পূর্ণিমায় বিলীন চন্দ্র পর্ব ২৬

পূর্ণিমায় বিলীন চন্দ্র পর্ব ২৬
সাদিয়া আক্তার

আজ শুক্রবার সবাই বাসায় তার উপর আবার রুপশার চাচা শশুর চাচী শাশুড়ি আসবে। সকাল সকাল রুপশারা এসে পরেছে। লিমন চন্দ্র শিহাব রিশানের সাথে ব‍্যস্ত।
— ছোট শালা বাবু চাচা একদম বন্দি বানিয়ে দিল।
— হ‍্যা লিমন ভাই রাইয়‍্যানরে মামী ক‍্যাডেটে না দিলেও পারত বেচারা সহজে ছুটিই পায়না।
চন্দ্ররা কথা বলছিল তখনই কোথা থেকে হতদন্ত হয়ে ঘরে ঢুকল চাদনী বেগম চন্দ্রের দিকে তাকিয়ে বলল — একটু বাজারে যানা বাপ,,

— এখন আবার কেনো আম্মু সকালেই না আব্বু সব বাজার করে দিল।
— একটা আইসক্রিমের টাব আনবি ফালুদা বানাচ্ছে রুপশা তার জন‍্য লাগবে,,
— আচ্ছা নামাজ পরে আসার সময় নিয়ে আসব নে,,,
চন্দ্রের কথা শুনে চাদনী বেগম যেভাবে এসেছিলেন সেভাবেই চলে গেলেন। রান্নাঘরে তার অনেক কাজ আছে এই প্রথম মেয়ের শশুর বাড়ি থেকে লোক আসবে বলে কথা। গতকাল রাতে রোজিনা বেগম দই ও পেতেছিলেন তাই ডেজার্ট এর কথা কেউ চিন্তা করেনি তবে রুপশা ফালুদা বানাতে চাইলে তাকে কেউ না করেনি।।
রান্নাঘরে তিন জা রান্না করছে রোজিনা বেগমকে যদিও কেউ কিছু করতে দিচ্ছে না তারপরেও সে জেদ ধরে করছে এভাবে কাজের সময় বসে থাকা যায়।
বেশা সাড়ে বারোটা বাজতেই সবাই মসজিদের উদ্দেশ্যে রওনা দিল। রমিজ সাহেব শিলা বেগমকে নিয়ে একটু আগেই এসেছে।। আজ পুনমের ছোট্ট ফুপি বেলা আক্তার ও এসেছে। ইনি খুব একটা পারিবারিক আয়োজনে থাকতে চায় না তবে ভাইঝি ভাইপোদের জ্বালাতে না এসে পারেন না।।

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

মুক্তির ঘরে সব বোনেরা আজ এসে খুটি গেরেছে। মুক্তিকে শাড়ি পরিয়ে দিচ্ছে রুপশা। ঝিনুক রিমি এটা সেটা বলে তাকে লজ্জায় ফেলছে তবে পুনমের মন খারাপ সে চুপচাপ বসে আছে মুক্তি রুপশা দুজনেই সেটা খেয়াল করে।। মুক্তি রেডি হওয়া ছেড়ে পুনমের কাছে আসে পুনমের নিচু মাথাটা উচু করে দেখে তার অশ্রুসিক্ত আখি জোড়া। মুক্তিও কেদেঁ ফেলে কাল রাত থেকেই পুনমের মন খারাপ।
পুনম মুক্তিকে ঝাপটে ধরে তার বুকে মুখ গুজে বলল

— তুমি এতো তাড়াতাড়ি চলে যেও না আপু আমি কার সাথে নিজের সব কথা শেয়ার করব। কে আমাকে অর্ধেক রাতে খিদে লাগলে খাওয়াবে। কে আমাকে বুঝবে তোমার মতো করে আব্বু ছাড়া আর কেউ আমাকে বুঝে না আপু। বলেই শব্দ করে কেদেঁ দিল। সাথে মুক্তিও কেদেঁ দিল এই মেয়েটাকে সে অনেক ভালোবাসে চাচাতো বোন হিসেবে সবাইকে ভালোবাসলেও পুনমকে একটু বেশীই বাসে। মা বোনের কাছে অবহেলিত পুনমকে সে যখনই ঢাকা আসত খুব আদর করত এখানে আসার পর সেটা আরো বৃদ্ধি পেয়েছে।
তাদের কান্নার মাঝে ঝিনুক দুষ্টুমি করে বলল — আপু শুধু পুনমকেই ভালোবাসে আমাদের না।
— হ‍্যা আপু শুধুমাত্র আমাকেই ভালোবাসে বলেই মুক্তিকে আরো জোরে ঝাপটে ধরল।
রিমি ঝিনুক হেসে দিলো। তবে খারাপ লাগল রুপশার নিজের বোনের বিয়ের সময় ও এতোটা মন খারাপ করেনি পুনম এখন যতটা করছে। আবার মনে মনে ভাবে -” আসলেই মন খারাপ করবেই বা কেনো সে তো তার সাথে একদিন ভালো করে দুটো কথা বলেনি তার যত সখ‍্যতা ছিলো নিশার সাথে। সেই নিশাই আজ কতটা পরপর বিহেব করে।।

