আমার প্রেমিক ধ্রুব পর্ব ৩৮

আমার প্রেমিক ধ্রুব পর্ব ৩৮
অবন্তিকা তৃপ্তি

ধ্রুব অদিতির গলায় নাক ঘষতে ঘষতে সেভাবেই শাড়ির আঁচলে হাত রাখলো। আঁচল-টুকু সরিয়ে ফেলবে; তার আগেই হঠাৎ দরজায় কেউ করাঘাত করলো। থমকে গেল ধ্রুব। অদিতির ঘোরও তখন কেটে গেছে। ধ্রুব অদিতির গলা থেকে মুখ তুলে দরজার দিকে তাকালো, অদিতিও তাকিয়ে! দরজার ওপাশে হারুন চাচা ডাকছে অস্থির গলায়———‘ধ্রুব স্যার, বড় স্যার কী করতেসেন যেন,বুকে অশান্তি হইতেসে উনার! আপনে একটা বার আহেন! স্যার? ঘুমায় গেছেন? স্যার?’

ধ্রুব ওভাবেই শুয়ে, ভ্রু কুচকে তাকিয়ে রইল দরজার দিকে। সৌরভ ইয়ামিনের অসুস্থতার খবর অদিতির কানে যাওয়ামাত্রই ও তাড়াহুড়ো করে দুহাতে ধ্রুবকে ঠেলে বলল——-‘দরজা খুলে আসুন ধ্রুব। বাবার কি হয়েছে?’
ধ্রুবও আস্তে করে উঠে বসলো। অদিতি তখন শাড়ির আঁচল ঠিক করে উঠে বসলো ধ্রুবর পাশে। দরজায় তখনও হারুন চাচা ধাক্কাচ্ছে। ধ্রুবর চেহারা বদলে গেছে মুহূর্তেই! একটু আগে যে নেশায় আচ্ছন্ন ধ্রুবকে অদিতি দেখেছে; এখন তেমন একটুও নেই। মুখটা গম্ভীর; চোখ দুটোতে কি একটা ভাষা ভাসছে। ও অদিতির দিকে থমথমে চেয়ে বলল——‘আমি দেখে আসি কি হয়েছে। তুমি থাকো এখানে, বেরিও না।’

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

বলে ধ্রুব বিছানা থেকে উঠলো! শ্বাস আটকে পুরো রুমটা একবার দেখে নিচ্ছে। অদিতিও উঠে দাঁড়ালো, ব্যাকুল গলায় বলল——‘আমিও আসি? যদি কিছু দরকার হয়?’
ধ্রুব রুমের থেকে চোখ সরিয়ে কোনা চোখে তাকালো অদিতির পড়নে সিল্কের; ট্রাসন্সপেরেন্ট শাড়িটার দিকে। ওভাবেই একনজর তাকিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল——‘অদিতি, এই টাইপের শাড়ি আমার জন্যে; বদ্ধ ঘরে পড়া এলাও আছে। বাট বাইরে নয়। আপাতত ঘর থেকে বেরিও না। আমি দরকার হলে ডেকে নেব। শাড়ি পাল্টে সুতির শাড়ি পরে যেও তখন।’

অদিতি নিজের দিকে চোখ নামিয়ে তাকালো! শাড়িতে দেহের আনাচে-কানাচের ভাঁজ স্পষ্ট! মুহূর্তেই কুণ্ঠিত হয়ে উঠল ও। দুহাতে পেটের দিকটা ঢেকে নিয়ে অস্ফুটে মাথা নাড়াল——‘ঠি..ঠিক আছে।’
ধ্রুব তখন হারুন চাচার উদ্দেশ্য চেঁচিয়ে বললো——-‘আসছি চাচা; যান আপনি।’
হারুন চলে গেলেন। ধ্রুব এলোমেলোভাবে চোখ ঘুরিয়ে মেঝেতে ছুড়ে ফেলা টিশার্ট খুঁজতে লাগলো। অদিতি সেটা বুঝে টিশার্ট খুঁজে সেটা উঠিয়ে ধ্রুবর দিকে বাড়িয়ে দিল। ধ্রুব টিশার্ট হাতে নেওয়ার সময় আরও একবার অদিতির চিন্তিত মুখটা দেখলো! তারপর ব্যস্ত হাতে পরে নিলো টিশার্ট। অদিতি তখনো চোখ নামিয়ে রেখেছে। ধ্রুব হয়তো বুঝে ওসব! টিশার্ট টেনেটুনে ঠিক করে, এগিয়ে এসে অদিতির গালের ডান পাশে নিজের আদুরে হাতটা ডুবিয়ে দিলো। অদিতি চোখ তুলে তাকালো ধ্রুবর চোখের দিকে।ধ্রুব ওভাবেই হাত রেখে মোলায়েম গলায় বলল——‘রাগ হচ্ছে? এভাবে রেখে যাচ্ছি দেখে?’

