কোন গোপনে মন ভেসেছে পর্ব ১৪

কোন গোপনে মন ভেসেছে পর্ব ১৪
মিসরাতুল রহমান চৈতী

পঞ্চম রোজা চলে গেলো। সন্ধ্যা হয়ে এসেছে, আকাশের গায়ে গোধূলির রঙ লেগে আছে। ঘরজুড়ে এক অদ্ভুত নীরবতা, শুধু দেওয়াল ঘড়ির টিকটিক শব্দ কানে আসছে।
চৈতী নিঃশব্দে উঠে দাঁড়ালো। সারা ঘর তন্নতন্ন করে খুঁজে বের করলো কোরআন শরীফ। মলাটের ওপরে হালকা ধুলো জমে গেছে। আঙুল দিয়ে ধুলো ঝেড়ে সে আলতো করে ছুঁয়ে দেখলো। বুকের ভেতর কেমন এক প্রশান্তির অনুভূতি ছড়িয়ে পড়লো।
ওজু করে এসে জায়নামাজ বিছিয়ে নামাজ আদায় করলো চৈতী। নামাজ শেষে তারপর ধীরে ধীরে তসবিহ হাতে নিলো। একটার পর একটা দানা এগিয়ে যেতে লাগলো, আর তার ঠোঁট নরম সুরে জপতে থাকলো—

“সুবহানাল্লাহ, আলহামদুলিল্লাহ, আল্লাহু আকবার
“লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু মুহাম্মাদুর রাসুলুল্লাহ।”
এরপর কোরআন শরীফ খুলে পড়তে শুরু করলো সে। চোখ পড়লো সূরা আর-রাদ-এর এক আয়াতে—
“আল্লাযীনা আমানুয়া ওয়া তাতমাইন্নু কুলুবুহুম বিঝিকরিল্লাহ্‌।
আলা বিঝিকরিল্লাহি তাতমাইন্নুল কুলুব।” (সূরা আর-রাদ, আয়াত ২৮)
অর্থ: “যারা ঈমান এনেছে এবং যাদের হৃদয় আল্লাহর স্মরণে শান্তি পায়, জেনে রাখ, আল্লাহর স্মরণেই হৃদয় শান্তি লাভ করে।”
চৈতী গভীরভাবে আয়াতটার অর্থ নিয়ে ভাবতে লাগলো। তার জীবনজুড়ে যে অস্থিরতা, দ্বিধা, কষ্ট—সেটা কি শুধুই দুনিয়াবি কারণে? হয়তো সে আল্লাহর ওপর পুরোপুরি ভরসা করতে পারেনি বলেই এখনো এত অশান্তি অনুভব করছে।

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

তার চোখ এবার গিয়ে পড়লো আরেকটি আয়াতে—
“ওয়াসতাইনু বিস্ সবরি ওয়াস্ সালাহ্‌। ওয়া ইন্নাহা লাকবীরাতুন ইল্লা আলাল খাশিঈন।” (সূরা আল-বাকারা, আয়াত ৪৫)
অর্থ: “ধৈর্য ও সালাতের মাধ্যমে সাহায্য প্রার্থনা করো। নিশ্চয়ই এটি কঠিন, তবে তারা নয়, যারা বিনয়ী ও একনিষ্ঠ।”
চৈতী ধীরে ধীরে নিঃশ্বাস ফেললো। হয়তো এইটাই তার জন্য আল্লাহর পক্ষ থেকে একটি সংকেত। সব দুঃখ, কষ্ট, অতীত—এসব নিয়ে অস্থির না হয়ে আল্লাহর ওপর ভরসা করাই তো উত্তম পথ।
তারপর কোরআন শরীফটা বুকের কাছে টেনে নিলো। মনে হলো, এখানেই তার সকল প্রশ্নের উত্তর আছে…
সেই মুহূর্তে ঘরে ঢুকলো রাতুল।

সাদা একটা গোল জামা আর হিজাব পরে বসে থাকা চৈতীকে দেখে রাতুল কয়েক মুহূর্ত হতবাক হয়ে গেলো। মনে হলো, কোনো সরোবরে ফুটে থাকা পবিত্র এক শ্বেতপদ্ম বসে আছে, যার সুবাস পুরো ঘরজুড়ে ছড়িয়ে পড়েছে।
সে চৈতীর দিকে তাকিয়ে রইলো কিছুক্ষণ। কিন্তু বেশিক্ষণ তাকিয়ে থাকা তার পক্ষে সম্ভব হলো না। চৈতীর স্নিগ্ধতা, তার পবিত্রতার ছোঁয়া যেন রাতুলের চোখ ঝলসে দিচ্ছে।
দ্রুত চোখ নামিয়ে নিলো সে।
তার মনে হলো, এই মেয়েটা… যার একদিন সে তীব্রভাবে বিরোধিতা করেছিলো, যার অস্তিত্ব একসময় তার কাছে শুধুই একটি দায় ছিলো, সে-ই আজ তার ঘরজুড়ে এক আশ্চর্য শান্তির সুর এনে দিয়েছে।
চৈতী তখনো মনোযোগ দিয়ে কোরআন শরীফ পড়ছিলো।
রাতুল চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকলো কিছুক্ষণ।

