রং পর্ব ৫৭ (৩)

রং পর্ব ৫৭ (৩)
তন্নী তনু

হতশায় ডুবতে থাকা মাথার উপর ছায়াহীন অসহায় মেয়েটার মুখটা শীর্ণ। তবুও সুভা ভঙ্গুর হৃদয় নিয়ে ছোট ভাইটাকে সামলাতে ব‍্যস্ত। নিজের চোখ থেকে যন্ত্রণার খসে পড়া জল কেবল স্বচ্ছ পানি মাত্র। না আছে তার মূল‍্য, না আছে ফিরে তাকানোর সময়। জীবন এক রহস‍্যজাল,যার পরতে পরতে দুঃখ। ফোন কল শেষে আবার পূর্বের জায়গায় ফেরে ইরফাদ। সুভাকে ডেকে নেয় একটু দূরে,
— সব সিচুয়েশনে হাত গুটিয়ে বসে থাকলে হয় না সুভা। চেষ্টা করতে হয়।
শীর্ণ মুখের মেয়েটা দূর্বল চোখেই তাকিয়ে থাকে। তার গলা ফেটে বের হয়,
–কোনো সন্তান উপায় থাকতে বাবার চিকিৎসা বন্ধ রাখে?
ইরফাদ জানে এই নিদারুণ, নির্মম সত‍্য। তবুও পাষাণের মতো বলে,

–তবুও..
ছোট্ট শব্দটা তীব্র জ্বালা ধরায় সুভার হৃদয়ে। তীক্ততায় বুজে আসা গলাটা শুধু টুপটুপ করে পানি ঝড়ায় চোখে,
–তুমি কি এখন আমাকে হারাম পথে যেতে বলছো! শ!রী!র বেঁচবো আমি?
তড়িৎ গতিতে শক্ত হয় ইরফাদের দাঁতের পাটি, চোখ হয় রক্তলাল। রাগগুলো ভেসে বেড়ায় শিরায় শিরায়। দাঁতের উপর দাঁত পিষে তীক্ষ্ম গলায় বলে,
— আর ইউ ক্রেজি! আই ডিডেন্ট সেইড,হোয়াট ইউ সে। আই সেইড যাস্ট ট্রাই। হোয়াট এভার, টাকা ট্রান্সফার হয়ে যাবে একাউন্টে । ট্রিটমেন্ট করিয়ে নিস।
তীক্ষ্ম ঝাঝালো স্বরে সুভা থমকে যায়। নিজের বলা কথাটা ভেবে নিজেই হতাশ হয়। ততোক্ষণে ইরফাদ পিছু ফেরে। ধেয়ে আসা ঝড়ের পূর্বাভাসে সুভা তড়িৎ গতিতে সামনে দাঁড়ায়।
— আমি ঐভাবে বলিনি। আমার কোনো টাকা লাগবে না। অনেক দিয়েছো আর না। জীবন আমাকে যেদিকে নেয় নিবে। বন্ধুত্বের জায়গায় থেকে তুমি যা করেছো আমি কৃতজ্ঞ,তবে আর না।

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

— সর!
সুভা নিজের কপাল,চোখে ডলতে ডলতে বলে,
— আমার মাথা ঠিক নেই। এতো প্রেশার আর নিতে পারিনা তাই ভুলভাল বলছি। ভুল হয়ে গেছে। কিন্তু তুমি আর টাকা দিবে না। যা হয়ে যাক।
— বেশী বুঝিস!!
— আর কতো ঋণ হবো ইরফাদ? আমি টাকা ব‍্যাক দিতে না পারলে আমার খুব অসস্তি হয়।
প‍্যান্টের পকেটে হাত গুঁজে লম্বা শ্বাস টানে ইরফাদ,
–আমার জীবনের তিনটা বছর আমি ভুলে যাই নি। ঐ সময়ে শূণ‍্য থেকে শুরু করা এই ছেলেটার পাশে কোনো বন্ধু ছিলো না। বাবা এতো সাপোর্টিভ তবুও আমার ভুলকে তিনি একসেপ্ট করেননি। যাস্ট বের করে দিয়েছিলেন বাসা থেকে। আমার পাশে সেদিন কেউ ছিলো না। কেউ না। তবে ঐসময়ে তুই আমার জন‍্য যা করেছিস আমি ভুলিনি। আমি তোর কাছে ঋণি!

— ঋণ শোধ করার দায়ে আমার পাশে দাঁড়াচ্ছো?
–বন্ধুত্বটাই আস্ত একটা ঋণ, যা কখনো শোধ হয় না! খারাপ সিচুয়েশনে বন্ধু হিসেবে পাশে দাঁড়ানো আমার রেসপন্সিবলিটি।
— এমাউন্ট গুলো তো অনেক বড় ইরফাদ!
–তো! স‍্যালারির কিছু অংশ প্রতি মান্থে আমার একাউন্টে পাঠাবি। ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র অংশ জমে একদিন সব পরিশোধ হবে। এখন আসছি আমি। সিনথি ওয়েট করছে। আমাকে যেতে হবে।
— এই টাকাটা আমি এইবার নিতে পারবো না।
— এইটা সিনথি দিয়েছে আমি না। ভালো সময় আসলে সবচেয়ে আগে ওর টাকা দিয়ে দিবি। মেয়েটার শখের জিনিস ।

