অশ্রুজলে বোনা বিয়ে সিজন ২ পর্ব ২৮
ইয়াসমিন খন্দকার
আদৃতা নিঝুম ও আবরাজের আসল মেয়ে নয়েই কথা টা শোনামাত্রই সবাই বিস্ফোরিত চোখে তাকিয়ে থাকে। আদৃতা চিতকার করে বলে ওঠে,”এটা হতে পারে না!”
নিঝুম হঠাৎ করেই ভীষণ অসুস্থ বোধ করে সোফায় বসে পড়ে৷ আবরাজ এগিয়ে এসে ব্লু হসপিটাল থেকে আগত লোকটির গলার কলার চেপে ধরে বলে,”এসব কি বলছেন আপনি? ছোটবেলা থেকে আমরা যাকে নিজের মেয়ে মনে করে লালন-পালন করলাম, সে আমাদের আসল মেয়ে নয়?”
লোকটি মাথা নিচু করে বলল,”আমি আপনাদের মানসিক অবস্থাটা বুঝতে পারছি কিন্তু এটাই সত্য। আপনাদের মনে আছে, যেদিন আপনাদের সন্তান হয়েছিল সেদিন রাতে প্রচণ্ড ঝড় হচ্ছিল?”
লোকটির কথা শুনে নিঝুম অতীতের পাতায় হারিয়ে যায়। আজ থেকে ঠিক ২০ বছর আগের ঘটনা৷ নিঝুম ও আবরাজ লন্ডনে থাকলেও তারা চেয়েছিল তাদের দ্বিতীয় সন্তানও বাংলাদেশের মাটিতেই জন্ম নিক। এজন্য নিঝুমের যখন গর্ভবস্থার ৬ মাস চলছিল তখনই সে হাসপাতাল থেকে মাতৃত্বকালীন ছুটি নিয়ে লন্ডন থেকে সিলেটে চলে আসে৷ এখানেই ছবি বেগম তার দেখভাল করেছিলেন। অতঃপর নিঝুমের ডেলিভারি ডেট এগিয়ে এলে আবরাজও লন্ডন থেকে সিলেটে আসে। সব কিছু ঠিকঠাকই ছিল কিন্তু হঠাৎ করে এক ঝড়বৃষ্টির রাত্রিতে নিঝুমের প্রসব বেদনা ওঠে। সেই সময় নিঝুমকে নিয়ে আবরাজ দারুণ সমস্যায় পড়ে। আবির-আনিকাও সেই সময় বাইরে ছিল। বাসায় ছিল শুধু আবরাজ, নিঝুম আর ছবি বেগম। ছবি বেগম এই অবস্থা দেখে সিদ্ধান্ত নেন, বাড়িতেই নিঝুমের নরমাল ডেলিভারি করানোর। কিন্তু আবরাজ বুঝতে পারে নিঝুমের অবস্থা স্বাভাবিক নয়। তাই সেই দিন সেই ঝড়বৃষ্টি মাথায় নিয়েই নিঝুমকে নিয়ে যায়। তারপর নিকটেই ব্লু হসপিটাল নামক একটা হাসপাতালে যায়।
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
সেদিন হাসপাতালে চিকিৎসক সংখ্যা খুব কম ছিল। অপরদিকে রোগী ছিল অনেক। সেই অবস্থাতেই নিঝুমের ডেলিভারি হয় এবং দীর্ঘ ১ দিন পর তার সন্তানকে তার কাছে দেয়া হয়। এটা নিয়ে আবরাজ ও নিঝুমের সেসময় কিছুটা খটকা লেগেছিল। কারণ সাধারণত বাচ্চাকে মায়ের কাছে দিতে এত দেরি করার কথা না। কিন্তু হাসপাতাল কতৃপক্ষ বলেছিল, বাচ্চাটার জন্মকালীন কিছু সমস্যা থাকায় তাকে আলাদা করে বিশেষ পর্যবেক্ষণ কক্ষে রাখা হয়েছিল। এজ্ন্য আর তারা বিষয়টা নিয়ে বেশি মাথা ঘামায়নি।
তবে আজ অতীতের এই কথাগুলোই তাদের ভাবাচ্ছে। ব্লু হসপিটাল থেকে আগত লোকটা বলে,”আপনাদের নিশ্চয়ই মনে আছে, আপনাদের বাচ্চাকে একদিন পর আপনাদের কোলে তুলে দেয়া হয়েছিল?”