অদিতি মৃদ‍্যু হেসে গালে ধ্রুবর ছোয়া হাতটায় নিজের গরম হাতটা স্পর্শ করে চেপে ধরে স্বাভাবিক গলায় বললো ——-‘একটুও না। আমি তো আছিই। এমন রাত আমাদের হাজার আসবে।’
ধ্রুব কিছু বলল না মুখে! মনেমনে ওর মন কিছুটা ক্ষুন্ন! বারবার ওর-অদিতির স্পেশাল মুহূর্তেই এত বিপদ কেন আসে? অদিতির সামনে নিজের এই ভাবনা-গুলি প্রকাশ করলো না ধ্রুব। থাক, মেয়েটা কষ্ট পাবে।
ধ্রুব মাথা এগিয়ে অদিতির কপালে ঠোঁট দাবিয়ে একটা শক্ত চুমু খেলো; আবেশে চোখ বন্ধ করে ফেলল অদিতি। ধ্রুব সরে এসে গালে হাতটা দিয়ে হালকা ছুয়ে হাসার চেষ্টা করল! অদিতিও হাসল তখন! ধ্রুব ওকে ছেড়ে দরজার দিকে এগুলো; দরজা খুলে যাওয়ার আগে আরো একবার পেছন ফিরে বলে গেল——-‘আবারও বলছি, এই অবস্থায় ঘর থেকে বেরিও না। পরিস্থিতি যদি হেল্পফুল হয়; আশা কিন্তু এখনো আছে। ঘর যেমন আছে তেমনি থাকুক; সাজানো!’
অদিতি মাথা নাড়িয়ে হাসার চেষ্টা করল। ধ্রুব দরজা আটকে চলে গেল। ও যেতেই অদিতি হেঁটে আয়নার সামনে দাঁড়াল। সিল্কের এই শাড়িতে অনেকটাই দেখা যাচ্ছে সবকিছু। অদিতি গলায় হাত রাখল। লাল হয়ে র্যাশ উঠেছে জায়গায় জায়গায়। ধ্রুবর কাজ একটা! পাগল একটা প্রেমিক; সঙ্গে ভীষন দুষ্টুও!’

সৌরভ ইয়ামিন বিছানায় শুয়ে আছেন, বারবার অশান্ত-অস্থির শ্বাস ফেলছেন। তৃণা পাশেই বুকে মুভ মালিশ করে দিচ্ছে। কান্নারত মুখ, চোখ দিয়ে টপাটপ অশ্রু পড়ছে।সৌরভ দেখার আগেই সেই অশ্রু মুছেও ফেলছে বারবার।
ধ্রুব দরজার সামনে দাঁড়াতেই; তৃণা ওকে দেখতে পেয়ে সরে বসলো কিছুটা। ধ্রুব গিয়ে বিছানার থেকে একটু দূরে চেয়ার টেনে বসলো। থমথমে চোখে বাবার অস্থিরতা দেখল অনেকসময়! তৃণার সঙ্গে কখনও আগ বাড়িয়ে তেমন কথা বলেনা ধ্রুব। তবে আজ না চাইতেও বলতে হলো———‘কখন থেকে এসব? একটু আগে ঠিক ছিলো!’
তৃণা জবাবে ভাঙা ভাঙা গলায় বললেন——-‘আধা ঘণ্টা হচ্ছে! হুট করে বলে ঘামছেন উনি। আমি ফ্যান চালিয়ে দিলাম। তাতেও ঘাম হচ্ছে দেখে এসিও দিলাম। এখন বুকে ব্যথা হচ্ছে বলে এভাবে শ্বাস ফেলছেন।’

ধ্রুব তাকিয়ে একবার দেখলো সৌরভকে। ওর বুকেও কোথাও না কোথাও একটা অস্থিরতা বয়ে বেড়াচ্ছে। শান্ত চাইলেও শান্ত থাকতে পারছে না। ও সেভাবেই গম্ভীর মুখে উঠে দাঁড়াল; ফোন বের করে কল লাগলো পাশের হাসপাতালের এম্বুলেন্স এর নম্বরে। সবাইকে এত ব্যস্ত হতে দেখে সৌরভ অস্ফুটে কিছু বলার চেষ্টা করলেন——‘ও-ঔষধ নিয়েছি আ.আমি। স…সময় দেও; ঠিক হ.হয়ে যাবে।’