ভেবেই দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে। এবারও নিশাটাকে কেউ বলে কয়েও আনাতে পারেনি তার এককথা। যতদিন ঐ বাচ্চাটা দুনিয়ায় না আসছে সে আসবে না অন্তত স্বামীর সামনে নিজেকে ছোট করতে পারবে না।।
নামাজ পরে সব ছেলেরা ঘরে ঢুকে একসাথে। এরমধ্যেই লিমনের ফোনে কল আসে ফাতেমা আক্তারের লিমন রিসিভ করলে জানায় তারা হাউজিং এর গেটের সামনে দাড়িয়ে। লিমন তাদের আনতে যায়।
মিনিট দশের মধ‍্যে লিমন পৌঁছে যায় ফাতেমা আক্তার ইশতিয়াক সাহেব ও ফাতেমা আক্তারের ভাই ভাবী সহ। তাদের সাথে আছে ইহান ও তার মামাতো ভাই কাইফি।
সবাইকে বসিয়ে পরিচয় করিয়ে দেয় লিমন। রান্নাঘর থেকে নিপা বেগম চাদনী বেগম ও রোজিনা বেগম আসতেই তাদের সাথেও পরিচয় করিয়ে দেয়। একে একে সবার সাথেই পরিচয় করিয়ে দেয় একে একে আলাপচারিতার পর ফাতেমা আক্তার বলল — আপা ভাইজান একটা আর্জি নিয়ে এসেছি আপনাদের কাছে,,,
চাদনী বেগম কামরুল সাহেব একে অপরের দিকে তাকায় যদিও তারা জানে কিজন‍্য তারা আজ এখানে এসেছে তবুও চুপ করে ফাতেমা আক্তারের কথা শুনল। বাবার পাশে বসা ইহান বিরক্তি নিয়ে বসে আছে তার পাশে বসা কাইফি তাকে খুচিয়ে যাচ্ছে। ইহান রাগী চোখে তাকালে চুপ করে আবার শুরু করে তাকে জ্বালানো। চন্দ্ররা আসতেই তাদের সাথে কথা বলা শুরু করে।

— আপনাদের মেয়ে মুক্তি মাকে আমি লিমনের বাসায় দেখেছি সেখানেই তাকে আমার পছন্দ হয়েছে তাকে আমার ছেলের বউ করে চাই। আপা আমার একটা মাত্র ছেলে ইনশাআল্লাহ ভালো থাকবে আপনাদের মেয়ে।
একদমে বলে থামল ফাতেমা আক্তার।
— আপা মেয়ে হয়ে যখন জন্ম হয়েছে বিয়ে একদিন না একদিন দিতেই হবে পরের ঘরে যেতেই হবে। তবে আগে ছেলে মেয়ে দুজন দুজনকে পছন্দ করুক তারপর আমরা কথা এগোই।
কামরুল সাহেবের কথা মনপ‍্যুত হয় ইশতিয়াক সাহেবের। সে মুচকি হেসে বলল — তো এবার আমাদের হবু বউমাটাকেও একটু দেখান।
বেলা আক্তার উঠে যায় মুক্তির ঘরে। ধীরে ধীরে নিচে নামে মুক্তি হালকা মেরুন কালারের একটা তাতের শাড়ি পরেছে মুক্তি ফর্সা শরীরে তা যেনো আরো ফুটে উঠেছে। ধীর স্বরে সালাম দিতে ইহান কাইফি দুজনেই একসাথে মাথা উচু করে। ইহানের মুক্তি দেখে চোখ আটকে গেলেও কাইফির মুক্তির পাশে দাড়ানো ধূসর রঙা থ্রিপিছ পড়া মায়াবী কন‍্যায় চোখ আটকায়।।