নিঝুম বলে ওঠে,”হ্যাঁ।”
“এর কিছু নিদিষ্ট কারণ ছিল৷ আপনাদের বলা হয়েছিল, বাচ্চাকে নিবিড় পর্যবেক্ষণ কক্ষে রাখা হয়েছিল। তবে আসল সত্য ভিন্ন ছিল। সেদিন আমাদেরও হাসপাতালে মোট ৩ টি নবজাতক সন্তানের জন্ম হয়েছিল একই সাথে। তবে আমাদের হাসপাতালে গোপনে কিছু বাচ্চা পাচারের চক্র গড়ে উঠেছিল এবং আমাদের হাসপাতালের কিছু কর্মকর্তাই সেই চক্রের সাথে যুক্ত ছিল। সেই চক্র মিলেই এই অঘটন ঘটিয়েছিল। সদ্যজাত তিনটি মেয়ের মধ্যে মধ্যে একটি শিশুকে চক্রের হাতে তুলে দেওয়া হয়েছিল, আর বাকি দুইটি শিশুকেও তারা পাচার করতে চেয়েছিল কিন্তু সেই সময় কয়েকজন ডাক্তার তাদের হাতেনাতে ধরে ফেলে। পরবর্তীতে হাসপাতালের সম্মান বজায় রাখতে বিষয়টা গোপন রাখা হয়েছিল।
তবে সেদিন যেই দুটি বাচ্চাকে ওরা পাচার করতে ধরেছিল তাদের ডাক্তাররা রক্ষা করতে পারলেও দুজনের মধ্যে কে কার সন্তান সেটা নিশ্চিত করার সুযোগ ছিল না। তাই তড়িঘড়ি করে ব্যাপারটা নিশ্চিত করার জন্য আমরা ভাগ্যের উপর ছেড়ে দেই। আমিও সেই চিকিৎসকদের মধ্যে একজন ছিলাম। মূলত উপরমহলের চাপেই আমরা বিষয়টা এভাবে সামাল দিতে বাধ্য হই৷ তবে এই ঘটনার কিছু দিন পরই আমরা কিছু ফাইল দেখে নিশ্চিত হই যে, আপনাদের দুজনের বাচ্চা অদল বদল হয়েছে। এরপর হাসপাতালের উদ্ধতন কর্মকর্তাদের আমরা বিষয়টা জানালে তারা আবারো আমাদের চুপ থাকতে বলে। কারণ এসব জানাজানি হলে হাসপাতালের লাইসেন্স বাতিল হবে এমনকি সাথে সাথে আমাদের ক্যারিয়ারও ধ্বংস হবে।
তাই ভয়ে আমরা ব্যাপারটা লুকিয়ে যাই। তবে এই ব্যাপারটা নিয়ে একটা অপরাধবোধ সব সময় কাজ করে আমাদের মধ্যে। আজ আমি বৃদ্ধ হয়ে গেছি। আমি একজন ব্ল্যাড ক্যান্সারের রোগী। আর বেশিদিন আল্লাহ আমার হায়াত রাখেন নি। তাই আজ মৃত্যুর আগে আপনাদের সত্যটা জানাতে এলাম। নাহলে যে মৃত্যুর পর এই পাপের বোঝা আমায় বয়ে নিয়ে বেড়াতে হতো।”
নিঝুম কান্নায় ফেটে পড়ে। আবরাজ এসে তাকে সামলায়। নিঝুম বলে,”আমার মেয়ে এখন কোথায় আছে?”
“আপনার সন্তান এখন কোথায়, কেমন আছে—আমি সেটা জানি না। তবে তার পালিত বাবা-মার ঠিকানা একটা ডকুমেন্টে ছিল। সেই ঠিকানাতে আমি গিয়েছিলাম এবং সেখানে গিয়ে দেখি তারা এখন আর সেখানে থাকে না।”
আবরাজের হাতের মুঠো শক্ত হয়ে গেল। তার কণ্ঠ রাগে কাঁপছিল, “তাহলে এতদিন ধরে আমরা যাকে আমাদের মেয়ে ভেবেছি, সে আমাদের মেয়ে নয়। আমাদের আসল মেয়ে অন্য কেউ!”
আদৃতার পুরো শরীর অসাড় লাগছে। সে অস্পষ্ট গলায় বলল, “আমার বাবা-মা তাহলে অন্য কেউ?”