বলে আবারও লম্বা করে শ্বাস টেনে নিলেন নিজের ভেতর! বুকের ব্যাথাটাও সঙ্গে কামড়ে ধরল। ‘আহ্’ বলে বুকটা আবার চেপে ধরেন সৌরভ। ধ্রুব এসব শুনছে না যেমন; ও ফোন কানে সৌরভের দিকে চেয়ে কাঠকাঠ গলায় বললো——-‘ একটু স্থির থাকতে পারেন না? কথা বলছি তো আমি; আমাকে দেখতে দিন এসব।’
সৌরভ আদো-আদো চোখ খুলে তাকিয়ে রইলেন ওমন অস্থির ভাবে পায়চারী করা ধ্রুবর দিকে। তৃণাও চোখের জল আঁচলে মুছে, পাশ থেকে ধমকে উঠেন——‘রাখো তোমার ঠিক আছি। সারাক্ষণ একটা মানুষ এত প্রেশার নিলে হবেই তো এসব ব্যামারি। ইলেকশন ধুয়ে এখন পানি খাও তুমি! কার ভোগান্তি হচ্ছে এখন? কে সাফার করছে?’
সৌরভ এসব শুনেননা। তখনও তার চোখ ধ্রুবর দিকে। ধ্রুব একদণ্ড শান্তিতে বসে নেই। ডক্টর ম্যানেজ করে ফেলেছে। নার্স রেডি রাখছে। অস্থির এক ধ্রুবকে দেখেন সৌরভ! যে তার বাবাকে মূল্যায়ন করেনা, অথচ বাবার একটু অসুস্থতায় পাগল হয়ে গেছে।

অ্যাম্বুলেন্স আসছে। ধ্রুব কল কেটে সৌরভের পাশেই চেয়ার টেনে আবার বসলো। ওর চোখে-মুখ চুড়ান্ত গম্ভীর! থমথমে মুখে মাথায় নিচু করে মেঝের দিকে চেয়ে বসে আছে সেই কখন থেকে ওভাবেই। সৌরভ ইয়ামিনকে ধ্রুব যত অবজ্ঞা করুক না কেন; দিনশেষে আপন বলতে শুধু এই একটা মানুষই আছে ওর জীবনে। যার রক্ত ধ্রুব নিজের শরীরে বয়ে বেড়াচ্ছে। হোক ধ্রুব তাকে পছন্দ করে না। তবুও- ধ্রুবর হয়েই সে আছে। ধ্রুব হয়তবা এই মানুষকে হারাতে চায়না কোনদিন।অথচ এই শব্দগুলো তো ধ্রুব কোনদিন বলবে না তার সামনে! বলার ইচ্ছেও নেই কখনো!
অ্যাম্বুলেন্স এসেছে। সৌরভকে শোয়া থেকে স্ট্রেচারে উঠাচ্ছে কিছু লোক!
তৃণাও তৈরি!আশপাশ দেখে হঠাৎ উনি জিজ্ঞেস করে বসলেন——‘অদিতি কোথায়?’

এ প্রশ্নে ধ্রুবর টনক নড়ল। অদিতি অপেক্ষা করছে এখনো! চিন্তায় মাথা থেকে বেরিয়ে গেছিল এই ব্যাপারটা। ও পাশে থেকে একজন মহিলা সার্ভেন্ট ডেকে বলল——-‘অদিতিকে ডেকে দিন; বলবেন আমি ডাকছি।’
মহিলা সার্ভেন্ট মাথা নাড়াল। একটু পর অদিতি সুতির একটা শাড়ি পরে এসেছে সৌরভের রুমে। ধ্রুব ওর দিকে তাকালো একবার। শাড়িটা দেখে ধ্রুবর হয়তবা অপরাধবোধ হচ্ছিল। ধ্রুব ওভাবেই চেয়ে রইলো! অদিতি সেটা বুঝে; ও মৃদু হেসে মাথা নাড়ল! ধ্রুব অদিতির থেকে চোখ সরিয়ে আবার সৌরভের দিকে তাকাল।
রাস্তায় অ্যাম্বুলেন্স সৌরভ হঠাৎ করে অজ্ঞান হয়ে যান। ধ্রুব তখন অস্থির হয়ে উঠল হুট করেই। অদিতি দেখল— ওই গম্ভীর ধ্রুব ইয়ামিনের চোখে-মুখের কি করুণ দশা! যেন উড়ে নিয়ে যেতে ছয় অ্যাম্বুলেন্স। এম্বুলেন্সের সাইরেনের শব্দ বেড়েই যাচ্ছে ক্রমশ।

