এক চিলতে রদ্দুর পর্ব ৭

এক চিলতে রদ্দুর পর্ব ৭
Yasira Abisha

রুহির সকালটা আজ যেন একটু আলাদা। ঘুম ভাঙতেই বুকের ভেতর একধরনের ভিন্ন অনুভূতি কাজ করছে। আনাই নেই—সেই ছোট্ট হাতের স্পর্শ নেই, মিষ্টি কণ্ঠে ‘আম্মু’ বলে ডাকার শব্দ নেই।
সারারাত ওকে খুব মনে পড়েছে, কিন্তু সকালবেলা সেই অনুভূতিটা আরও প্রবল হয়ে উঠল। যেন পুরো ঘরটা ফাঁকা হয়ে গেছে, নিঃশব্দ। চোখের সামনে আনাইয়ের ছোট্ট পুতুলগুলো, তার ফেলে যাওয়া রঙিন ক্লিপগুলো, সবকিছুই যেন এক একটা স্মৃতির দাগ কেটে যাচ্ছে।
রুহি ধীর পায়ে উঠে জানালার পর্দা সরিয়ে দিল। সকালের সোনালি রোদ জানালা বেয়ে ঘরে ঢুকছে, কিন্তু তার মনে কেমন যেন এক ধরণের খালি খালি লাগছে। আনাই থাকলে এই মুহূর্তেই দৌড়ে এসে তার কোলের মধ্যে লাফ দিত।
আর সহ্য হলো না।

রুহি তাড়াতাড়ি রেডি হতে লাগল।
আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে রুহি কিছু ড্রেস দেখে, একটা সুন্দর গোলাপি রঙের জামা বেছে নিল। হালকা সফট ফেব্রিক, কোমরের কাছে একটা নটেড ডিজাইন, আর হাতায় নরম লেসের কাজ—জামাটা যেন ওর গায়ের সাথে মিশে গেছে।
আজ একটু সাজবে সে। চোখে হালকা কাজল, ঠোঁটে নরম গোলাপি রঙের লিপস্টিক। হালকা হাইলাইট করা চুলগুলো হাত দিয়ে আলতো করে ঠিক করে নিল। সাদা মুক্তোর ছোট্ট একটা কানের দুল পরতেই যেন সৌন্দর্য আরও ফুটে উঠল।

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

রুহির সৌন্দর্য এমনিতেই মোহময়ী—নরম ত্বক, গভীর বাদামি চোখ, আর ঠোঁটে লেগে থাকা একটা শান্ত অথচ আকর্ষণীয় হাসি। আজকের সাজ তাকে যেন আরও স্বপ্নিল করে তুলেছে।
বের হবার সময় রুহি ভাবলো তার ছোট্ট পরীটার জন্য কিছু একটা নিতে হবে। ভাবতে ভাবতে কেক শপে গেল সে। আনাইয়ের সবচেয়ে পছন্দের জিনিস—পেস্ট্রি কেক। নরম, তুলতুলে, আর চকোলেটের মিষ্টি গন্ধে ভরা।
কেক হাতে নিয়ে বের হয়ে আসার সময় রুহির মুখে একটা শান্তির হাসি খেলে গেল। আজ আনাইয়ের মুখে হাসি ফুটবে, এটা ভেবেই মনটা ভালো হয়ে গেল।

সারারাত পার হবার পর ইরাদের মনে হলো আর যাই হোক রুহির যেহেতু আপত্তি নেই মেয়েটা কিছুদিন ওর সাথে মিশুক অন্তত পক্ষে শান্তি পাবে, ছোট একটা মানুষ ওর মনে এতো কঠিন সত্যির ক্ষত এখন বসানোর কোনো প্রয়োজন নেই। রুহির রূপ অহনাকে মনে করালেও রুহি তো অহনা না আর সে ইরাদকে ভালোবাসেও না এমন যেহেতু কিছু নেই ইরাদের উচিত নিজ থেকে একজন ভালো বন্ধুর মতো রুহির সাথে আচরণ করা, যদিও এই চেহারাটা দেখলে ভালোবাসা ছাড়া অন্য কোনো অনুভূতি কাজ করতে চায় না কিন্তু নিজের মনকে তো মানাতে হবে। ইরাদ ভেবে নিয়েছে মেয়ের জন্য নিজের ভাবনা গুলোকে সে সমাপ্ত করবে। রুহির সাথে আজ থেকে ভালো বন্ধু হবার চেষ্টা করবে।