চন্দ্র ভ্রু কুচকে কাইফির দিকে তাকায়। শিহাব রিশান লিমন এতোক্ষণ তাদের সাথে কথা বললেও চন্দ্র হু হা ছাড়া আর কিছুই বলেনি তার এসব ভালো লাগে না শুধু মায়ের জন‍্য বসে আছে।
কাইফির নজর অনুসরণ করে দেখতেই চন্দ্রের চোয়াল শক্ত হয়ে গেলো। চাদনী বেগমের দিকে তাকিয়ে বলল — আম্মু আমার মাথা ব‍্যাথা করছে আমি একটু ঘরে যাই
আবার পুনমের দিকে তাকিয়ে বলল — আমার জন‍্য এককাপ কফি নিয়ে আসো,,,
বলেই গটগট পায়ে চলে যায়। পুনম ভরকে গিয়ে সেখানে দাড়িয়ে থাকে চন্দ্র থেমে আবার বলল — পুনম আমি কিছু বলেছি,, পাঁচ মিনিট সময় দিলাম।
পুনম আর দেরী না করে রান্নাঘরে গিয়ে কফি বানানো শুরু করে বিড়বিড় করে বলে — তিতা করলা তুই কি আমাকে ছাড়া আর কাউকে পাসনি। একটু মুক্তির আপুর পাশে থাকতেও দিলো না।। মনে মনে কতক্ষণ চন্দ্রকে বকে কফি নিয়ে দৌড় দিল।
ফাতেমা আক্তার ছেলের দিকে তাকায় ছেলের হাসি হাসি চেহারা দেখে বুঝতে পারে মেয়ে তার পছন্দ হয়েছে।

— ভাই একবার ছেলে মেয়ে আলাদা কথা বলে নিজেদের বোঝা পড়া করে নিক।
— ঝিনুক রিমি মুক্তির সাথে ছাদে যাও কামরুল সাহেব বললে রিমি ঝিনুক চলে যায় সেখান থেকে মুক্তিকে নিয়ে।
ইহান কাইফিকে ইশারা করলেও সে যায় না। কাইফির মনোভাব এখন অন‍্য সে তার মায়ের সাথে কথা বলবে।
অগত‍্যা ইহান একা একাই চলে গেছে। মুক্তিকে ছাদে রেখে রিমি ঝিনুকও অন‍্যপাশে চলে গেছে ছাদে পৌঁছে মুক্তিকে একা দেখে স্বস্তির নিঃশ্বাস ছাড়ে।
— আমি ভেবেছিলাম আপনার বোনদের কারণে একান্তে কথা বলা যাবে না।
— আমার বোনেরা কোথায় সম্পর্কে মেইনটেনেন্স করতে হবে তা জানে। আর আপনি এখন ওদের কাছে অচেনা তাই এখন চুপচাপ আছে
— ওওওও আচ্ছা আপনার নাম??
— সায়মা কামরান মুক্তি,, বলেই ইহানের দিকে তাকাতেই ইহান নিজের নাম বলল — ইহান আহমেদ।
মুক্তি মাথা নাড়িয়ে মাথা নিচু করে। — আপনার কি এই বিয়েতে মত আছে,,

মুক্তি মাথা নিচু করেই বলল — আমার বাবা মায়ের উপর বিশ্বাস আছে তাই তারা যা বলবেন তাই হবে।।
মুক্তির কথা শুনে ইহান মুচকি হেসে এগিয়ে যেতে যেতে বলল — তাহলে বি প্রিপেয়ার মাই মিসেস মিস মুক্তি।
মুক্তিও লাজুক হাসে। ইহান নিচে গিয়ে ফাতেমা বেগমকে পজিটিভ সাইন দিতে ফাতেমা বেগম বিস্তর হাসে।। ততক্ষণে দুপুরের খাবারের জন‍্য ডাকা হয়েছে সবাই টেবিলে বসে গেলো।। কিছুক্ষণের জন‍্য বিয়ের কথা বার্তা বন্ধ রেখে খাবার দাবারে মনোযোগ গেলো। খেতে বসে কাইফি মায়ের কানে কানে কিছু বলতে তিনি আশে পাশে তাকায়। কাইফি ইশারা করতে তারো পছন্দ হয়। তবে আপাতত চুপ থেকে পরে বলার সিদ্ধান্ত নেয়।