হাসপাতালে এসেই ডক্টর মানভ সৌরভের পুরনো রিপোর্ট দেখে; পুরোদস্তুর আহাম্মক হয়ে গেলেন। ধ্রুবর দিকে চেয়ে বললেন——-‘ধ্রুব। তোমার বাবা কি নিয়মিত মেডিসিন নেন?’
ধ্রুব কিছুটা অপ্রস্তুত হয়ে তৃণার দিকে তাকাল। ও তো এসব নিয়ে কখনো মাথা ব্যাথা রাখেনি। লোক ছিলি সৌরভের; টাটাই দেখভাল করতো এসব বিষয়। ধ্রুবর মুখটা তেতো হয়ে গেল। তৃণা ডক্টরকে বললেন——-‘মেডিসিন নিয়মিত খাওয়ানোর দায়িত্ব উনার সেক্রেটারির ছিলো।’
ডক্টর মানভ তৃণার দিকে তাকিয়ে বললেন——‘সে কোথায় এখন?’
তৃণা জবাবে বললেন——-‘ছুটিতে, ১৫ দিন ধরে। এক সপ্তাহ ধরে আমি খাওয়াচ্ছি মেডিসিন।’
ডক্টর মানভ চিন্তিয় হয়ে গেলেন; বললেন——-‘ধ্রুব তোমার বাবা আমি জানি। কেউ হয়তবা ছিলোই না এই ১৫ দিন উনার টেইক কেয়ার করার জন্যে। তাই এত অনিয়মিত হওয়ায়; উনার হার্ট অ্যাটাক হয়েছে। রিং বসানো লাগবে হার্টের!’

ধ্রুব হতভম্ব তাকিয়ে রইলো ডক্টরের দিকে। ধ্রুব আসলেই একটা লুজার। নিজেও এসব খেয়াল রাখেনি ইগোর বশবর্তী হয়ে; না কাউকে রেখেছে এসব দেখার জন্যে। ইলেকশনের ঝামেলায় পরে সৌরভ নিজেও বেখেয়াল ছিলেন! ধ্রুব অপরাধবোধটুকু দাবিয়ে রেখে, স্বাভাবিক গলায় বলল——‘দ্রুত যা লাগে করান। সার্জারি করাতে হলে করুন।’
ডক্টর মানব মাথা নাড়লেন। দ্রুতপায়ে ঢুকলেন ওটি রুমে।
সার্জারি হচ্ছে। ধ্রুব তখন থেকে ওটি রুমের সামনে ওভাবেই স্থির দাড়িয়ে রয়েছে। ওর বুক কাঁপছে হাত শিভারিং হচ্ছে। হয়তবা পুনরায় বহুদিন পর আবার ওই এক অসুখ চেপে ধরতে চাইছে ধ্রুবকে। অদিতি ওর জীবনে আসার পর শেষ কবে ওর অ্যাংযাইটি অ্যাটাক হয়েছিল ওর নিজেরও মনে নেই। আজ আবার সেই জঘন্য-বিশ্রী কিছু সিমটম দেখা দিচ্ছে ওর শরীরে।

‘আপনার মেডিসিন।’——- একটা ট্যাবলেটের পাতা বাড়িয়ে রেখেছে ধ্রুবর দিকে।
ধ্রুব পাশে তাকাল। অদিতি স্বাভাবিক ভাবে পানির গ্লাস একহাতে; ওপর হাতে মেডিসিন নিয়ে দাড়িয়ে রয়েছে।
ধ্রুব অবাক হয়েছে কিছুটা। ওর এই অসুস্থতার ব্যাপারে তো কখনো অদিতিকে বলা হয়নি। অদিতি হয়তবা ধ্রুবর ওই চাওনি বুঝে; বললো——-‘ইমন ভাইয়া বলেছেন। মেডিসিন ফার্মেসি থেকে কিনে এনেছি।’
ধ্রুব কিছু বলল না; শুধু ট্যাবলেট খেয়ে নিয়ে পানির গ্লাস অদিতির হাতে দিয়ে দিল।
অদিতি সেসব রেখে এসে ধ্রুবর পাশে এসে দাড়ালো। ওভাবেই ধ্রুবর ন্যায় ওটির দিকে চেয়ে থেকে বললো———‘বাবা ঠিক হয়ে যাবেন; ধ্রুব। টেনশন করবেন না।’