রুহি আনাইয়ের বাসার সামনে এসে কলিং বেল বাজাল।
কিন্তু দরজা খুলতেই যা দেখল, তাতে সে এক মুহূর্তের জন্য থমকে গেল।
ইরাদ দাঁড়িয়ে আছে, গায়ে অ্যাশ কালারের একটা সিম্পল টি-শার্ট। কিন্তু সাধারণ হয়েও সেটার মধ্যে একটা অন্যরকম আভিজাত্য আছে। চুলগুলো ভিজে, মনে হচ্ছে একদম স্নান শেষ করেই বেরিয়েছে। হাতে সাদা তোয়ালে, চুলের ভেজাভাব মুছছে।
আর সবচেয়ে বেশি চোখ আটকে গেল ওর মুখের হাসিতে।
একদম ফ্রেশ, সতেজ, যেন ভোরের নরম বাতাসের মতো স্বচ্ছ।
ইরাদ ভ্রু উঁচিয়ে একপাশে হেলে দরজার ফ্রেমে ভর দিল, মুচকি হাসি ছড়িয়ে বলল,
“আজ এত সকাল সকাল?”

রুহি একটু হাসল, কিন্তু চোখ সরাতে পারছিল না।
হালকা গলা খাঁকারি দিয়ে বলল, “স্যার, আপনাকে না জানিয়েই চলে এলাম।”
“আসলে আনাইকে খুব মিস করছিলাম।”
ইরাদের হাসিটা একটু গভীর হলো। তারপর পেছন ফিরে ঘরের ভেতরে হাঁটতে হাঁটতে বলল,
“আনাই তো সকাল থেকেই তোমার নাম নিচ্ছিল।”
রুহির মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল।
আনাইয়ের মুখে হাসি থাকলেই রুহির দিনটা ভালো যায়।

সকালটা শুরু হয়েছিল একরকম শূন্যতা নিয়ে, কিন্তু এখন সে একদম অন্যরকম উষ্ণতায় ভরে উঠেছে। ছোট্ট আনাই খুশি মনে তার কোলে বসে আছে, ছোট্ট হাতে পেস্ট্রি কেকটা মুখে তুলছে, আর ইরাদ একপাশে বসে ওদের দেখছে।
টেবিলের উপর নানারকম নাস্তা সাজানো—পরোটা, ডিম, মধু, ফ্রেশ ফল, আর রুহির আনা চকোলেট পেস্ট্রি।
আনাই ছোট ছোট শব্দ করে খেতে খেতে বলল, “আম্মু, এটা খুব মজার! তোমার আনা কেক সবসময় সেরা!”
রুহি মৃদু হেসে আনাইয়ের কপালে চুমু দিল।
ইরাদের কাছে এই শান্ত, পারিবারিক মুহূর্তগুলো তার কাছে যেন এক ধরনের আশ্রয়। এই টেবিলের চারপাশে গড়ে ওঠা বন্ধন, আনাইয়ের আনন্দিত মুখ, রুহির মমতামাখা হাসি—সবকিছুই তার মনের গহীনে আলাদা একটা জায়গা করে নিয়েছে।