— ভাই সাহেব বড় মেয়ে যখন আমাদের এখানে দিচ্ছেন এবার ছোট মেয়েটাকেও দিয়ে দিন তাহলে আলহামদুলিল্লাহ্ দুইটা বিয়ে একসাথে সেড়ে ফেলি।
ফাতেমা বেগমের কথায় কামরুল সাহেব একগাল হেসে বলল — সে তো আগেই আপনাদের বাড়ির বউ হয়েছে আছে বেয়ান,,
— আমি রুপশা বউমার কথা বলছি না আমি পুনমের কথা বলছি,,,
পুনমের নাম শুনে পুরো বাড়িতে নিস্তব্ধতা বিরাজ করে। চন্দ্র চোখ বন্ধ করে আবার খুলে তার চোখ জোড়া লাল হয়ে আছে পুনম সবার জন‍্য দইয়ের গ্লাস আনছিল তা পাও সেখানেই থেমে গেছে।।
চন্দ্র ঝিনুককে ইশারা করে পুনমের হাতের ট্রে নিতে। ঝিনুক পুনমের হাতের ট্রে নিতেই রিমি পুনমকে নিয়ে উপরে চলে গেলো। পুনম কিছু বুঝার আগেই রিমি তাকে নিয়ে ঘর আটকে দিলো।

— তো কি বলছিলেন আন্টি??
ফাতেমা বেগম এবার চন্দ্রের দিকে তাকিয়ে বলল
— তোমার ছোটবোন পুনমকে আমাদের কাইফির বেশ পছন্দ হয়েছে তার জন‍্য চাইছী,,
— ওওও আন্টি পুনমের সাথে তো এই বিয়ে সম্ভব না
— কেনো বাবা??
হাসি মুখে বলল ফাতেমা আক্তার।
— কারণ বিবাহিত মেয়ের তো স্বামী বেচে থাকতে আর বিয়ে হতে পারে না যদিও হয় তবে সেটা ডিবোর্স দিলে তবে সেটা ও এই জনমে পাবে না আমি বেচে থাকতে না।
শান্ত স্বরে বলেই উঠে চলে গেলো চন্দ্র। ফাতেমা বেগম কামরুল সাহেবের দিকে তাকিয়ে বলল
— ভাই ছেলের বিয়ে দিলেন কাউকে জানালেন না।

কামরুল সাহেব জোর করে হাসলেন বিড়বিড় করে বললেন — আমি নিজেই তো জানি না।।
তবে গম্ভীর হলো রোজিনা বেগম ভরা মজলিশে এমন কথা চন্দ্র বলল কেনো। এর মানে সে খুজে পেলো না পারভেজ সাহেবের দিকে তাকাতেই দেখে সে নির্লিপ্ত ভাবে বসে আছে। তাতে সন্দেহ হয় রোজিনা বেগমের।
এবার শুরু হয় মুক্তি ও ইহানের বিয়ের কথা বার্তা।। সবাই মিলে ঠিক করে আজ আংটি পরিয়ে যাবে মুক্তির অনার্স শেষে বিয়ে হবে। সবাই তাতেই রাজী হয়। কাইফি ও তার মা সেদিন মন খারাপ করে চলে যায়। অনেক দিন পর তার ছেলের একটা মেয়েকে পছন্দ করল সেও বিবাহিত। ভেবেই আরো মন খারাপ করল।।

রাত বারোটা পুনম ঘুমাচ্ছে গভীর ঘুমে ঘুমের মধ‍্যেই তার মনে হলো কেউ তার চোখ বাধছে। পুনম ছটফট করতে তার হাত ও মুখ বেধে কাধে তুলে নিলো।
পুনমকে কাধে তুলে নিয়ে চন্দ্র তাকে নিয়ে আসে ছাদের চিলেকোঠায়। ধপ করে তাকে বিছানায় ছুড়ে মারে। পুনম ডুকরে কেদেঁ ওঠে ভয়ে তার জান যায় যায় অবস্থা। তখনই বুঝতে পারে তার কানে কেউ হিসহিসিয়ে বলছে — বিয়ে করবি না বিয়ের পাখনা গজাইছে। দেখি দেখি কোথায় সেই পাখনা।

পূর্ণিমায় বিলীন চন্দ্র পর্ব ২৫

বলেই পুনমকে বসিয়ে পিঠে চেক করে আবার বিছানায় চেপে ধরে বলল — তোর ঐ বিয়ের পাখনা কাটতে আমার দুই মিনিট লাগবে। যাষ্ট মাইন্ড ইট ইয়‍্যু আর অনলি মাইন। মাই জোহরা। অনলি মাইন জোহরা।

পূর্ণিমায় বিলীন চন্দ্র পর্ব ২৭