ধ্রুব উত্তরে নীরব থাকলো। হুট করে ওর যেন আজ কিছু একটার ভয় হচ্ছে। কিছু একটা হারিয়ে ফেলার তীব্র ভয়! নিজের যোগ্য দায়িত্বটুকু থেকে হেরে যাওয়ার ভয়। আজ যদি সৌরভ ইয়ামিনের কিছু হয়ে যায়—ওপারে ধ্রুব মা’কে কি জবাব দেবে? মায়ের শেষ ভরসা তো ধ্রুব ছিল।
কারিশমা চৌধুরী মারা যাবার দিন ধ্রুবকে হতে ধরে বলেছিলেন—তার অনুপস্থিতে তার বাবার খেয়াল রাখার জন্যে। ধ্রুব চেয়েছিল মায়ের কথা রাখতে। কিন্তু তার মাঝখানে তৃণা চলে এলো ওদের জীবনে। ছোট ধ্রুব যখন মা হারানোর শোকে কাতর, তখন বাবার দেওয়া এই আ-ঘাত ও সহ‍্য করতে পারেনি।কিশোর বয়সের প্রচণ্ড অভিমান-রাগ নিয়ে সরে এসেছিলো মা’কে দেওয়া কথা থেকে।
আর আজ…ধ্রুব আস্তে করে একটা লম্বা বেঞ্চের একপাশে বসে দুহাতে মাথার চুল খামচে ধরে বসে থাকলো কেবিনের বাইরে।

অদিতি ওর পাশে দাড়িয়ে দেখে যেতে লাগলো; অস্থির, ভঙ্গুর এক ধ্রুবকে। তারপর ধীর স্বরে ডাকল———‘ধ্রুব!’
ধ্রুব তাকাল না; সেভাবেই মাথা নিচু করে বসা। অদিতি দীর্ঘশ্বাস ফেলল। ও বসলো ধ্রুবর পাশে। আলতো করে হাত রাখল ধ্রুবর কাঁধে। ডাকল নরম গলায়——-‘ধ্রুব? অ্যাই ধ্রুব!
ধ্রুব চুল ছেড়ে মাথা তুলে তাকাল অদিতির দিকে। অদিতি চমকে উঠলো: ধ্রুবর চোখ টলমল করছে। যেকোনো মুহূর্তেই কেদে ফেলবে যেন। এতটা ভেঙ্গে পড়া ধ্রুব ইয়ামিনকে কি আদৌ মানায়? অস্থির হয়ে উঠলো অদিতি। সঙ্গেসঙ্গে ধ্রুবর দুগাল চেপে ধরল———‘ধ্রুব? কি হয়েছে? আপনি এমন ভেঙ্গে পড়েছেন কেন? আপনি এমন করলে বাকিদের অবস্থা কি হবে? শুনুন; শান্ত হন; স্থিন হোন প্লিজ! বাবা ঠিক হয়ে যাবে।’
ধ্রুব অদিতির দিকে চোখ নামিয়ে নিয়ে, ভাঙা গলায় বলল——-‘আমি বোধহয় সবচেয়ে বাজে; চুড়ান্ত ফালতু একটা ছেলে। যার কারণে তার নিজের বা…ওই মানুষ আজকে ওইখানে সার্জারীর টেবিলে শুয়ে আছে। আমার উচিত ছিল একবার হলেও তাকে জিজ্ঞেস করা- সে ঠিক আছে কিনা। সবকিছু আজ আমার গাফলতির কারণে হীচ্ছে। আমি সবসময়ই একটা লুজার হয়েই রয়ে গেলাম। শ্যেইম অন মি।’

অদিতি দ্রুত ব্যস্ত হাতে ধ্রুবর মাথাটা নিজের ঘাড়ে শক্ত করে চেপে ধরল। ধ্রুব অদিতির ঘাড়ের একপাশে মাথা হেলিয়ে রেখে চুপ করে আছে; অস্থির শ্বাস ফেলছে। অদিতি সেভাবেই ধ্রুবর মাথা ঘাড়ে চেপে রেখে বলল———‘আপনি নিজের ভুল বুঝেছেন এটাই অনেক ধ্রুব। বাবা সুস্থ হয়ে যাবে; তারপর ক্ষমা চেয়ে নিবেন উনার কাছে। বাবা খুব খুশি হবে এতে; ট্রাস্ট মি!’
ধ্রুব ঘাড়ে মাথা হেলিয়ে সেভাবেই গা ছেড়ে বলল——-‘ক্ষমা আমি চাইবো না কখনো। সে আমার ক্ষমা পাওয়ার যোগ্য নয়। আমার মায়ের সঙ্গে চিট করা আমি এখনও মানতে পারছি না অদিতি। আমি নিজেকে অনেক বুঝিয়েছি; আমার মন মানে না এসব। আমার মা অনেক লক্ষ্মী একটা মেয়ে ছিলো; ঠিক তোমার মতোই। তার সঙ্গে ওই লোক চিট করেছে ভাবলেই আমার নিজেকে এলোমেলো লাগে। আমি অনেকবার চেয়েছি- নিজেকে এগিয়ে যেতে তার দিকে। ব্যাট অ্যাই কুডন্ট!!’.
অদিতি ধ্রুবর পিঠে হাত বুলিয়ে দিচ্ছে। ধ্রুব অস্থির আজ; ভিসজন ভঙ্গুর আজ। অথচ সৌরভের প্রতি রাগটাও ওর ততটাই জোরালো। অদিতি বলল———‘বাবার সাথে জীবনে একবার বসেছেন? আপনার মনের এই ভাবনাগুলো বাবাকে বলেছেন? প্রশ্ন করেছেন তিনি কেন এসব করেছেন? হয়তবা বাবর কাছেও এটার জন্যে কোনো কারণ ছিলো আপনাকে বলার।’