ইরাদ ব্যস্ত ছিল খাবার সাজাতে। এক হাতে প্লেট এগিয়ে দিচ্ছিল, আরেক হাতে জ্যাম বাটিতে তুলে রাখছিল।
ঠিক তখনই রুহিও একপাশ থেকে কফির কেটলি ধরতে গেল।
অপ্রত্যাশিতভাবে তাদের হাত একসঙ্গে ছুঁয়ে গেল।
নরম, উষ্ণ একটা স্পর্শ— হঠাৎ করে।
এক মুহূর্তের জন্য দুজনেই থমকে গেল।
রুহির আঙুলের ডগায় যেন একটা শীতল স্রোত বয়ে গেল, অথচ ভেতরে কোথাও অদ্ভুত উত্তাপ জমল। ইরাদের হাত শক্ত, উষ্ণ— কিন্তু সেই শক্তিমত্তার মাঝেও কেমন যেন এক ধরনের প্রশান্তি লুকিয়ে ছিল।
ইরাদ ধীরেধীরে চোখ তুলল, গভীর দৃষ্টিতে তাকাল রুহির দিকে। সেই দৃষ্টি বোঝা মুশকিল— নাকি বোঝার মতো কিছু ছিল না?

রুহি দ্রুত হাত সরিয়ে নিল, কিন্তু তার আঙুলের ডগায় যেন সেই ছোঁয়ার অনুভূতি রয়ে গেল।
ইরাদ একটু থেমে গিয়ে কফির কেটলিটা এগিয়ে দিল, গলায় হালকা খাঁকারি দিয়ে বলল, “কফি লাগবে?”
রুহি জবাব দিতে গিয়েও থেমে গেল। ঠোঁট কাঁপল, কিন্তু শব্দ বের হলো না।
আশ্চর্য লাগছিল নিজের প্রতিক্রিয়া!
কেন এত অল্প স্পর্শেই বুকের ভেতর এত অস্থিরতা?
কিন্তু ঠিক তখনই একটা আকস্মিক শব্দ ভেসে এল—
রিং… রিং…
ইরাদের ফোনটা বেজে উঠল।
সে এক পলকে স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে বুঝতে পারল, এটা অফিস থেকে। ফোন তুলতেই ওপ্রান্ত থেকে তাড়াহুড়োর গলা শোনা গেল।

“ডক্টর ইরাদ, একটা ইমার্জেন্সি কেস এসেছে। আজই অপারেশন করতে হবে। আপনি কতক্ষণে পৌঁছাতে পারবেন?”
ইরাদের মুখ মুহূর্তেই গম্ভীর হয়ে গেল।
হাতের চা রেখে উঠে দাঁড়াল সে।
“আমি এখনই রওনা হচ্ছি।”
রুহি বুঝতে পারল, পরিস্থিতি গুরুতর।
ইরাদ কোনো মতে প্লেটে থাকা শেষ টুকরো খাবার মুখে তুলল, তারপর আনাইয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে বলল, “বাবু, আমাকে একটু কাজে যেতে হবে। কিন্তু চিন্তা করো না, আমি বিকেলের মধ্যে ফিরে আসব।”
আনাই ভ্রু কুঁচকে বলল, “তুমি কি সত্যি ফিরবে? আমরা না আজকে ঘুরতে যাব!”
রুহি একটু নরম গলায় বলল, “আনাই, বাবা খুব জরুরি কাজে যাচ্ছে। কিন্তু ওর কথা তো শুনলে? বিকেলের মধ্যে ফিরে আসবে বলেছে।”

ইরাদ হাঁটু গেঁড়ে বসে আনাইয়ের ছোট্ট হাতটা নিজের হাতে নিল।
“তুমি তো আমার সবচেয়ে ভালো মেয়ে, তাই না? আজকে আমি যদি সময়মতো ফিরি, তাহলে আমরা সবাই মিলে ঘুরতে যাব। তোমার প্রমিজ!”
আনাই একটু চুপ করে তাকিয়ে রইল, তারপর ছোট্ট মাথা নাড়ল।
“ঠিক আছে, কিন্তু দেরি করো না!”
ইরাদ একটা হাসি দিয়ে উঠে দাঁড়াল, কিন্তু যাওয়ার আগে এক ঝলক রুহির দিকে তাকাল।
“আপনি থাকলে ভালো লাগবে, রুহি। আনাই আজ অনেক এক্সাইটেড।”
তারপর সে ব্যস্ত পায়ে দরজার দিকে এগিয়ে গেল।
রুহি তাকিয়ে থাকল তার চলে যাওয়ার দিকে।
কেমন যেন একটা শূন্যতা আবার ফিরে এল।
এই মানুষটার উপস্থিতি পুরো ঘরটাই যেন অন্যরকম করে তোলে, আর যখন সে থাকে না, তখন যেন কোথায় একটা শুন্যতা তৈরি হয়।