— কি বলো! এটা ঠিক না।প্লিজ ইরফাদ এই টাকা টা আমি নিবো না।
–ভুলের পেছনে ছুটতে যেয়ে একটা সময় টাকার অভাবে পড়াশুনা ছেড়ে দিতে চেয়েছিলাম,মনে আছে! ঐদিন তুই যে সাপোর্টটা দিয়েছিলি! না হলে হয়তো স্টাডি কন্টিনিউ করা হতো না, আজ এই পজিশনে হয়তো দাঁড়াতে পারতাম না। আমিও তো ঋণি সুভা। সেদিনের ঋণ কি কোনো কিছু দিয়ে পরিশোধ করা যায়?
— এভাবে বলছো কেনো!
–আসছি এখন। আপডেট দিস।

অন্ধকারাচ্ছন্ন ধূসর আকাশটার এককোণে ছোট্ট চাঁদ। আকাশজুড়ে ছড়ানো ছিটানো তারাগুলো মিটি মিটি জ্বলছে। ফাঁকা মৃদু আলো আধারে শূন‍্য নির্জন রাস্তায় স্ট্রিয়ারিং এ হাত রেখে আপন গতিতে চলছে ইদফাদের গাড়ি। নির্জন রাস্তায় একাকী চলতে চলতে সেদিনের ঘটনার স্মৃতিচারণ করছে ইরফাদ। নির্জন, নিরব, হু হু করা জঙ্গলে এতোগুলো হায়েনার সাথে সিনথিয়ার একার লড়াই! অনেক কিছুই হতে পারতো! অনেক জনকে আটক করা হলেও এখনো চিহ্নিত করা বাকি। কে স্পর্শ করতে চেয়েছিলো সিনথিয়াকে! কে জঘন‍্য ভাষায় কথা বলেছে। তাদের হাত সে ভেঙে গুরিয়ে দিবে। এমন ভাবনার মাঝে মৃদু কম্পনে কেঁপে ওঠে ইরফাদের ফোন। মৃদু আধারে ডুবতে থাকা ইরফাদের চোখ জোড়ায় আলতো হাসির ছাঁপ। নিশ্চিত সিনথিয়া। ফোনের স্ক্রিনে তাকায় ইরফাদ। ” কলিং শিশির”। অতঃপর,

— স‍্যার!
–বলুন…
–আপনার সাথে পারসোনাল কিছু কথা ছিলো স‍্যার।
— বলুন।
— সামনাসামনি বলতে পারলে…
— আমি তো শহরের বাইরে।
— ওহ! তাহলে পরেই বলবো।
— নো প্রবলেম। আমি শুনছি বলুন।
— স‍্যার! তপন চৌধুরীর বিষয়ে কথা ছিলো। ডিআইজি সহ ওনাকেও তো কাল থেকে রিমান্ডে নেয়ার কথা।
–হুম! ডিআইজি এখনো কিছু স্বীকার করেননি। তার সাথে আর কে কে জড়িত এসব তদন্ত এখনো বাকি।
–আমি পারসোনাল একটা বিষয়ে কথা বলতে চাই স‍্যার। তপন চৌধুরী আমার মামা। আমাদের বাসায় পূর্বে হওয়া সব ঘটনা আপনাকে আমি বলেছি। তবে আমার আরেকটা ডাউট আছে। আমার ওয়াইফ তিথি। ওর মা হঠাৎ যে হারিয়ে গেলো। নাম হলো পালিয়ে গেছে। কিন্তু সেই মানুষটা কোথায় গেলো। আর কেনো কখনো খোঁজ মিললো না। এই বিষয়টা ধোঁয়াশা। আমার ডাউট আছে তপন চৌধুরী এই বিষয়টা ভালোভাবেই জানেন। হতে পারে তিনি গুম করে দিয়েছেন। এর চেয়ে বেশী কিছুও হতে পারে।
— বিষয়টা আমি দেখবো।
— ধন‍্যবাদ স‍্যার।