ধ্রুব অদিতির ঘাড়ে মাথা হেলিয়ে তখনও; তাচ্ছিল্যের হাসি হাসল ও! জবাবে বলল———‘বলার দরকার পড়েনি: আমি দেখেছি নিজের চোখে। জানো দিনের পর দিন বাবার চোখে অন্য একটা নারীর জন্যে আদর-মায়া দেখলে একটা ছেলে হিসেবে আমার কেমন লাগে? আমি পুড়ে যাই একদম। তবুও সহ‍্য করা লেগেছে আমার এসব। কারণ আমি নিরুপায়; বাধা!’
ধ্রুব হাসতে হাসতে বললো শেষের কথাটা! অদিতি ঢোক গিলে, ওর এত কান্না পাচ্ছে এখন। ধ্রুব কখনোই এসব কথা আজ অব্দি অদিতিকে বলেনি। অদিতি অপেক্ষা করেছে; ধ্রুব কবে নিজেকে খোলা বইয়ের মতো মেলে ধরবে ওর কাছে। সময় দিয়েছে ওকে অদিতি!

অথচ আজ যখন ধ্রুব নিজের এতকালের রাগ-দুঃখের কথাগুলো অদিতিকে বলে যাচ্ছে; কেন যেন সহ‍্য করতে পারছে না। বারবার মনে হচ্ছে— ওই সময়ে যদি অদিতি ধ্রুবর সাথে থাকতে পারত। ধ্রুব যখন দিনের পর দিন সাইকোলজিক্যাল ট্রমাতে ভুগে অসুস্থ হয়ে হাসপাতালের বেডে শুয়ে ছিলো, তখন যদি অদিতি একটু, একবার ধ্রুবর মাথায় হাত বুলিয়ে দিতো! অথবা ধ্রুবর জীবনে কোনো ম্যাজিক হতো; কারিশমা মা যদি কোনোদিন না মারা যেতেন।
অদিতি বহু কষ্টে কান্না আটকালো। ওভাবেই ধ্রুবর চুলে হাত বুলিয়ে দিয়ে বলল———‘আপনি কষ্ট পান বলেই; বাবা আজ অব্দি তৃণা’মাকে কখনোই এ বাড়ি নিয়ে আসেননি। অপেক্ষা করেছেন আপনার অনুমতির।’
ধ্রুব জবাবে তাচ্ছিল্যের হাসি হাসল; অদিতির ঘাড়ে মাথা হেলিয়ে ওটির দিকে চেয়ে বলল———‘হ্যাঁ অনুমতি। দিয়েছি তো আমি অনুমতি। আমার মাথায় ব-ন্দুক ঠেকিয়ে অনুমতি নেওয়া হয়েছিল।’
অদিতি অবাক হয়ে গেল! ধ্রুবর চুলে বুলিয়ে দেওয়া হাত থেমে গেল ওর, অবাক গলায় জানতে চাইলো———‘ব-ন্দুক ঠেকিয়ে মানে?’

