপারটাকে স্বাভাবিক ভাবেই নিয়েছি। হ্যাঁ প্রথমদিকে একটু কষ্ট হয়েছিল কিন্তু কি আর করার। জোর করে তো আর ভালোবাসা পাওয়া যায় না। তাছাড়া, আমার ভাগ্যে হয়তো অন্য কেউ ছিল। যাইহোক, আমি তোর ভাবি না হতে পারলেও তুই কিন্তু চাইলেই আমার ভাবি হতে পারিস।”
নিঝুমের মুখে হঠাৎ হাসি ফুটে ওঠে। সন্ধ্যা বলে,”আমি ভাবছি আমার বিয়েটা হওয়ার আগেই সায়ন ভাইয়ার বিয়ের কথাটা তুলব। যাতে করে আমার এই সুন্দরী বান্ধবীটাকে নিজের ভাবি করতে পারি।”
“ধুর! কি যে বলিস না।”
“বাহ, মেয়ে তো দেখি লজ্জা পাচ্ছে। সায়ন ভাইয়ার কথা ভাবলে এতো লজ্জা পাস কেন তুই?”
নিঝুম মনে করে সেই অতীব সুদর্শন চেহারার পুরুষটার কথা। অতঃপর ভাবে,”সত্যি কি লোকটাকে আমি নিজের করে পাবো? যাকে আমি সেই ছোটবেলা থেকে পছন্দ করে এসেছি।”
আরিশা নিজের কক্ষেই অবস্থান করছিল এমন সময় হঠাৎ কেউ দরজা খুলে আরিশার কক্ষের মধ্যে প্রবেশ করে। আরিশা কিছু বলতে যাবে তার আগেই আরিশার মুখ চেপে ধরে দেখে বিছানায় ফেলে দেয়। আরিশা অবাক চোখে জাঈদকে দেখতে থাকে। জাঈদের চোখগুলো ছিল ভীষণ রক্তিম৷ সে আরিশার গলা চেপে ধরে বলে,”আমার মাকে অপমান করার সাহস তুমি কোথায় পেলে? এর শাস্তি তোমায় পেতেই হবে।”
কথাটা বলেই আরিশার গলা আরো জোরে চেপে ধরে। আরিশা এক ধাক্কায় জাঈদকে নিজের উপর থেকে সরিয়ে বলে,”আমাকে দূর্বল ভেবে বারবার আঘাত করতে আসবেন না। মনে রাখবেন, দেয়ালে পিঠ ঠেকে গেলে একটা পিপড়াও ঘুরে দাড়াতে পারে।”
অশ্রুজলে বোনা বিয়ে সিজন ২ পর্ব ১৭
বলেই আরিশা পাশ থেকে একটা ফুলদানি তুলে নিয়ে জাঈদের মাথায় আঘাত করে। সাথে সাথেই জাঈদ ফ্লোরে পড়ে যায়৷ পুরো ফ্লোর ভেসে যায় জাঈদের রক্তস্রোতে।