হলদেটে টিমটিমে আলোর একটা শেল। দেয়ালে ঠেস দিয়ে নিরালায় বসে আছেন প্রভাতরঞ্জন সরকার। যার চোখ নিমজ্জিত বুদ্ধির খেলায়, নতুন ফাঁদের চিন্তায় বিভোর, ডুব দিয়ে আছে কল্পনার ইন্দ্রোজালে। পায়ের ক্ষত এখনো তাজা। রিমান্ডে নেওয়ার আগ মূহুর্তে পর্যন্ত তিনি অশুভ খেলায় মেতে থাকবেন। বুদ্ধির জাল বিছাবেন ততোক্ষণ পর্যন্ত যতোক্ষণ না মুক্তি মেলে।বিদঘুটে রহস‍্যময় পরিবেশ। লোহার শেলে মেঝেতে বসানো থালাটা এক ধাক্কায় মাঝখানে পৌঁছায়। চোখ তুলে তাকান প্রভাতরঞ্জন সরকার।থালার উপর পোড়া রুটি আর একটুখানি সবজি। ক্ষুধাটাও নতুন করে জ্বলে ওঠে। হামাগুড়ি দিয়ে প্লেটটা কাছে টেনে নেয় প্রভাতরঞ্জন। রুটিটা ছিড়তেই মাঝখান থেকে ছিটকে পড়ে কিছু একটা,টিন টিন করে পড়ে মেঝের উপর। ছোট্ট বস্তুটাকে দেখে পোড়া, ভাঁজ পড়া ওষ্ঠাধরে ঝিলিক দিয়ে ওঠে অশুভ হাসিটা। পৈচাশিক হাসিতে হৃদয়টা হিসহিসিয়ে ওঠে। “চাবি” চাবিটা মিললো অবশেষে! তাকে দমানোর সাধ‍্য উপরওয়ালা ছাড়া কারো আছে! প্লেটের কোণায় কুচি কুচি করে কাটা সবজি এলোমেলো করেন তিনি। আরেকবারের মতো কাঙ্ক্ষিত বস্তুর হদিস মিললে খলখলিয়ে হাসেন তিনি। এইবার! একবার! শুধু একবার বের হতে পারলে । এসপির অস্তিত্ব মুছেই ছাড়বে সে । তার হাত কতো লম্বা এইবার স্বচক্ষে দেখাবেন তিনি। প্রয়োজনে মেরে তবেই মরবে সে!

নিচতলার পাখির কিচির মিচির শব্দে বেজে ওঠে বেল। সিনথিয়া কাঁথা মুড়িয়ে গুটিশুটি মেরে শুয়ে আছে তখন। কিচির মিচির শব্দটা সেট করা হয়েছে গতকাল। নতুন শব্দটা তার দূর্বার হৃদয়ের গতিটা বহুগুণে বাড়িয়ে দেয়। একটানে নিজের উপর থেকে ছুড়ে ফেলে কাঁথাটা। “ইরফাদ ফিরেছে”
এই ছোট্ট সত‍্যটুকু তাকে ভাসিয়ে নিয়ে যায় কল্পনায়। অপেক্ষার প্রহর গুণতে থাকা মেয়েটার হৃদয় অপর হৃদয়ের উষ্ণ ওম পেতে মরিয়া হয়ে ছোটে। পরণে হলুদ রঙের মাটি ছোঁয়া স্কার্ট, কালো রঙের কোমল কাপড়ের টিশার্ট। সিঁড়ি ভাসিয়ে দিয়ে সে ছুটে চলেছে। দম ফেলার সময় তার নেই। চোখের তৃষ্ণায় ছটফট করতে থাকা সিনথিয়া ভারী দরজার সিটকি খুলে দেয়। দু”পাল্লা খুলে যায় দুহাতের মতো, ভালোবাসা নামক অনুভূতিরা উষ্ণ হাওয়া রূপে ধেয়ে আসে তার দিকে। সামনে দাড়ানো স্বপ্নের পুরুষ। তৃষ্ণায় খাঁ খাঁ করা বুকটা আরো ধূ ধূ করতে থাকে। মনে হচ্ছে কতোকাল, কতোসময় দেখা হয়ে ওঠেনি। তৃষ্ণায় খা খা করছে হৃদয়। এমন তৃষ্ণার্ত হৃদয়টাকে শীতল করতে ঝাপিয়ে পড়ে ইরফাদের বুকে,কোমল আলিঙ্গনে ঝাপটে ধরতেই হীম হয়ে আসে সিনথিয়ার হৃদয়। হৃদয় নামক ছোট্ট জায়গাটা ধুকধুক করে কাঁপে। অস্তিরতা, সস্তি, ভালোলাগার বরফ শীতল অনুভূতিতে ডুবতে থাকা সিনথিয়া জড়ানো গলায় ফিসফিসিয়ে বলে,

— আই লাভ ইউ,
আই লাভ ইউ, আই লাভ ইউ।
এতেই গ্রীষ্মের উত্তাপ ছাপিয়ে নামে প্রবল বৃষ্টি। দুটো হৃদয়জুড়ে নামে হীমশীতল প্রবাহ।

রং পর্ব ৫৭ (২)

শুনশান নিরব চারপাশ। নির্জন, নিরালায় পাতা জাল গুটিয়ে নেওয়ার সময় চলে এসেছে। এদিক সেদিক চোখ ঘুড়িয়ে সবটা পর্যবেক্ষণ করেন প্রভাতরঞ্জন সরকার। বাইরে ঝুলন্ত তালাটাতে চাবি দেয়। এক সেকেন্ডে খুলে যায় তালা। আর একটু খানি পথ। ক্লোরোফর্মে বাতাসে ছড়িয়ে দিয়ে সবার চোখ ফাঁকি দিয়ে এই বদ্ধ কক্ষ থেকে বেড়িয়ে যাবেন তিনি। অতঃপর রঙিন, সুন্দর জীবনগুলোতে নামবে ধূসর রঙের খেলা…….আর একটু… কেবল একটু সময়ের অপেক্ষা….

রং পর্ব ৫৮