ধ্রুব হাসলো, চোখ বন্ধ করে জোরে এক নিঃশ্বাস ফেলে বললো———‘তোমাকে বিয়ের করার বিনিময় আমাকে দিতে হয়েছে; নিজের বুক প্রতিদিন পুড়ানোর পারমিশন দিয়ে।’
অদিতি অবাক হয়ে ঘাড় বাকিয়ে ধ্রুবর দিকে তাকিয়ে রইল! ধ্রুবর মাথা তখনও ওর ঘাড়ে হেলিয়ে রাখা। ধ্রুব আবার বললো———‘আমার মাথায় তখন তুমি ভীষন ঘুরছিলে: মানা করতে পারিনি আমি তখন! তাই আজ; ওই মহিলা, আমার মায়ের জায়গায় আমার বাড়িতে ঘুরে বেড়াচ্ছে।’
অদিতি নিজেকে সামলালো। ধ্রুব যা ভাবুক; ওকে ধ্রুবকে ভালোটাই বোঝানো উচিত। ও আলতো করে ধ্রুবর চুলে হাত বুলিয়ে বলল——-‘তৃণা মা এতটাও খারাপ না ধ্রুব। আমি তাকে দেখেছি; উনি চান আপনি তাঁকে মেনে নিন। যদি সে আপনাকে স্নেহ করে, তবে আপনি কেন তাকে মানছেন না?’

ধ্রুব এ কথা বলার সাথেসাথেই কাঠকাঠ গলায় বলল——-‘আমার মায়ের প্রক্সি হিসেবে আমার কাউকে চাইনা।’
অদিতি জবাবে বলল——-‘প্রক্সি নয়। মায়ের মতো কেউ আপনাকে ভালোবাসকে তাকে মূল্যায়ন করতে হয় ধ্রুব।’
ধ্রুব এ কথা শোনামাত্রই অদিতির ঘাড় থেকে মাথা তুলে ফেলল। সোজা হয়ে বসে অদিতির দিকে তাকাল; অদিতি চেয়ে রয়েছে ধ্রুবর দিকে! ধ্রুব ভ্রু কুচকাতেই, অদিতি ধ্রুবর বাম পেশিবহুল হাতটা জড়িয়ে ধরল দুহাতে; ওর কাঁধে আস্তে করে মাথা হেলিয়ে বলল———‘ধ্রুব প্লিজ! এসব মান-অভিমান ভুলে যান। মেনে নিন বাবাকে, তৃণা মা কে। ওরা ভীষন খুশি হবে। কারিশমা মায়ের অভাব হয়তবা কেউ পূরণ করতে পারবে না। কিন্তু ওদের একটা সুযোগ দিন! আপনি আজ যেমন: আপনি তেমন বেঁচে থাকা ডিজার্ভ করেন না।’
ধ্রুব কিছু বলল না। শুধু কঠিন মুখে সেভাবেই বসে রইল। অদিতি আবার বলল——-‘বাবার জন্যে আপনার বুক এত পুড়ে; অথচ সেটা স্বীকার করতে এত কষ্ট আপনার। কেন বলুন তো?’

ধ্রুব জবাবে স্পষ্ট কণ্ঠে বলে উঠলো—-‘কারণ আমি মানুষ তাই। অমানুষ নই।’
অদিতি হাসল! এ মানুষ ভাঙবে; পুড়বে, তবে কখনো মাথা নত কর্ণে না নিজের ইগোর কাছে। অদিতি তারপর হঠাৎ কিছুটা ইতস্তত করে বলে উঠলো——‘একটা কথা বলি ধ্রুব? ধরুন আমাদের দুজনের বাচ্চা; আপনার সঙ্গে তেমনি বিহেভ করছে যেমনটা আপনি বাবার সঙ্গে করেন। আপনার ভালো লাগবে?’
ধ্রুব ভ্রু কুচকে তাকাল অদিতির দিকে।! অদিতি সেভাবেই অবাক ধ্রুবর খোচা খোচা গাল ছুয়ে দিতে দিতে বলল———-‘আপনি নিজের বাচ্চার বেলায় যেই ব্যবহার চাইবেন না; বুঝেন বাবা আজ এতটা বছর ধরে আপনার সেই একই ব্যবহার সহ‍্য করে যাচ্ছেন। তার কেমন লাগছে?’

ধ্রুবর এবার হুট করে প্রচণ্ড রাগ হলো! ও সেই রাগের রেশ ধরেই বলল——-‘নো! আমি অভিয়েসলি বেস্ট বাবা হবো! তার মতো নয়! আমাকে উনার সঙ্গে তুলনা করছো, পাগল তুমি?’
অদিতি ধ্রুবর রাগকে এখনো প্রচণ্ড ভয় পায়। তাই এবারেও পেল। কিছুটা দোনামোনা করে ও বলার চেষ্টা করলো—-‘প্লিজ হাইপার হবেন না। আপনি যদি বেস্ট বাবা হোন; বাবাও একজন বেস্ট বাবা হবার চেষ্টা করছেন। কি করেননি উনি আপনার জন্যে? আপনার জন্যে জান তার সবসময় হাজির থাকে। আপনি কোনদিন জানতে চেয়েছেন- সে ভালো আছে কিনা? অথচ সে সবসবময় আপনার ভালো থাকার দোয়া করেন। সামনে না থেকেও; আপনার প্রতিটা বিপদে আপনার পাশে থাকেন।আপনার এসব একবার হলেও ভাবা উচিত, ধ্রুব।’
ধ্রুব কিছু বলবে; তার আগেই অদিতি ওকে চুপ করিয়ে দিতে বলল——‘পরে, আমি বলি আগে? আপনি জানেন; আমার আপনার সঙ্গে বিয়েতে বাবা এত খুশি কেন ছিলেন?’