নিঝুম ধপ করে সোফায় বসে পড়ে, মাথা দুই হাতে চেপে ধরে। তার চোখের সামনে ২০ বছর আগের ঝড়বৃষ্টির সেই রাত ভেসে উঠল। যদি তার সন্তান সত্যিই হারিয়ে গিয়ে থাকে, তবে সে কোথায়? কেমন আছে? এই মেয়েটি যদি তার না হয়, তবে আসল মা-বাবা কে?
হাসপাতাল থেকে আসা লোকটি ধীরে ধীরে বলল, “আমরা জানি, এর জানি আমি ভীষণভাবে দুঃখিত, কিন্তু এখন কিছুই বদলানো যাবে না। আমি চেয়েছিলাম অনেক আগেই আপনাদের সত্যটা বলতে কিন্তু কি করবো বলুন? আমার পুরো ক্যারিয়ার, আমার বউ বাচ্চার মুখের খাবার জড়িয়ে ছিল এর সাথে। যদি সত্যটা বলতাম তাহলে যে নিজে বিপদে পড়তাম। আর আজ এই সত্যটা গোপন রাখার জন্যই এত গুলো জীবন এলোমেলো হয়ে গেল। আমার সত্যিই ভীষণ খারাপ লাগছে।”
আবরাজ তার কলার চেপে ধরে হুঙ্কার দিয়ে উঠল,”কেনো? আমার আসল মেয়েকে কোথায় নিয়ে গেছে? আপনি কিছুতেই বলতে পারেন না যে কিছু করার নেই! আপনি তো চাইলেই সব সত্যটা আরো আগে বলতে পারতেন নাকি? কেন বললেন না? এতদিন ধরে একটা মেয়েকে বড় করার পর আমরা জানতে পাচ্ছি সে আমাদের আসল মেয়ে নয়! এখানে কেমন অনুভূতি হতে পারে তা কি আপনি উপলব্ধি করতে পারছেন? আপনার সাথে যদি এমন হতো তো কি করতেন?”
লোকটি ভয়ে কেঁপে উঠল। আর সাথে লজ্জায় মাথা হেট করে বলল,”আমি জানি, যা হয়েছে তা শোধরানোর কোন উপায় নেই। কিন্তু আমি আপনাদের কথা দিচ্ছি, নিজের পাপ শোধরানোর চেষ্টা করবো৷ আমি জানি না, আর কতদিন বাঁচব, আল্লাহ আর কতটুকু হায়াত বাকি রেখেছেন কিন্তু বাকি দিনগুলো আমি আপনার মেয়েকে খুঁজতে আপনাদের সাহায্য করব। তাকে আপনাদের কোলে তুলে দিয়েই আমি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করবো।”
সিলেটের থেকে অনেক দূরে সুনামগঞ্জের ছোট্ট একটি গ্রাম শিমুলপুর। এই গ্রামেই বাস করে এক দরিদ্র পরিবার৷ সেই দরিদ্র পরিবারেরই হাসিখুশি মেয়ে সালমা। মা-বাবার তিন সন্তানের মধ্যে সবার বড় সে।
সালমা আজো অন্য সব দিনের মতো বসে পড়েছে অবসর সময়ে তার মা-বাবার সাথে গল্প করতে। সালমার বাবা তাকে বলে,”কপাল কইরা এমন একখান মাইয়া পাইছি। হামার মাইয়া হইয়াও তার কি রূপ! গ্রামের লোক তো খালি কয়, এইডা কি সত্যি হামার মাইয়া নাকি কোথাও থাকি কুড়াইয়া পাছি।”
অশ্রুজলে বোনা বিয়ে সিজন ২ পর্ব ২৭
সালমার মা বলেন,”তা কইবে না? আমাদের বাকি পোয়াগুলাকে দেখ আর সালমারে দেখ। আকাশ-পাতাল তফাৎ। সালমা তো যেন মেয়ে নয় আসমানের পরী। আল্লাহর কত বড় রহমত থাকলে এত সুন্দর এক নূরানী চেহারার মেয়েকে আমাদের ঘরে পাঠাইল। অথচ তোমার মনে আছে, যেদিন সালমা জন্ম নিল, সেদিন কি ঝড়বৃষ্টিটাই না হলো?”
“তা আবার মনে থাকইবে না? আমার আইজো মনে আছে।”