তারপর ধীরে ধীরে এগিয়ে এলো…চৈতীর দিকে একবার তাকিয়ে নিয়ে সোজা আলমারির সামনে গিয়ে দাঁড়ালো।
আলমারির দরজা খুলে ভেতর থেকে এক সেট জামা বের করলো সে। চোখে এক অদ্ভুত নিস্তব্ধতা, মুখে কোনো অনুভূতির ছাপ নেই।
তারপর এক মুহূর্তও না থেমে ওয়াশরুমের দিকে পা বাড়ালো, যেন নিজের অস্থিরতাকে জল দিয়ে ধুয়ে ফেলতে চায়।
কোরআন শরীফের শেষ কয়েকটি আয়াত পড়ার পর আলতোভাবে পবিত্র গ্রন্থটি বন্ধ করলো সে।
তারপর হাত তুলে মোনাজাত শুরু করলো।
চোখ বন্ধ করে নরম কণ্ঠে ধীরে ধীরে প্রার্থনা করতে লাগলো চৈতী—
প্রার্থনা তার নিজের জন্য, তার হৃদয়ের অস্থিরতার জন্য, তার জীবনের প্রতিটি সিদ্ধান্তের জন্য…
এবং তার মৃত্যুতে বাবা-মা’র জন্য দোআ করলো।
রাতুল পিছনে দাঁড়িয়ে বলো – “কি পড়ছিলে চৈতী?”

চৈতী কোরআন শরীফের উপর হাত রাখলো, তারপর শান্ত কণ্ঠে বললো, “আল্লাহর কালাম। যা হৃদয়কে প্রশান্ত করে, অন্তরকে আলোর পথ দেখায়।”
রাতুল গভীর শ্বাস নিলো। কিছু বলতে গিয়েও নিজেকে সংযত করলো।
“এই আলো কি আমাকে ছুঁতে পারবে, চৈতী?”
চৈতী চমকে তাকালো। রাতুলের চোখে এক ধরনের শূন্যতা, এক ধরনের আকুলতা, যেন সেও এই আলোয় ডুবে যেতে চায়।
কিন্তু চৈতী জানে, রাতুলের পথ সহজ নয়… সে শুধু আল্লাহর দয়া চাইতে পারে, যাতে এই মানুষটাও সঠিক পথ খুঁজে পায়।
চৈতী ধীরে ধীরে বললো—

“আল্লাহ চান, তাহলে অবশ্যই…”
রাতুল চুপ করে রইলো, যেন এই কথাগুলো তার মনের গহীনে কোথাও গিয়ে ঠেকেছে। তারপর হঠাৎই তার চোখের গভীরতা বদলে গেলো, ঠোঁটের কোণে হালকা বিদ্রূপের হাসি এলো।
“তাহলে বলো, চৈতী… তোমার প্রার্থনায় আমার নাম আছে তো?”
চৈতী এবার পুরোপুরি থমকে গেলো। তার বুকের ভেতর ধক করে উঠলো।
সে কী বলবে?

এই মানুষটার জন্য সে কী প্রার্থনা করে?
তার ঠোঁট কাঁপলো, কিন্তু কোনো শব্দ বের হলো না।
রাতুল তখনো তাকিয়ে, অপেক্ষায়…
চৈতী সব কিছু গুঁছিয়ে রাখতে রাখতে বললো,, এইটা কেবল আল্লাহ্ আর তার বন্দার গোপনীয় কথা এইটা প্রকাশ করতে নেই।
রাতুল ঠোঁট টা বাকিয়ে হেসে বললো– “ইফতারি করেছো?”
হুম।
রাতুল আর কিছু বললো না। সে সমস্ত কথাগুলো নিজের মনে গুছিয়ে নিয়ে বেলকনিতে চলে গেলো। সেখানকার সোনালী আলোয় বসে, বেড সিস্টেমের দোলাতে আড়াল হয়ে শুয়ে পড়লো। তারপর হঠাৎই গলা ছেড়ে গান গাওয়া শুরু করলো, এক অদ্ভুত আবেগে:

“আমার নামাজ রোজার সকল সোঁ সওয়াব দেও গো বিধিতারে,
যেন পরকালে সে আসিতে পারে গো, সে আসিতে পারে,
যদি না তারে পাবো, নরগে হেঁটে যাবো,
স্বর্গ যে তারই বুকে দেখেছি তা বারো মাসে।
চারোদিকে রাখবি নজর, সে না যেন দেখতে আসে,
ভাড়া কইরা আনবি মানুষ, কান্দিতে মো’ লাশে পাশে,
চারো দিকে রাখবি নজর, সে না যেনো আসতে আসে।”

কোন গোপনে মন ভেসেছে পর্ব ১৩

তার গলায় অদ্ভুত এক কান্না, এক আকুলতা, যেন গভীর এক দুঃখ তার ভেতরে লুকিয়ে আছে। গানটার প্রতিটি শব্দ যেন তার নিজস্ব কষ্ট আর বিভ্রান্তির প্রতিফলন। চৈতী ঠিকই বুঝতে পারে, রাতুলের ভেতরে অগণিত প্রশ্ন, অপরাধবোধ, আর অনুরাগের ছায়া জমে আছে।
গানটি গাইতে গাইতে রাতুল আরও একবার নিজের ভেতরের অস্থিরতা সঙ্গীতের মাধ্যমে মুক্তি দিতে চাইল।

কোন গোপনে মন ভেসেছে পর্ব ১৫