রুহি আস্তে করে আনাইকে জড়িয়ে ধরল
ইরাদ চলে যাওয়ার পর রুহি আর আনাই একসঙ্গে নাস্তা শেষ করল। আনাই তখনও বেশ উৎফুল্ল, বারবার ঘুরতে যাওয়ার কথা বলছিল।
মেয়েকে কাছে পেয়ে ভালো লাগলেও রুহির মন পড়ে ছিল অন্য কোথাও।
“ইরাদ স্যার যেন এখনো এই ঘরেই আছেন। তার গলায় ভেসে আসা সেই নরম অথচ ভারী স্বর, তার হাসিটা, সকালের সেই একঝলক উষ্ণতা—সবই যেন এখানেই রয়ে গেছে।”
নাস্তা শেষ করে রুহি কাপটা ধীরে ধীরে নামিয়ে রাখল। অথচ তার ভেতরে কিছু একটা অস্থিরভাবে নাড়া দিচ্ছিল।
কেন জানি মনে হচ্ছিল, এই মানুষটার পাশে থাকলে মন শান্ত থাকে। আর দূরে গেলে একটা শূন্যতা যেন পেঁচিয়ে ধরে।

ইরাদ কি ঠিকঠাক পৌঁছেছে?
কাজের চাপে হয়তো এখন খুব ব্যস্ত, কিন্তু রুহির মন বেখেয়ালি হয়ে বারবার তার কথা ভেবে চলেছে।
এমন হচ্ছে কেনো?
এমনটা তো কখনও হয়নি।
হাতের মুঠোটা একটু শক্ত করে ধরল রুহি। নিজেকেই বুঝানোর চেষ্টা করল—”এসব কিছু না, এটা স্রেফ এক ধরনের অভ্যস্ততা। কিছুদিনের জন্য এই পরিবেশে থাকছি, তাই এমনটা লাগছে।”
কিন্তু বুকের ভেতর যে টানটা অনুভব করছে, সেটাকে কি অভ্যস্ততা বলে উড়িয়ে দেওয়া যায়?
হাসপাতালে পৌঁছে ইরাদ দ্রুত নিজের কাজ শুরু করল। আজকের অপারেশন জরুরি, এক মুহূর্তও দেরি করা যাবে না। কিন্তু… মন কোথাও যেন টেনে ধরছিল।
অপারেশন রুমে ঢোকার আগে এক মুহূর্ত থমকে দাঁড়াল সে। ফোনটা বের করল পকেট থেকে।
রুহি…
সকালবেলা যখন চলে আসছিল, ওর চোখে কেমন যেন একটা অভিমান ছিল। আর ছিল এক অদ্ভুত কেমন একটা মায়া।
কেন জানি ইচ্ছে হলো, জানিয়ে দেই আমি ঠিকঠাক পৌঁছেছি।
“আমি পৌঁছে গেছি। ভালো থাকবেন।”
মেসেজটা পাঠিয়ে ফোন রেখে দিল।
আর তখনই রুহির ফোনটা ভাইব্রেট করল।

এক চিলতে রদ্দুর পর্ব ৬

ফোনের স্ক্রিনে ভেসে উঠল ইরাদের নাম।
মেসেজ খুলে দেখল ছোট্ট একটা বাক্য।
“আমি পৌঁছে গেছি। ভালো থাকবেন।”
এতটুকুই।
কিন্তু কেন জানি বুকের ভেতর একটা প্রশান্তির বাতাস বইল। যেন সে নিজেই অপেক্ষা করছিল এই মেসেজটার জন্য।
একটা অজানা হাসি ফুটল তার মুখে।
সব কিছু কি আর মুখে বলা যায়?

এক চিলতে রদ্দুর পর্ব ৮