ধ্রুব সেভাবেই গা ছাড়া ভঙ্গিতে তাকিয়ে রইলো।হাতদুটো মুষ্টিবদ্ধ করে ভেতরে ভেতরে ফুলছে। ওর কানে এখনো বাজছে— অদিতি সন্দেহ করছে কি? ধ্রুবকে সৌরভ ইয়ামিনের সঙ্গে কেন গুলিয়ে ফেলল? সৌরভ ইয়ামিন যেখানে স্ত্রী মারা যাওয়ার দু মাসের মাথায় বিয়ে করে ফেলেছে; তার সাথে ধ্রুব? ধ্রুব ইয়ামিন? ধ্রুব যাকে ভালবেসেছে; তার কিছু হয়ে গেলে ধ্রুব দু মাস কেন, এক যুগেও কি আর স্বাভাবিক হতে পারবে? সেখানে বিয়ে; অসম্ভব!
ধ্রুবর রাগের পারদ বাড়ছেই ক্রমশ! বোকা অদিতি সেটা বুঝেনি। ও বলতেই থাকে নিজের কথা—-—-‘কারণ উনি একদিন বলেছিলেন, আমার মধ্যে উনি কারিশমা মাকে দেখেছেন। আমি জানিনা কেন দেখেছেন। কিন্তু উনি সেদিন কালচারাল প্রোগ্রাম আমাকে এটাই বলছিলেন। বিয়ের দিনও বলেছেন। বাবা আমাকে নিয়ে আশাবাদি ধ্রুব, আমি আপনাকে ঠিক করে দেব। অথচ উনি জানেন না; তার ছেলের বউও একটা লুজার!’

ধ্রুব এবার আর রাগ সামলাতে পারল মা। হাত থেকে অদিতির জড়িয়ে ধরা হাতটা ছাড়িয়ে নিলো। অবাক হয়ে তাকাল অদিতি। ধ্রুব কাঠকাঠ গলায় বলল——-‘তোমার আসলেই মনে হচ্ছে আমি ভুল? আমার ভাবনা তাকে নিয়ে এসব জাস্ট এমনি? সে আমার সাথে কি করেছে এসব তোমার কাছে কিচ্ছু না? তুমি, লিটারেলি তুমি আমাকে ওই মানুষের সাথে আমার বাবা হওয়া টাইপ ফিলিংসকে কম্পেয়ার করছো? হ্যাভ ইউ লস্টেড? হাও কুড ইউ সে দিস টু মি অদিতি?’

অদিতি বুঝতে পারল; ও না চাইতেও ধ্রুবকে রাগিয়ে দিয়েছে ও। অদিতি ধ্রুবর হাত চেপে ধরে দ্রুত বলার চেষ্টা করল কিছু ——-‘আপনি ভুল ভাবছেন।আমি এটা মিন করতে চাইনি——‘
ধ্রুব আর কিছু বলারই সুযোগ দিল না। অদিতির হাতটা একপ্রকার জোর করেই নিজের হাতের থেকে ছাড়িয়ে নিয়ে উঠে দাঁড়াল। চলে যাবে; তার আগে পেছন থেকে খপ করে ওর হাতটা চেপে ধরে অদিতি, আবারও কৈফিয়ত দেওয়ার চেষ্টা করে ——-‘ধ্রুব; প্লিজ! আমার কথা তো শুনুন।’

আমার প্রেমিক ধ্রুব পর্ব ৩৭

ধ্রুব শুনে না। জোর করে হাত ছাড়িয়ে নিলো অদিতির। বড়বড় পা ফেলে চলে গেল সামনেই। সিগারেট ধরিয়ে সেটা ওখানে দাঁড়িয়েই ফুকতে লাগলো! অদিতি তাকিয়ে রইলো নির্নিমেষে ওর দিকে! আজকের রাতটা এত বিস্বাদ কেন?

আমার প্রেমিক ধ্রুব পর্ব ৩৯